পর্ব-১৯
রকিবের সাবেক স্ত্রী ইলোরা চৌধুরী দুই মাসের জন্য দেশে ফিরেছেন কন্যার এইচএসসি পরীক্ষা উপলক্ষে। মেয়ের কাছ থেকে দেশের সব ঘটনা শুনেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সংবাদ সম্মেলন, বিবিসির প্রতিবেদন, দেশ-বিদেশের চলমান আন্দোলন, রকিবের থিসিস পেপারসহ সব টিভি ক্লিপ ও পেপার কাটিং তিনি ফাইল করেছেন। রুহিন জোয়ারদারের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিন মা-মেয়ে ব্রহ্মপুর যান। দেখা করেন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে। ডিসিকে জানান, তারা রকিবের সঙ্গে দেখা করতে চান।
ডিসি অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, রকিব সাহেব এই জেলা কারাগারে নেই। কোথায় আছেন বলা নিষেধ। এ বিষয়ে ওপরের নির্দেশনা আছে, বিষয়টি খুবই গোপনীয় এবং মামলাটি সেনসেটিভ। পুরো বিষয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দেখছেন, আমাদের কিছুই করার নেই।
ইলোরা ডিসিকে বলেন, ওপরে যোগাযোগ করে জানান প্লিজ, রকিবের মেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
আপনি অযথা কথা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া কিছুই করা যাবে না। দেশের হাল বুঝতে পারছেন তো? তিন সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ চলছে, রাস্তাঘাট বন্ধ। সবকিছু স্থবির। অফ দ্য রেকর্ড বলছি, পরিস্থিতি খুবই খারাপ, ঘণ্টায় ঘণ্টায় খারাপের দিকে যাচ্ছে। কয়েক কোটি লোক রকিব সাহেবের ফাঁসির দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। শুধু দেশে নয়, সারা বিশে^ বিক্ষোভ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী মহোদয় তার পক্ষ নিয়েছেন, তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন তাকে।
রকিবের অপরাধ কী?
ডিসি বিস্মিত হয়ে বলেন, ম্যাডাম কোন দেশে আছেন। অদ্ভুত প্রশ্ন। রকিব সাহেব কী এক মতবাদ দিলেন, সারা দুনিয়া বিভক্ত হয়ে জ্বলছে আগুন। নতুন করে জাতিগত রায়ট শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৃথিবী। এটা ধর্মের বিরোধ নয়, বর্ণবাদ নয়, মানবজাতি ও পশুশক্তির দাঙ্গা। মানবসভ্যতা বিপন্নের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষণে রাস্তার বাঁকের ব্যাংকিং খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল, অথচ ইস্যুটি রিপোর্টের কোথাও পাওয়া গেল না। প্রতিবেদনটি কোনো তাকে করতে দেয়া হলো, বুঝলাম না।
মাফ করবেন জনাব, রকিব কোনো মতবাদ দেননি। তিনি একটি সাইন্টিফিক থিসিস ফাইনাল করেছেন, জাস্ট একটি সার্ভে। সেটা পাবলিশ করেছে রাশিয়া। ভূ-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে থিসিসটা রাশিয়ার প্রয়োজন ছিল। আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমি নিউজিল্যান্ড থাকি, ইউনিভার্সিতে গণিত পড়াই। রকিব আমার মেয়ের বাবা। আমাদের ডিভোর্স হয়েছে অনেক আগে। আপনি রকিবের থিসিসটা পড়েছেন?
ম্যাডাম, দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সরকার টালমাটাল। অবস্থা এতটাই বেসামাল, এ নিয়ে কোনো কথা বলা যাচ্ছে না। অনেক বিষয় বুঝেও চুপ থাকতে হচ্ছে। আমি বোটানির ছাত্র। সাড়ে পাঁচশ পৃষ্ঠার থিসিসটা চারবার পড়েছি। জটিল সার্ভে, এ কারণে বারবার পড়তে হয়েছে। বিজ্ঞানের ছাত্র-শিক্ষক ছাড়া এর মূলকথা উদ্ধারের সাধ্য কারও নেই। আগাগোড়া ম্যান্ডেলিজম, ডারউইনের বিবর্তনবাদের ধারে কাছে কিছু নেই। দুনিয়াজুড়ে বিক্ষোভ চলছে ভিন্ন কারণে, সেটা আন্তর্জাতিক রাজনীতি। আমাদের দেশে বিক্ষোভ হুজুগে এবং না বুঝে, না জেনে। থিসিসটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের দুর্ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবের সার্ভে, তাতে অনেক বিষয় যোগ হয়েছে। কোথাও বলা হয়নি, মানুষের বিবর্তন কুকুর থেকে। ডারউইনের মতবাদ এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অথচ প্রচার হচ্ছে তা-ই। মূল বিষয় কেউ পড়ে দেখছে না, কেউ কারও কথাও শুনছে না।
ম্যাডাম, আবারও অফ দ্য রেকর্ড বলছি, সরকার গভীর বিপদে আছে, দেশ সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। যোগাযোগব্যবস্থা লণ্ডভণ্ড। বিরোধীদল ফায়দা নিচ্ছে। রকিব স্যারের থিসিসের কুকুরমানবরা রাস্তায় নেমেছে। সঙ্গে বিরোধীদল থাকায় তাদের আলাদা করা যাচ্ছে না। সরকারদলীয় অধিকাংশ নেতা-কর্মী কিছুই না বুঝে ধর্ম রক্ষায় মরিয়া, কেন্দ্রের নির্দেশ মানছে না। তারাও পরোক্ষভাবে বিক্ষোভে আছেন। এমপি-মন্ত্রীরাও বিভ্রান্ত। সরকার বাঁচাবেন নাকি ধর্ম রক্ষা। মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে সব চুপ, প্রধানমন্ত্রী একা লড়াই করছেন। নীরবে সবার সিরিজ দাবি- রকিবের ফাঁসি, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ওআইসিকে সমর্থন, থিসিস প্রত্যাহারে রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ। নিঃসঙ্গ প্রধানমন্ত্রী হাল ছাড়ছেন না, সর্ববিনাশের অন্তিমক্ষণে হয়তো এদের সুমতি হবে।
শিক্ষিত বিবেকবান সমাজ কথা বলছে না কেন?
সুশীল সমাজ, মানে বুদ্ধিজীবীদের কথা বলছেন তো? তা আর অবশিষ্ট নেই, তলানীতে ঠেকেছে। বলেন যে, গুচ্ছ গুচ্ছ ধান্ধাবাজরা কোথায়। তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। রাজনীতিকরাও ওদের আর পাত্তা দেন না। রকিব স্যারের থিসিস ওরা বুঝেছে বলেও মনে হয় না। বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো আলোচনা এখন আর দেশে নেই। কিছু দলবাজ বুদ্ধিজীবী এখনো আছেন, আচরণ দলীয় কর্মীর চেয়েও নিম্নগামি। তারা খুবই নিম্নমূল্যের পণ্য, ইজি পার্চেজেবল। ওরা নেতাদের বক্তব্য লিখে দেন। কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে নেতা, আমলা এমনকি শিল্পপতিদের নামে গান-কবিতা-বই লিখে রোজগার করেন। সর্বত্র বেহায়াপনার প্রতিযোগিতা। একটা অদ্ভুত বিষয়, দেশে এখন আর সায়েন্স ফ্যাকাল্টির কোনো বুদ্ধিজীবী নেই, লেখক-কলামিস্ট নেই, কবি-সাহিত্যিকও নেই। দু-চারটা দালাল বুদ্ধিজীবী যা আছে সব আর্টস ফ্যাকাল্টিার। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধার ধারে না, যা মনে আসে তাই লিখে চলেছে।
পত্র-পত্রিকা আরও বেহাল, কোথাও বিজ্ঞানের লোক আছে বলে মনে হয় না। কিছু কিছু খবর বা খবর বিশ্লেষণে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা প্রয়োজন হয়। যেমন, কয়েকদিন আগে বড় একটি পত্রিকায় একটি বিশেষ সড়ক দুর্ঘটনার বিশ্লেষণ আগ্রহ নিয়ে পড়তে গিয়ে হতাশ হয়েছি। সেখানে স্থিতিবিদ্যা, গতিবিদ্যাসহ নানা বিষয় আলোচনায় এসেছে। রিপোর্টার গতি, বেগ, ভর, ভরবেগ সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। বিশ্লেষণে রাস্তার বাঁকের ব্যাংকিং খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল, অথচ ইস্যুটি রিপোর্টের কোথাও পাওয়া গেল না। প্রতিবেদনটি কোনো তাকে করতে দেয়া হলো, বুঝলাম না।
বাংলাদেশের শুধু একটি পত্রিকা অনেক বছর ধরে সেরা এবং বিশ^মানের, এর নেপথ্যের রহস্য জানেন কিনা জানি না, আমি জানি। কারণ হলো, এর সম্পাদক ফিজিক্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির, ডিসিপ্লিনও বলে দিলাম-স্ট্যাটিসটিক্স। এই দেশ পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ, সব সেক্টরে বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদতা। থাক সেসব কথা, আপনার সময় নষ্ট করলাম।
জোয়ারদার বংশের একটা চিজ রকিব, কইত্থেইকা কি বাল-ছাল পইড়া আইছে, সারা দুনিয়ায় কানেকশন। আমরিকা, লন্ডন, রাশিয়াসহ দুনিয়ার হগলতে চিনে। টিভি ছাড়লেই দেখি, বেক্কে কথা কয় একজনরে নিয়া। লাভ নাই, বাবারা বাঁচাইতে পারবে না।
যাই হোক, রকিব স্যারের মেয়েকে নিয়ে এখানে আসা আপনার ঠিক হয়নি। আইনশৃঙ্খলা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, লোকজন কুকুরের চেয়েও নিচে নেমে গেছে, যা ইচ্ছা করছে। এখানে স্যারের মেয়েকে বেশি সময় বাড়তি নিরাপত্তা দিতে পারব না, মব ঠেকানো কঠিন, আমাদের তত ফোর্স নেই। আমি সর্বোচ্চ সিকিউরিটি দিচ্ছি, তাকে নিয়ে আপনি ঢাকায় গোপন স্থানে চলে যান, বেঁচে থাকলে বাবার সঙ্গে দেখা হবেই।
স্যারের মেয়ে এখানে অপেক্ষা করবে, আপনি ল্যাবরেটরি স্কুলে যান, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন, আমি ব্যবস্থা করছি। স্কুলটি জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে চলছে, যা আমি চাই না। নামকরা প্রতিষ্ঠানটির সুনাম অটুট থাকা দরকার, এমন স্কুল চাইলেই প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
কেয়া ম্যাডাম আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, তবে তার একাডেমিক সীমাবদ্ধতা আছে। মর্জিনা মেম সহায়তা দিচ্ছেন, কিন্তু সিআইএ এজেন্ট দিয়ে স্কুল চলবে না, একাডেমিশিয়ান লাগবে। লোকাল এমপি শুরু থেকে রেগে আছেন। আমি যত দিন এখানে আছি কেউ আর বড় সমস্যা করতে পারবে না, কখনো বদলি হলে পরে সমস্যা হবে। রকিব স্যারের ক্ষমতা নজিরবিহীন, স্কুলে তার পরিবারের লোক দাঁড়াতে হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আপনার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
আমি রকিব পরিবারের কেউ না।
আইন তা বলে না মেম। আপনি স্যারের একমাত্র উত্তরাধিকারের জননী, আঠারো বছর পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কন্যা স্যারের সব ক্ষমতা এবং বিপুল সম্পত্তির মালিক। আপনি এই মুহূর্তে রকিববলয়ের পরোক্ষ অভিভাবক। প্রায় পাঁচশ ট্যালেন্ট ও অর্ধশত শিক্ষকের নিরাপত্তার দায় এড়ানোর সুযোগ আপনার আছে কিনা, বিবেচনা করবেন প্লিজ। এই স্কুলে যত মেধাবী ছাত্র আছে, সারা বাংলাদেশে তা আছে কিনা সংশয় রয়েছে। এদের বাঁচানো দরকার। আপনি বিষয়টা ভাবতে পারেন।
গভীর ভাবনায় ইলোরা, পা বাড়ান স্কুলের দিকে। রকিবের ভয়ানক বিপদ। শিক্ষার্থীদের জীবন বিপন্ন। দায়বদ্ধতা তো আছেই। রকিবের সঙ্গে বিরোধটা একান্ত ব্যক্তিগত, কিন্তু সে তো রাষ্ট্রীয় সম্পদ। অন্তত রুহিনের বাবা এবং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেও রকিব সাপোর্ট পেতে পারে।
অধ্যাপক ড. ইলোরাকে ঘিরে প্রিন্সিপালের কক্ষে বিকেলে বড় বৈঠক বসে। স্কুলের প্রশাসক এডিসি জেনারেলের সভাপতিত্বে সভা। সব শিক্ষক, মর্জিনা ও কেয়া মেম আছেন। একপর্যায়ে এমপি সাহেবও মিটিংয়ে যোগ দেন। তার কথায় সবাই নড়েচড়ে বসেন। এমপি বলেন, জেলার পৌনে দুইশ স্কুল-কলেজের সভাপতি আমি, অথচ এই লোমের স্কুলের সভাপতি ডিসি সাহেব। এতে আমার কোনো দুঃখ নাই, দুঃখ একটাই, স্কুলটি ভয়ানক বিপদের মুখে। এতে প্রমাণ হয়, রাজনীতিবিদ ছাড়া কেউ চলতে পারবে না। রাজনীতি অত সহজ নয়, পলিটিক্স কিছুতেই বাইপাস করা যায় না। দুই দিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন। রকিব সাব, দুই কলম পইড়া ধরারে সরা জ্ঞান করেন, জ্ঞানের এত গরিমা ভালো না। কুত্তা-বিলাই নিয়া কি এক গবেষণা করছেন, সারা দুনিয়া নিয়া দিছেন টান। দেশে-বিদেশে মানুষ মরতেছে। মহান আল্লাহ পাকের সেরা জীব মানুষরে নিয়া আপনে খেলেন, তামাশা করেন। আশরাফুল মাখলুকাতরে আপনে কুত্তা-বিলাই বানাইবেন আর আপনেরে সবাই কোলে নিয়া নাচবে, তা হবে না। আল্লাহর ঘর স্কুলে বইসা আপনে আল্লার সৃষ্টির বিরুদ্ধে কাজ করেন, দুনিয়ায় কঠিন বিচার হবে আপনার। জোয়ারদার বংশের একটা চিজ রকিব, কইত্থেইকা কি বাল-ছাল পইড়া আইছে, সারা দুনিয়ায় কানেকশন। আমরিকা, লন্ডন, রাশিয়াসহ দুনিয়ার হগলতে চিনে। টিভি ছাড়লেই দেখি, বেক্কে কথা কয় একজনরে নিয়া। লাভ নাই, বাবারা বাঁচাইতে পারবে না।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-১৮॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন