[পর্ব-৮]
তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ভরা
মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তোমাকে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও ‘একুশে পদক’প্রাপ্তদের জন্যে পাশাপাশি (জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মানে) আলাদা দুটি স্থান নির্দিষ্ট করা আছে, সে জায়গায়ই তোমার কবর হবে। অভিন্ন, অব্যয় ও পরিবারের স্বজনেরা মিলে তা আগের দিনেই দেখে এসেছিল। অভিন্ন-অব্যয়ের ইচ্ছে হলো একুশে পদকপ্রাপ্তদের কবরের দ্বিতীয় সারির প্রথম কবরটা তাদের বাবার হোক। কবরস্থানে প্রবেশ করেই যেন কবরটি চোখে পড়ে সবার। দেশের অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ আজ শুয়ে আছেন এইখানে।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ অসমাপ্ত কবরের সারি শেষ না করে দ্বিতীয় সারির প্রথমেই দিতে চাইছে না জায়গা, এই নিয়ে তাদের দু’ভাইয়ের খুব মন খারাপ।
তোমাকে বারডেমের মরচুয়ারিতে রেখে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এসে আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। প্রচণ্ড মাথাব্যথায় কাতরাচ্ছি, মনে হচ্ছে মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে। ওষুধ খেয়েও যখন কমছে না, তখন বাসার উল্টোদিকের এক পার্লার থেকে শিল্পী নামের একটা মেয়েকে ডেকে এনেছে, সে আমার মাথা ম্যাসেজ করে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এই সময়ে আমাকে দেখতে এলেন আমার বিসিএস ওমেন নেটওয়ার্কের সভাপতি সুরাইয়া বেগম এনডিসি, তিনি তখন পিএম অফিসে সচিব হিসেবে কর্মরত। তার সঙ্গে নেটের মহাসচিব নাসরিন আক্তারও এসেছেন। তিনিও তখন অতিরিক্ত সচিব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের। প্রশাসন ক্যাডারসহ সরকারের সাতাশটি ক্যাডারের নারী কর্মকর্তাদের উন্নয়ন ও সুবিধা বৃদ্ধির প্রয়োজনে সংগঠনটি সৃষ্টি হয়েছিল বছর সাতেক আগে। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে নমিনি করে ওই সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। ওই সময় থেকেই সুরাইয়া আপার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি হয়। বিসিএস ওমেন নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি হিসেবে এখনো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে ১৫০ জন শিক্ষা ক্যাডারের নারী কর্মকর্তা এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
সুরাইয়া আপা আমাদের ছেলেদের ইচ্ছের কথা জেনে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ডিসির সঙ্গে কথা বলে অভিন্ন-অব্যয় যেভাবে আশা করেছিল, সেভাবেই তোমার কবরের ব্যবস্থা করে দিলেন।
এক সময় তুমি যখন জাতীয় গ্রন্থগারে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলে, তখন সুরাইয়া আপা সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের সচিব হিসেবে কর্মরত থাকায় তোমার সঙ্গেও তার ব্যক্তিগত অনাবিল একটি সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
সুরাইয়া আপা আন্তরিকভাবেই আমাদের পরিবারের ইচ্ছেটাকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পর্যায়ের একজন কবির কথা ভেবে, তোমার কবিতাকে ভালোবেসেই তা করেছিলেন।
বাদ আসর তোমার তৃতীয় জানাজা শেষ করে ধানমন্ডির বাসা থেকে এবার শেষ বিদায়। লাশবহনকারী গাড়িতে তোলার আগে আমাকে উঠানে নিয়ে গিয়ে তোমার মুখ দেখালো অভিন্ন-অব্যয়।
পেছন ফিরে তোমার কবরের পানে আর একবার তাকাতেই মনে হলো সেই গানটির কলি, ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা
তোমার ততোধিক শীতল কপালে শেষ চুম্বন দিয়ে পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইলাম, ‘জীবদ্দশায় যদি তোমার মনে কষ্ট দিয়ে থাকি, সেজন্যে ক্ষমা করো হে প্রাণনাথ, ক্ষমা করো আমায়।’ তোমাকে তুলে নিয়ে আমার সন্তানেরা চলে গেলো আগে আগে। আমি পরের গাড়িতে স্বজনদের নিয়ে কবরস্থানে পৌঁছে যাই মিনিট দশেকের ব্যবধানে।
গাড়ি থেকে নেমে আমি খোলামুখ কবরের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। যদিও শেষকৃত্যের পুরো কাজটি পুরুষের দ্বারা পরিচালিত, সেজন্যে নারীদের দাঁড়াতে হয় একটু দূরত্ব রেখে। আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে নারী বান্ধবেরা, বোনেরা, অব্যয়ের শাশুড়ি, অব্যয়ের বন্ধুর মা কলি ছাড়া আরও অনেকেই। কারু মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠছে না আমার দৃষ্টিতে। দূরে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি, তখনো শূন্য কবরে একটা সাইকেলের চাকা, কাঁচা বাঁশের একটা খণ্ড কবরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যেখানে কিছু বালু ছিটানো রয়েছে। সোঁদা মাটির এই বিছানায় শোবে আজ তুমি কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদ। কাব্য জগতের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একজন কবি, স্বাধীনতার সৈনিক, যে একজন নারীর দীর্ঘদিনের মর্মসহচরী, স্বামী, সন্তানের আদর্শ পিতা কত নিঃশব্দে তুমি মেনে নিয়েছেন বিধির এই বিধান।
শুনেছি কবর খুঁড়ে নাকি শূন্য রাখতে হয় না, লাশ আসা অবধি কিছু একটা রাখতে হয়। সম্ভবত, গোর যারা খুঁড়েছে, তারাই এভাবে কবর পাহারাদার রেখে দিয়েছে।
সন্তানেরা কাঁধে নিয়ে তোমার লাশ কবরে নামালো, সবার মুখে দোয়া আর কলেমা। উত্তরদিকে মাথা রেখে মুখটা পশ্চিম দিকে একটু কাত করে রেখে ওপরে উঠে এলো সবাই। এরপর বাঁশের টুকরোগুলো পরপর সাজিয়ে চাটাই বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর কোদালের ঝপঝপ মাটি ফেলার শব্দগুচ্ছ ক্রমাগত আমার শ্রবেন্দ্রিয় বিদীর্ণ করে দ্রিমদ্রিম শব্দ তুলে হাহাকার করছিল।
মহাকালের এক অজানা স্রোত তুমুল তরঙ্গ তুলে বুকের ভেতরটা ভাঙছিল ক্রমাগত। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আর দু’চোখের দৃষ্টি তলিয়ে যাচ্ছিল এক নিঃসীম আঁধারে।
ততক্ষণে তোমার মাটির ঘর নিজস্ব আয়তনে তোমার কবিতার মতোই নান্দনিকতায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। তোমাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে কফিনে ভালোবাসার যত ফুল জমেছিল, সবই তোমার কবরের ওপর বিছিয়ে দিলো সবাই মিলে। কে যেন আমার হাতে গোলাপের কিছু পাঁপড়ি তুলে দিলো তোমার বুকের প’রে ছড়িয়ে দিতে। অসাড় হাতে তুলে নিয়ে আমি তা ছিটিয়ে দিলাম কবরের ভেজা মাটির ‘পরে। অভিন্ন, অব্যয় বাঁশের বেড়ার ওপর দিয়ে নতজানু হয়ে কবরের মাটি ছুঁয়ে, আনত চোখের জলে আর ফুলে, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ঢেকে দিলো তোমার কবর।
কবিতা পরিষদের সভাপতি, ড. মোহাম্মদ সামাদ, সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত; দুজনেই পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে তোমাকে শেষ অভিবাদন জানালো। সুদূর গড়পাড়া থেকে পীরবাবার মেজছেলে আমার প্রিয় ছোট ভাই তাজিনুর রহমান তাজ কবরস্থানের সব কাজ সমাধা করে তবে ফিরে গেলো নিজ গ্রামে।
শোকের ভার নামিয়ে সবাই যেন যার যার গন্তব্যে চলে গেলো জীবনের ডাকে।আমি, কেবল আমিই সর্বস্ব হারানো একজন নিঃস্ব, রিক্ত মানুষ। সাঁইত্রিশ বছরের জীবনসঙ্গী কবি রফিক আজাদকে মৃত্তিকাবাসে শুইয়ে রেখে ধানমন্ডির শূন্য ঘরে ফিরে গেলাম সন্তানদের হাত ধরে।
পেছন ফিরে তোমার কবরের পানে আর একবার তাকাতেই মনে হলো সেই গানটির কলি, ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা, কে বলে তুমি নেই, তুমি আছো মন বলে তাই।’
চলবে…
কবি রফিক আজাদের শেষ ৫৮ দিন এবং ইতঃপূর্ব-৭॥ দিলারা হাফিজ