[পর্ব-৫]
‘পৃথিবী একটা বই। যারা ভ্রমণ করে না তারা বইটি পড়তে পারে না।’
[সেন্ট অগাস্টিন]
আজ ১৭ অক্টোবর ২০১৯। সকাল সাতটায় আমাদের বিমান ‘দিল্লি ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল ইয়ারপোর্ট’-এ এসে অবতরণ করলো। শীতের চাদর সরিয়ে সদ্য ঘুমভাঙা বালকের মতো চোখ কচলে তাকিয়ে দেখি। সত্যিই তো, এই তো দিল্লি। মির্জা গালিবের দিল্লি। আমির খসরুর দিল্লি। মুহূর্তে মির্জা গালিব যেন আমার অন্তরে হেসে উঠলেন। হে বন্ধু গালিব, বাংলার জলহাওয়া নিয়ে আমি এসেছি তোমার দেশে। আমাকে বরণ করে নাও। তোমার কবিতার কিছু সুবাস আমাকে দাও।
জান দি দি হুয়ি উসি কি থি
হক তো য়ে হ্যায় কি হক আদা না হুয়া
[যে প্রাণ দিলাম তোমায় সে তো তোমারই দেওয়া
আসল কথা এই—তোমাকে কিছুই দেওয়া হলো না।]জিন্দেগি য়ুঁ ভি গুযার হি জাতি
কিঁউ তেরা রাহগুযার য়াদ আয়া’
[জীবন তো এমনি কেটে যেতো
কেন যে তোমার পথের কথা মনে পড়লো]
গালিবের গজল আমাকে আচ্ছন্ন রেখেছে ভেতরে ভেতরে। এমন মগ্নমন নিয়ে হাঁটছি। ‘দিল্লি ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’ বিশ্বের ২১তম এবং ভারতের অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘পালাম বিমানবন্দর’ নামেও পরিচিত। তথ্যমতে, বিমানবন্দরের আয়তন ৫,১১০ একর। নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটারের দূরত্ব। এখানে বিভিন্ন দেশের বিচিত্র সব মানুষের আনাগোনা। সবাই ব্যস্ত যেন। ছুটছে তো ছুটছেই। কেউ আমাদের মতো কেবল বিমান থেকে নেমেছেন। কেউ ছুটছেন আবার বিমানে উড়াল দেবেন নিজের গন্তব্যে। ঢাকা, কলকাতা ও দিল্লির তিনটি বিমানবন্দর তিনজন বিশেষ ব্যক্তির নামে। যাদের জীবন মহৎ কর্মে উজ্জ্বল। মহৎ মানুষেরা বুঝি এভাবেই যুগযুগ ধরে মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকেন।
কবিতার পথে পথে-৪॥ ফারুক সুমন
বিমান থেকে নেমে আমরা অপেক্ষমাণ এয়ার বাসে চড়ে বসলাম। এয়ার বাসের যাত্রীদের মুখে সন্তুষ্টির ছাপ। এই তো দিল্লি, আমাদের গন্তব্যস্থান। যেখানে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিতব্য ‘সার্ক সাহিত্য উৎসব’-এ যোগ দিতে সুদূর বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এয়ারবাসে কলকাতা বিমানবন্দরের সেই প্রবীণের সাথে আর একবার দেখা হলো। হাত নেড়ে তিনি বিদায় জানালেন। এটাই বোধহয় মুসাফিরের জীবন। পথিমধ্যে ক্ষণিকের অতিথি। তারপর যে যার গন্তব্যে। এয়ারবাস থেকে নেমে আমরা এবার বিমানবন্দরের অন্দরাঞ্চলে প্রবেশ করলাম। আহা, অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর মনভোলানো কারুকাজ বন্দরের দেয়ালে, মেঝেতে ও চৌদিকে। নানামত্রিক নকশাকৃত বৃহদাকার টেরাকোটা এবং স্থাপত্যশৈলী দেখে আমরা বিমোহিত হলাম।
এই তবে আমার কল্পনার দিল্লি! আমরা তিনজন বিমুগ্ধ চোখে দেখে নিচ্ছি দিল্লির ‘ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমেই আরও এক বিস্ময়কর সুন্দরের মুখোমুখি হলাম। অন্যদেশ থেকে আগত নতুন অতিথিরা যে কেউ এই জায়গায় এসে কিছু সময়ের জন্য থেমে যাবেন সন্দেহ নেই। এখানে দেয়ালের শরীরজুড়ে পেতলের তৈরি নানান আকৃতির চাকতি। এগুলো অবতল কিংবা উত্তল আকারে দেয়ালে ঝলমল করছে। পরে বুঝলাম পেতলের এই সোনাবরণ চাকতিগুলো বসানো হয়েছে অভ্যাগত অতিথিদের দৃষ্টিগোচর করার জন্য। কারণ চাকতিগুলোর মাঝখানে দুহাত অন্তর বসানো হয়েছে গৌতম বুদ্ধের একাধিক হাত। যেখানে নাচ কিংবা ধ্যানরত বুদ্ধের বিভিন্ন মুদ্রা আভাসিত হয়। আমরা মুদ্রাগুলোর নাম জানি না। তবে আমাদের সঙ্গে আছেন কবি সেঁজুতি বড়ুয়া। তিনি চেষ্টা করে কয়েকটি মুদ্রার নাম বলেছেন। তবে সহসা আমরা নয়টি মুদ্রার নাম সংবলিত একটি বোর্ড দেখতে পাই। সেখানে লেখা আছে অভয়া মুদ্রা, ভারদা মুদ্রা, আকসা মুদ্রা, ময়ূর মুদ্রা, চতুরা মুদ্রা, ত্রিপতকা মুদ্রা, প্রাণা মুদ্রা, ত্রিশূল মুদ্রা, ও প্রাণায়াম মুদ্রা।
কবিতার পথে পথে-৩॥ ফারুক সুমন
কবি কামরুল হাসান ঝটপট বোর্ডের ছবি তুলে নিলেন। তার দেখাদেখি আমিও। তিন জনের হাতে মোবাইলফোন। সুন্দরের পাশে দাঁড়িয়ে তিন জনই ইচ্ছে মতো ছবি তুললাম। আগেই বলে নেওয়া ভালো। তিন জনের মধ্যে আমার মোবাইলফোনের ক্যামেরার রেজুলেশন খুবই কম। ফলে ছবি তোলার ক্ষেত্রে বারবার সেঁজুতি বড়ুয়ার দ্বারস্থ হতে হয়েছে। নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে আমরা সামনে পা বাড়াই। আমি তখন মনে মনে আওড়াতে লাগলাম ‘দিল্লির লাড্ডু কী মজা!’ স্বাদে-আনন্দে অতুলনীয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই পিতলের চাকতি ওি গৌতম বুদ্ধের নানা মুদ্রার হাতখচিত দেয়ালের অন্যপাশেই রয়েছে আটটি শ্বেতস্তম্ভ। সেঁজুতির ভাষ্যমতে এগুলাকে বলাহয় ‘স্তূপা’। গৌতম বুদ্ধের দেহাবসানের পর তার ভক্তরা বিপাকে পড়ে যান। তাকে কবরস্থ করবেন নাকি পুড়িয়ে ফেলবেন, এই নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। অবশেষে পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হলো। পবিত্র দেহ পোড়ানো ছাই মৃৎপাত্রে ভরে বিভিন্ন অঞ্চলের বৌদ্ধ প্যাগোডায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বুদ্ধের সম্মানার্থেই এয়ারপোর্টের অন্দরে এধরনের ‘স্তূপা’ স্থাপিত হয়ে থাকতে পারে।
আমাদের পাশ দিয়ে একজন সুদর্শন সুপুরুষ হেঁটে যাচ্ছিলেন। লম্বা, ধবধবে ফর্সা। তিনি ভারতীয় নয় এটা নিশ্চিত। তাঁর সাথে কথা বলবেন বলে কামরুল ভাই দাঁড়ালেন। অপরিচিত দীর্ঘদেহী সুপুরুষের পরনে বৌদ্ধভিক্ষুদের মতোই গেরুয়াবসন। এতক্ষণ গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন মুদ্রার হাত এবং ‘স্তূপা’ দেখে আমাদের মনে যে অলৌকিক আবহ তৈরি হয়েছিল। এই গেরুয়া বসনের বৌদ্ধভিক্ষুকে দেখে আমরা বোধহয় অজান্তে সেই ঘোর অনুভব করছিলাম। কামরুল ভাই হ্যান্ডসেক করে নিজের পরিচয় দিলেন। তখন অপরিচিত তরুণের মুখ থেকে জানা গেল তার নাম ‘তাই’। বাড়ি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি মার্শাল আর্ট শেখার জন্য চীনের শহর কুনমিং শহরে এসেছেন। এখন যোগব্যায়াম এবং ধ্যান শিখতে যাচ্ছেন হরিদ্বার। এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরে বড় একটি ফার্মেসি। যেখানে দেশি-বিদেশি নানা ঔষধ ছাড়াও কসমেটিক্সের বিভিন্নরকমের প্রসাধনী রয়েছে। আমি ঢুকলাম ‘ঝাণ্ডুবাম’ কিনবো বলে। দিল্লি আসার আগে মা ঝাণ্ডুবাম নেওয়ার কথা বারবার স্মরণ করে দিয়েছিলেন। নাহ, এখানে ঝাণ্ডুবাম পেলাম না। তবে শিশুদের পেটের পীড়ায় অব্যর্থ সিরাপ WOODWARD’S কোম্পানির ‘Gripewater’ পেয়ে যাই। সচরাচর এই ওষুধের যা দাম, তার থেকে এখানে দ্বিগুণ। বিমানবন্দর বলে কথা। যাহোক, না কিনেই বেরিয়ে এলাম।
কবিতার পথে পথে-২॥ ফারুক সুমন
লাগেজ, ব্যাগ নিয়ে আমরা এখন গন্তব্যে ছুটবো। আমাদের গন্তব্য মহিপালপুর। সার্ক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটি আমাদের জন্য হোটেল বরাদ্দ দিয়েছেন সেখানে। আমন্ত্রণপত্রের সাথে সংযুক্ত করা আছে হোটেলের ঠিকানা। এয়ারপোর্টের অদূরে মহীপালপুর। সেখানেই ‘হোটেল কিয়ান’ এবং ‘হোটেল সপ্তগিরি’। যেখানে সার্কভুক্ত বিভিন্ন দেশ থেকে কবি-সাহিত্যিকগণ এসে শিল্পসাহিত্য নিয়ে আড্ডামুখর হয়ে উঠবেন। যাত্রাপথে আমি এবং সেঁজতি কিছুটা নির্ভার ছিলাম বলা যায়। কারণ কামরুল ভাই সাথে আছেন। তিনি দায়িত্বশীল। তাছাড়া ইতোপূর্বে তিনি বেশ কয়েকবার দিল্লি এসেছেন। মহীপালপুর যাওয়ার জন্য তিনি পুলিশের কাউন্টার থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করলেন। ভাড়া আড়াই’শ রুপি। আমরা তিনজন সোৎসাহে ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলাম। ছবির মতো পরিচ্ছন্ন পিচঢালা পথে সহনীয় গতিতে ট্যাক্সি চলছে। রাস্তার দুধারে পরিকল্পিত সবুজায়ন। না শীত, না গরম।
দিল্লির ফুরফুরে বাতাস এসে যেন আমাদের জানাচ্ছে আনন্দিত অভিবাদন। রাস্তার দুধারে সারি সারি গাছ। শুধু তাই নয়; রাস্তার মাঝখানের আইল্যাণ্ডে সড়কের সমান বিস্তারিত জায়গায় খেজুর গাছ, তালগাছ এবং পাম গাছের সুবিন্যস্ত সারি। এসব বৃক্ষ যেন যাত্রীদের চোখে এনে দেয় অবারিত শান্তি। মিনিট পনেরো এভাবে চলার পর আমাদের ট্যাক্সি গিয়ে থামে মহীপালপুর ট্রাফিক সিগন্যালে। এতক্ষণ যে সবুজ আচ্ছাদিত প্রশস্ত পথে আমরা এসেছি তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি নিয়ে। সেটা মুহূর্তে উবে গেলো। কারণ এই ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে সম্মুখে, ডানে কিংবা বামে তাকালে রাজধানী ঢাকার মগবাজার কিংবা মহাখালীর বিশৃঙ্খল হৈচৈ চোখে পড়ে। ফ্লাইওভার, ধূলিওড়া পথ, গাড়ির হর্ন, এবড়োথেবড়ো ফুটপাথ। যেদিকে চোখ যায় কেবল আবাসিক হোটেলের সাইনবোর্ড।
কবিতার পথে পথে-১॥ ফারুক সুমন
মুহূর্তে মনে হলো দিল্লির ইন্ধিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যদি এতো জৌলুষপূর্ণ ড্রয়িংরুম হয়। তবে তার অন্দরমহল এমন কেন? এই তবে দিল্লির লাড্ডু! এমনটি ভাবতে ভাবতে আমাদের ট্যাক্সি একটা সরু গলির ভেতর গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। থামলো কেন? মুখ বাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ‘হোটেল কিয়ান’-এর খাড়া সিঁড়ি।
চলবে…