পর্ব-৮
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?
[জীবনানন্দ দাশ]
ধীরে ধীরে আমরা কুতুবমিনারের পাদদেশে এসে দাঁড়াই। হেলে পড়া সূর্যের তির্যক রোদে মিনারচূড়ায় চোখ রাখতে কিছুটা অসুবিধে হচ্ছিল। কপালে হাত রেখে রোদ আড়াল করে তাকাই সুউচ্চ মিনারের চূড়াদেশে। যতদূর চোখ যায় অপূর্ব কারুকাজ মুগ্ধ হয়ে দেখি। গোলাকার মিনারের চারপাশে খোদাই করা চোখজুড়ানো আরবি ক্যালিওগ্রাফি। ক্যালিওগ্রাফির ওপর ও নিচের অংশে আছে খোদাই করা বিভিন্ন নকশা। আছে ফুল, পাতা ও বিভিন্ন জ্যামিতিক অবয়বের নান্দনিক শোভাময় আকর্ষণ। মিনারের চারটি স্তরে আছে বারান্দা বা বেলকুনির মতো জায়গা। সেই সঙ্গে আছে জানালা। আছে মিনারের ভেতর দিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। যদিও দর্শনার্থীরা এই সিঁড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। কুতুবউদ্দিন আইবেক কিসের খেয়ালে এই অনিন্দ্য সুন্দর মিনার তৈরি করেছেন, তার যথাযথ উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববাসীর কাছে এই মিনার ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সম্মানিত হয়ে আছে।
কুতুবউদ্দিন আইবেক ছিলেন মধ্যযুগীয় ভারতের একজন শাসক। দিল্লির প্রথম সুলতান এবং মামলুক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তবে সুলতান হিসেবে তিনি ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লি শাসন করেন। ধারণা করা হয় যে, মধ্য এশিয়ার কোনো এক স্থানে কুতুবউদ্দিনের জন্ম। তার পূর্ব পুরুষরা ছিলেন তুর্কি। শিশু বয়সে কুতুবউদ্দিনকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয় ইরানের খোরাসান অঞ্চলের নিসাপুরের প্রধান কাজী সাহেবের কাছে। কাজীর মৃত্যুর পর তার ছেলে কুতুবউদ্দিন আইবেককে আবারও বিক্রি করেন গজনির গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ ঘুরীর কাছে। ইতিহাসের হাত ধরে কুতুবউদ্দিনও হয়ে উঠেছেন ভারত ইতিহাসের অংশ।
কুতুবমিনারকে ঘিরে তৈরি হয়েছে মনোরম একটি কমপ্লেক্স। এর আয়তন প্রায় ১০০ একর। কারও কারও এটি আফগানিস্তানে অবস্থিত ‘জাম মিনার’-এর অনুকরণে নির্মিত। উচ্চতায় পাঁচতলার সমান এই মিনারের নামকরণ নিয়ে দুটি অভিমত প্রচলিত আছে। কারও মতে, এর নির্মাতা কুতুবউদ্দিন আইবেকের নামানুসারে এর নাম ‘কুতুবমিনার’। আবার অন্যদের মতে, ট্রান্স-অক্সিয়ানা থেকে আগত বিখ্যাত সুফিসাধক হজরত কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীর (জন্ম ১১৭৩-মৃত্যু ১২৩৫) সম্মানার্থে এটি নির্মিত হয়েছে বিধায় এর নাম ‘কুতুবমিনার’।
ধনসম্পদ থেকে মোহমুক্তি লাভের ভেতর দিয়ে স্রষ্টার আনুকূল্য লাভ। ফলে ফকিরি জীবনের ভেতর দিয়ে মানবাত্মা ক্রমশ ভেতরের অহংবোধকে চূর্ণ করে।
স্বভাবতই কৌতূহল বোধ করি। কে এই কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী? যার প্রতি অনুরক্ত হয়ে কুতুবুদ্দিন আইবেক ‘কুতুবমিনার’-এর নামকরণ করলেন। প্রত্নতাত্ত্বিক এইসব নিদর্শনের পেছনে রয়েছে অনেক আধ্যাত্মিক ইতিহাস। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে ‘চিশতিয়া’ তরিকার কথা সর্বজন বিদিত। গরীবে নেওয়াজ খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতীর (রহ,) হাতে ভারতের আজমিরে এই তরিকার সূত্রপাত। পরবর্তী সময়ে এই তরিকা সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের কাছে বিপুল পরিমাণে অভিনন্দিত হয়েছে। ধনী-নির্ধন, রাজাবাদশা নির্বিশেষে দলেদলে মানুষ এই তরিকার অনুসারী হয়েছেন। মঈনুদ্দিন চিশতী প্রতিষ্ঠিত এই তরিকা তার একান্ত শিষ্যদের হাত ধরে সিলসিলা মতো নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
কথিত আছে, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি একবার কিরগিন্তানের ‘উশ’ নামক স্থানে সফররত অবস্থায় ছিলেন। যেখানে খাজা বখতিয়ারের জন্ম। তিনি মাঈনুদ্দিন চিশতীর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। বায়াতের পর ইসলামের নানা বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এভাবে সাধনার একপর্যায়ে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি তাকে ‘চিশতিয়া তরিকা’র প্রথম খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন। তার পুরো নাম ‘কুতুবুল আকতাব হজরত খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী’। খলিফা হিসেবে মনোনীত হওয়ার আগে চিশতিয়া তরিকা কেবল আজমীর এবং নাগাউর স্থানেই সীমাবদ্ধ ছিল। চিশতিয়া তরিকাকে দিল্লিতে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বখতিয়ার কাকী (রহ.) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কুতুবুদ্দিন আইবেক বখতিয়ার কাকীর একনিষ্ঠ শিষ্য ছিলেন। স্বয়ং বাদশা তার শিষ্য হলে কী হবে, তিনি কখনোই বাদশার পাঠানো উপহার গ্রহণ করতেন না। বাদশা যখন কাকী (রহ.)-এর কাছে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তখন এই মর্মে তিনি বাদশাকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন—যতক্ষণ তিনি না চাইবেন, ততক্ষণ বাদশার তরফ থেকে তাকে যেন কোনো ধরনের আর্থিক উপহার না পাঠানো হয়। চিশতিয়া তরিকার মূল দর্শন—জাগতিক ধনসম্পদ থেকে মোহমুক্তি লাভের ভেতর দিয়ে স্রষ্টার আনুকূল্য লাভ। ফলে ফকিরি জীবনের ভেতর দিয়ে মানবাত্মা ক্রমশ ভেতরের অহংবোধকে চূর্ণ করে।
ওইদিন থেকে মানুষ তাকে ‘কাকী’ নামে সম্বোধন করা শুরু করে। তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী।
কুতুবমিনারের অত্যন্ত সন্নিকটে মেহরুলির জাফর মহলের পাশেই তার দরগাহ। যেখানে নির্দিষ্ট তারিখে ওরশের আয়োজন হয়। ভারতের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি তার শিষ্য ছিলেন। সুলতান ইলতুতমিশ কাকীর সম্মানে ‘ঘান্দাক কি বাউলি’ নামে একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন। শের শাহ সুরি নির্মাণ করেছেন একটি বড় গেইট। বখতিয়ার কাকীর সবচেয়ে বিখ্যাত শিষ্য এবং খলিফা হলেন ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই গঞ্জেশকার আবার দিল্লির বিখ্যাত সাধক খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার পীর বা সুফি গুরু।
বখতিয়ার নামের সঙ্গে ‘কাকী’ উপাধি যুক্ত হওয়ার পেছনে একটি ঘটনা রয়েছে। পরিবারে ভীষণ দারিদ্র্য অবস্থা বিরাজ করছিল। খাজা বখতিয়ার সেই দুঃসময়ে তার স্ত্রীকে স্থানীয় রুটিওয়ালার কাছ থেকে রুটি না নিতে নিষেধ করেন। তিনি স্ত্রীকে এও পরামর্শ দিলেন। যখন প্রয়োজন হবে তিনি যেন ঘরের এক কোণা থেকে ‘কাক’ (এক ধরনের রুটি) সংগ্রহ করেন। স্ত্রী তার আদেশ মতো প্রয়োজন মুহূর্তে কাক পেয়ে যেতেন। এদিকে স্থানীয় রুটিওয়ালা খাজার অনুপস্থিতিতে চিন্তিত হয়ে তার স্ত্রীকে খোঁজ নেওয়ার জন্য খাজার বাড়িতে পাঠালেন। রুটিওয়ালার স্ত্রী খাজা বখতিয়ারের স্ত্রীর কাছে ‘কাক’ বা রুটি আনতে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। তখন খাজার স্ত্রী তাকে প্রয়োজন মুহূর্তে ঘরের কোণে রুটি পেয়ে যাওয়ার গল্পটি বলেন। এতে রুটিওয়ালার স্ত্রীও অবাক হয়ে যান। এই গোপন তথ্যটি জানাজানি হয়ে গেলে ঘরের কোণে রুটি আসা বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিন থেকে মানুষ তাকে ‘কাকী’ নামে সম্বোধন করা শুরু করে। তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী।
১২৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর তিনি একটি সেমা মাহফিলে অংশগ্রহণ করেতে গিয়েছিলেন। যেখানে সুফি কবি আহমদ-এ-জাম একটি পঙ্ক্তি ভক্তিসঙ্গীতের আদলে গেয়ে শোনান:
যারা আত্মসর্ম্পণের খঞ্জরে নিহত হয়েছে,
অদৃশ্য থেকে তাঁরা প্রতিনিয়ত নব জীবন প্রাপ্ত হয়।
এই ভক্তিসঙ্গীতের ভাবকথা দ্বারা খাজা বখতিয়ার কাকী ভীষণ পরমানন্দ লাভ করলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ ভাবাবিষ্ট হয়ে মূর্ছা গেলেন। এভাবেই চারদিন অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তিনজনের হাতে থাকা ধাতব কয়েন গেইটের নির্দিষ্ট বাক্সে ফেলে বেরিয়ে আসি। অপেক্ষমাণ ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন আগেই।
কুতুব মিনারের পাশেই ভারতের প্ৰাচীনতম মসজিদগুলোর অন্যতম ‘কুব্বত-উল-ইসলাম’। এটি এখন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে মসজিদ গেটের অনেকটা এখনো বিদ্যমান আছে। কথিত আছে, রাজপুতদের সঙে দিগ্বিজয়ের স্মারক হিসেবে কুতুবউদ্দিন আইবেক ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। এখানেও দেয়ালজুড়ে আছে পাথরের খোদাই করা আরবি ক্যালিওগ্রাফি। মূল গেটের সামনে খোলা জায়গা থাকলেও পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে আছে একতলা সমপরিমাণ স্থাপনা। এই মসজিদ গেইটের সামনে লোহার একটি স্তম্ভ দেখে বিস্ময় জাগে। এটি ‘দিল্লির লৌহস্তম্ভ’ হিসেবেও পরিচিত। উচ্চতা ২৩.৭ ফুট। কথিত আছে যে, পূর্বে এটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদয়গিরিতে ছিলো। পরবর্তী সময়ে এটি এখানে এনে স্থাপন করা হয়। স্তম্ভের গায়ে ব্রাহ্মী লিপিতে এর ইতিহাস লেখা আছে।
এছাড়া পর্যটকরা মসজিদ প্রাঙ্গণে এসে তিনটি সমাধি দেখতে পারেন। সেগুলো হলো—সুলতান ইলতুৎমিশ, সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবন, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সমাধি। কুতুব কমপ্লেক্সের একপাশে আছে আলাউদ্দিন খিলজি নির্মিত মাদ্রাসাভবন। বেশ কয়েকটি কক্ষ নিয়ে গঠিত এই মাদ্রাসাভবন। এখন এই মাদ্রাসাভবনের অস্তিত্বও বিলীয়মান। কুতুবমিনারের ঐতিহাসিক চিহ্নাদি দেখে আমরা বিস্ময়ের ঘোরে ডুবে আছি যেন। ফিরে যেতে মন চাইছে না। প্রিয়জনকে ফেলে যাওয়ার মুহূর্তে যেমন বারবার পেছন ফিরে তাকাই, তেমনি কুতুবমিনারের সুউচ্চ সৌধ এবং কমপ্লেক্সে প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে থাকা মায়ার বাঁধনে আমরা বাঁধা পড়েছি।
ফেরার আগমুহূর্তে আমি আর সেঁজুতি বহির্গমন গেটের সম্মুখভাগে অপেক্ষা করছিলাম। কারণ তখনো কামরুল ভাইকে খুঁজে পাইনি। হঠাৎ উৎকণ্ঠিত মুখে কামরুল ভাই সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার চেহারা দেখে বুঝতে পারছি আমাদের ওপর রুষ্ট হয়েছেন। আমাদের মতো তিনিও খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছেন। আর একমুহূর্তও দেরি নয়। বেরুতে হবে পরবর্তী গন্তব্যে। আমরা জোরকদমে গেটে এগিয়ে যাই। তিনজনের হাতে থাকা ধাতব কয়েন গেইটের নির্দিষ্ট বাক্সে ফেলে বেরিয়ে আসি। অপেক্ষমাণ ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন আগেই।
চলবে…