[ষষ্ঠ পর্ব]
মাটির পৃথিবীতে তোমার শেষ অশ্রুবিন্দু
আহা! আজ কতদিন ওই জিহ্বায় ঠাণ্ডা পানির স্পর্শ নেই। খাবারের সব উপাদান চলে যেতো রাইসটিউবের ভেতর দিয়ে। শুকনো খরখরে ঠোঁটজোড়ায় নিয়মিত সকাল-বিকাল পেট্রোলিয়াম জেলি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হতো। মুখমণ্ডলে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, একটু বড় হলেই ডিউটিরত বয়কে দিয়ে শেভ করিয়ে দিতাম আইসিইউর বেডে শায়িত অবস্থায়ই।
একবার তাকাচ্ছি প্রেসারের মনিটরে, আর একবার তোমার চোখের পাতায়। চোখের দু’পাশ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তোমার ভালোবাসার অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আমার হাতে।
মাটির পৃথিবীর মায়া, সন্তানদের জন্য মায়া, কবিতার জন্য তোমার অশ্রুসজল উদ্বেগ, প্রেমময় এক মুহূর্তের সবটুকু পেছনে ফেলে নিজেকে অতিক্রম করে গেলে তুমি।
মিনিট দুয়েকের ব্যবধানে মনে হলো কেউ যে চলে যাচ্ছে কোথাও। চলে যাওয়ার মুহূর্তে দরোজায় হোচট খাওয়ার মতো মৃদুশব্দ শুনেই আমি স্তব্ধ, হতবাক। মনিটরে তাকাতেই দেখি হার্টবিটের ঢেউ মুছে দিয়ে কেউ যেন দীর্ঘ শাদা একটা লাইন টেনে দিলো। অর্ধনির্মিলিত চোখের পাতা দুটো হঠাৎ মিলিত হলো পরস্পর।
আমার অস্ফুট ঠোঁট নড়ে উঠলো, লা ইলাহা ইল্লিলাহু মুহাম্মাদুর রাসুলিল্লাহ। কলেমা তৈয়ব, কলেমা শাহাদৎ পাঠ করলাম তিনবার।
অতপর ক্রমাগত অনেকটা সময় ব্যেপে উচ্চারণ করলাম বিদায়, বিদায় সখা, বিদায় বন্ধু, বিদায় প্রাজ্ঞ-পারমিতা, হে বন্ধু আমার। বাংলা কাব্যের অমর রাজপুত্র, তোমায় বিদায়।
মনে হলো আমাকে তুমি ফাঁকি দাওনি, বাংলা কবিতার ভাষা-ছন্দ-অলঙ্কারের মতো সবকিছু বলে-কয়ে যেন বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলে তোমার নিজস্ব ভঙ্গিমায়। সাঁইত্রিশ বছর আগে সেই বাংলা অ্যাকাডেমির বটতলায় সবুজ ঘাসের ‘পরে যেমন দেখেছিলাম প্রথম দিন, ঠিক সেভাবেই চলে গেলে নির্মোহ কবির মতো, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচ্ছেদ গায়ে চাপিয়ে!
আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা শেষে অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে তুমি খুঁজে নিলে তোমার অনন্তলোকের অজানার নীল ঠিকানা।
এই সান্ত্বনা আমাকে মুহূর্তের জন্যে একটা নির্ভীক কণ্ঠস্বর উপহার দিলো। আমি মাত্র দুটো কল করলাম। একটি কলে হাসপাতলের ভিসি ডা. কামরুল ইসলামকে অন্যটি দিলাম ডা. হারিসুল হককে। নির্ভীক স্বরে শুধু বললাম, তিনি চলে গেলেন এইমাত্র। আর ডানহাতে মোবাইল চেপে তখন ঘড়ির সময়ে দেখি দুপুর ১ টা ৪৫ মিনিট।
হাসপাতালের নিয়মানুযায়ী রোগীর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করার আগে একটা ইসিজি করতে হয়, কবি ও ডাক্তার হারিসুল হক সেই কাজটি করলেন অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায়। হৃদয়ের ডাক্তার তিনি, তোমার দীর্ঘদিনের চিকিৎসক এবং কাব্যসতীর্থ, বন্ধু। একজন ডাক্তার যিনি কবি, তার প্রিয় অগ্রজ কবির মৃতসংবাদ ঘোষণা করলেন দুপুর ১ টা ৫৯ মিনিটে।
খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এলেন সৈয়দ শামসুল হক ভাই। বাংলা কাব্য জগতের একমাত্র জীবিত অভিভাবক তখন তিনি। তাঁর সঙ্গেই এলেন ভাবি আনোয়ারা সৈয়দ হক, তরুণ কবি পিয়াস মজিদ।
কবির প্রিয় সংগঠন কবিতা পরিষদের সভাপতি ড. মোহাম্মদ সামাদ, সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাতসহ এলেন সাহিত্য জগতের নবীন প্রবীণ সব স্তরের লেখক-কবি। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা এলো দলে দলে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা ছাড়াও শিল্প ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অনেক গুণীজন, আমাদের চেনা-অচেনা নানা পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ এসে দেখলেন নীরব তোমাকে।
ইতোমধ্যে কবির গোসল হয়ে গেছে।
আমাকে নিচ থেকে ধরে এনে হাসপাতালের যে কক্ষটিতে তোমাকে শুইয়ে রেখেছে, সেখানে আমার চারপাশ ঘিরে বসে আছে সবাই। সেই কক্ষটিতেই কবি আসাদ চৌধুরী এলেন সবার আগে।
বিছানার পাশে আমার মাথায় সান্ত্বনার হাত রেখে বসে থাকলেন অনেকক্ষণ। একজন সাংবাদিক এসে এই ভিড়ের মধ্যেই কবি আসাদ চৌধুরী ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর মাহফুজা বেগমের ইণ্টারভিউ করলেন। ছোট্ট কক্ষটিতে আমার সহকর্মী ছাড়াও অসংখ্য মানুষে ভিড়। কারও মুখ-চোখ আলাদা করে আমি আর চিনতে পারছি না, মনে করতে পারছি না আমার অতীত, বর্তমান-ভবিষ্যৎ।
বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণপন লড়াই করে আমরা দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম, কিন্তু এখনো দেশটাকে আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে দাঁড় করাতে পারিনি।
অনন্ত কালের পেটের মধ্যে যেন সেঁধিয়ে গেছে সময়। একটি শূন্যতর বিন্দুতে এসে থেমে গেছে আমার সব, সবকিছুই। চিনতে পারছি না বিশেষ কাউকেই। সবার মুখাবয়ব মিলিত হয়ে তখন একটি বৃহৎ শূন্য গহ্বরে পরিণত হয়েছে যেন। আমার নিজের অস্তিত্ব তখন শোকের কুয়াশায় আচ্ছন্ন। অগ্নিদহনের সর্পিল লাভার উদ্গীরণে আমি তখন রক্তিম ও রক্তাক্ত।
মরুভূমির লু-হাওয়া এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে বারংবার। তোমার আগেই যেন আমি মাটিতে পড়ে আছি ধুলোর লুটিয়ে।
হাসপাতালের সাততলা থেকে ছয়তলায় আমাকে কয়েকজনে ধরে নিয়ে গেলো। শেষবারের মতো আমি তোমার মুখটি দেখবো। ধবধবে শাদা মার্কিন কাপড়ে নতুন নওশার সাজে তখন তুমি পরিপাটি। অনন্তের শুভ্রতায় আবৃত, পবিত্রতার অসীমে আনত।
কেবল উষ্ণতার বদলে হাতটি তোমার বড়ই হিমশীতল, তুষারাবৃত্ত বরফ শীতলের ফল্গুধা তোমাকে স্পর্শ করা মাত্রই মনে হলো, এই তো সেই উনিশ শত একাত্তরের হাত, মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধরত হাত, দ্রোহে একে ফরটি সেভেনের ট্রি গারে রাখা হাত, দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়া হাত, পাক-বাহিনীর মতো শত্রুকে নিধন করা হাত, দু’বাহু বাড়িয়ে প্রেমিকাকে শক্ত আলিঙ্গনে বাঁধার মতো হাত।
দু’হাতে সন্তানকে জড়িয়ে দুঃখ-কষ্ট-সন্তাপ মুছে ফেলা হাত। সর্বোপরি কাব্যলক্ষ্মীর বরে পাওয়া এই হাতে যত কালজয়ী পঙ্ক্তিমালা তুমি লিখেছিলে, সব পেছনে ফেলে রেখে শূন্যহাতে চলে যাচ্ছ তুমি।
আমকে তো আরও বেশি শূন্য করে গেলে তুমি সতীনাথের সেই পুরোনো দিনের গানের মতো—‘মরমিয়া তুমি চলে গেলে, দরদি আমার কোথা পাবো? কারে আমি এ ব্যথা জানাবো।’ ঋষিতুল্য সেই হাতে হাত রেখে বরফশীতল তোমার কপালে আমার শেষ চুম্বন রেখে এসে দাঁড়ালাম। দাঁড়ালাম আমি দেশবাসীর প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত সেইসব প্রিন্ট ও মিডিয়ার সাংবাদিকদের সামনে।
বাম হাতে আমাকে জড়িয়ে, আমার অন্য হাতটি শক্ত করে ধরে রেখেছে আমারই কোলের সন্তান অব্যয়, আমাদের দু’জনের ছোট্ট আব্বু সোনা। তাকে হঠাৎ অনেক বড় মনে হলো। আমার বয়সকে ছাপিয়ে হঠাৎ যেন সে এক প্রাচীন বটবৃক্ষ হয়ে দাঁড়ালো আমার মাথার’পরে ছায়া হয়ে।
আমার বামপাশে হক ভাই, ডানপাশে অব্যয়। একসঙ্গে অনেকগুলো চ্যানেলের মাউথপিচের সামনে কবি সৈয়দ শামসুল হক দেশবাসীর উদ্দেশে বললেন, ‘বাংলা কাব্য জগতের প্রাণপুরুষ, অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ আজ ১২ মার্চ ২০১৬ সাল শনিবার বেলা দুপুর ২টায় চিকিৎসারত অবস্থায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর নশ্বর দেহের অবসান হলেও তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কালজয়ী পঙ্ক্তিমালায়। বাংলা কবিতা যতদিন থাকবে, রফিক আজাদের নাম ততদিন উচ্চারিত হবে ভক্ত-পাঠকের মুখে মুখে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে তার অবদান।’
বিদেশে বসবাসরত তোমার সন্তানদের অপেক্ষায় আজ তোমার লাশ বারডেম হাসপাতালের মরচুয়ারিতে রাখা হবে। যেহেতু তুমি দীর্ঘদিন বাংলা অ্যাকাডেমিতে কর্মরত ছিলেন, সে জন্যে আগামী ১৩ তারিখ সকাল ১০টায় প্রথমে বাংলা অ্যাকাডেমি এবং সকাল ১১টায় তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে শহীদমিনারে সর্বস্তরের জনগণের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে। এই সময়ে তোমার কফিন জাতীয় পতাকায় আবৃত করে বিউগল বাজিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মান প্রদর্শন করা হবে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তোমাকে দাফন করা হবে।
এরপর সাংস্কৃতিক জোটের নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এবং গোলাম কদ্দুস দু’জনেই বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশে বললেন, ‘কবি রফিক আজাদ একজন মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তিনি কোনো সদনপত্র নেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদত্ত ভাতাও তিনি গ্রহন করেননি।তিনি যথার্থই দেশের জন্যে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। তার জন্যে কোনো সুবিধা নেয়ায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না বলেই কোনো সনদ তাঁর নেই। কিন্তু একজন সনদধারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে শেষ শয়ানে যে সম্মান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে কবি রফিক আজাদের ক্ষেত্রেও যেন তার কোনো ব্যতয় না হয়, সরকারের কাছে আমরা সেটাই আশা করবো।’
এরপর অব্যয় তার প্রতিক্রিয়া জানালো, ‘‘আমরা একজন কবি ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠেছি। দেশকে ভালোবাসার কথা বার বার বলে গেছেন আমাদের বাবা। মাঝে মধ্যেই দুঃখ করে বলতেন, বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণপন লড়াই করে আমরা দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম, কিন্তু এখনো দেশটাকে আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে দাঁড় করাতে পারিনি। বাবা, ভালোভাবে পড়াশোনা করে, তোরা এই দেশটাকে দেখিস।একমাত্র গদ্যগ্রন্থ বাবা লিখে গেছেন, ‘কোনো খেদ নেই’নামে। বাবার মতো আমাদেরও কোনো খেদ নেই।’’
চলছে…
কবি রফিক আজাদের শেষ ৫৮ দিন এবং ইতঃপূর্ব-৫॥ দিলারা হাফিজ