॥পর্ব-২৫॥
শুনেছ, রাতের বেলায় তাপীয় ভারসাম্য বজায় রাখার কথা মাটিকে মনে করিয়ে দিলো হাওয়া? মাটি মুঠোয় ধরে রেখেছিল দিনের বেলার আঁচ; ছাড়ল, আবার খানিকটা ধরেও রাখতে চাইলো। কিন্তু ছাড়া পাওয়া আঁচের তো আর মাটির পরে কোনো মায়া জন্মেনি। সে সূর্যের সন্তান, সেদিনের পিতৃবিয়োগের স্মৃতি তখনো তার ভেতরটা পোড়াচ্ছে। শূন্যের ডাকে সে সাড়া দিয়ে উড়ে গেল।
ওরা সদর রাস্তার এক পাশ ধরে হেঁটে চলেছিল। সড়কদ্বীপে নিয়মিত বিরতিতে দাঁড়িয়ে থাকা আলোকদণ্ড তখন নিয়ন আলোর ছদ্মনামে রহস্য ছড়াচ্ছে। রাত ঘন হয়ে এসেছে বলে পথের দু পাশের ঘরবাড়ি দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ তখন। গলির অন্ধকার ছেড়ে বাইরে এসে দেখা দিলো একটা সাদা বেড়াল, মুখে ধূসর ইঁদুর, নিথর। ইঁদুরের পেলব এক জোড়া পা বেড়ালের মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে শরীরের নিম্নাংশের সঙ্গে দুলছে। দৃশ্যটা দেখল কেবল সলিল। মেহেদি আর পল্লবের চোখ তখন দেখছে কেবল পথের কাঁকর আর শূন্যগর্ভ পলিব্যাগের এপারওপার আসা যাওয়া। পথের হলুদ আলোর রহস্যে ডুবে থেকে দুজন মনে মনে কথা বলছিল। চোখজোড়া বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল ওদের। দৃঢ় চোয়ালে গত কদিনের জাড্যতা তখনো চেপে বসে আছে। মেহেদির কোমরে আক্ষেপ, থেকেই থেকেই সে পিছিয়ে পড়ছিল।
চৌরাস্তার মোড়ে এসে ওরা থামল। এখান থেকে কেওয়ার দিকে ছোট ছোট টেম্পো ছেড়ে যায়। পরপর দাঁড়িয়ে থাকা যন্ত্রযানগুলোর প্রথমটির দিকে ওরা নির্বাক এগিয়ে গেল। এতো রাতে তিন সম্ভাব্য যাত্রীকে দেখে দ্বিগুণ সরব হয়ে উঠল সাঁঝঘুমে ডুমো চোখের ছোট্ট বালক; টেম্পোর চালক সহকারী। তার কোমল মুখ থেকে ভারি কণ্ঠে বেরোতে থাকল গন্তব্যের ডাক, তাগাদা, আশ্বাস, এসব। চালকের আসনে বসা কঠোর মুখের কিশোর গাড়ির পেছনদেখা কাচে চোখ রেখে দেখতে পেল বিম্ব সবার। একটা হাতাগোটানো বাহু গাড়ির কাচবিহীন কপাটের ওপর এলিয়ে রাখা। আধভাঙা কপাট পাটের দড়ি দিয়ে কৌশলে বেঁধে রাখা ভেতরের এক আঙটার সঙ্গে। সড়কবাতির আলোয় পথের ওপর গাড়ির কাঠামোগুলোর কালো জ্যামিতির নকশা থেকে থেকে স্থানবদল করছে। ওরা তিনজন উঠে বসল বেঞ্চের মতো পাতা আসনে, একদম শেষাংশে গিয়ে থিতু হলো। ওদের দেখে ভরসা পেয়ে উঠে এলো এদিক ওদিক হাঁটতে থাকা আরো কিছু মানুষ; রোগা কর্মক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত। সলিল আর মেহেদি পাশাপাশি। মুখোমুখি হয়ে অপর পাশের বেঞ্চে আসন নিয়েছে পল্লব। মেহেদির মুখের পাশে আলো আর উত্তাপ ছড়াচ্ছে একরত্তি হলুদ বাতি। সলিল নীরবে নিচের দিকে তাকিয়ে। দু পায়ের ফাঁকে চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে আছে আধখাওয়া সিগারেটের টুকরো। বিতৃষ্ণ চোখজোড়া সরিয়ে নিলো সলিল, তাকাল পল্লবের চোখে। পল্লব কিছু না বলে হাসল। ওদিকে সলিলের ওপর নিবদ্ধ মেহেদির চোখ। ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চেপে এবার ওই চোখজোড়ার দিকে তাকাল সলিল। মেহেদির উরুর ওপর হাত রেখে নীরবতা ভাঙল থানা থেকে বেরোনোর পর প্রথমবারের মতো।
শুধু তো আমাকেই বের করে আনলে। আর সবাই তো থেকে গেল ভাই!
কণ্ঠে জমা শ্লেষ্মা এতোটাক্ষণের নির্বাকের বাগজড়তাকে তখনো বজায় রাখতে চাইলো। ভগ্ন স্বর বাক্য দুটির ভেতরের হাহাকারটিকে বাড়িয়ে তুলেছে। মেহেদি একবার পল্লবের চোখের দিকে তাকিয়ে কী এক ভাব যেন বিনিময় করল পরস্পরে। এরপর মুখে হাসি ফুটিয়ে ভরসা দেওয়া কণ্ঠে বলল, ও নিয়ে চিন্তা করো না সলিল। জহির স্যারের কথা বলেছিল হাসনাত, মনে আছে? তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি আমরা। তিনি বলেছেন, সব ব্যবস্থা করবেন। নিরাপত্তারক্ষীরা ছাড়া আর অন্যরা ছাড়া পাবে। তারেক, হাসনাত সবাই। তবে হয়ত একসঙ্গে নয়। ধীরে ধীরে।
সমীরের কোনো খোঁজ নিয়েছ?
ওর কাছে লাবুকে পাঠিয়েছি, বলল পল্লব। বলে দিয়েছি যে ক’দিন তারেক না ফেরে, ওর কাছছাড়া যেন না হয়। ছেলেটা খুব অসুস্থ খবর পেয়েছি। তবে ঠিক সামলে নেবে। শক্ত ছেলে সমীর।
বাকি পথ কেউ কারো সঙ্গ কথা না বলে কেবল এপাশ ওপাশ দুলে কাটিয়ে দিলো। কেওয়ার বাস স্টেশনের কাছে এসে টেম্পো যখন থামল, রাত আরো ঘন হয়েছে। মহাসড়কের আলোকদণ্ডগুলো এখানে আরো দলছুট, তন্দ্রাচ্ছন্ন। বাতাসে ম ম করছে ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ। মেহেদি বলল, শীত এগিয়ে আসছে। ঘ্রাণ পাচ্ছ সলিল?
জবাবে হেসে মাথা ওপর-নিচ দোলালো ধস্ত তরুণ। রাত গভীর। একটা দুটো রিকশাকে কেবল সযাত্রী লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছুটে যেতে দেখা গেল, কোনো খালি বাহনের দেখা নেই। বনবান্ধব মাটির ওপর পায়ে হেঁটেই এগোতে থাকল ওরা তিনজন। থেকে থেকে পেরিয়ে যাওয়া গাড়ির আলোয় ওদের ছায়াগুলো ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ হয়ে আধবৃত্তাকার পথ ঘুরে দীর্ঘ থেকে ফের ক্ষুদ্র হয়ে মিলিয়ে গেল। দেখা গেল দু পাশে মাথা উঁচিয়ে রাখা সব আকাশমণির সারি, ডাল দুলিয়ে সায় জানানো স্ফীত কড়ই, সজনে, নিঃসঙ্গ তাল নারকেল, সবান্ধব বয়েসী মেহগণি, ভূত আটকে পড়া এলোকেশীর ঝাড় আর থেকে থেকে ঝাঁপি ফেলা দোকানপাট, ফাটল ধরা মাটির বাড়িঘর। মেহেদির জন্যে থেমে থেমে এগোতে হচ্ছিল। একসময় শক্তিমতির রাস্তায় উঠে এলো ওরা।
আজ আর ওই গেরস্তবাড়ি গিয়ে কাজ নেই সলিল। পল্লব শুনছ? রাতটা আমার সঙ্গে কাটাও তোমরা। বিছানায় হবে দুজন। আর আমি মেঝেতে শোবো।
মেহেদির কথার প্রতিবাদ করে উঠল পল্লব। না না! পিঠের অবস্থা বেজায় ভালো তোমার। এই অবস্থায় মেঝেতে কষ্ট করার পরিকল্পনা থাকলে কবর দাও।
বুঝতে পারছ না। একসঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে। আর গল্পে কাটিয়ে দেবো রাত, শোওয়া আর কতক্ষণই বা। আর মেঝেতে না হয় তুমিই শুলে, ঠিকাছে? বন্ধুর জন্যে করলে না হয় এটুকু! চাপা হাসল মেহেদি।
কে বন্ধু, কাউকে চিনি না আমি। পল্লবের কণ্ঠে আমোদ।
কাল কারখানা চলবে? সলিলের প্রশ্ন।
মাথা খারাপ তোমার! মেহেদির কণ্ঠে বিস্ময়। চালাতে চাইলেও তো দেবো না, বলল পল্লব। সৌরভের কথা বলা যায় না। ও নিজের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে রাখতে চাইছে। কালও জোর খাটাতে পারে। আমরা একরকম বলেছি, সবাই না আসা পর্যন্ত আমাদের হাতে কিছু উঠবে না। বেচারার সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
এ প্রসঙ্গ আসার পর বহুক্ষণ কারো মুখে কোনো জোগাল না। দেখতে দেখতে পথ ফুরাল। কারখানার অপরপাশের মাঠটা বানবাতির আলোয় খানিকটা আলোকিত। নীল ফটকের সামনে কারখানার ছায়ার সামনে যখন এসে দাঁড়াল তিন তরুণ, সলিল বলে উঠল, আমি কাজ ছাড়ব। তোমরা?
তার প্রশ্নটা কারখানার ফটকে আছড়ে ফিরে এলো। ফটকের ওপারে নড়ে উঠল কেউ। টুল সরানোর শব্দ এলো কানে। মেহেদি, পল্লব দুজনেই থাকল নিরুত্তর। খানিক বাদে পল্লব বলল, কয়েক জায়গায় আবেদন করেছি। ডাক পেলে চলে যাব, এই তো। মেহেদিও তাই।
আমার তো শুধু পিছুটান। মেহেদির কণ্ঠ শান্ত। কিছু বোঝাপড়া বাকি এখানে অনেকের সাথে। ওসব আগে চুকে যাক। এরপর চট্টগ্রাম ফিরে যাব, সেখান থেকে দরিয়ারকূল। কিছুদিন হয়ত ছুটি কাটাব, বা কে জানে। বিশ্রাম নেবো একবারে, মাঝে মাঝে এটাও ভাবি। তো যাক। কিছু বলার নেই আর। শেষবাক্যে হাসল মেহেদি, তবে তার ভেতর কোনো উচ্ছ্বাস ছিল না।
ফটকে দমাদম কিল বসিয়ে রবির নাম ধরে বারকয়েক ডাকল পল্লব। রবি ঢালাই দেওয়া পথে পায়চারির ওপর ছিল। ফটকের সামনে কথার ওঠানামা শুনেই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। কাছে থাকতে সাহস হয় নি। খানিক দূরে টিনসেডের ছাউনি নিচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল ফটকের দিকেই। অস্বাভাবিক একটা কিছু ঘটার অপেক্ষা। এমন সময় নিজ নাম শুনতে পেয়ে এগোতে গিয়েই আবার থেমে গেল। তার নাম জানে না কে! শেষটায় পল্লবের গলা চিনতে পেরে পাল্টা সাড়া দিলো সেও। এরপর সশব্দে পকেটদরজা খুলে দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াল। সলিল ঢুকে ওর গালে হাত দিয়ে আদর করল একবার। ছেলেটা এরপর ছুটে গেল রসুইঘরের দিকে। বানবাতির আলোয় তার সঙ্গে দৌড়োল আরো চারটি ছায়া। অতিথিঘরে গিয়ে ঢুকল তিনজনই। বিছানার ওপর তখনো বালিশ আর কাঁথা দিয়ে তৈরি মানুষের আকারটা শুয়ে। সেদিকে আঙুল তুলে সলিল বলল, তোমাদের বিশ্বাস হয় এটা হাসনাতের করা?
কখনই না। পল্লবের জোরালো উত্তর। মেহেদির মুখ দেখে মনে হলো পল্লবের উত্তরেই তার মনের কথা বলে দেওয়া হয়েছে। বলল, এটাই কাল হয়েছে বেচারার। অতিথিঘরের দরজাটা সবসময় খোলাই থাকে। ওকে জসিম ভাইয়ের ঘরে নেওয়ার পর কেউ এটা করে গেছে নিশ্চিত। অসুবিধা নেই, সৌরভ যেভাবেই বোঝাক, ওর নিজের অবস্থানই আসলে নড়বড়ে এবং নিজেও জানে তা।
খাবারের পাত্রগুলো আগেই ঢেকে সাজিয়ে রাখা। নতমুখে টেবিলের ওপর জলভরা জগ এসে রাখল রবি। এরপর মুখ তুলে পল্লবের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাতটাই শুধু চুলায়। কখন আসেন, তাই ভাবলাম; যা বোঝাতে চায়, পেরেছে জ্ঞান করে সে থেমে গেল। মেহেদি ততক্ষণে জলডালার ওপর ঝুঁকে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে চলেছে। জলের রুপালি ধারা রাজহাঁসের গ্রীবার মতো বাকা নল থেকে ঝরেই চলেছে অবিরল। মুখ ঘুরিয়ে বলল, ঠিকই আছে। ভাতটা গরম দরকার ছিল, শাবাশ রবি! তোর তুলনা নাই।
তার কণ্ঠের আমোদ ছড়িয়ে পড়ল অন্য দুজনের মধ্যেও। পরিবেশ খানিকটা হালকা হয়ে উঠল তাতে। টেলিভিশনের দূরনিয়ন্ত্রকটা কাপড় রাখার খাটো আলমারির ওপর থেকে হাতে তুলে নিয়ে ফের রেখে দিলো পল্লব। চেয়ার টেনে বসে জল ঢেলে খেল। সলিল কাঁথা বালিশের সজ্জাটা নষ্ট করবে বলে এগিয়ে আবার থেমে গেল। বিছানার পায়ের কাছটায় বসে পড়ে নীরবে পায়ার গোলাকার মাথায় রাখলো হাত, নকশায় বোলালো আঙুল। মেহেদির পর পল্লব এবং এরপর তার পালা এলে, ধীর পায়ে সেও তোয়ালে হাতে এগিয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে এলো। টেবিলে টুংটাং তুলে খেয়ে নিলো সবাই, কোনো বাক্যবিনিময়। খাওয়ার পর খাটের ওপর কাঠামোয় ঝুলন্ত তোয়ালের গায়ে হাত মুছল মেহেদি। ভেজা কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে বলল, বালিশ কটা নিয়ে নাও, লাগবে।
একবার ধরতে নিয়েছিলাম; বলে উঠল সলিল। পরে ভাবলাম; বাক্য অসমাপ্ত। ভাব উদ্ধারে অসুবিধা হলো না মেহেদির। সকালে পুলিশ এসেছিল না? তোমাদের যখন জেরা করছে, একটা দল এসে এখান থেকে ছাপ ছাপ্পড় ছবি সব তুলে টুকে নিয়ে গেছে। তাই তো দেখলাম। অসুবিধা নেই, নিয়ে নাও। আচ্ছা, দাঁড়াও! থাক থাক, এভাবেই থাক। ঘরে আলাদা কাঁথা আছে বেশ ক’টা, তাই দিয়ে নাহয় বালিশ বানানো যাবে। রবি! এই বিছানা কিন্তু ধরিস না! নাকি ধরে ফেলেছিস এরই মধ্যে! খবরদার ভাই, ধরিস না যেন। আমাদের হাতে অন্তত কিছু যেন নষ্ট না হয়। বলা যায় না। এভাবে আছে যখন থাক, কী বলো তোমরা? চল।
সিগারেট আছে? পল্লবের প্রশ্ন।
দুটো বোধয় আছে, দেখতে হবে।
তো দুটোয় চলবে কী করে? সারারাত না গল্প করার লোভ দেখালে।
আরে বন্ধু, কী করব, তোমরাও তো কেউ মনে করলে না। নয়ত কিনে নিতাম!
দোকানপাট কিছু খোলা ছিল না তো। সলিল হেসে বলল।
কে বলে খোলা ছিল না! পল্লবের প্রতিবাদ। সিগারেটের দোকান একবার খোলা না থাকে! সেই যে আমরা চৌরাস্তায় তখন দাঁড়ালাম, খোলা ছিল একটা, দেখেছি। আমরা টেম্পোতে উঠছি যে তার বাঁ পাশেই, একটা গলির মাথায়।
তো নিলে না কেন? দোষ তো তাহলে তোমার। দেখলে কিন্তু নিলে না। জানো না পরে নাও পাওয়া যেতে পারে? নিজের জন্য তো কেনার কথা মনে আসা উচিৎ ছিল তোমার চাঁদ! তখন আমার ঠিক মনে পড়ত থাকার কথা তোমাদের বলতে।
আরে নিজের দোষটা দেখছি বলেই তো ক্ষেপছি, পাগল না কি তোমরা, এটা বুঝতে পারছ না! হাসতে হাসতে বলল পল্লব। সলিল আর মেহেদিও যোগ দিলো হাসিতে। রসিকতার ছড়াতে থাকা ডালপালা ধরে ধরে ওরা আরো এগোল কিছুদূর। অনতিদূরে বনের হাতছানি। মেহেদির ঘরে বাকি রাত নিজেদের অতীতের কথা হাত পা নেড়ে বলতে বলতে দুই দফায় দুই সিগারেট ভাগ করে খেল ওরা। ভোরের দিকে শুয়ে পড়ল।
পরদিন কারখানার বাঁশি আর বাজল না। বেলা করে উঠল ওরা তিনজন। জানালার বাইরে তাকিয়ে পাতাবাহারের দোল খাওয়া ডালের ভেতর দিয়ে পল্লব দেখতে পেল পিএফআই ঘরের বন্ধ দরজার সামনে ঝাড়– হাতে আগপিছ করছে ফজল। এরপর দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে তাকাল সৌরভের ঘরের দিকে। পর্দা নড়ছে না। অপরদিকে দপ্তরের জানালাটা খোলা, পাখার বাতাসে পর্দা দুলছে। দিনপঞ্জিটাও দুলে দুলে এদিক ওদিক করছে, তার সাদা পৃষ্ঠ দেখা গেল। খানিক বাদে কাঁধে তোয়ালে নিয়ে পেছনে এলো মেহেদি। পল্লব তাকে যাওয়ার জায়গা করে দিলো।
স্নানে চললে?
একদম!
মেহেদি ধীরে ধীরে হেঁটে অতিথিঘরের জলডালারর ওপর রাখা কলমদানির ভেতর থেকে তার মাজন তুলে নিয়ে চলে গেল ভেতরে। ফের শব্দ পেয়ে পল্লব পেছনে তাকিয়ে দেখল, মেঝেতে পাতা বিছানায় উঠে বসেছে সলিল। পল্লব যে বালিশে শুয়েছিল, পাশ থেকে সেটা হাতে তুলে নিয়ে কোলের ওপর রেখে চোখ বুজল আবার। পুব দিকের জানালা দিয়ে আসা রোদ পেছনে তার বালিশের ওপর পড়েছে। হঠাৎ শরীরে বিদ্যুৎ খেলিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালে সাঁটা কীলকের দিকে হাত বাড়াল সলিল। গতকালের শার্টটা তুলে পরে নিয়ে প্রভাতী সম্ভাষণ জানাল পল্লবকে। বেরিয়ে গেল এরপর। পাতাবাহারের জোড়াটা না পেরোতেই পেছন থেকে ডেকে উঠল পল্লব, দাঁড়াও, আমি আর থেকে কী করব!
গৃহস্থবাড়ি ফিরে স্নানপর্ব সেরে পোশাক পরে টেবিলে ঝুঁকে বসল সলিল। দেরাজে ল্যাপটপ কম্পিউটারের নিচে চাপা পড়ে থাকা একতাড়া সাদা কাগজ থেকে দুটি বের করে, যত্নে ভাঁজ করে সমীনা বানিয়ে দু’বার কলম ঝেড়ে, একটিতে অব্যাহতি পত্র লিখতে বসল। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ক’বাক্য লিখে দেখে নিলো একবার নিয়ম কানুন আছে কিনা ঠিকঠাক। অল্পস্বল্প কাঁচি চলল লেখায়। এবার নতুন আরেকটি কাগজে টুকে নিয়ে উঠে পল্লবের ঘরের চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়াল। পল্লব তখন দেয়ালে ঝোলানো ঢেউ তোলা আয়নায় তাকিয়ে ভেজা চুলে আঁচড় কাটছে। সলিলের বাড়িয়ে দেওয়া কাগজটা হাতে নিয়ে একবার ওপরনিচ দেখে নিলো। এগিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলল কেবল, আজই? খানিক বাদে দুজনেই দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে গেল।
সলিলকে ঘরে ঢুকতে দেখে আরামকেদারায় এলিয়ে দেওয়া শরীরটা দোল থামাল। এগিয়ে এসে কাচঢাকা টেবিলের ওপর অব্যাহতিপত্রটা রাখল সলিল। সৌরভ তখন কেদারার আরামদায়ক হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে বসে ঝুঁকে দেখল একবার কাগজটা। হাতে তুলে নিলো না।
অব্যাহতিপত্র এটা। আমি আর কাজ করছি না এখানে, স্যার।
সৌরভ কিছু বলল না। শরীরটা ফের এলিয়ে দিয়ে দোল খেল একবার। হয়ত বেমানান ঠেকল নিজের কাছেই। চোখজোড়া আড়াল করতে দৃষ্টি চালিয়ে দিলো দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে বাইরে। মেহগনির সারিটা গাঢ় সবুজ পাতায় সেদিকে দৃষ্টির আড়াল তৈরি করে রেখেছে। সলিল স্বপ্রণোদিত হয়ে বলে গেল, দাপ্তরিক নিয়ম মেনেই আবেদন করছি স্যার, হয়ত দেখেছেন। এই ভাঙা মাসে নয়। বরং পরের মাস থেকে। পরের মাসে অব্যাহতি কার্যকরের অনুরোধ করছি।
সৌরভ নিরুত্তর। সলিল বেরেবো বলে এগোতে গিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়াল। যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেছে, এমনভাবে বলতে চাইলেও তার পূর্বপ্রস্তুতিটা সৌরভের কাছে চাপা থাকল না কণ্ঠের অপরিণত ওঠানামায়।
ভালো কথা স্যার, আলমগীর কেমন আছেন এখন? তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে তো শেষতক? বেচারা। অবাধ্যতার মূল্যটা একটু বেশিই দিতে হলো তাঁকে।
প্রিয় শুভ্রা,
তোমার সঙ্গে দেখা নেই অনেকদিন। গত মাসেই দেখা না হয় হলো, কিন্তু তাতে কী। তোমার কি আর জানা নেই, না দেখার একেকটা দিন আমার কাছে একেক বছরের মতো? নিশ্চয়ই আছে। কারণ নিজেকে প্রশ্ন করেও তুমি একই উত্তর পাও। সামনে আসছে উত্তরা হাওয়ার দিন। প্রকৃতিতে তার লক্ষণ চলে আসতে শুরু করেছে। সেদিন রাতে মেহেদি ভাই বলছিলেন, বাতাসে ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ চলে এসেছে। ঘ্রাণ আমিও পেয়েছিলাম, কিন্তু কাউকে তা বলার মতো মানসিক অবস্থা আমার ছিল না বলে চুপ করে ছিলাম। এরই মাঝে অনেক কিছু ঘটেছে। এই বৈদ্যুতিক চিঠিতে তোমাকে সব খুলে বলতে ইচ্ছে করছে না। আশা করি মুখোমুখি হবো যেদিন, চোখে চোখ রেখে অনেক কথা বলবো। না বলে পালাব কোথায়?
এ কারখানা জীবন আমাকে জীবনের একাধিক নতুন দিক সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে, কিছু অভিনবত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে, আমাকে বদলেও দিয়েছে সত্যি; তবে এ বদল ঠিক নৈতিক, আদর্শিক নয়। জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়ায় প্রাসঙ্গিক। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর টানা বছর দেড়েকের মতো যখন বেকার বসে, তখন কত আকাশপাতাল ভাবতাম। আজ সেসব দিনের কথা মনে এলে বেশ লাগে। মনে আছে, ভাবতাম, একটা কোনো কাজ যদি পাই, নিজেকে প্রমাণ করে দেবো। বুঝবে জগৎ, কে এসেছে! মাঝে একটি বছর পেরোল কেবল। এখন আমি মুক্তি চাই। আগে ভাবতাম, যেখানেই যাব, বিপ্লব ঘটিয়ে দেবো। তা ঘটানোর যথেষ্ট রসদ আমার ভেতরে ছিল বলে ভেবেছিলাম। আমার আগের চিঠিতে তো পড়েছই। জানো, ওই ধারণা আমার মনের ভেতর গোর পেয়েছে। আরো বড় ব্যক্তিগত আঘাত আমার জন্য এখানে অপেক্ষা করে ছিল। এক দিক থেকে ভাবলে তা বড় বটে। গতায়ু বিশ্বের পটে দাঁড়িয়ে ভাবলে এ আঘাত কিছুই নয়। কিন্তু মন তো এখনো ব্যক্তির ঘরে বাস করছে। বিশ্বের উঠানে তাকে মুক্ত করতে পারিনি। মনের ছোট ঘরে অনুরণনটা তাই বেশি। আঘাত পেয়েছি যখন মিলিয়ে দেখেছি, পশ্চিম কি দূরপ্রাচ্য যখন বিশ্ব চালাতে নেমেছে, আমরা তখন পেট চালাতেও অযোগ্য। ঠিক এমনই আমাদের শ্রমের ধরন, পড়াশোনার পরিধি, ক্ষুদ্র মানসিকতা। কারখানায় এসে এই আমার অনুধাবন। তবু এটা অস্বীকার করা অন্যায় হবে, সহকর্মী ও কারখানা শ্রমিকদের ভেতর কিছু মানুষের দেখা এখানে আমি পেয়েছি যারা বিশ্বের জন্য লড়েন। কিন্তু এদের চারপাশ যে ধরনের মানুষে ঘেরা থাকে, তাদের সঙ্গে অবিরত সংঘাতে নিজের প্রাণশক্তি খোয়াতে খুব বেশি সময় লাগে না। সবাই তারা অজায়গায় ভুগছেন। এবং এভাবেই একদিন তাদের দিন ফুরোবে। কারখানায় এক বিচিত্র অভিযোগে আমি অভিযুক্ত হয়েছিলাম, এখানে এটুকুই আপাতত বলি। কর্তৃপক্ষ ওই অভিযোগ যদিও তুলে নিয়েছে, আমার পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত তুলে নেইনি আমি। নিজেকে এখানে আর রাখব না বহাল। অর্থাৎ, চাকরিটা আমি ছাড়ছি। অনেক ভণিতার পর তোমাকে অবশেষে জানালাম এ কথা। জানি, পরিবারের আর কারো কাছে আশ্রয় না পেলেও আমার আর্ত মন তোমার কাছে ঠিকই আশ্রয় পাবে। এ কারখানা যত অপদস্থই আমাকে করুক, মনে এও জানি, কখনো না ভোলার মতো প্রেম আমি পেয়েছি এখানে। কিন্তু জানোই তো, ক্ষয়িষ্ণু হলেও সম্পর্কসুতো যতোক্ষণ অন্তত বজায় থাকে, মানুষের মনের এক দুষ্টু অংশ অপ্রেমের অংশগুলোই কেবল মানসপটে নিয়ে এসে ক্লান্ত করতে চায়। অথচ সুতোটা ছেঁড়ামাত্র প্রেমের অংশগুলোর জন্য কেঁদে আর কাঁদিয়ে বিব্রত করে। বিষয়টা জানা আছে বলে সচেতন আমি বেশ। দেখো, দুষ্টু অংশটাকে আমি কোনোদিন ভালোর ওপর বিজয়ী হতে দেবো না।
শুভ্রা, মানবিক সম্পর্কের বাইরে চলো এবার। অজৈব যান্ত্রিক এক লব্ধির সঙ্গে এখানে আমার সত্য প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কারখানার বাঁশি! বয়েসে আমি বহু বন্ধুসঙ্গ হয়ত ভুলে যাব। কিন্তু এই এক সঙ্গসুখ আমি কখনও ভুলব না। প্রতিদিন একটু একটু করে এর সঙ্গে আমার আত্মীয়তার গিঁট দৃঢ় হয়েছে। তাই যখন ছেড়ে যাব বলে স্থির সিদ্ধান্তে এসেছি, অবশ্যম্ভাবী রক্তপাতের ভয়ে ভীষণ আর্ত হয়ে উঠেছে মন। কারখানা ছেড়ে গেলেও এখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে এই গোলাকার পৃথিবীতে হয়ত আমার আবারো দেখা হয়ে যাবে। ক্রমশ অভিন্ন গ্রাম হয়ে ওঠা এই একার্ণব বিশ্বে চাইলেই পরস্পরের কণ্ঠধ্বনি, এমনকি হৃদয়ের ধুকপুকও হয়ত শুনতে পাবো। কিন্তু প্রতিদিনের এই আশ্চর্য সুরটিকে আজকের মতো পারিবারিক পরিসীমায় দাঁড়িয়ে আর কোনোদিন নয়।
জানি, আমার যেটুকু সাধ্য, তার ভেতর থেকে এ কারখানায় দেওয়ার মতো আমার কিছুই ছিল না। এখানে আসার আগে যা ছিল আমার অনুমান, তা এখন অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত। মনের সঙ্গে কাজের প্রকৃতির কোনোদিন মিল হলো না। হয়ত আমি অন্য কিছুর জন্যে জন্মেছিলাম। কিন্তু এ কাজের জন্যেই জন্মেছেন এমন কিছু মানুষের দেখা আমি পেয়েছি। তারা ওই বিশ্ব চালানোর মানসিক শক্তিধরদের ক’জন। একেকজনের হৃদয় কারখানার যন্ত্রের ছন্দের সঙ্গে সমসুর। চলে আসার আগে আমি কর্তৃপক্ষকে তাদের কথা জানাতে চাই। ওরা সম্ভাবনার একেকটা পৃথক পৃথিবী। মনের ভেতর তাদের একটা তালিকা আমি বানিয়ে রেখেছি। কর্তৃপক্ষ আমার ওই তালিকা গ্রাহ্য করুক আর না করুক, ওটা আমি দেবোই। কারখানার বন্ধুকে চিনতে হবে কর্তৃপক্ষের। তাতে শত্রু চেনার শ্রম লাঘব হবে।
পরের মাসে দেখা হবে তোমার সঙ্গে। তখন শীতকাল। পুরনো দিনগুলোর মতো আবার আমরা কুয়াশাঢাকা ভোরের শহরে হাত ধরে বেড়াব। কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
ইতি
সলিল
চলবে…