পর্ব-২২
জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষ ভবনে সাব জেলে নজিরবিহীন নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে রকিবকে। বন্দি দুই মাস। দেশে শুধু নয়, দুনিয়াজুড়ে জাতিগত দাঙ্গা চলমান। মানবজাতি এবং কুকুরমানব জাতির সম্মুখ লড়াই। দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ। কুকুরমানবদের এখন দেখলেই চেনা যায়, জলাতঙ্কগ্রস্ত পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করছে। কোথায় নেই তারা, সব শ্রেণি-পেশায় কমবেশি আছে। উভয় পক্ষের অস্তিত্বের সংগ্রাম। বহুজাতিক আমেরিকা জ¦লছে। নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডা, নিউজার্সি, টেক্সাস, টেনেসি, মিশিগান, পেনসিলভেনিয়াসহ অন্তত কুড়ি রাজ্যে কারফিউ, দেখামাত্র গুলির নির্দেশ উপেক্ষা করে বিক্ষোভ। ল্যাটিন আমেরিকার অবস্থা আরও ভয়াবহ। এদিকে আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের দিকে এগোচ্ছে রাশিয়া। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের ঘোষণা, পৃথিবীতে একমাত্র কুকুরমানবমুক্ত জাতি রুশ।
বিশ্বজুড়ে কুকুরমানব নিধনে ন্যাটো চাইলে রুশ সেনা পাঠাতে প্রস্তুত রাশিয়া। পাশাপাশি মানবজাতি রক্ষায় মানবাকৃতির এই প্রাণী নিধনে অভিযান চালাতে অবিলম্বে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাশের আহ্বান জানিয়েছে মস্কো। মানবসভ্যতা রক্ষায় কালক্ষেপণ না করে প্রস্তাবে সই করতে সিকিউরিটি কাউন্সিলের অন্য চার সদস্যের প্রতি তাগিদ দিয়েছে তারা। আহ্বানে বৃটেনের সম্মতি মিললেও বেঁকে বসেছে চীন। যথারীতি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স।
মানবজাতির সমূহ ধ্বংস এড়াতে অবশেষে একমত হয়েছে পঞ্চশক্তি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যৌথ বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে।
অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিল পাঁচ ভেটো পাওয়ার। এসব দেশের শীর্ষ নেতারা যৌথভাবে কুকুরমানব নির্মূলের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান।
থরে থরে নটী, রাষ্ট্রযন্ত্র আর দেশ-বিদেশের বিশ্বজুয়াড়িরা তাহার ভয়ংকর মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়া অশ্রু বিসর্জন দিতে বাধ্য হইবে, ইহার অধিক কিছুই করিবার রহিবে না।
রাশিয়ার প্রশাসনিক কেন্দ্র ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়, ভবিষ্যৎ বিশ্বে মানবজাতি বিপন্নের ঝুঁকি এড়ানোর দায় এই পাঁচ দেশের। বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে এর ঝুঁকি এড়ানো ও কৌশলগত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় একযোগে কাজ করতে হবে।
‘মানবসভ্যতার প্রধান অন্তরায় কুকুরমানব বহাল রেখে কোনোভাবেই অগ্রগতি সম্ভব নয়’- এমন মন্তব্য করে পাঁচ বিশ্বশক্তি বলেছে, যেসব দেশে এরই মধ্যে এই প্রাণীর ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে এবং তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে, সেসব দেশে অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রতিরোধ এবং নির্মূল অভিযান পরিচলনা হবে।
এই বিবৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মন্তব্য করেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যৌথ বিবৃতি পারমাণবিক শক্তিধর পাঁচ দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
নির্মূল অভিযানে নীতি-নৈতিকতার কথা স্মরণ করিয়ে তিনি জানান, কোনো দেশ বা মানুষ অযথা আক্রমণের শিকার হলে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে বাধ্য হবে বেইজিং। এই সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সদিচ্ছা আছে বলে জানিয়েছে ফ্রান্স সরকার।
সিদ্ধান্তের পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় জাতিসংঘের শন্তিরক্ষা বাহিনী ব্রাজিল, মেক্সিকোসহ ষোলো দেশে একযোগে অভিযানে নামে। ন্যাটো অভিযানে যায় মধ্যপ্রাচ্যসহ আফ্রিকার দশ দেশে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে বিশ্ব।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কোনো অভিযান চলবে না। সরকারের দেয়া তালিকা অনুযায়ী সীমিত পরিসরে অভিযান চলতে পারে। অভিযানের নামে কোনো বিশেষ দেশের ঘাঁটি করতে দেয়া হবে না। এই অভিযান মানবাধিকার রক্ষার, মানব স্বার্থ বিপন্ন যেন না হয়।
এই ইস্যুতে দিল্লির সমর্থন পেয়েছে ঢাকা। তবে এরই মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দাঙ্গায় শত শত লোক মরছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাহাড় থেকে সশস্ত্রাবস্থায় নেমেছে প্রকাশ্যে। তাদের পুরোনো ইস্যুগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, হিন্দু-মুসলমান বিরোধও চাঙা। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বিষয় ছাড়া সাবেক জাতিগত বিরোধ সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যেকোনো সময় উদগিরণ হওয়ার শঙ্কা। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে শান্তিরক্ষীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার কৌশল খুঁজছে। তবে এখন পর্যন্ত দাঙ্গা দমনে পুরোপুরি ব্যর্থ। মৃতের সঠিক হিসাব নেই।
রকিবের থিসিসের কনসেপ্ট জনমনে পরিষ্কার না হওয়ায় দেশজুড়ে যেখানে সেখানে যা-তা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বিশ্রীভাবে। যে যার মতো পূর্বশত্রুতা মেটাতে মরিয়া।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধ, তবে ব্রহ্মপুর ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্ররা হোস্টেলেই থাকছে। তাদের কারণে স্টেশন লিভ করতে পারছেন না ইলোরা। সার্কিট হাউসে শুয়ে-বসে কাটে দিনরাত। মাঝে মাঝে কেয়ার সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প। রকিবের অবস্থান পিএমও থেকে জানানো হয়েছে শুধু ইলোরাকে। নজিরবিহীন গোপনীয় তথ্যটা কেয়াও ভিন্ন মারফত জানেন। একদিন দুপুরবেলা স্কুলে একটি চিঠি আসে। খামের ওপর লেখা- প্রাপক, অধ্যাপক ড. ইলোরা চৌধুরী, প্রিন্সিপাল, ব্রহ্মপুর ল্যাবরেটরি স্কুল। দারোয়ান সেটা সার্কিট হাউসে দিয়ে যান। ইলোরা দেখেন, সাধু ভাষায় হাতে লেখা চিঠি।
শ্রদ্ধেয়া ভাবি সাহেবা,
আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম গ্রহণ করিবেন। সবাই জানিয়াছে আমি মরিয়া গিয়াছি, অথচ পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আমি মরি নাই। এখনও বাঁচিয়া রহিয়াছি। জগৎ অপার রহস্যময়, সর্বত্র গাফুরুর রাহিমের লীলাখেলা। রঙ্গমঞ্চে নাটকের পর নাটক চলিতেছে। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মেধাজনিত কারণে আপনার সাবেক স্বামী রকিব জোয়ারদারকে আমি অত্যন্ত পছন্দ করি। অথচ সে আমাকে কুকুরের বাচ্চা প্রমাণ করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিল। তাহার কারণে সারা দুনিয়ায় অনলে জ¦লিতেছে। এই অগ্নি ভয়ংকর, শুধু জ¦লিতে জানে, নিবারণের নিয়ম জানে না।
রকিবকে আমি দীর্ঘকাল হইতে জানি, সে নিজের মেধার অধিক জেদি। জেদ তাহাকে বিশ্বপরিচিতি দিয়াছে মাশাল্লাহ। অপরপক্ষে আমি হইলাম বিশ্ব কুকুরমানব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। দুই সত্তার একটা মিল বিদ্যমান রহিয়াছে, আমরা অনিবার্য মৃত্যু হইতে বাঁচিয়া ফিরিয়াছি। রকিবকে টার্গেট করিয়া সেই রজনীতে নিজ হস্তে স্বয়ংক্রিয় একে-৪৭ লইয়া বৃষ্টির মতো গুলি চালাইয়াছিলাম, মরিয়াছে নিরীহ অংকন। ভাগ্য সুপ্রন্ন হওয়ায় রকিব বাঁচিয়া রহিয়াছে। স্বয়ং আল্লাহতালা নিজ হস্তে তাহাকে রক্ষা করিয়াছেন। আবার কুমিল্লা সীমান্তে ক্যাসিনো বাদশা অন্ধকারে খুব কাছ থেকে মেশিনগান চালাইয়াছিল। আমি গুলি লাগিবার পূর্বেই ধানক্ষেতে পড়িয়া গেলাম। মারিয়া গিয়াছি ভাবিয়া সে চলিয়া যাইল। বিধাতার অপার মেহেরবানিতে বাঁচিয়া ঘটনাস্থল হইতে পালাইয়াছি।
ভাবি সাহেবা, রকিবকে চ্যালেঞ্জ করিবার বুদ্ধি এবং সামর্থ্য কোনোটাই আমার নাই। শুধু গুলি করিবার সাহস ছিল, তাহাতেও ব্যর্থ হইয়াছি। এখন বনেজঙ্গলে পালাইয়া বেড়াইতেছি। শান্তিরক্ষীরা পাইলে কাবাব বানাইবে। আমার তিন সন্তান ইতিমধ্যে জানিয়াছে তাহারা কুকুরের বংশধর। তাহাদিগকেও তালিকা ধরিয়া হত্যা করা হইবে। জন্মে কাহারো হাত নাই, তথাপি নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলিতেছে। কোনো অপরাধ না করিয়াও আমরা আসামি, মৃত্যুদণ্ড হইয়াছে, ফাঁসির দড়ি নাসিকা বরাবর ঝুলিতেছে। রকিবের ফরমুলা অনুযায়ী দেশে দেশে কুকুরমানবের তালিকা হইতেছে, একযোগে নিধনযজ্ঞের সূচনা হইবে শিগগিরই।
সভ্য মানব সম্প্রদায় গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের কথা বলিয়া মুখ ফেনাময় করিলেও অন্তরে ফ্যাসিবাদ। কুকুরমানব সম্প্রদায়কে বুদ্ধিতে পরাস্ত করিবার সামর্থ্য তাহাদের নাই। তাহারা সংখ্যাগুরু হইবার প্রাকৃতিক সুযোগ পাইয়াছে, তাহা কাজে লাগাইতেছে। মানবগোষ্ঠী যা ইচ্ছা করিয়া যাইবে, সেই দিন ফুরাইবার হইবার পথে। কুকুরমানবগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হইলেও বসিয়া নাই, গেরিলা ট্রেনিং লইতেছে। দুনিয়াব্যাপী দীর্ঘ মেয়াদে গেরিলাযুদ্ধ চলিবে।
আমরাও সর্বাত্মক ডিএনএ পরীক্ষার দাবি জানাইতেছি। প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা গিয়াছে, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান মানব সম্প্রদায়ের নহে। শন্তিরক্ষীরা তাহাদিগকে উৎখাতে যতই বলপ্রয়োগ করুক, ব্যাপারটা অত সহজ হইবে না। গেরিলাদের সহায়তা দিতেছেন তাহারা। শান্তিরক্ষা মিশন জোরদার হইলে বিশ্ব পরিস্থিতি রসাতলে যাইবে। কুকুরমানব সম্প্রদায় দেশে দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে মরিয়া হইয়া উঠিবে অচিরেই। এরই মধ্যে জরিপে উঠিয়া আসিয়াছে, মানব সম্প্রদায় নিজেদের অস্তিত্ব লইয়া ততটা উদ্বিগ্ন নহে, আরাম-আয়েসে নির্ভেজাল-নির্বিকার রহিতে বালিতে মুখ বুজিয়া থাকিবার পক্ষে। তাহারা সংঘবদ্ধ নহে। এই গা-ছাড়া ভাব উহাদের কাল হইবে। ইহা কাজে লাগাইবে অস্তিত্বের লড়াইয়ে সংঘবদ্ধ কুকুরমানবগোষ্ঠী। দীর্ঘ লড়াইয়ে মানবগোষ্ঠীর জয়লাভের কোনো আশঙ্কা আপাতত দৃশ্যমাণ নহে।
আপনার অবগতির জন্য বলিতেছি, রকিবকে বহুবার কায়দামতো পাইয়াও নিধন করি নাই। তাকে তুলা বানাইয়া আকাশে উড়াইয়া দিতে পারিতাম, তাহা করি নাই। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস- সে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জুয়ায় জড়াইয়া পড়িয়াছে, রাশিয়ার তুরুপের তাসে পরিণত হইয়াছে। আমাকে থিসিসের গিনিপিগ বানাইয়াছে, থিসিসে সাতাইশ বার আমার নাম আসিয়াছে। সারা দুনিয়া কুত্তার বাচ্চা রমিজরে চিনিয়াছে। দুনিয়া কাঁপানো বেশ্যা মর্জিনা দিবারাত্রি রকিবের সেবায় নিয়োজিত। আরেক বারবনিতা কেয়া তাহার রক্ষিতা হইতে সদা প্রস্তুতি লইয়া রহিয়াছে। আর নগরনটী ফাহমিদা দেশ-বিদেশে রকিবের পত্র চালাচালিতে দিবারাত্রি ব্যস্ত সময় পার করিতেছে। ইহারা সকলে লাল কালিতে চিহ্নিত রহিয়াছে।
দুনিয়াজুড়ে রক্তের হলিখেলা, অন্যদিকে আপনার সাবেক স্বামী সরকারের কেন্দ্রে বসিয়া মুরগির রান চিবাইতেছে আর দেশে দেশে যুদ্ধের পথরেখা আঁকিতেছে। মানুষের চাইতে তাহার ছায়া দীর্ঘ হইলে বুঝিতে বাকি থাকে না, সূর্য অস্ত যাইতে বেশি দিরং নাই। রকিব নিজেকে ছাড়াইয়া গিয়াছে বহু আগে। আকাশপানে গুলি ছুড়িলে তা নিরুদ্দেশ হইয়া যায় না, ফিরিয়া আসিতেই হইবে।
আপনাকে হুমকিধমকি প্রদান আমার কম্ম নহে, উদ্দেশ্যও নহে, নিশ্চিত মরণ হইতে বাঁচিয়া পরবর্তী মৃত্যুর কবর খুঁড়িতেছি, সেই তথ্য সরবরাহই লক্ষ্য। একটা অনুরোধ করিবার জন্য এই পত্রের অবতারণা- তাহা হইলো, জাফর উল্লাহ কুকুর বংশের হইলেও স্বভাবে বলদ। এই বলদের কোনো অপরাধ নাই, সে যত অপরাধ করিয়াছে, সকলই আমার প্ররোচণায়। জননীর প্রতি অনুরোধ- জাফরকে বন্দিদশা হইতে মুক্তি দিতে যদি আপনার মর্জি হয়। তাহাকে মুক্ত করিলে শান্তিরক্ষীরা হত্যা করিবে জানি, তবু আমার কারণে সে আটকা পড়িয়া রহিয়াছে, সেই অপরাধবোধ হইতে মুক্তি চাই।
রকিবের কন্যাকে সরকার বাড়তি নিরাপত্তা প্রদান করিয়া যাইতেছে ভালো কথা, কিন্তু কত দিন?
ভাবি সাহেবা, জানিয়া রাখিবেন- রকিবের অধিকতর করুণ মৃত্যু হইবে। জীবনাবসানকালে যন্ত্রণার মেয়াদ হইবে দীর্ঘতর। থরে থরে নটী, রাষ্ট্রযন্ত্র আর দেশ-বিদেশের বিশ্বজুয়াড়িরা তাহার ভয়ংকর মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়া অশ্রু বিসর্জন দিতে বাধ্য হইবে, ইহার অধিক কিছুই করিবার রহিবে না।
ইতি, রমিজউদ্দিন খোনকার।
আদালতে জুরিদের সামনে তার বক্তব্য ছিল- তোমরা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলে যে দেবতারা আমাকে পাঠিয়েছেন তাদেরকেই দোষী প্রমাণ করা হবে। আমি সদাসর্বদা মানুষকে জ্ঞানের উপদেশ দিয়েছি। আমার মতো কে আছে? অতএব আমাকে মুক্তি দাও।
ইলোরার চিঠি পড়া শেষ হতেই কেয়ার প্রশ্ন, এই চিঠি কার বুঝতে পেরেছেন? এটা রমিজের কিনা বিভ্রান্তি আছে।
– আর কার হতে পারে?
– আমার মনে হচ্ছে জাফর উল্লাহর চিঠি। পুরো চিঠির মূল কথা জাফরের মুক্তির তদবির। এছাড়া লাইনে লাইনে কোরআন-হাদিস বলার অভ্যাস তারই। রমিজ হলে গালিগালাজের প্রাধান্য থাকত। তবে আমি নিশ্চিত নই, রমিজও হতে পারে। হয়তো তাদের যোগাযোগ আছে, চিঠিটা জাফরকে দিয়ে লেখানো হতে পারে।
– যেই লিখুক, চিঠি তথ্যবহুল, বড় সংশয় ও শঙ্কা তৈরি করাতে পেরেছে, রমিজ হয়তো বেঁচে আছে। আতঙ্ক সৃষ্টি চিঠির উদ্দেশ্য হতে পারে। ডিসিকে ফ্যাক্স করব?
– এখনই ফ্যাক্স করছি। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত জানা দরকার।
– হুম।
– ম্যাডাম, পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে, আর কী কী হতে পারে?
– বুঝতে পারছি না। মর্জিনা অনেক বিষয় জানতে পারেন। ফাহমিদার কাছেও তথ্য আছে।
– রকিব স্যার বলেছিলেন, সচিব পর্যায়ে তার এক বন্ধু আছেন, নাম মনোজ।
– হুম, তার সঙ্গেও কথা বলা দরকার। মনোজদার মোবাইল নম্বর থাকলে কল দিন।
কেয়া স্বরাষ্ট্রের যুগ্ম সচিব ড. মনোজ সেনগুপ্তের সংযোগ পেয়ে মোবাইল ইলোরাকে দিয়ে চিঠি ফ্যাক্স করতে যান।
– মনোজদা বলছেন? আমি ইলোরা, আপনার বন্ধু রকিবের সাবেক বউ। চিনতে পেরেছেন?
মোবাইলের ওপার থেকে মনোজ বলেন, আরে ভাবি যে, কেমন আছেন?
– ভালো নেই। গ্রামে আছি, দেশ-দুনিয়ার কোনো খবর জানি না, হচ্ছেটা কী?
– তুমুল দাঙ্গা হচ্ছে, আপাতত এটাই খবর। আপনাদের খোঁজখবর ডিসির মাধ্যমে পাচ্ছি। কিন্তু ওভার ফোন আপনাকে কিছুই বলতে পারছি না। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে রাখি, রমিজ মরে নাই, সে অজ্ঞাত স্থান থেকে পুলিশপ্রধানকে হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। আরও কথা আছে, চেষ্টা করব দু-চার দিনের মধ্যে আপনার সঙ্গে দেখা করার। এর বাইরে আর কিছুই বলতে পারছি না, রাখলাম।
মোবাইল ফোন রেখে ইলোরা কেয়াকে বলেন, রমিজ তো সত্যিই বেঁচে আছে। সবাইকে থ্রেট করে বেড়াচ্ছে।
– যার কিছু করার নেই, সে থ্রেট করেই বেড়ায়। দেশ চলছে বন্দুকের নলে, ওর হুমকিতে কি যায় আসে। পুলিশ পেলে মোরব্বা বানাবে, এই খবর সে রাখে?
– যত যাই বলেন, প্রচণ্ড ভয় লাগছে, মেয়েটার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত আছি। রকিবকে না পেয়ে তার মেয়ের ক্ষতি করতে চাইবে রমিজ। মেয়ের কিছু হলে রকিবের কলিজা ছিঁড়ে পড়বে। সমস্যা আরও আছে, মেয়েকে নিয়ে রকিব একবার যদি শঙ্কায় পড়ে, সে জেলহাজত মানবে না, সোজা বেরিয়ে রমিজকে ব্রাশফায়ার করে দেবে। দুনিয়ার কেউ আটকাতে পারবে না। রমিজ ব্যাপারটা জানে, শুধু এ কারণে সেদিকে পা নাও বাড়াতে পারে। যিনি বিজ্ঞানী তিনি গুন্ডা- গোটা দুনিয়ায় মনে হয় এক পিসই আছে- তার নাম রকিব জোয়ারদার।
– মেম, অত ভাববেন না। ঢাকায় আপনাদের মেয়ের দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী, তাকে স্পর্শ করার কোনো সুযোগ নেই।
– কিন্তু এসবের শেষ কোথায়?
– ধৈর্য হারাবেন না মেম। রকিব স্যারের শেষ কথা ছিল- দুর্যোগ সাময়িক, ক্ষতিটা স্থায়ী; তাই দুর্যোগে বিচলিত না হয়ে মোকাবিলা করা উত্তম।
পুলিশপ্রধান রমিজের চিঠি পাওয়ার দুই ঘণ্টার মাথায় বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্তসহ সারা দেশে রেড অ্যালার্ট জারি করেছেন। ইন্টারপোলকে জানানো হয়েছে। রমিজ মোস্ট ওয়ান্টেড।
ইলোরার সঙ্গে ফোন আলাপের সাত দিনের মাথায় সর্কিট হাউসে আসেন মনোজ সেনগুপ্ত। তাদের আরেক বন্ধু ব্যারিস্টার ড. কুতুবউদ্দিন দেওয়ান সঙ্গে। সুপ্রিম কোর্টের জাঁদরেল আইনজীবী। ড. দেওয়ান যুুক্তিবাদী ও উদাহরণবাদী মানুষ। উদাহরণ ছাড়া কথা বলেন না। ইসলামিতরিকা অনুযায়ী তার দাড়ি আছে, গোঁফ নেই; লম্বা জোব্বা পরেন। আদালতেও এই পোশাক পরে যাওয়া চেষ্টা-তদবির চালিয়েছেন, অনুমতি মেলেনি।
ইলোরার সঙ্গে ড. দেওয়ান পরিচিত হন নিজেই।
বলেন, আসসালামু আলাইকুম। আমি রকিবের বন্ধু কুতুবউদ্দিন দেওয়ান। তার শ খানেক বন্ধু আছে আমার মতো, তাই আপনি হয়তো নামই শোনেন নাই। আমি সেই ভেড়ার পালের একটা। ইউনিভার্সিটিতে নৃবিজ্ঞানে পড়তাম, বের হয়ে বার অ্যাট ল’ পড়তে যুক্তরাজ্য চলে যাই। দেশে ফিরে নানা কারণে মনোজের সঙ্গে যোগাযোগটা রয়ে গেছে, রকিবের সঙ্গে মাঝে মাঝে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে গঠন করা আইনজীবী প্যানেলের আমি একজন। পুরো ব্যাপার এবং পরিকল্পনা আপনাকে জানানো প্রয়োজন।
– চারদিকে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না, এসে ভালো করেছেন।
– কনফুসিয়াসের নাম তো শুনেছেন, চীনের বিরাট দার্শনিক। তার প্রকৃত নাম খুন ছিউ। কনফুসিয়াস হলো সম্মানসূচক। মূল নাম হারিয়ে সম্মানসূচকটা টিকে আছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫১ অব্দে জন্ম তার।
‘শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধের পথে যাওয়ার আগে দুটি কবর খুঁড়ে রেখো, একটি নিজের, অপরটি শত্রুর জন্য।’
কনফুসিয়াসের এই দর্শন অনুযায়ী রকিব নিজের জন্য জায়গায় জায়গায় কয়েক শ কবর খুঁড়ে রেখেছে।
– শুধু যে নিজের জন্য খুঁড়েছে তা নয়- কন্যা, বন্ধুবান্ধব, দেশবাসী এমনকি বিশ্ববাসীর জন্য সে কোটি কোটি কবর প্রস্তুত রেখেছে।
– ভাবি যথার্থ বলেছেন। সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটল ট্রিলজিতে চতুর্থ সংযোজন হতে যাচ্ছে এক বাঙালি। তার নাম রকিব। সক্রেটিস জীবদ্দশায় ছিলেন ধাঁধার মতো, মৃত্যুর পর চিরন্তন বিস্ময়ে পরিণত হয়েছেন। দর্শন বিষয়ে কিছুই লিখে যাননি, তবু তিনি মহান দার্শনিক। পৃথিবীর মানুষের দর্শন চিরতরে বদলে দিয়েছেন এই একজন। সক্রেটিসের জন্ম ৪৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সের সিরকা নগরীতে।
সক্রেটিসের জন্য দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, তার সমসাময়িক সমাজে তার মতো প্রখর জ্ঞানী ছিল না। তারা ছিল রক্ষণশীল ও সংকীর্ণমনা। তৎকালে ঈশ্বর সম্পর্কে নানা কল্পকাহিনি প্রচলিত ছিল। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন দেবত্ব যৌক্তিকতার অপর নাম। তারা মানুষের কাছে অর্থহীন আচার অনুষ্ঠান আশা করেন না। তার এই তত্ত্ব ধর্মীয় রীতিনীতিগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। এই অভিযোগও আনা হলো, তিনি মানুষকে ঈশ্বর থেকে পৃথক করতে চাইছেন।
ভাবি, আমার কথা আঁতলামি মনে হতে পারে, পরিস্থিতি জানাতে হলে উদাহরণ না দিলে কিছুই বুঝতে পারবেন না। দুই মিনিট ধৈর্য ধরে শুনেন। ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আদালতে সক্রেটিসের বিচারের রায় দেওয়ার জন্য ৫০১ জুরির সমন্বয়ে বোর্ড গঠন হলো। সক্রেটিসের যুক্তি হেরে গেল। ২২১ জনের নির্দোষ ঘোষণার বিপরীতে ২৮০ জন সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। সক্রেটিস তখনও নিজের যুক্তিতে অনড় থেকে বিপদ বাড়িয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী তাকেও জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি কি নিজের দোষ স্বীকার করে নিচ্ছেন কি না। সক্রেটিস যেন খুব করে চাচ্ছিলেন তাকে মৃত্যুদণ্ডই দেওয়া হোক। দোষ স্বীকার করলে রায় অন্যরকমও হতে পারত। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং তার কর্মকাণ্ডকে যুক্তিযুক্ত বলেন। তিনি প্রজ্ঞা আর প্যারাডক্সিক্যাল বাচনভঙ্গিতে বিচারকদের কটাক্ষ করেন। দোষ স্বীকার দূরের কথা, তিনি বরং পুরস্কার দাবি করে বসলেন। বিচারকরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। রায় তার বিরুদ্ধে যায়। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়। তিনি শান্তভাবে রায় মেনে নেন।
জীবনের শেষ দিনেও সক্রেটিস ছিলেন হাসিখুশি ও সহজ স্বাভাবিক। বিষ নিয়ে আসা লোকটির হাত থেকে বিষের পেয়ালা নিয়ে ‘হেমলক’ পান করতে তিনি খুব একটা বিলম্ব করেননি।
ভাবি, সক্রেটিসের জীবনী বলার কোনো ইনটেনশন আমার নেই। তবে পরিস্থিতি অনেকটা সেদিকে গড়াচ্ছে।
সক্রেটিসের দর্শনের বিশেষ দিক হলো- যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থান ধরে রাখা। আদালতে জুরিদের সামনে তার বক্তব্য ছিল- তোমরা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলে যে দেবতারা আমাকে পাঠিয়েছেন তাদেরকেই দোষী প্রমাণ করা হবে। আমি সদাসর্বদা মানুষকে জ্ঞানের উপদেশ দিয়েছি। আমার মতো কে আছে? অতএব আমাকে মুক্তি দাও। এটা আমার আবেদন নয়, উপদেশ।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-২১॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন