পর্ব-১০
১৪ নভেম্বর। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রমিজের খলিশাপুর গ্রামে হাজির হন রকিব। খেয়া পাড়ি দিয়ে গ্রামের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে গগন শিরীষতলায় রমিজের জন্য অপেক্ষা। গ্রামের রাস্তার দুই ধারে সারি সারি শিরীষ বৃক্ষ একে অপরকে আলতো ছুঁয়েছে গগনে। মৃদু বাতাসে দুলছে ছায়া। সূর্য আটকে যাচ্ছে পাতায় পাতায়। এরই মধ্যে ঝরা পাতার বৃষ্টি।
শিরীষ পত্রঝরা ও পত্রমোচী বৃক্ষ। আদিনিবাস ইন্দোনেশিয়া, নিউগিনি এবং উত্তর অস্ট্র্রেলিয়া। ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালয় ও চীনে এই বৃক্ষ জন্মে। ইদানীং আমেরিকা ও আফ্রিকায় এর চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে। গগন শিরীষ ছায়াতরু। পরিচর্চা ছাড়া আপনা আপনি জন্মে। এখানে সরলরেখায় সারিবদ্ধভাবে বেড়ে উঠেছে, কে কবে এভাবে রোপণ করেছে কে জানে। গগন শিরীষ মিমোসেসি গোত্রের, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম মনে করার চেষ্টা করছে রকিব, এরই মধ্যে রমিজ হাজির।
-স্যরি দোস্ত, তোরে দীর্ঘ অপেক্ষায় রাখলাম। খেয়া পারাপারে বিলম্ব। যাত্রী কানায় কানায় না ভরলে নাও ছাড়ে না খানকির পোলা।
-জায়গাটা অনেক সুন্দর। এই জায়গায় বকাবকি বাদ দে। দুদিন-দুরাত থাকব, কোনো পচা কথা বলা যাবে না।
-ওকে, নো বকাবকি। পেট পুড়ছে, বাড়ি চল। রান্না শেষ, খাবার রেডি।
-খাওয়া-দাওয়ায় বেশি সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। পুরো গ্রাম ঘুরব, লোকজনের সঙ্গে কথা বলব, ছবি তুলব-অনেক কাজ।
-আরে কী বলিস, না খেয়ে ঘুরলে চলবে? চল আগে বাড়ি যাই, ভাত খাই, বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলে বের হবি।
গণ্ডগ্রামেও সুন্দর বাড়ি বানিয়েছেন রমিজ, দোতলা ডুপলেক্স। ছাদে সোলার প্যানেল। শব্দহীন ফাঁকা বাড়ি। কেয়ারটেকার তার বউ নিয়ে থাকেন। দোতলায় ডাইনিং টেবিল ভরে নানা জাতের খাবার সাজানো। দুজন তৃপ্তি মিটিয়ে খায়, অন্তহীন আতিথেয়তা। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাড়ির এক কোণে একটি ঝুপড়িঘর দেখিয়ে রমিজ বলেন, ওইটা আমার জন্মস্থান। যতটা জায়গাজুড়ে ঘর আমাদের জমিও ততটুকু ছিল। পরে কিছু কিনেছি, কিছুটা দখল। এই ডুপলেক্স দখলিজায়গায়। আমাদের কোনো টয়লেট ছিল না, আশপাশে অন্যের জায়গায় গিয়া কাজ সারতাম। মা অনেক কষ্ট ভোগ করে তিন বছর আগে মারা গেছেন। আমি যখন তিন বছরে তখন ঝড়ে গাছ পড়ে মারা গেছেন বাবা। মা আমাকে কীভাবে বড় করছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ভালো পরিচালক পাইলে সিনেমা বানাইতাম, অস্কার উপযোগী ছবি, টেকা যা লাগে লাগুক। দর্শক কইলজা ভইরা দেখত, একটা মানুষ জীবনে কতবার মরতে পারে। ফ্যান্টাসি না দোস্ত, সত্যি কথা। শিয়াল-কুত্তা অনেকবার আমারে নিয়া রওনা দিছে, মায়ে তাদের মুখ থেইকা টাইনা বাইর করছে। তোর মনে হইতেছে আমি বানায়ে বলতেছি, নিজের মরা মারে নিয়া কেউ মিথ্যা বলে না। এই গেরাম বড়ই ভয়ংকর, কিছু ঘটনা শুনলে তোর বাংলাদেশ মনে হবে না, আফ্রিকার জঙ্গল এর চেয়ে ভালো। তুই তো আমারে টাউট হিসেবে জানিস, আমি আর কিছু কমু না, দুই-চারজনের সঙ্গে কথা কইলে বুঝবা। গগন শিরীষতলার কাহিনি শুনলেই ফিট পড়বি, জিনের প্যাদানিতে তোমার লজিক আর ফিজিক্স কই যাইব উইড়া।
তবে টেনশন নিও না দোস্ত, তুমি তারে দেখতে চাইবা এইটা আমি জানতাম, তুমি তো আর মাগিবাজির ঊর্ধ্বে না, ব্যবস্থা আগেই করা হইছে। আইজ রাইত আটটায় সে শিরীষতলায় আসবে, গানও শুনাইবে।
তোর ফিজিক্স কি ব্যাখ্যা দেয় জানি না, তবে মন দিয়া শোন-এই গ্রামে এক জাতের ঝড় উঠে খুব কম জায়গা নিয়া। ঝড়ের কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত মানে ব্যাসার্ধ প্রায় চার ফুট অর্থাৎ ব্যাস আট ফুট। এই বৃত্তে যা থাকবে, যত ভারী বস্তুই হোক ঝড় টেনে আকাশে তুলে ফেলে। ঝড় থামলে সেইটা আবার আকাশ থেকে বিকট শব্দে আশপাশের অন্য জায়গায় পড়ে। ধর দশ-পনেরো মিনিট পর পড়ে, অধিকাংশ সময় আশপাশের নদীতে গিয়া পড়ে। বুঝতেছো সেটা কত উপরে ওঠে। ঝড়টা নদী থেকে ঢুকে গ্রাম ঘুরে আবার নদীতে নেমে যায়। প্রথম দুই-তিন মিনিট তীব্র গতি ও শক্তিশালী হয়, এরপর দুর্বল হতে থাকে। শক্তি থাকা অবস্থায় গরু, ছাগল, মানুষ, গাছ-গাছালি এমনকি টিউবওয়েলও টেনে তুলে ফেলে। ঘটনাটা বেশি ঘটে পূর্ণিমার মধ্যরাতে, অন্য সময়ও হয় তবে দিনে কখনো ঘটেনি। রাতে হওয়ার কারণে এই ঝড় বেশি মানুষ মারতে পারে নাই, তবে শিয়াল-কুত্তা-বিলাই ও পশুপাখি-গাছপালার অনেক ক্ষতি করে। কুত্তা বেশি মরে, এতে কুত্তার পরিমাণ কমে। এইটা এই ঝড়ের পজিটিভ দিক, নইলে এই গ্রামের নাম হইতো কুত্তার গ্রাম, কোনো মানুষ টিকতে পারত না। এখানে এই ঝড়ের নাম-কুত্তা মারা ঝড়। ধর, এই ঝড় কোনো দীঘির ওপর দুই-তিন মিনিট থাকলে সেখানে এক ফোঁটা পানিও পাওয়া যাবে না।
-তুই তো বিজ্ঞান মানতে নারাজ, ব্যাখ্যা তো অবশ্যই আছে। তুই ব্যাখ্যার সঙ্গে চাস সমাধান। সবকিছুর তো আর সমাধান নাই। বাদ দে, চল বেরোই, আগে বাজারে যাব।
-রাত ৮টায় গগন শিরীষতলায় গানের আয়োজন করছি।
-গান? গাইবে কে?
-এই গ্রামে একটা গানের দল আছে, তারা গানবাজনা করে; আজাইরা গান, জাতের কিছু না। ধর, যা-ই গায় শুনতে শুনতে হুইস্কি খাইলাম। এখানে বিনোদনের আর কিছু নাই।
দশ-বারোটি ছোট-মাঝারি মুদি দোকান নিয়ে বাজার। কয়েকটি চা-শিঙাড়ার টং আছে। একপাশে মাছ নিয়ে বসে আছেন কয়েকজন জেলে। প্রতি বৃহস্পতিবার হাট বসে, এদিন গরু জবাই হয়। আগের দিনের অর্ডার অনুযায়ী বাইরে থেকে গরু আসে। হাঁস-মুরগিও মেলে হাটের দিন। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নদীতে মাছ ধরে ও সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখানে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া কোনো সরকারি অফিস নেই। স্কুলে হেডমাস্টারসহ তিনজন শিক্ষকের মধ্যে কেউ এই গ্রামের না, তবে অনেক বছর ধরে আছেন। হেডমাস্টার খন্দকার আইয়ুব আলীর ত্রিশ বছর চলছে, অবসর নেয়ার সময় ঘনিয়েছে। গ্রামের মানুষের চাঁদায় চলে একটি মোক্তব, একই সঙ্গে মসজিদ।
খলিশাপুর গ্রামের বিস্তর ঘটনা বলছিলেন, বটেশ্বর বাজারের মুদি দোকানদার রজব মুন্সি। বয়স ৭০ পেরিয়েছে। রমিজ এগিয়ে গিয়ে বলেন, ও রজব মিয়া, খবর কী তোমার, ব্যবসাপাতি কেমন চলে? মেহমান নিয়া আইলাম, দুধ-চিনি বাড়াইয়া টাটকা গরম চা দিতে বলো। শরীলটা পোতায়া গেছে, গরম হওয়া দরকার। গেরামের খবর-সবর কী কও, মেলা দিন কিছুই জানি না। শুনলাম, তালতলীর শাজাহান কামালের বউ মর্জিনা নটী আবার নিকাহ বসছে, ঘটনা সত্য?
-জি, ঠিক শুনছেন মিয়া ভাই। তারে রফিক চৌকিদারের পোলা আব্বাস নিকাহ করছে। পোলাটা সরল, কানে কম শুনে, তয় ভালা। গঞ্জে শাড়ির দোকান দিছে, সংসারে অভাব নাই। বিবি মর্জিনা সুখে আছে।
-হুম। নটীরা সুখেই থাকে।
-নটী কন ক্যান? রেডিও খুললে হ্যার গান হুনা যায়, রাইতে বেশি বাজায়। গান তো আপনেও হুনছেন, আহারে কী সোন্দর গলা।
-ওই অইলো, নটী তো নটীই, গান গাইলেও নটী, বোরখা পিনলেও নটী।
রকিব জানতে চান, নটী কেন? আগে নাচত নাকি? এই গ্রামে নাচ-গান করে এমন মেয়ে আছে? কোথায় থাকে সে?
রমিজ অবাক হয়ে বলেন, মাইয়া মানুষের নাচ-গানের কথা শুইনা তুই ফাল দিয়ে উঠলি, ব্যাপার কী? তারে নিয়া বিরাট ইতিহাস। সে এই গেরামের কেউ না। নদীর ওই পাড়ে গঞ্জের পুব ধারে নাগরপাড়ায় থাকত মর্জিনা বাঈ। দেশ স্বাধীনের আগে ওই পাড়ার নাম আছিল বাইজিপাড়া। স্বাধীনের পর সুরুজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাম উল্টাইয়া রাখছে নাগরপাড়া। ক্যান নাম শুনছ নাই? বাদামতলী, দৌলতদিয়ার পরেই তো নাগরপাড়ার নাম। নাগরপাড়ার মর্জিনা নামকরা বাইজি, দেশে এই লাইনের সবাই তারে চিনে। বিদেশ থেকেও তার কাছে লোকজন আইতো। বেচারা মারা গেছেন নামটা মনে আসতেছে না, আরে বল না, ওই যে ইন্ডিয়ার বড় লেখক, নামটা টুটিতে আটকা পড়ছে মুখে আসতেছে না, ওই যে হ্যায় কবিও।
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়?
-ঠিক। সুনীল সাহেবও আইসা দেখা কইরা গেছে।
-সত্যি?
-মিছা বইলা কোনো লাভ আছে? মর্জিনার কাছে সুনীল সাহেবের অটোগ্রাফ আছে, একসঙ্গে ছবিও আছে। এমন অনেক সুনীল আইছে আর গেছে। সুনীল সাহেবরে চিনবি বইলা নাম বললাম। আমাদের হুমায়ূন আহমেদ সাহেবও নাকি আসতে চাইছিলেন, নিরাপত্তা বিবেচনায় আসেন নাই। সুনীলরে এই গাঁও গেরামে কে চিনে, বুঝিস না? কোলকাতায় মর্জিনার বিরাট কদর, পশ্চিমবঙ্গের এক পত্রিকা তারে নিয়া কাভার স্টোরিও করছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওইখানে তার কথা লেখছিলেন। দেশে মর্জিনার দাম নাই। তবে এই দেশের বেতারযন্ত্রটা এখনও সেক্যুলার আছে, মানে জাত-পাত মানে না, হগলেই সমান, গলাটা ঠিক থাকলেই অইলো।
-মর্জিনা এই গ্রামে কীভাবে এলো?
-তুই তো দেখি নাছোড়বান্দা। তার এই গেরামে আসাও একটা ইতিহাস। গেরামের তিন নম্বর খেয়াঘাটের পাশে তালতলী পাড়া। সেই পাড়ার শাজাহান কামাল বিরাট গাঞ্জাখোর, গান-বাজনা নিয়া থাকত। গঞ্জে তার নিজের দোকান ছিল, বাপ-দাদা সূত্রে হাঁড়িপাতিলের ব্যবসা করত আর নাগরপাড়ায় পইড়া থাকত। দিনে দিনে মর্জিনার লগে পিরিত বাড়ল। পিরিত করবি ভালো কথা, তোর বিয়া করার দরকার কি? হারামজাদা বাইজিরে বিয়া কইরা গেরামে আনলো। পঞ্চায়েত গেল খেইপা, সালিশ বসায়া দিল এক ঘরে কইরা। আম গেল, ছালাও গেল, গাছসহ সব শ্যাষ।
-মানে?
-মানে বুঝো না? ব্যবসাপাতি, আয়-রাজগার উঠল লাটে। তারে ধরল ক্ষয় রোগে, ছয় মাস না যাইতেই শাজাহান কামাল গেল মইরা।
-হায় হায়, মর্জিনার কী হলো?
-ধৈর্য ধর দোস্ত, ছবি তো কেবল শুরু।
-সে কি এখানেই রইল?
-জি, জনাব। শাজাহান কামালের সব সম্পত্তির মালিক মর্জিনা, গঞ্জের দোকানসহ বিরাট সম্পত্তি। দিন শেষে সব আগুন নিভে যায়, তারে সবাই মাইনা নিছে। ভিতরের খবর অইলো, মাতবর রইস মুনসিরে সে ম্যানেজ করছে, কেমনে করছে জানি না, বুইঝা নে। শুনছি মাতবরের মাইয়ারে তলে তলে কাজী নজরুলের গান শিখাইছে। হেই মাইয়া উপজিলায় গানের প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট অইছে, এতে মাতবরের মন গেছে গইলা। মাইয়া অবশ্য জিলায় বাদ পড়ছে, নইলে খবর খারাপ আছিল। মাতবর রইস মাইনকা শয়তান। সে সুরুজপুর ইউপি নির্বাচনে মেম্বার পদে দুইবার হারছে, তবু সে-ই গেরামের মাতবর। এই খলিশাপুর গ্রাম সুরুজপুর ইউনিয়নের মইধ্যে।
-মর্জিনার সঙ্গে দেখা করা যাবে?
-এত উত্তেজনা ক্যানরে দোস্ত? তারে না দেখা-ই মঙ্গল, ফিট পড়বি।
-কেন?
-আমি তো জানি, তোর অভ্যাস নাই। কয়টা মাইয়া মানুষ হাতাইছো জীবনে? এই জিনিস তুমি সহ্য করতে পারবা না। লক্ষেèৗর গণিকারা তার কাছে কিছু না, চাকরবাকর। এইটা অন্য জিনিস। খোদা তালার অপার মহিমা। দীর্ঘ সময় নিয়া তারে নিজ হাতে বানাইছে, গলায় সেতার বসাইছে, চোখে লাগাইছে জনম কাজল, শরীলে ঢালছে বরিশালের গৌরনদীর গাওয়া ঘি। আর ছিনালিপনায় কী কমু, এক কথায় রাজগণিকা। তারে দেইখা লোল পড়ে না, এমন কোনো বাপের পুত নাই। তবে টেনশন নিও না দোস্ত, তুমি তারে দেখতে চাইবা এইটা আমি জানতাম, তুমি তো আর মাগিবাজির ঊর্ধ্বে না, ব্যবস্থা আগেই করা হইছে। আইজ রাইত আটটায় সে শিরীষতলায় আসবে, গানও শুনাইবে। সে আসবে বলাতে গানের দলের পোলাপানরে বাদ দিছি।
-চল তবে, আটটা বাজতে তো বেশি বাকি নেই।
-ধৈর্য ধর, সেখানে সোলার বাতি লাগানো চলতেছে, হুইস্কি নেওয়া হইতেছে, কাজ শেষ হইলে খবর আসবে।
এই মাপের বিজ্ঞানীর কাছাকাছি অতিভৌতিক জিন আসার কোনো শঙ্কা নেই। আর কথা বাড়াব না, আপনি অনুমতি দিলে গান ধরি।
ভরা পূর্ণিমা। শিরীষতলা জ¦ল জ¦ল করছে। বাতাসে শীতের গন্ধ। মৃদু আয়েশি হাওয়ায় দুলছে গগন শিরীষ। যথাসময়ে শামিয়ানা টাঙানোসহ সম্ভাব্য সব আয়োজন হলো। রকিবের কানের কাছে এসে রমিজ বলেন, শিরীষগাছের উপরের দিকে তাকানো নিষেধ আছে। অযথা বিপদ ডাকার দরকার নাই। আলোতে সাধারণত ওরা আসে না, আজ আসছে, পরিস্থিতি ভালো ঠেকতেছে না, ঝামেলা করতে পরে, এখানে গানের আয়োজন করাটা বিরাট ভুল হইছে।
-ওরা কারা?
-গাছের ওপরে কারা ঘুরে বুঝিস না, জিন দল দলে আসছে, এই ডাল ওই ডাল করতেছে। ভুলেও তাকানোর চেষ্টা করবি না, সমস্যা আছে।
-কী সমস্যা, দেখলে কী হবে? জিন আছে বলে তো কখনো বিশ্বাসই করিনি, আজ দেখার সুযোগ হলে তো ভালোই।
-দেখতে চাইলে কাইল রাইতে আসবি। ইচ্ছামতো সুখ-দুঃখের গপগুজারি করবি।
-ঠিক আছে, তাকাব না, এত সুন্দর আয়োজন পণ্ড করার মানে নেই।
-ওই যে, কে আসতেছে বল?
-এ-ই সম্ভবত মর্জিনা। সত্যি তো, তোর বর্ণনার চেয়ে সুন্দর। তার হাঁটায় নাচের মুদ্রা, অবিকল শরৎচন্দ্রের পার্বতী। কাঁচা হলুদ বর্ণের মানুষ প্রথম দেখলাম। লম্বা তো মনে হচ্ছে আমার মাথার ওপর আরও দুই ইঞ্চি।
-পার্বতীরে তুই কই দেখলি, শরৎ তোর বন্ধু? তোরে নিয়া পরিচয় করায়ে দিছে? আর মেয়ে মেয়ে করস ক্যান, এর বয়স চল্লিশ প্লাস। যৌবন শেষ।
-চল্লিশোর্ধ মেয়েকেই সবচেয়ে সুন্দর দেখায়, এর আগের মেয়েরা অপ্রাপ্তবয়স্ক। মানসিক ও শারীরিক পূর্ণতা আসে এই বয়সে।
-তোরে কইছে, দয়া কইরা কথা কম বল, সময় নষ্ট করিস না, দেখ। কথা রাইতে কমু।
মর্জিনা এসে করজোড়ে প্রণাম করে দেড়ফুট উচ্চতার চৌকি দিয়ে বানানো স্টেজে ওঠেন। রকিব দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান। শিরীষতলা শব্দহীন, সব মিলিয়ে দর্শক শ দেড়েক। দূর নদী থেকে স্টিমারের মৃদু আওয়াজ আসছে। ওপরে গাছে গাছে সম্ভবত লক্ষ্মীপ্যাঁচা ওড়াউড়ি করছে, তাকানোয় নিষেধাজ্ঞার করণে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। রকিব ভাবছেন, এই অপরূপ কোত্থেকে এলো, তার জন্মস্থান কোথায়। চেহারার ধরন মোঙ্গলীয়, হংকং-ফিলিপিন্স মেয়েদের আদলে ঠোঁট ও চোয়াল। গালের রং সুপার সাইক্লোনের রাতের আকাশের মতো, লালাভ। ইসরাইলের মেয়েদের আদলে নাক ও উচ্চতা। পেটে এক তোলা মেদ নেই, যেন চাবুক। এই বয়সে বুকের যে হাল হবার কথা তা নয়, টনটনে ধনুক। সিনা টানটান। শিরদাঁড়া সোজা।
রমিজ বলেন, দোস্ত আস্তে দেখ আর হুইস্কিটা কম খা, আইজ বেশি পিনিকের দরকার নাই।
স্টেজ থেকে মর্জিনা কথা বলে উঠলে দাঁড়িয়ে পড়েন রকিব। এদিক সেদিক তাকান। তার কানে লাগছে লতা মঙ্গেশকর কথা বলছেন। রকিব খুঁজছেন লতাজিকে। রমিজ তাকে টেনে বসান। বলেন, দোস্ত আগেই বলেছি, হুইস্কিটা কম খা।
-মর্জিনা বলেন, রকিব স্যার বিষয়ে শুনেছি, উনি পদার্থবিজ্ঞানী। হেডমাস্টার স্যার বলেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের কী একটা জটিল কনার বিষয়ে আইনস্টাইনের পর সত্যেন বোস, এরপর এই স্যার থিউরি দিয়েছেন। মানুষটাকে পায়ে ছুঁয়ে প্রণামের বাসনা ছিল, কিন্তু স্যার বিব্রত হবেন, তাই ইচ্ছেটা অপূর্ণ রয়ে গেল। লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে যার থিউরি পড়ে, তার সামনে এই অভিশপ্ত গ্রামের লোকজন সত্যিই বসে আছি কিনা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। হাতে চিমটি কাটার সময় দেখি সব পশম দাঁড়িয়ে আছে, শরীরজুড়ে একই অবস্থা, মনে হচ্ছে পুরোটা সময় এভাবেই কাটাতে হবে।
রকিব স্যারকে বিনয়ের সঙ্গে বলছি, আপনি অনায়াসে ওপরের দিকে তাকাতে পারেন, লক্ষ্মীপ্যাঁচা উড়ছে, জিন নয়। প্যাঁচাগুলো ভাবছে, তাদের আবাস দখল করে নিচ্ছে মানুষ, তাই অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এই মাপের বিজ্ঞানীর কাছাকাছি অতিভৌতিক জিন আসার কোনো শঙ্কা নেই। আর কথা বাড়াব না, আপনি অনুমতি দিলে গান ধরি।
-নিশ্চয়ই। গান শুনতেই ঘটা করে বসেছি।
গান ধরেন মর্জিনা। এক, দুই, তিন করে দশটি। শেষ করলেন নজরুল দিয়ে-
সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচে নটরাজ
হে মহাকাল প্রলয়-তাল ভোলো ভোলো।
. ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু-শশীর কিরণ-ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো।
মন্দ-স্রোতা মন্দাকিনী সুরধুনী-তরঙ্গে
ধুতুরা ফুল খুলিয়া ফেলি’
. জটাতে পরো চম্পা বেলী
শ্মশানে নব জীবন, শিব, জাগিয়ে তোলো।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-৯॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন