॥১৩॥
সমীরকে নিয়ে কথা হচ্ছিল ওদের মধ্যে। কারখানা ছুটি হতে অল্প কিছু সময় তখনো বাকি। স্বরের ওঠানামায়, ভ্রূভঙ্গিতে,একে অপরকে সাক্ষী মানার ভেতর দিয়ে উদ্বেগটুকু দিব্যি উঠে আসছিল।
কারখানার দশজন সমীরকে শান্ত-শিষ্ট আর আবেগী বলেই জানে। জানেতারঅনন্য আরো এক গুণের কথা; তুলনাহীন সততারকথা। দুর্বল শ্রমিক দলের ভেতর দায়স্বীকারের গুণ দুর্লভ। যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো অজুহাতে ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার ভীতি যেখানে নিত্য, সেখানেএ গুণ সমীরের কব্জায়। কোনোকাজে নিজ ভুলের দায় যেমন কখনো অন্য কারও ওপর সে চাপায়নি, তেমনই বন্ধু থেকে শুরু করে অনুজকে বাঁচাতে সহাস্যে ঝুঁকি নিতেও দেরি করেনি। যখনই স্থান-কাল-পাত্রে মিলে গেছে দায় যতটা পেরেছে নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে। এই করে সমীর নিজে দণ্ড পেয়ে ভুগেছে একাই। জরিমানা গুনেছে, হাসতে হাসতে দুজনের কাজ একা করেছে, বাড়তি মোট বয়েছে অসংখ্যবার। ছুটি বাতিল হয়েছে, গালমন্দও শুনেছে অশেষ। আজ যারা এখানে কথা বলতে জড়ো হয়েছে, তারা কি এসবের ভেতর দিয়েই তার আত্মার বন্ধু হয়ে ওঠেনি?
ওদিকে যে বিপরীত মতও আছে। এ সমস্ত ভালোমানুষির মুখোশটার আড়ালে এক জঘন্য বিশ্বাস ঘাতক এই সমীর। জাত চেনাচ্ছে প্রতিনিয়ত, তবু কারো চোখ খুলছে না। কতজন কত লঘু পাপে ছাঁটাই হলো এ কারখানা থেকে,সমীর কিন্তু ঠিকই বহাল। কী কৌশলে যেন বড়দেরও ঠিক হাত করে নেয়। ভাইটা আছে কী করতে নইলে? মালিক-শ্রমিক দু’পক্ষেই বিশ্বাসী থেকে লাগাতার কান ভারী করে ওপরের। দু’ভাই মিলে ফন্দি আঁটে, রাতের বেলায় এক বিছানায় হিসাব মেলায়।
ষড়যন্ত্রীদের মতো গলা খাদে নামিয়ে চলছিল এসব আলাপ। পাশ দিয়ে কেউ চলে গেলে তার চোখের দিকে চেয়ে মন পরীক্ষা করছিল আলাপের যারা অংশী তারা। ফল খারাপ হলেই চুপ।ঘুরিয়ে নিচ্ছিল প্রসঙ্গ। ফল ভালো হলে স্বর, উপলক্ষ সবই রাখছিল অপরিবর্তিত। তখন চক্রে ওদের বাড়ছিল আরো আলাপী। এভাবেই একে একে জড়ো হলো মেহেদী, লাবু, ফিরোজ, শংকর, বাবুল, মহাদেব; আরো বেশ ক’জন।
হ্যাঁ, কারখানায় থাবা লুকিয়ে রাখা অনেক বড় ষড়যন্ত্রী আছে। কিন্তু ভালো মানুষ সমীরের যে ভাবমূর্তি, তা ষড়যন্ত্রীর কুটিলতার চেয়েও বেশি শক্তি ধরে নিশ্চিত।তাই তো অত সব কানকথার পরও সমীরের ওপর মিছে অভিযোগ চাপিয়ে কেউ পার পেতে চেয়েছে, এমন ঘটেনি। কারখানা বিপুলা কর্মযজ্ঞের সুবিশাল অগ্নিকু-। পায়ে পা বাঁধিয়ে, পেছন থেকে ঠেলে অনেকেই অনেককে সেই কু-ে নিয়ে ফেলছে, পুড়িয়ে মেরেছে। কিন্তু সমীরের বিপরীতে মানুষের খোলস কেটে তেমন অমানুষ বেরিয়ে কখনো আসেনি। তবে আসেনি বলেই যে কখনোআসবে না তা তো নয়। আর সমীরের কোনো ঘাট কখনো মানতে হয়নি বলে কখনো মানতে হবেও না এমন সিদ্ধান্তে আসাও কঠিন। এই দুই ঘুর্ণির মধ্যখানে পড়ে আলাপীরা হয়ে পড়েছে বিভ্রান্ত, সিদ্ধান্তহীন, প্রগলভ, ভীত, বাচাল।
সমীরের কাছের বন্ধুদের একজন লাবু। বেশ চটপটে এবং করিৎকর্মা। মাথার ঝাঁকড়া চুলের থোক কৌতূহলী বড় চোখজোড়াকে প্রায় ঢেকে রাখে। তার ফাঁক গলেই নাকি মাঝপুকুরে ছোট মাছের তোলা বুড়বুড়িও সে দেখতে পায়।
দুপুরে খাওয়ার বিরতির কিছু আগে ক’টা স্কচ টেপ লিখিয়ে আনতে কারখানার ভাঁড়ারে গিয়েছিল লাবু। ভাঁড়াররক্ষী মকবুলের সঙ্গে নৈমিত্তিক সালাম বিনিময়ের পর গেল বুক খেলা তাকের এক সারিতে। তখন এক দৃশ্য চোখে পড়ল তার। এমন দৃশ্য কখনো চোখে পড়বে তা বুঝি তার দূরবর্তী কল্পনাতেও ছিল না। চোখজোড়াও তাই আদকা বিস্ফারিত হয়ে উঠল। মুহূর্তে ওই দৃশ্য থেকে ঘুরিয়ে নিলো মুখ। সমীর তখন দুটো পকেট ট্রান্সফর্মার হাতের মুঠোয় নিয়ে পকেটে চালান করছিল। চোখজোড়া আরাধ্য বস্তুর দিকে নয়, বরং অনির্দিষ্ট সামনের দিকে। মুখটাও অল্প ফাঁক। বুঝি চোখের দিকে না তাকালে তার কাজটিও কোনো চোখ দেখবে না।
কারখানার কাজেই যদি সমীর নেবে ও দুটো, তাহলে তো নির্ঘাৎ পকেটে ঢোকাতো না। এরপরো কথা আছে।
দু হাত পকেটে ঢুকিয়ে এক পা পিছিয়ে আবার এগিয়ে চিবুকটা উঁচিয়ে বলতে শুরু করল লাবু।
পকেটে যদি সাদা মনেই ঢোকাতো, তো সেটাও আমি খুব বুঝতাম। আমি তো নজর চিনি রে ভাই! একটা কিছু গোপন করছে, কেমন দ্রুত হাত চালাচ্ছে, পকেট ফসকে যাওয়ায় কেমন ভড়কে যাচ্ছে, এসব তো আর ঘটতো না তখন, ঠিক কিনা। আর মোটের ওপর জায়গাটা অন্ধকারই ছিল বলা যায়। আর কেউ হলে এতো কিছু দেখতোই কিনা কে জানে। কিন্তু আমি দেখলাম। কারণ আমার যে কপাল মন্দ! নেহাৎ কপাল খারাপ হওয়া ছাড়া এসব কেউ দেখে বল? আর এখানেই কি শেষ? এরপর তো প্রমাণ পেলাম হাতেনাতে।
চোখের কোণ দিয়ে লাবু দেখছিল, সমীর বেরোনোর উপক্রম করছে। দুটো খোলা তাকের মধ্যখানের ফাঁক গলে অন্য এক সারিতে সটকে পড়ল তখন। সমীর বেরোনোর সময় ভাঁড়াররক্ষী মকবুলকে ওগুলো দেখিয়ে নিয়ে স্বাক্ষর করে কিনা, তা দেখার জন্য নিরাপদ দূরত্বে থেকে টেবিলে চোখ রাখতে হবে। একে তো নিঃশব্দে চলতো লাবু। তার ওপর ভাঁড়ারের মেঝেতে পুরু মাদুর পাতা। সুতরাং কোনো শব্দ উঠল না এবং অনুসরণকারীর কোনো আভাসও মিললো না সমীরের লটে। মাদুরের ওপর পুরু ধুলার স্তর আর এখানে ওখানে ছিঁড়ে ফেঁড়ে যাওয়া। লক্ষণীয়ের দ্রুত গমনের জন্যে ওই ছেঁড়ার দিকে চোখ রাখার যথেষ্ট অবকাশ লাবুর ছিল না। একটা বড় ফাঁড়ায় পা বাঁধিয়ে টাল হারিয়ে পড়তে ধরেছিল। সামলেও নিয়েছিল শেষ মুহূর্তে।
আমার তখন বুকের ভেতর ঢিপঢিপ, আর একটা কেমন ব্যথা।
ব্যথার কথা বলার পর লাবুর কণ্ঠের জোর খানিকটা পড়ে গেল।
পকেটে যা নিয়েছিল, মকবুলের সামনে তা রাখল না সমীর। যে দুটো জিনিস ছিল হাতে, এখন মনেও নেই কী ছিল ওই দুটো, ওগুলোই কেবল দেখিয়ে নম্বর লিখে বসালো স্বাক্ষর। এরপর মুখটা এক কোণে ফিরিয়ে কেমন করে যেন হেসে বেরিয়ে গেল। ও কারো চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। ভাবতেও পারি না এটা আমাদের সমীর। প্রথমে ভাঁড়ার ঘর ছাড়তেই গিয়ে দ্রুত হাঁটতে লেগেছিল। পরে থামল। ধীরে ধীরে হেঁটে বেরিয়ে গেল এরপর। চুলায় যাক। সমীরের মনে কিসের এমন পরিকল্পনা তোরা বল? সেটা কি এতোই বড়, যে আমাদের মতো তুচ্ছ বন্ধুরা তা জানলো না? বা সেটা কি এতোই তুচ্ছ, যে আমাদের জানানোর কোনো দরকারও সমীর মনে করে নাই?
এরপর? এরপর কী করলে তুমি?মহাদেবের কথায় বরেন্দ্র অঞ্চলের টান প্রবল।
ব্যাপারটা বুঝতেও তো আমার কিছু সময় লেগে গেল। আর লাগাটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? কী করব তাই ভাবছিলাম। পিছু নেবো। দেরিও করে ফেলেছি। নিজেকে বোঝালাম, হুতোতাড়া করো না লাবু! হুড়োতাড়া হলে ভুলও হবে। শান্ত হও। ঘড়িতে দেখলাম তখনো এক ঘণ্টা মতোন বাকি আছে।
টেপগুলো নিয়ে স্বাক্ষর করে ধীরে সুস্থেই বেরিয়েছিল লাবু। সমীর আর তার কাজের ঘর পাশাপাশি। নিজ ঘরে গিয়ে টেপগুলো ঘরের কোণে একটা বারোয়ারি তেপায়ার ওপর রেখে লাবু আবার বেরিয়ে এলো। মোড় ঘুরে এগিয়ে গেল সমীরের কাছে।
সমীর তখন একটা যন্ত্রের ব্যবহারবিধির পাতা খুব মনোযোগ দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিল। লাবু তার সামনে দাঁড়িয়ে কিভাবে কী জিজ্ঞেস করবে ভেবেই পাচ্ছিল না। সরাসরি জিজ্ঞেস করলে যদি আবার সমীর রাগ করে। উপকারি এই বন্ধুটিকে সেভাবে কিছু জিজ্ঞেস করার হৃদয় এখানে কারোরই নেই। আর যদি দেখা যায় শেষমেষ, এই কারখানারই কোনও কাজের জন্য সমীর ওই পকেট ট্রান্সফর্মার দুটো এনেছে, তখন লাবুর অবস্থানটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
সমীরের মতো বন্ধুকে তুই সন্দেহ করেছিস লাবু! মনের নোংরামোর সত্যিই কোনো সীমা নেই রে তোর!
লাবুর চোখে এমন একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছিল। আর ছিল লুকোতে না পারা সন্ত্রস্ততা। ওই দুটোর লব্ধি সমীরকে সাবধান করে দিয়ে থাকবে। কেননা তার মনটিও তো ওদিকে দুর্বল হয়ে রয়েছে। লাবুকে সে কোনও প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই সমীর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একবার থামতে লেগেছিল বেরিয়ে যাবার পথে। হয়ত মনে হচ্ছিল বোকামো হচ্ছে, দিব্যি বোকামো। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলালো পরমুহূর্তে। এমনভাবে গায়ের জোর দেখিয়ে ঘর ছাড়ল যেন এই করা ছাড়া তার সামনে আর উপায়ই ছিল না কোনো। এদিকে আরও বিপাকে পড়ে যাওয়া লাবুর মনেও ছলকে উঠল একটা পরিকল্পনা। বড় বোকামো মনে হলেও একইসঙ্গে এও মনে হলো, এটা ছাড়া আর কোনও পথই খোলা নেই। কারণ সমীর, তারেক সরু সুতোর ওপর হাঁটছে, নিচে আগুন। সবচেয়ে যা করুণ তা হলো বিষয়টি এই দুটি ভাইয়ের কারোরই জানা নেই। এ অবস্থায় একবার যদি কোনোভাবে ওদের বিরুদ্ধে যা বলা হয় তার কিয়দংশও, ভুলক্রমে হলেও, এক ধরনের ছদ্মসত্য তৈরি করতে পারে তো ওদের নিস্তার থাকবে না। সেইসঙ্গে নিস্তার থাকবে না সমীরের কাছে বন্ধু হিসেবেও তাদেরও। এ কারখানার ধর্মই এখন এই। বড় সন্ত্রস্ত এর প্রশাসন। ওই মহাঠগ ব্যবস্থাপনা পরিচালককে হঠানোর পর এ নিয়ে এখন আরো বেশি ভীত কর্তারা সবাই। কাজে নয়, কারো বিশ্বস্ততাও ন্যূনতম খুঁত পেলেই বরখাস্ত; কোনো মায়াদয়ার অবকাশ নেই। আর ক্ষতিপূরণের টাকা তোলার পথও এতো শত কাঁটা ফেলে দুর্গম করে তোলা যে বরখাস্ত হলে ছয় মাস থেকে এক বছরের আগে তা তুলতে পারার কথা ভাবাই যায় না।
লাবু দ্রুত হেঁটে গেল অপর সুহৃদদের কাছে। অনেকে তখন সেদিনের মতো নিজ নিজ কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। কেউ কেউ ইতোমধ্যেই শেষ করেছে কাজ, নির্দিষ্ট জায়গায় গুছিয়ে রাখছে ব্যবহারের যন্ত্রপাতি।
তখনই যত জনকে পারে জড়ো করে যা দেখেছে তা গোপন রাখার শর্তে আদ্যপান্ত বলে অবশেষে লাবু তার অভিমত জানালো।
সমীরের কাছাকাছি থাকতে হবে। আমি তো ওগুলো ওকে আর কোথাও রাখতে দেখিনি। হয় রেখেছে নয় নিত্যদিনের মতো এই ভরসায় আছে যে ওকে তেমন একটা হাতড়ে দেখা হবে না, আমাদেরকে যেমন হয়। এই ভরসায় ও যদি ওগুলো নিয়েই বোরোতে চেষ্টা করে, আর যদি ধরা পড়ে তো সব দায় আমি নেব। এই হলো আমার মত। বুঝলে? আমার মাথায় আর কিছুই খেলছে না এ মুহূর্তে। আর কিভাবে নেব তাও বুঝতে পারছি না। তোমাদের মনে কি কিছুই আসছে না! বোবা কালা হয়ে গেলে নাকি সব!’
হাত দুটো বুকের কাছে বেঁধে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব শুনছিল ফিরোজ। এতোক্ষণের আলাপে একটা কথাও সে বলেনি। এবার বলে উঠল, এতোক্ষণ এতো হিসেব করে শেষমেষ তুমি এই কাঁচা কথায় আসলে? ঘটনা আরো ঘোট পাকানো ছাড়া কিছুই হবে না এতে।তার কথায় চন্দ্রদ্বীপের টান। কথাগুলো শান্তভাবে বললেও কেমন রাগত শোনালো।
পশ্চিম কামরূপের ছেলে এই মেহেদী, পড়াশোনা ঢাকায়। কথার মিশ্র টান তাই অঞ্চলজ্ঞানের জায়গা থেকে শ্রোতাকে বিভ্রান্ত করে। বলল, তোর সদিচ্ছার কথা জানলাম লাবু। জানি এটার পেছনে যথেষ্ট কারণও তোর আছে। সেদিনের তেল নিয়ে ওই গ-গোলের কথাই ধর। বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারত, তাও আবার ক্লায়েন্টের সামনে। নেহাৎ তোরটা শরীরটা খারাপ ছিল আগের দিন থেকে, তা তো আমরা জানি, মানি। কারখানাও জানে, কিন্তু মানবে তো আর না। সমীর সেদিন জসিম স্যারকে তোর হয়ে না ধরলে খবরই ছিল, বল? তাও জসিম স্যার যে মানুষ, পল্লব স্যার, নতুন স্যার না থাকলে তোর ওপর দিয়ে কী যেত তা তো অনুমান করাই যায়। তখন সমীর কী বলল? বলল, সেই তোকে মনে করিয়ে দিতে ভুলে গেছে তেল বদলানোর কথা। কিন্তু সেটা কি সত্যি? আমরা জানি সে ঘটনা। সব মিলিয়ে বুঝলাম, তুই কেন এভাবে ভাবছিস। কিন্তু বন্ধ বলি কী, আবেগের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত নিস না। আমার মনে হয় অন্য কোনো উপায়ও বের হবেই।’
ওরা ক্রমশ ঘেমে নেয়ে উঠছিল। ঘন ঘন পা ঠুকছিল মেঝেতে। থেকে থেকে কেউ আলাপের চক্র থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওই এক মুহূর্তের জন্যেই। পরমহূর্তে আবার কোনো অদৃশ্য সুতোয় টান পড়তেই চক্রে গিয়ে জুড়ছিল। তুবড়ি ছোটাচ্ছিল মুখে, যদিও স্বরটা ছিল নিচু। ওইনিচু স্বরে দ্রুত কথা বলে যাওয়া আর সন্দিগ্ধ দৃষ্টির অবিরত আসা যাওয়ার এদিকওদিক,সব মিলিয়ে ওদের ভেতরের অস্বস্তিকর ভাবটা বাইরের কোনো পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি হয়ে উঠছিল প্রকট। তা ওরাও দিব্যি বুঝতে পারছিল। তবু নিরুপায়।আলাপের অনুষঙ্গটাএমনই বিচিত্র, উপলক্ষটা এতোটাই অনাকাক্সিক্ষত যে একদিকে বন্ধুর জন্যে মানুষের সহজাত পরিতাপের দুঃখমুখী পুলকটা ওদের যেমন ধরে রাখছিল, তেমনইক্রমশ তটস্থ করে তুলছিল অজানা অশাস্ত্রীয় ভীতি। এই ভীতি বন্ধুর দুর্ভাগ্যচিন্তায় কপালেভাঁজ তোলে, ব্যক্তিগত দুর্ভোগ-ভাবনাতেও ক্রমশ ন্যুব্জ করে।
বর্ধমানের ছেলে শংকর বলল, এখনও যেহেতু কিছুটা হলেও সময় বাকি আছে, যে কোনওভাবে হোক সমীরকে ধরে বলতে হবে, পকেট ট্রান্সফর্মার দুটো সরাতে তাকে অনেকেই দেখেছে, বুঝলে? সুতরাং অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকলে এখনই তা ত্যাগ করে ভাঁড়ারে বুঝিয়ে দাও। নয়ত কী করতে চাও আমাদের জানাও, আমরাও তাহলে সাহায্য করতে পারি। বলব, তোমার মতো বন্ধুকে সাহায্য করতে আমরা সবসময়ই প্রস্তুত। কিন্তু মুশকিল হলো, এ কথা বলামাত্র সমীর খুশি হয়ে আমাদের সব বলে দেবে তা আশা করা যায়া না। হয়ত তার প্রতিক্রিয়া হবে ভয়ানক খারাপ। আর যে এটা বলবে, যতো ভালোর জন্যেই বলুক, হয়ত চিরদিনের জন্য তার শত্রু হবে। এরপরও এটাই মন্দের ভালো। কী বলো তোমরা?’
লাবুদের মতো ঘনি না হলেও সমীরকে অপছন্দ করে না আমান। ওই মুহূর্তে শংকরের পক্ষ নিয়ে তার বলা কথাগুলোই বাকিদের বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো বলে গণ্য হলো।ওই কথার ওপর তরুণদের দলটা তাদের কর্তব্যকর্ম করল স্থির। যতোটুকুও যা দোদুল্যমানতা ছিল, যুক্তির কাঁচির ধারে গেল কেটে। সিদ্ধান্তটা পড়ল গিয়ে পেতে রাখা রেললাইনের ওপর চলতে থাকা পরিকল্পনার রেলগাড়ির একেবারে চালকের ড্যাশবোর্ডের ওপর। সুতরাং চালকদের মগজে কর্তব্য খেলে গেল।
আমানের কথাটা ছিল এই: সমীরকে যে দেখা গেছে ভাঁড়ার থেকে ট্রান্সফর্মার সরাতে, এ কথা আগে হোক পরে হোক চাপা থাকবে না। কারণ আমাদের এ কারখানার পরিসর বেশি নয়। শুধু লাবুই নয়, আরও কেউ না কেউ তাকে অবশ্যই দেখেছে। কারণ ভাঁড়ার ঘরে সারাক্ষণই অনেকের আনাগোনা। আর মকবুল যখন হিসাব মেলাতে বসবে তখন হলেও এটা বেরিয়ে আসবেই। সুতরাং ওই সময়ের কথা ভেবে দেখ, এটা যেহেতু ঠেকানো যাবে না, সেহেতু ঠেকানো যাবে না সমীরের অপ্রিয় হওয়াটাও। ঠেকানো যখন যাবে না, তখন তার উপকারে এসেই অপ্রিয় হওয়া যাক। এখনই ওকে থামানো হোক। লাবুর নিজ কাঁধে দায় নেওয়াটা কোনও সমাধান না। এটা ¯্রফে ছেলেমানুষী। আর সেই সঙ্গে আমাদের সবাইকে নতুন বিপদে ফেলার একটা উপায় হয়ে দাঁড়াবে ওটা পরে, তখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে এমনভাবে চলে যাবে নিজের বা আর কারও ভালো করার ক্ষমতা কিছুই থাকবে না। এখানে চাকরি করে আমরা পরিবার চালাই, বুড়ো বাবা মাকে দেখি, বাড়িতে টাকা পাঠাই। নতুন কোনও উপায় হাতে আসার আগে আমাদের চাকরি হারানো চলবে না। বন্ধুর অকল্যাণও হতে দেওয়া চলবে না আবার। এই হলো আমার মত।’
এটুকু জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অনুধাবনটুকু যে ধীরে ধীরে একটু সূক্ষ্ম সুতোর মতো টেনে বের করে আনলো এই তরুণ। আমানের কথা বলার ভঙ্গি বরাবররই এমন এবং এ নিয়ে ওর ভেতর সূক্ষ্ম এক ধরনের গৌরব টের পেয়েও অন্যদের অস্বস্তি খুব একটা হয় না।
ভেবে দেখ, যেটাই ঘটুক— আমরা আগেই ওকে জানাই, আর পরেই সব কথা বেরিয়ে আসুক— ওর অভিমানপরব আমরা এড়াতে পারব না। তাই পরে না হয়ে আগেই ওকে সাবধান করে দেওয়াটা হবে মন্দের ভালো।’
আমানের কথায় সবাই ওপরনিচ মাথা দোলালো। ঠিক এমন সময়ে সবার কান বিদীর্ণ করে বেজে উঠল কারখানার বাঁশি।
ভেতরে শব্দের স্রোত সারাক্ষণ চলমান আর চার দেয়ালে আটকে প্রতিধ্বনিরত। কিন্তু বাইরে তা নয়। কারখানার সামনে দিয়ে সেই কিশোর যখন সাইকেলে টুংটাং শব্দ তুলে চলে, ঝালাই বা লোহা কাটার শব্দের তীব্রতার পরিবর্তে একটা আধকোমল শব্দগোমর কেবল কানে আসে তার। কিন্তু বাঁশি যখন বাজে তখন ডাল বদল করে দূরে গিয়ে বসে পাখি। শেষ বিকালের নৈশঃব্দ ধরে হেঁটে যাওয়া পিতা পুত্রের, চা দোকানির, নিকটবর্তী মসজিদে উপাসকদের কানে এমনভাবে বাজে যে তাদের চমকে উঠতে হয়।
বাঁশি বাজা শেষ হলে তাদের শোনার ক্ষমতা এমনকি কিছুক্ষণের জন্যে ভেঙেও পড়ে। আবার জমাট হতে সময় নেয়। দূরের ওই রিকশাওয়ালার কানে এই শব্দ ঠেকে ভারি রহস্যময়। তখন কারাখানার প্রতি অন্যরকম আগ্রহে আর ভালো লাগায় তার শূন্য মন ভরে ওঠে। একেকসময় সে চমকে সেদিকে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এরপর রিকশার হাতলের দিকে নতমুখী হয়ে ধীরে দূরে চলে যায়।
আগের মতোই বাজল বাঁশি আর ভীষণ চমকে দিলো কথা বলা তরুণদের। লাবু শান্ত মুখে বাইরের দিকে পা বাড়াতেই সবার শেষে এসে যুক্ত হওয়া জিয়া তার একটা হাত ধরে ফেলল। লাবু হেসে বলল, হাত ছাড় পাগল। আমি আমানের কথা শুনেছি তো, আমার পছন্দ হয়েছে কথাগুলো। আমি নিজে কোনও ঝুঁকি নেব তখনই যখন মরব শুধু একা। সবাইকে বিপদে ফেলে মরব না এটা মনে রাখিস। ওকে থামিয়ে দুটো কথা তো বলতে হবে তো, ওটা আমিই করতে চাই। এটা করতে দিবি তো বন্ধু, নাকি!
লাবুর মতো বিশ্বস্ত ও আবেগী বন্ধুর কাছ থেকে নিশ্চয়তা পাওয়ার পর আর হাত ধরে রাখা চলে না। সুতরাং জিয়া তার শক্ত অমসৃণ হাতটা ছেড়ে দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকল। লাবু যন্ত্রপাতিতে বোঝাই মলিন দেয়াল ঘেরা ঘরটা ছাড়তে ছাড়তে ফিরে দাঁড়াল আরেকবার। অপর দিকের জানালা দিয়ে আসা বিকেলের সোনালী আলো তার মুখের নিচের অংশে পড়ল তৎক্ষণাৎ। দরজার বাইরে পড়ল লম্বা ভুতুড়ে ছায়া।
লাবু বিষণ্ন মুখে যা বলল তা যেন কোনও সিদ্ধান্ত নয়, বুঝি বরাবরের মতোই একটা অভিমত।
আমি তো কোথাও ওকে ওসব রাখতে দেখিনি। বোধয় তখন বাইরে গিয়ে সীমানা দেয়ালের ওপর দিয়ে বাইরে চালান করে দিয়েছে, পরে কুড়িয়ে নেবে।’
সেই মুহূর্তে ওই অভিমত অর্থহীন ঠেকল শ্রোতাদের কাছে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে মৃদু হাসল ওরা। আবার যখন সামনে তাকাল, তখন লাবুর ছায়া করিডোর থেকে অন্তর্হিত হয়েছে। পেছন পেছন বেরোল আমান এবং এরপর একে একে সবাই। বেরিয়েই ফটক পেরোনোর লম্বা সারিটা দেখতে পেল, ক্রমেই বড় হতে লেগেছে। দূর থেকেই সেখানে সমীরকে দেখা গেল। আগেই গিয়ে সারিতে দাঁড়ানোয় তার অবস্থান অনেকটাই সামনের দিকে। ফটকের কাছে চলে যাওয়া অল্প ক’জনের পেছনে রয়েছে মাত্র। কোনও দিকে তাকাচ্ছে না। হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সে চাইছে না কোনও সূত্র ধরে কারও দৃষ্টি তার ওপর এসে পড়–ক।
সমীরের ভুরুজোড়া কুঁচকে আছে। নিচের ঠোঁট কাঁপছে অল্প অল্প। হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে এমন এক কাজ সে করেছে যে কাজ কখনো করবে বলে দূরতম কল্পনায় কখনো আসেনি। তার সততা নিয়ে যতো আনন্দেই সে থাকুক না কেন, মানুষের অনবরত স্বীকৃতি পেতে পেতে এক ধরনের অহম তার অনভিজ্ঞ তরুণ মনে বাসা বেঁধেছিল। আজ তার অনুতপ্ত এবং বিব্রত ভ্রূভঙ্গিতে, আপাত তুচ্ছ কিছু পাওয়ার আশায় খুব বড় কিছু বিসর্জন দিয়ে ফেরার অভিমানে ক্ষণে ক্ষণে ফুলে উঠতে থাকা নাকের পাটায়, ক্ষণে ক্ষণে এক পা থেকে অপর পায়ে শরীরের ভর বদলের অস্থিরতায় স্পষ্ট হয়ে উঠল সেই অহম ভেঙে পড়ার চিহ্নটুকু।
হঠাৎ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল এই ভেবে,পকেট ট্রান্সফর্মার দুটো হুড়োতাড়ায় এমন এক জায়গায় রেখে এসেছে যেখানে অল্প একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যেতে পারে যে কেউ। আর অমন অস্থির সময়ে চারদিকে একবার চোখও বোলানো হয়নি। কোথাও থেকে কেউ নিশ্চয়ই তাকে লক্ষ করে থাকবে। ঘরে যখন ঢোকে তখন টিয়াও ওখানে ছিল।
ধূর্ত টিয়া।
ঈর্ষাপরায়ণ টিয়া।
গুপ্তচর টিয়া।
এবং নিজ কাজে কুশলী, দক্ষ, প্রতিভাধর টিয়া।
অবস্থা যখন এই, তখন শঙ্কার কারণ আছে এমনটা মনে না করাই হবে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। যদিও অন্য লক্ষণগুলোও ইতোমধ্যেই তার ভেতর প্রকাশিত। দুঃখ কী?
সমীরের চোখজোড়া টিয়াকে খুঁজতে গিয়ে লাবুকে দেখতে পেয়ে আবার দমে গেল।
কারখানার পেছনের ওই কড়ইতলায় আরশোলার সংসার ভাঙা ছেঁড়া মাদুরের ওপর বসে বিতাড়িত প্রকৌশলী অপুর এক সান্ধ্য ভাষণের কথাগুলো ছিল এমন— প্রকৃতি তরুণদের প্রতিশ্রুতি দেয় প্রচুর, কিন্তুসমাজ যখন প্রকৃতির দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তখন তরুণের মন স্বাভাবিকভাবেই দমে যায়।শ্বসন ব্যহত হয়।শ্বসনের চাই অব্যাহতি। সেই চাওয়া থেকেই জন্ম বিদ্রোহের।এই বিদ্রোহের যারা অজ্ঞ সেপাই, তাদের অস্ত্র বল।ওই অজ্ঞদের অহম খুব অল্পেই আঘাত পায়। তাদের নিয়ে বড় ভয়।
এসব কথা বৃদ্ধ দ্বাররক্ষীরও মনের কথা। তরুণদের ওই প্রথম পক্ষই দলে ভারি। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে লাঠি চালাবার ইচ্ছে তার আদর্শগতভাবেই ছিল না, আর শক্তি তো নয়ই। কিন্তু দায়িত্ব পালনের খাতিরে প্রতিানের নির্দিষ্ট করে দেওয়া উপায়ে ওই অবমাননাকর তল্লাশি প্রক্রিয়া তাকে চালাতেই হতো। এর জন্য যতো টিটকারি, ব্যক্তিগত আক্রমণ এসেছে, সবই সে গা সওয়া করে নিয়েছে। কারখানার ওই ধুরন্ধর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে তাড়ানোর দিনকয় আগে অরবরত উস্কানির মুখে শ্রমিকদের একটা দল ভাঁড়ার খালি করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিল। তখন প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে হলেও দ্বাররক্ষী হিসেবে তার কাজের আদর্শ সে বজায় রেখেছিল। এখনো ওসব স্মৃতি দিব্যি তাজা। নেহাৎ বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় বহুদিন আগেই সে উৎরে গিয়েছিল কারখানার অন্য পরিচালকদের চোখে।তাই ওই মুখোশধারী এমডি শেষমেষ তার বিরুদ্ধেই চুরিতে সহায়তার সাহায্য করার অভিযোগ এনেও আর হালে পায়নি জল।
এবং শেষতক জয় হয়েছে দ্বাররক্ষীর সততারই।
এসবে উৎসাহিত দ্বাররক্ষী তরুণদের গোমড়া মুখে মনে মনে খানিকটা বিব্রত হলেও বয়েসটা বুঝে, মানসিকতাটা বুঝে, দমটা বুঝে তল্লাশিটা চালাতে ভুল করে না। এখনো তার অকুঞ্চিত ভুরুজোড়ায়, শান্ত চোখে, শক্ত হয়ে থাকা চোয়ালে আর সাবলীলভাবে সঞ্চালিত হাতে তার প্রকাশ স্পষ্ট দেখা গেল। সবাই দেখতে পেল সমীর ফটকরক্ষীর হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। তার মুখের ভাব বোঝার উপায় নেই।
রক্ষী বরাবরের মতোই শরীরের দু’দিকে কোমরের নিচ থেকে গোড়ালি অব্দি একবার হাত দুটো বুলিয়ে গেল, পেলই না কিছুই। বেরিয়ে যাওয়ার ইশারা পেয়ে মাথা নিচু করে ফটকের কাঠামোটা পেরিয়ে গেল সমীর। দেখে হাঁফ ছাড়লো লাবু, তাকাল অন্যদের দিকে। কেউ তার দিকে তাকিয়ে হাসল, কেউ আবার গম্ভীর হয়ে রইল যেন এখনো কিছু ঘটার বাকি রয়েছে।
তাদের ছোট দলটার পেছন থেকে আরও একজন মানুষকে ফটকের দিকে চোখ রাখতে দেখা গেল। তার চোখের উদ্দেশ্যপূর্ণ দৃষ্টি বোঝাতে বাকি রাখল না, সমীরের পরবর্তী ভাগ্য আর কারখানার ঘটনাক্রম নির্ভর করছে তারই ওপর। অন্তত সে তেমনটাই মনে করছে।
সমীর বেরিয়ে যাওয়ার পর লাবু যখন পেছন ফিরে বন্ধুদের দিকে তাকিয়েছিল, তখনই তার চোখ পড়েছিল টিয়ার ওপর। পেছনে একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে যেন খুব আয়েশে দাঁড়িয়ে। তারচোখে মুখে চাতুর্য একটা পরিক্রমণশীল আলোর মতো খেলে বেড়াচ্ছিল।
সমীর বেরিয়ে গেছে— এটা নিশ্চিত হতেই, লাবু দেখতে পেল, এলিয়ে পড়া শরীরটাকে সোজা করে দাঁড়ালো টিয়া। বুকের কাছে ভাঁজ করে রাখা হাত জোড়াও পকেটে ঢোকাল। এরপর সোজা তার নিজ ঘরের দিকে হেঁটে গেল গটগটিয়ে।
চোখে মুখে একটা সপ্রতিভভাব জোর করে ধরে থাকলেও, বিশ্বাসীর স্বর্গভাঙা দৃশ্যটা আজ তাকে দেখতে হয়েছে— এই এক ভাবনা শুরু থেকে তখন অব্দি তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ওদিকে সমীরকে থামানোর আগেই এভাবে বেরিয়ে যাওয়ায় সব পরিকল্পনা গেছে ভেস্তে। সুতরাংবাইরে গিয়ে তাকে পাকড়াও করা গেলেওকালকের আগে ফেরকারখানায় ঢোকার কোনো উপায়ই আর থাকছে না।
নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে বেরোনোর সারির শেষপ্রান্তে গিয়ে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল লাবু। সে সহ ওই সারির আরও অনেক তরুণের মাথাভরা কালো চুলের ওপর লোহার গুঁড়ো স্তর পড়ে লাল হয়ে ছিল। বিকালের সূর্যের আলো তেরছাভাবে পড়ছিল লালের সেই স্তরের ওপর। টিয়া কেন তার কাজের ঘরে ফিরছে— প্রশ্ন এলেও তার পিছু নেওয়ার কথা বাইরে পা রাখার আগে লাবুর মনেই এলো না।
টিয়া ওই কারখানার সেরা পরিশ্রমী তরুণদের একজন। উন্নতির শক্তিকে মন্দীভূত করতে প্রাকৃতিক নিয়ম মেনেই অবনতির অপশক্তি সচল থাকে। ওই বিপরীত শক্তির পূজার প্রভাবে টিয়ার অপর পরিচয়গুলো দাঁড়িয়েছে দলবাজ, স্বার্থপর, পরশ্রীকাতর, মারকুটে প্রভৃতি বিশেষণের ওপর। কারখানার অপর তরুণদের একটা বড় অংশ তো বটেই, তরুণদের সাতে পাঁচে না-থাকা প্রৌঢ়দের একটি অংশও এ বিষয়ে একমত দিব্যি। নতুন কারও কাছে টিয়া সম্পর্কে বলতে গেলে আগে ওরা এসবই বলে থাকে। পরে বলে তার কর্মদক্ষতা, একাগ্রতার কথা; কর্মকৌশল, প্রতিভার কথা।
সবসময় নিজ দল গড়তে উন্মুখ টিয়া যখন সমীরকে অমন ত্যাগী রূপে পেত, আর সবার মুখে তার গুণগান শুনে নিত্য অতি হয়ে উঠত, তখন একটা কোনো সুযোগের জন্য তার অপেক্ষা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠত। তার সেই অপেক্ষারআভাস লাবু আগেও পেয়েছে। আজ দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিজ হাতে চুল ছেঁড়ার দশা হলো তার।
বাইরে জামালের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো লাবু। বাকি বন্ধুরা সবাই মাথা নিচু করে ফটকের পকেটদরজা গলে বেরিয়ে আসছিল একের পর এক।
মাথার ওপর পাখির কিচির মিচির সন্ধ্যাকে ডাকছে। মাটির রাস্তা থেকে ঢাল বেয়ে পুব দিকে নামলেই সেই টুকরো পতিত জমি, খেলার জায়গা। উত্তরপূর্ব কোণে একটা গর্ত বড় সড়। ভেজা কালো মাটি ভেদ করে বেশ ক’গাছি চিনা ঘাসের মাথা জেগে উঠেছে। তারই কাছে শুয়ে বসে একে অপরকে শুঁকছে দুটো কুকুর।
জামালের বছর দশের ছেলেটা মাটির ঢেলা কুড়িয়ে মারল ছুড়ে কুকুর দুটোর দিকে। ঢেলাটা মুঠো থেকে বেরোতেই ছররা গুলির মতো কয়েক টুকরোয় বিচ্ছিন্ন হয়ে সামনে ছুটে গেল।
কুকুরগুলোর ক্রিয়াকাণ্ডে কোনো পরিবর্তন এলো না দেখে আরো একটা ঢেলা কুড়োতে ঝুঁকলো ছেলেটা। উঠে দাঁড়িয়ে হাফপ্যান্টটা পেছন থেকে টেনে কোমরের ওপর তুলল অন্য হাতে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিঃশব্দে দোকানের এক কোণে লাবুর কাছে এসে দাঁড়াল আমান।
কিছুই তো হলো না। টিয়ার হাবভাব দেখলে?
দেখেছি সব।
বোধয় একটা কিছু হতে চলল সমীরের। খারাপ কিছু।
সিগারেটের অবশিষ্টাংশ মাটিতে ফেলে মাড়িয়ে মুখ তুলে তাকাল লাবু। ঠোঁটচাপা কৃত্রিম হাসিতে কাঁদছে তার চোখ। বলল, ব্যাপারটা কতো ছোট, না? কিন্তু অল্পের ওপর দিয়ে যাবে না মোটেও। লিখে দিতে পারি। সময় ভালো না!
চলবে…