পর্ব-১৮
পুরো ঢাকা শহর অচল, সামনে-পিছে নড়তে পারছেন না বাদশা। তিনি এই গন্ডগোলের সুযোগটা হাতছাড়া করতে চান না। ক্লান্ত শরীরকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, অপারেশন রাতেই শেষ করতে হবে। বাদশা বিক্ষোভ ঠেলে কোনোমতে বেরিয়ে পড়েন, সঙ্গে মাত্র একখান মেশিনগান।
ঢাকার বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে আশুলিয়া, বগুড়া, রাজশাহী, সীতাকুণ্ড ও চট্টগ্রামে। রাত বাড়তে ক্ষোভ-বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়।
এদিকে সময়ের হিসাব নেই অংকন-কেয়ার বাসরঘরে। কেয়ার চুম্বনে সংবিৎ পান অংকন, ঘটে কুমার জীবনের অবসান। তখনই মোবাইল বেজে ওঠে কেয়ার। তার বাড়িতে হামলা হয়েছে, নির্বিচারে গুলি। ডুকরে কেঁদে ওঠেন নববধূ, রওনা দেন বাবা-বোনকে বাঁচাতে। অংকন যেতে চাইলে বাধা দেন। বাড়ি গিয়ে দেখেন সব শেষ, কয়েক শ বুলেট বিদীর্ণ করে গেছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বোনকে। বাবার ছিন্নভিন্ন দেহ মেঝেতে।
একই বন্দুকধারীরা নিমেষে হামলা চালায় স্কুলে। রকিবের চিলেকোঠায় ব্রাশফায়ার। উপুড় হয়ে ছিটকে পড়েন অংকন। ফিরতি পথে নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাঁচ হামলাকারী। ফের এলোপাতাড়ি গুলি। সাত ছাত্রের মরদেহ পড়ল বারান্দায়। রকিব এই প্রলয়ক্ষণেও ডরমেটরিতে অংকনের ঘরে গভীর ঘুমে অচেতন। সাক্ষী হয়ে রইল সিসিটিভি ক্যামেরা। রমিজের অ্যাকশন ভবিষ্যৎ যেকোনো সিনেমার নন এডিটেড ফুটেজ হয়ে ক্যামেরাবন্দি থাকল। তবে অপারেশন পুরো ব্যর্থ, মারা পড়েছে নিরীহ লোকজন, বেঁচে আছেন টার্গেট রকিব-কেয়া। আনাড়ি রমিজ অযথা কষ্ট করলেন।
পালাতে গিয়েও ধরা। রমিজের মোবাইল ট্র্যাক করছিলেন ক্যাসিনো বাদশা। কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরা পালাচ্ছিলেন রমিজ। নোম্যান্স ল্যান্ডে পা দেয়ার আগমুহূর্তে মেশিনগানের বীভৎস গুলির শব্দ। ক্যাসিনো বাদশার মিশন সম্পন্ন। রমিজ গ্যাংয়ের ক্ষত-বিক্ষত পাঁচ দেহ ভাসল ধানক্ষেতের হাঁটু পানিতে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই স্কুলে হাজির ড. ফাহমিদা ও গোয়েন্দা মর্জিনা। চারদিকে গিজগিজ করছে পুলিশ-র্যাব-ডিবি এবং সাদাপোশাকের গোয়েন্দারা। এর মধ্যেই রকিবকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিলেন মর্জিনা, পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন, সম্ভবও ছিল; রকিব রাজি হননি। বলেন, এমন ঘটনা ঘটবে আগেই বলেছিলাম, সবকিছু প্রোগ্রামিং করা। রকিব নিজেকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন। ছাত্রদের মরদেহ উঠল পুলিশ ভ্যানে। আগে-পিছে গাড়িতে সাত ছাত্র ও অংকনের নিথর দেহ নিয়ে পুলিশ পাহারায় রকিব রওনা দিলেন থানার দিকে।
রকিব পেছন ফিরে দেখেন ফাহমিদা ও মর্জিনা হাত নাড়ছেন। বাহ্, অসাধারণ দৃশ্য, অভূতপূর্ব ভোর। ভোরবেলা ঈশ^রের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। জীবনের জটিল সময়েই শুধু ভোরের বাতাস শরীরে ছোঁয়ানো যায়, সাধারণত অহেতুক ঘুমে কাটে স্বর্গীয় সময়টা। প্রত্যুষে মুসলমান সম্প্রদায়ের ফজরের আজানে একটি বাক্য আছে- আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম। বাক্যটির অর্থ- ঘুম থেকে নামাজ উত্তম। মানুষকে ভোর উপভোগ করাতে ধর্মের অন্তহীন উদ্যোগ।
বিদায়বেলায় দুই নারীকে অপরূপ লাগছিল। ফাহমিদা ধবধবে সাদা শাড়ি পরেছেন কেন কে জানে। মর্জিনার পুরো আর্মি সাজ। কেয়াকে দেখা গেল না, হয়তো বোন ও বাবার দেহের ওপর তখনো কাঁদছিলেন। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ দরকার। ভাগ্য ভালো হলে থানায় দেখা হতে পারে, সুরতহালের জন্য ওদের বডিও থানায় নেয়ার কথা।
নবম ও দশম শ্রেণির এগারো ছাত্র যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট সিনাই এবং এমআইটিতে কোর্স করার সুযোগ পেয়েছে, একজন গত রাতে গুলিতে মারা গেছে, বাকি দশজন যেন সুযোগটা মিস না করে।
মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি জীবন ভয়ংকর সুন্দর। অংকনের সঙ্গে মেয়েটি অসাধারণ একটি রাত কাটিয়েছেন নিশ্চিত, তিনি কোনোদিন এই রাত ভুলতে পারবেন না। একটি রাত অবলম্বন করে বেঁচে থাকবেন। তাদের ফিজিক্যাল ইউনিয়ন হয়েছে কিনা কে জানে, হয়ে থাকলে এরই মধ্যে হয়তো একটি শিশু জন্মের ক্ষণগণনা শুরু হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে কেয়া টের পাবেন তার ভেতরে নড়ছে জুনিয়র অংকন। জুনিয়র অংকন কি পারবে একটি সম্পূর্ণ জীবনচক্র সম্পন্ন করতে, নাকি বাবার মতো অর্ধেক জীবনে বিদায় নেবে। কেয়ার কয়েক ঘণ্টার দাম্পত্য জীবন, অতঃপর সব শেষ, কী নিয়ে বাঁচবেন মেয়েটা। তবু জীবন থেমে থাকবে না, বাকি জীবনে তিনি কি আর কখনো হাসতে পারবেন? মানবজীবন এমন কেন? জন্মই কি মানুষের আজন্ম পাপ?
বিক্ষিপ্ত ভাবনায় তন্দ্রার মধ্যে হাতকড়া পরে থানায় পৌঁছেন এই মুহূর্তে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানী রকিব জোয়ারদার।
রকিবের অনুমান ঠিক হয়েছে, থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেয়া। গোটা এলাকা লোকে লোকারণ্য। রকিব এরমধ্যে কেয়াকে ইশারায় ডেকে সোনালি ব্যাংকের চেক বই দিয়ে বলেন, সব পাতায় সই করা আছে। অ্যাকাউন্টে একশ ত্রিশ কোটি বাইশ লাখ পাঁচশ সাতাশ টাকা আছে। স্কুল দু-এক বছর চলতে কোনো সমস্যা হবে না, এর মধ্যে আমি ফিরে আসব। আর এই খামের মধ্যে স্কুল পরিচালনার সবকিছু লেখা আছে। আপনি আমার প্রতিনিধিত্ব করবেন, আপনাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করা আছে, গতরাতে এসব বানিয়েছি। ড. ফাহমিদা ও মর্জিনা আপনাকে সহায়তা দেবেন। ফাহমিদকে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নিতে বলবেন, সে অপারগতা জানালে মর্জিনা নতুন পরিকল্পনা দেবেন। এর মধ্যে ডিসি স্কুল টেকওভার করবেন, প্রশাসক বসাতে পারেন, তাতেও সমস্যা নেই।
সব মামলা চলবে আপনার তত্ত্বাবধানে, মর্জিনার পরিকল্পনায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. মনোজ সেনগুপ্ত আমার বিশ^বিদ্যালয় জীবনের বন্ধু, তার সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করবেন। মনে রাখবেন, দুর্যোগ স্থায়ী নয়, ক্ষতিটা স্থায়ী, তাই ক্ষতি যতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নয়া মতবাদ প্রতিষ্ঠা পেতে বছরের পর বছর পার হবে। আমার থিসিস কঠিন সত্য, জাতিতে জাতিতে মেনে নিতে সময় লাগবে। এর মধ্যে অনেক হাঙ্গামা হবে, বহু প্রাণহানি ঘটবে, কিছুই করার নেই; শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান মানতেই হবে। ড. ফাহমিদা আমার অ্যাডভাইজার। ল’ ইয়াররা থিসিসের ভুল ব্যাখ্যা দিলে সে সংশোধনী দেবে।
থিসিসটা অনেক বুদ্ধিজীবীর মাথার ওপর দিয়ে যাবে, অনেকে না বোঝার ভান করে অসভ্যতা করবেন, তাতে সময়ক্ষেপণ হবে, এর বেশি কিছু না। আমার ইস্যুতে নার্ভাস হবেন না, এই সরকারপ্রধান বিজ্ঞান বোঝেন, যুক্তি মানেন; তাকে কেউ বিভ্রান্ত করতে পারবে না। উনি আমাকে ছাত্রকাল থেকে জানেন। অতএব, অযথা হয়রানি এবং অবিচারের শিকার হবার কোনো শঙ্কা নেই। আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী নিজেই পুরো বিষয়টা তদারকি করবেন।
আপনার মনের অবস্থা বুঝেও কথাগুলো বলতে হচ্ছে, চরম বাস্তবতার মুখে আমরা সবাই। মর্জিনার সহায়তায় আমি রাশিয়া পালিয়ে যেতে পারতাম, সব প্রস্তুত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ওভারলুক করত, কিন্তু তা আমি পরিকল্পিতভাবেই করব না।
রাশান এজেন্টরা কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে রমিজের ডিএনএ স্যাম্পল নেয়ার কথা, মর্জিনাকে বলবেন মনিটর করতে। আমাকে দীর্ঘদিন কারাগারে রাখা হবে, সেখানে উগ্রধর্মপন্থী কয়েদিরা আছে। তারা আমাকে হত্যার চেষ্টা চালাবে, ব্যাপারটা মর্জিনাকে জানিয়ে রাখবেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সাহেবের সংবাদ সম্মেলন মানেই রাশিয়া আমার থিসিস অনুমোদন দিয়েছে। তারা মেইল করার কথা। চেক বইয়ের পেছনে আমার ই-মেইল অ্যাড্রেস লেখা আছে, মর্জিনা পাসওয়ার্ড জানেন। তাকে বলবেন কন্ট্রাক করতে। রাশিয়া সরকারের কাছে দেড় বিলিয়ন ডলার প্রাপ্য হয়েছি, বিল আদায়ে প্রক্রিয়া চালাবেন, আপনি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি।
এবার একটা বিশেষ অনুরোধ, স্কুলটা যেন টিকে থাকে, টাকার কোনো সমস্যা নেই। নবম ও দশম শ্রেণির এগারো ছাত্র যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট সিনাই এবং এমআইটিতে কোর্স করার সুযোগ পেয়েছে, একজন গত রাতে গুলিতে মারা গেছে, বাকি দশজন যেন সুযোগটা মিস না করে।
পুলিশ দুপুরে রকিবকে বিচারিক হাকিমের আদালতে নিলে শুনানি শেষে ওপরের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক। জেলহত্যার শঙ্কা নিয়ে জেলা কারাগারে ঢোকেন রকিব।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-১৭॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন