পর্ব-৯
রকিবের চোখে পানি এসে গেছে। তার মনে হচ্ছে, কান্না ব্যাপারটা সম্ভবত সংক্রামক। এমনভাবে মানুষ বাঁচে কী করে। তবু মানুষ বাঁচতে চায়, সুদিনে স্বপ্ন দেখে। কেয়াও কি কোনো দিন সুন্দর কোনো স্বপ্ন দেখেছেন? কখনো কী ভাবেন, ছোট বোন জয়া উঠে দাঁড়াবে, স্কুলে যাবে। দু-বোন ভরা পূর্ণিমায় উঠানে বসে চা খেতে খেতে গল্প করবে। বাবা হাট থেকে ইলিশ নিয়ে ফিরবেন। সেই ইলিশ ভাজা দিয়ে তিনজন মজা করে পেট ভরে ভাত খেয়ে ঘুমোতে যাবেন। কেয়া কী ভাবেন, একদিন দুপুরে দলবল নিয়ে কেউ একজন বর বেশে এসে তাকে বউ সাজিয়ে নিয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে ফিরে দেখে, জয়া ভিজে যাচ্ছে চাল থেকে পড়া বৃষ্টির পানিতে। পাশের ঘর থেকে বাবা বলছেন, মা কেয়া, জয়ার জ¦র কি আরও বেড়েছে? দেখ তো, উঠানে পানি কতটা বেড়েছে, এই ধারায় বৃষ্টি হলে রাতে যে ঘরে পানি উঠে যাবে, কোথায় যাব তখন?
আর ভাবতে চান না রকিব।
– কেয়া, আমার প্রশ্নের জবাব কি দেবেন?
– এক বছর আগে মায়ের ডেঙ্গু জ¦র হইলো, চিকিৎসা হয় নাই, মারা গেছেন এই ঘরে। দাফন কাফনের ব্যবস্থা নাই, দৌড়ায়ে গেলাম মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে, সেখানে বসা ছিলেন জাফর উল্লাহ স্যার। ইমাম সাহেব পাঁচশ টাকা দিয়ে বললেন, আর নাই, এই দিয়া যা পারো করো। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলাম, সঙ্গে আসলেন জাফর উল্লাহ স্যার। উনি জানাজা থেকে শুরু কইরা দাফন পর্যন্ত সবকিছু করলেন। মানুষটা অনেক ভালা, এমন মানুষ জীবনে দেখি নাই। সেদিন থেইকা আমারার খোঁজখবর নেন, মাসে মাসে টাকা দিয়ে যান, বাবার ওষুধপাতিও দেন। আমরা কোনোদিন সাবান কি জিনিস দেখি নাই, উনি মাসে দুইটা লাক্স সাবান কিনে দেন। এই যে শাড়ি দেখতেছেন, তিনটা শাড়ি গত মাসে কিনে দিছেন।
আমারে ভালোবাসেন কি না ঠিক জানি না, কখনো বলেন নাই। কাজেকর্মে বুঝি মনে হয় ভালোবাসেন। তিন-চার মাস আগে বলছিলেন, আমারে বিবাহ করতে চান। আমারে নিয়া যাবেন। আমি বলছি, আপনের মাথা খারাপ? বাপ-বইনসহ তিনজনরে নিয়া কই যাইবেন? উনি বলছিলেন, ওই দুইজনও পরিবারের সদস্য হয়ে সঙ্গে থাকবে। মানুষটা সরল। কোনোদিন গায়ের দিকে তাকায় নাই, কথা বলছে মাটির দিকে চায়া। তয় মনে হয় সঙ্গে জিন আছে। এই কথা বলার কারণ আছে, শোনেন, চার মাস আগের কথা। মাঝি পাড়ার রফিক মাতবর আমার পিছে লাগছিল, আজাইরা আলাপ করতে আসতো। একদিন বিকালে আইসা কুপ্রস্তাব দিয়া বসল। আমি দাবড়ানি দিয়া খেদাইলাম। হারামজাদা যাওয়ার সময় বইলা গেল- দেইখা নিবে। ঘটনা পরে জাফর স্যাররে কইলাম। স্যার খুবই বিরক্ত হয়ে বলেন, মাতবর দেখে নেওয়ার সুযোগ আর পাবে না। হায় আল্লাহ, দুই দিন পর রফিক মাতবরের লাশ মিলল পাতার বিলে। পুরা জিনের কাম।
– আপনার ধর্ষণ মামলা সাজিয়ে দিল কে?
– আপনাকে বলতে পারি একটা শর্তে, জাফর স্যারের কোনো বিপদ হবে না তো?
– জাফরের সামনে ঝুলছে ফাঁসির দড়ি অথবা যাবজ্জীবন জেল, এর চেয়ে বড় বিপদ আর কী?
– কিন্তু স্যার বলছিলেন, কোর্ট নাকি ধর্ষণ প্রমাণ করতে পারবে না। এ কারণে তার কিছুই হবে না। কয়েক মাস পর বাইর হয়ে যাবেন। আমারে অযথা চিন্তা করতে না করছেন।
– রায় তো হয়ে যাবে। আপনাকে দিয়ে জাফর মামলা করিয়েছেন, কিন্তু কেন?
– বলেছিলেন, উনি দুই জালিমের অধীনে চাকরি করেন, জালিমের চাকরি করা শরীয়তমতে হারাম। তিনি জালিমের জেলখানায় যেহেতু আছেন, তা হইলে সরকারের জেলখানায় থাকাই উত্তম। জেলের ভিতরে নানা জাতের কাজ আছে, সেইসব কাজের পাশাপাশি আল্লার এবাদত করবেন। আমার হাতে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে বলছিলেন, এইটা নাও, এক বছরের খোরাকি, কোনো রকমে চলবা, পাঞ্জেগানা নামাজ পড়বা, আল্লাহ বরকত দিবেন। দুনিয়াদারি মিছা মায়া, রোজ কেয়ামতের কথা স্মরণ রাখবা। জেল থেইকা বাইর হয়ে আল্লাহ চাইলে তোমাকে বিবাহ করব ইনশাল্লাহ। দয়াল রাব্বুল আলামিন চাইলে সব সম্ভব, তোমার দিন ফেরবে। আল্লায় চায়তো তোমার বাপ-বইন ভালো হয়ে উঠবে। ওনার কথায় অন্য রকম হয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম, আপনে কি চান? জবাবে বলছিলেন, তুমি আমার নামে থানায় গিয়া ধর্ষণের মামলা করবা। ভয় নাই, মিথ্যা মামলা। মিথ্যা মামলা বড় খারাপ জিনিস, তবু অসুবিধা নাই, আমি তো অন্যেরে ফাঁসাইতে বলতেছি না। এতে তোমার বদনাম হবে, তবে সর্বোচ্চ এক বছরের বদনাম। অসুবিধা নাই, আমি বিবাহ করব।
বিধাতার অপার লীলা বোঝা অসম্ভব। হারামজাদা জাফর তার কাছাকাছি গেল, এ আরেক বিস্ময়।
কেয়া ডুকরে কেঁদে ওঠেন। দীর্ঘ কান্না। এক পর্যায়ে গোঙানি। বলেন, আমার জীবনটা এমন হইলো ক্যান। জন্মের পর থেকে একই অবস্থা। একটু বড় হওয়ার পর বাড়ির আশপাশে গুন্ডা-বদমাইশের উৎপাত দেখে খালা আইসা নিয়া গেলেন। শহরের ইশকুলে ভর্তি করলেন। কলেজে উঠতেই খালু গেলেন মইরা, খালা পড়লেন বিপদে। অভাবের সংসারে তিন বাচ্চারে নিয়া তার নিজেই চলে না। আমারে দিয়া গেলেন বাপ-মার কাছে, পড়া শেষে। জীবনের সঙ্গে আর কত যুদ্ধ করা যায়। সাপ-ব্যাঙের মতো মানুষও দিনে রাইতে ঘরে ঢুকতে চায়, ছিঁড়ে-খাবলে খাইতে ধরে, আর পারি না।
– কেয়া, জাফর উল্লাহ যে দুই জালিমের কথা বলেছেন, আমি তাদের একজন। তাকে স্কুলে চাকরিটা আমি দিয়েছিলাম, উনি যে আমার প্রতি এতটা বিরক্ত বুঝতে পারিনি। তবে এই মুহূর্তে সবারই ঘোর বিপদ। জাফরের দণ্ড হয়ে গেলে বিপদ আরও ঘনীভূত হবে। আপনার কি হবে জানি না, আমার সহসা ঝামেলামুক্ত হওয়ার চান্স নেই। স্কুলের শিক্ষার্থীরা পড়বে মহাসংকটে। উনি ঠিকই বলেছেন, আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব। উপায়ও আছে, আপনি যদি আমার কথাটা রাখেন।
আমি সাধারণত কাউকে অনুরোধ করি না, আজও করছি না, শুধু একটা পরামর্শ দিয়ে যাই। মন দিয়ে শুনবেন। তার আগে বলেন, আপনি তো প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারেন, বলছেন না কেন জানি না। যাই হোক, সেটা আপনার ব্যাপার। আমার কথাটা হলো- মামলা তুলে নেন। এতে অনেক মানুষ বেঁচে যাবে, আপনি-আমিসহ। আপনি শিক্ষিত মানুষ, সমাজের প্রতি আপনার দায় এবং দায়বদ্ধতা আছে। নিজেদের স্বার্থ বাদ দিয়ে অন্তত পাঁচশ ছাত্রের শিক্ষাজীবন রক্ষায় এগিয়ে আসার পরামর্শ দিচ্ছি। একটা ছোট কথা দিতে পারি, আমি আপনাকে স্কুলে কম বেতনের চাকরি দিয়ে দেব। এটা বিনিময় বা উপহার নয়, আপনার যোগ্যতা মাপের একটা চাকরি। আপনি মাধ্যমিক পাস না হলে এটা দিতে পারতাম না।
– আপনি দেবতার মতো মানুষ। জাফর স্যার আপনার ওপর বিরক্ত হলেন কেন মেলাতে পারছি না। উনি অনেক উপকার করেছেন, ওনার সব কথা আমি বিশ^াস করেছি, এখনও করি। কিন্তু, নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলেন, আপনাদের বিপদে ফেললেন, শত শত বাচ্চা অসহায় হয়ে পড়ল। এর কারণ কি, আপনি জানেন?
– জাফর জেল থেকে বের হোক, পরে একদিন বলব। এত তাড়া কিসের, আপনি তো কলিগ হয়ে যাচ্ছেন। আপনার এসএসসি সার্টিফিকেট সঙ্গে আছে তো? না থাকলেও সমস্যা নেই, স্কুলের নাম, সেশন বলবেন, আমি আনিয়ে নেব। বিশ^বিদ্যালয়ে আমার ডিপার্টমেন্টের এক স্যার অবসরের পর এখন আপনাদের শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান।
– আপনি মানুষ না স্যার, আপনি দেবতা, আপনি দেবতা বলতে বলতে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন কেয়া।
অনিচ্ছায় জেল থেকে বের হন জাফর উল্লাহ। ওই মামলার শেষ শুনানিতে আদালতের পর্যবেক্ষণে ঘটনাটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক এবং দুঃখজনক বলে উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়, দারিদ্র্যের কারণে মানুষের মর্যাদা, মূল্যবোধ ও আত্মসম্মানবোধ বিপন্ন। এর দায় কোনোভাবেই প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা এড়াতে পারেন না। জেলা প্রশাসনকে মোসাম্মৎ রেবেকা সুলতানা কেয়ার বাবা ও বোনের চিকিৎসা ব্যয় বহন এবং সরকারি দুই শতাংশের একখণ্ড জমিতে ঘর বানিয়ে হস্তান্তরের নির্দেশনা দেওয়া হলো। এছাড়া তিন কার্যদিবসের মধ্যে নির্বাচন কমিশন তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং উপজেলা প্রশাসন ভিজিএফ কার্ড সরবরাহ করবে। পাশাপাশি সুচিকিৎসায় জাফর উল্লাহর বিকৃত মস্তিষ্কের ভারসাম্য সুনিশ্চিত হওয়া অবধি স্কুলে যাতায়াত রোহিত থাকবে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনায় রকিবের মুগ্ধতার সীমা রইল না। কিন্তু, জাফর উল্লাহকে ঘিরে জমেছে প্রশ্নের পাহাড়, কে দেবে জবাব। হাজারো কেনোর উত্তর কি মিলবে? উনি কি সত্যিই কেয়াকে ভালোবাসেন? অপূর্ব স্নিগ্ধ মেয়েটিকে ভালোবাসার যোগ্যতা বা অধিকার কি তার আছে? কেয়ার আইনজীবী আজাদ রহমান তার চেম্বারে কথায় কথায় বলেছিলেন, ইন্ডিয়ার নায়িকা স্মিতা পাতিলকে চেনেন মিস্টার রকিব? অনেক আগের অভিনেত্রী, না চেনারই কথা। গুগল সার্চ দিয়ে চেহারা দেখুন প্লিজ, অথবা ইউটিউব খোলেন। তার হাইট বুঝতে হলে ইউটিউবে টাইপ করুন- স্মিতা পাতিল হাইফেন অমিতাভ বচ্চন সং। দেখুন, লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে অমিতাভের সঙ্গে বৃষ্টিতে নাচছেন স্মিতা পাতিল। নাচটা একটু উল্টাপাল্টা তবে স্মিতা পাতিলের হাইট এবং কেয়ার সঙ্গে সাদৃশ্যের মোটামুটি আন্দাজ পাবেন।
রকিবের জবাবের অপেক্ষা না করে আজাদ সাহেব বলেই চলেছেন। দেখুন, কেয়া মেয়েটার সঙ্গে স্মিতা পাতিলের অমিল নেই, যেন ক্লোন। মুম্বাইয়ের ফিল্ম মেকাররা এর খোঁজ জানলে দলে দলে ছুটে আসবেন, তার বাড়ির সামনে চার্টার্ড বিমানের মেলা বসে যাবে। পুঁজিবাদী বিশ^ব্যবস্থায় সুন্দর চেহারার মূল্য অসীম, এ দেশেই শুধু দাম নেই। মেয়েটা একবিন্দু সাজেননি অথচ চোখ ফেরানো কঠিন। কার জন্ম কোথায় হবে তা কেউ জানে না। বিধাতার অপার লীলা বোঝা অসম্ভব। হারামজাদা জাফর তার কাছাকাছি গেল, এ আরেক বিস্ময়।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-৮॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন