পর্ব-২৩
তিনি সেখানে আরেকটা কথা বলেছিলেন- অপরীক্ষিত জীবনের কোনো অর্থ নেই। জুরিদের কাছে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর সক্রেটিস এই উক্তিটি করেন।
পৃথিবী সক্রেটিসকে মনে রেখে দিয়েছে।
– মানে কী ভাই?
– সক্রেটিসের আদলে রকিবের প্যারাডক্সিক্যাল বাচনভঙ্গি এবং চরিত্র আমি ছাত্রকাল থেকে ভয় পাই। আড়াই হাজার বছর পর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে হয়তো।
– আপনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না, খুলে বলেন।
– আন্তর্জাতিক আদালতে উঠছে রকিবের মামলার ফাইল। সেই আদালতের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো বিবদমান মামলার জন্য অনানুষ্ঠানিক আদালত বসতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। ৫০৩ সদস্যের জুরিবোর্ড গঠন হয়েছে। সেখানে দেড়শ বিজ্ঞানী রয়েছেন, আইনজীবী দুইশ, বাকিরা নানা পেশার। এই মামলায় গণশুনানি শেষে ভোটাভুটিতে রায় নির্ধারণ হবে। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলবে না। জুরিবোর্ডে দেখলাম শ্রীলঙ্কার সাবেক এক ক্রিকেটার ও কিউবার এক বিউটিশিয়ান আছেন। মনে হচ্ছে, বিশ^সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিচারক প্যানেল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই বোর্ড গঠন করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের হাতে থাকলে অন্য চিন্তা করতাম। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ পঞ্চাশটি বিশ^বিদ্যালয় এই বোর্ডের কঠোর সমালোচনা করেছে। পরিস্থিতি ভালো ঠেকছে না।
– বিচারে রকিব হেরে যাবে তেমন কিছু ভাবছেন? অত গভীরে ভাবার কোনো প্রয়োজন কী আছে? আন্তর্জাতিক আদালত আজ পর্যন্ত কোনো মামলার চূড়ান্ত রায় দিয়েছে? নামমাত্র আদালত। ইয়াসির আরাফাতের মামলার বিচার কোথায় গেছে? নিরাপত্তা পরিষদের কর্তৃত্ব ছাড়া জাতিসংঘের আর কোনো ভয়েস আছে? এর মধ্যে রাশিয়া আর আমেরিকা যা বলবে তাই হবে। রাশিয়া বেঁকে বসলে কার বাবার সাধ্য আছে রকিবের পশম স্পর্শের? ৫০৩ সদস্যের জুরি প্যানেলের রিয়ালিটি শো চলছে। বোর্ডে ক্রিকেটার, বিউটিশিয়ান আছে, নায়িকা-গাইকা-নাচনেওয়ালি নাই ক্যান? শোনেন ভাই, একদম টেনশন করবেন না। রকিব কী করছে তাই বলেন। মনোজদা কথা বলছেন না ক্যান?
দীর্ঘশ^াস ফেলে মনোজ বলেন, কুতুবকে এনেছি পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ বলার জন্য। আমি সারাক্ষণ রকিবকে দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত।
সরকার থেকেই আমাকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে এই দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তবে রকিব জেলে আছে নাকি ল্যাবে আছে সে নিজেই জানে না। দিনরাত কম্পিউটারে কী যেন লিখে চলেছে, কিছুই বুঝি না। জিজ্ঞেস করলে বলে, থিউরি অব রিলেটিভিটির দশ শতাংশ সুবিধাও মানবজাতি কাজে লাগাতে পারেনি। এই থিউরির সম্ভাবনা অনন্ত, কিন্তু পুরোটাই অপচয়, আইনস্টাইন পণ্ডশ্রম করেছেন। থিউরির ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। একটা প্রকল্পের তত্ত্বীয় অংশ ফাইনাল স্টেজে পৌঁছাছে, প্র্যাকটিক্যালি সাকসেসের চূড়ান্ত পর্বের ট্রায়াল চলছে। প্রকল্পের বেসিকটা হলো- চিন্তায় স্পর্শের অনুভূতি। মানুষকে আর কষ্ট করে ছোটাছুটি করতে হবে না। ধরা যাক কারও বউ চট্টগ্রামে থাকে। বউকে স্পর্শ করতে চাইলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ছুটতে হবে না। চিন্তা করলেই স্পর্শ করা যাবে, শুধু স্পর্শ নয়, সবই করা যাবে।
স্যরি ভাবি, ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না, রকিব কি বলতে চেয়েছে বুঝেছেন নিশ্চয়ই? ব্যাপক অর্থে বিষয়টা এমন, ভালোবাসার মানুষকে পাবার জন্য বিবাহের আর কোনো দরকার নাই, চিন্তাই যথেষ্ট। এর মধ্য দিয়ে নাকি না পাবার যন্ত্রণায় আত্মহত্যার ঘটনা শূন্যে নামবে।
ভাবি, পাগলামির একটা সীমা থাকা প্রয়োজন, রকিব সেটা ছাড়িয়ে সুপার লেভেলে চলে গেছে। যে মুহূর্তে মানবসভ্যতা ধ্বংসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে, ঠিক সেই সময় সে আরেক ভয়াবহ রিসার্চে মশগুল। অনুমান করতে পারছেন, তার এই থিসিস আলোর মুখ দেখলে পরিণতি কী হবে? সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়াজুড়ে জন্মহার শূন্যের দিকে ছুটবে। মানুষ তো আর বিয়েই করবে না। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কেও ফিজিকেল ইউনিয়নের প্রয়োজন ফুরোবে। আলটিমেট রেজাল্ট হলো- ওর এই ফর্মুলা আবিষ্কারের রাত থেকে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ক্রমমৃত্যুর মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ এক শ বছরে মানবসভ্যতার যবনিকাপাত ঘটবে।
ভাবি, রকিব আমাদেরই বন্ধু, কি আর বলব, মেধা নিয়ে জন্মানো ভালো, তবে সবকিছুরই সীমা থাকা দরকার। মেধা নিয়ে অত খেলা উচিত না। সারাটা জীবন বোবার মতো থেকেছে, কিন্তু যা করেছে সবই বিধ্বংসী, শুধু মানুষ মরেছে।
– আপনাদের ধারণা এবারও সে পার পেয়ে যাবে?
– আপনি নিজেই তো বললেন, রাশিয়া আছে ওর সঙ্গে, আর কিছু লাগে?
– তবে এসবের শেষ কোথায়?
– আমরা এখনো জানি না, তবে রকিব নির্ভার, শেষটা তার নিশ্চিত জানা। কাঁচুলি টেনে যে ছিঁড়তে জানে, সে জোড়া দিতেও জানে। একদিন দেখবেন সব ঠিকঠাক, তা কবে সে ছাড়া কেউ জানে না। রকিব একটা কবিতার লাইন বলত- রক্তপাত ছাড়া পৃথিবী উর্বর হবে না।
দুনিয়াজুড়ে যে রক্তপাত ঘটানোর সাহস লেনিন দেখাননি, মাও সেতুং চাইলেও দেখাতে পারেননি, সেই স্পর্ধা রুশবিপ্লবের একশ বছর পর দেখিয়েছে রকিব। এরপরও সে নির্বিকার। এই রক্তপাত হয়তো একদিন থামবে, কিন্তু ওর পরবর্তী থিসিস দুনিয়াকে কোথায় নিয়ে যাবে তা সে নিজে জানে কিনা, সংশয় আছে।
– তাকে সঠিক পথে নিতে আপনাদের কোনো উদ্যোগ নেই?
– ভাবি, আপনার একটু ভুল হচ্ছে, রকিব কিন্তু ভুল পথে নেই। সে যা করছে সেটাই ঠিক, কিন্তু পৃথিবী সেই সত্যটা নিতে প্রস্তুত নয়। ওর থিসিসের ভার বহনের সামর্থ্য মানুষের নেই। সে তো দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছে মানবসভ্যতার শত্রু কারা। সেই শত্রুরা মানবজাতিকে দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল উইপোকার মতো।
এই থিসিস দেরি হয়ে গেছে, আরও আগে প্রকাশ দরকার ছিল। কুকুরমানবের সঙ্গে তো আর মানুষের বসবাস চলে না, এটাই রকিব প্রমাণ করে দিয়েছে। এখনো যদি মানব সম্প্রদায় রুখে না দাঁড়ায়, তবে কী আর করা, বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এক রকিবের আর কি করার আছে। তার থিসিসে অনিবার্য সংঘাত প্রতিরোধের কৌশল বলা আছে, সরকার কি এখন পর্যন্ত তা অনুসরণ করেছে? এ অঞ্চলের জাপান, ভারত, ভিয়েতনাম থিসিসের পরামর্শ মেনে নিয়ে সে মতো চলছে, তাতে পরিস্থিতিরও উন্নয়ন ঘটছে। আমাদের দেশে কয়টা কোয়ারেন্টি খোলা হয়েছে, কোনো লক্ষণ তো দেখছি না।
চলবে
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-২২॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন