[পর্ব-চার]
ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। সে জানতে পারে দুনিয়ার তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র।
[গুস্তাভ ফ্লবেয়ার]
একটা বাড়ির ড্রয়িংরুম যেমন সাজিয়ে গুছিয়ে ঝকঝকে তকতকে রাখা হয়। আমার কাছে মনে হলো একটা দেশের এয়ারপোর্টও তেমনি দেশের ড্রয়িংরুমের মতো। অতিথি প্রথম বাড়িতে এসে ড্রয়িংরুমে বসে বাড়ির মালিকের রুচিবোধ এবং বাড়ির অন্দরের আভাস পেয়ে থাকেন। তেমনি অন্য দেশ থেকে আগত ব্যক্তি এয়ারপোর্টে এসে ওই দেশের রুচিবোধ, রাষ্ট্রপ্রধান ও দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারেন হয়তো। সেজন্যে এয়ারপোর্টগুলোতে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা যেখানে বসে আছি তার কাছাকাছি অপেক্ষমাণ বিভিন্ন দেশের যাত্রীরাও আছে। আমাদের দুই বেঞ্চ পরে একজন প্রবীণ ব্যক্তি চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। মনে হলো তিনি কলকাতার মানুষ। কাছে গিয়ে বসলাম। পরিচিত হলাম। তিনি অবসরপ্রাপ্ত একজন কলেজ শিক্ষক। তিনিও দিল্লি যাবেন। সেখানে তার ছেলে থাকেন সপরিবারে। মিনিট দশেক তারপাশে বসে কথা বলার সুযোগ নিলাম। কথা বলার ফাকে বললাম, এই বিমানবন্দরের নাম আগে ছিল দমদম। এখন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নামে করা হয়েছে তাই না? তিনি মাথা নাড়লেন। নেতাজী আমাদের কাছে স্মরণীয় ব্যক্তি। কারণ ভারত স্বাধীন হওয়ার পেছনে তার অনেক অবদান। আমি এইটুকু বলার পর এবার তিনি মুখ খুললেন। নেতাজীকে নিয়ে অনর্গল বলে গেলেন। আমি তার মুখ থেকে মুগ্ধ হয়ে শুনছি একজন মহৎপ্রাণ দেশপ্রেমিকের গল্প।
-নেতাজী ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাঙালির গর্ব। ভারত স্বাধীন হওয়ার পেছনে তার অসামান্য অবদান আমরা কখনো ভুলবো না। ভোলা সম্ভবও নয়। নেতাজী ওড়িশার কটক শহরে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর ভাবনা ছিল কিন্তু ভারতবর্ষের মুক্তি নিয়ে। নেতাজীর জীবন ও কর্ম ভারতবাসীকে এখনো সমান ভাবে উজ্জীবিত করে। তিনি যখন দেশবাসীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তুম মুঝে খুন দো, ম্যায় তুমহে আজাদি দুঙ্গা (তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।) তখন কার সাধ্য ছিল ঘরে বসে থাকে?’
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, আমিও নেতাজীর ভক্ত। তিনি জানতে চাইলেন আমি কোথায় যাচ্ছি? বললাম সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি যাচ্ছি। তিনি ‘বাহ! খুব ভালো’ বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন।
কবিতার পথে পথে-৩॥ ফারুক সুমন
আমি সৌভাগ্যবান। কারণ ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে দু’জন শিল্পপ্রাণ মহৎ মানুষকে পেয়েছি। এই ফাকে দু’জন সম্পর্কে কিছুকথা বলা প্রয়োজনবোধ করছি। কারণ দিল্লি ভ্রমণের বেশি সময়জুড়ে এই দু’জনের সান্নিধ্য পেয়েছি। একজন কামরুল হাসান। যিনি বহুমাত্রিক ভাবনায় উচ্ছ্বসিত মানুষ। তিনি একাধারে কবি-প্রাবন্ধিক ও সরস ভ্রমণগদ্য লেখক। বিশেষ করে তার কাব্যগন্ধী গদ্য পাঠককে ভাবাবিষ্ট করে রাখে। তার লেখায় এক ধরনের সম্মোহন তৈরি হয়। বোধকরি কবিখ্যাতির পাশাপাশি একজন ভ্রমণগদ্য লেখক হিসেবে তার বিশেষ একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে ইতোমধ্যে। তার আরও একটি বিশেষ পরিচয় আছে। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। প্রায় একযুগ ধরে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। এই পর্যন্ত প্রকাশিত তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- ‘সহস্র কোকিলের গ্রীবা’ (১৯৯১); ‘প্রান্তসীমা অনন্তদূর’ (১৯৯২); ‘ছুঁলে বিদ্যুল্লতা, না ছুঁলে পাথর’ (১৯৯৩); ‘পাখি নই আশ্চর্য মানুষ’ (১৯৯৪); ‘দশদিকে উৎসব’ (১৯৯৭); ‘বৃক্ষদের শোভা দেখে যাব’ (২০০০); ‘রূপচৈত্রের অরণ্যটিলায়’ (২০০৪); ‘পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আমার গ্রামে’ (২০০৭); ‘ঈশ্বরের নিজ গ্রহ’ (২০০৯); ‘ঘুমপ্রহরের মোমকূহক’ (২০১০); ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০১২); ‘খিলানের নিচে আলো)’ (২০১৪); ‘সহস্র চরণের ধ্বনি’ (২০১৬); ‘বাছাই ১০০ কবিতা’ (২০১৭)। ছোটগল্পগ্রন্থ: ‘মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প’ (২০০৫)। প্রবন্ধগ্রন্থ: ‘প্রহরের প্রস্তাবনা’ (২০১৫), ভ্রমণকাহিনী: ‘বিলেতের দিনলিপি’ (২০১৭)। অনুবাদ: Poems of Mujib Erom (2014)। সম্পাদনা : Postmodern Bangla Poetry 2003 (2003); (with Tushar Gayen and Samir Roychowdhury)।
কামরুল হাসান যেহেতু ভ্রমণগদ্য লেখেন, সেহেতু একজন অনুসন্ধিৎসু ভ্রমণগদ্য লেখকের মনোভঙ্গি ইতোমধ্যে আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি। তার হাতে একটা কলম ও নোটবুক। তিনি যা কিছু প্রয়োজন ইচ্ছেমতো টুকে নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, প্রয়োজন মতো ছবিও তুলে নিচ্ছেন ফটাফট। তার কৌতূহলী এই অভীপ্সা একজন তরুণ লেখক হিসেবে আমাকে আন্দোলিত করেছে বৈকি। কামরুল হাসান ও সেঁজুতি বড়ুয়া দু’জনেই ইতোপূর্বে ভারতভ্রমণ করেছেন। আমিই প্রথম যাচ্ছি। ফলে তাদের দু’জনের চেয়ে আমি যে ভ্রমণবিষয়ে ঈষৎ উত্তেজনাপ্রবণ অবস্থায় আছি, সেটা মোটেও দুর্লক্ষ্য নয়। কামরুল ভাইকে সঙ্গে পেয়ে আমার বাড়তি পাওনা এই- তিনি ভারতের বিখ্যাত স্থান ও স্থাপনাগুলো সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল। কথায় কথায় তিনি সেসব বলে যাচ্ছেন। আমি আর সেঁজুতি মুগ্ধ হয়ে শুনি।
কবিতার পথে পথে-২॥ ফারুক সুমন
সেঁজুতি বড়ুয়া আমার সমবয়সী কবিবন্ধু। তার সঙ্গে ইতোপূর্বে আমার সাক্ষাৎপরিচয় ছিল না বললেই চলে। তবে তার কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়েছি। সেসুবাদে তিনি আমার পরিচিতই বলা যায়। কারণ লেখকের লেখা কমবেশি লেখকের পরিচয় বহন করে। ভোর ৫টায় এয়ার ইন্ডিয়ার অন্য একটি বিমান কলকাতা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দর থেকে দিল্লির উদ্দেশে উড়াল দেয়।
ঢাকা থেকে কলকাতায় আসার সময় রাতের অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাইনি। সেজন্যে মনে কিছুটা খেদ ছিল বৈকি। এখন বোধহয় সেই খেদ কিছুটা লাঘব হবে। কারণ ধীরে ধীরে সূর্যের ঈষৎ সোনালি রোদ ঠিকরে পড়ছে শৈলচূড়ায়। এই প্রথম বিমানের ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখছি বিস্ময় জাগানিয়া সুউচ্চ পাহাড়ের শীর্ষদেশ। আমরা তিনজন পাহাড় দেখে ক্ষণে ক্ষণে উচ্ছ্বসিত হয়ে মুগ্ধমুহূর্ত যাপন করছি। কলকাতা থেকে দিল্লির যাত্রাপথে সময় লেগেছে দুঘণ্টা। এই যাত্রার অর্ধেক পথজুড়ে আমরা দৃশ্যমান পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সূর্যালোকের স্বর্গীয় দৃশ্য উপভোগ করেছি। নিশ্চল পাহাড়কে মনে হচ্ছিল ধ্যানমগ্ন ঋষি। সুউচ্চে থেকে তিনি পৃথিবীর কর্মযজ্ঞ পর্যবেক্ষণ করছেন। কবি কামরুল হাসান মানচিত্রের ভৌগোলিক হিসেবনিকেশ শেষে আমাদের নিশ্চিত করতে চাইছেন যে এটাই হিমালয়। তবে এই পথে যারা নিয়মিত যাত্রী। তাদের চোখে এসব নিয়ে তেমন কোনো কৌতূহল নেই। অনেকেই নাকডেকে ঘুমাচ্ছেন। কেউ কেউ আমাদের এই অতিউৎসাহী পাহাড়দর্শনের মনোভাব আধো ঘুমজাগরণ চোখে নিরীক্ষণ করছেন। অবশ্য সেসবে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমরা কবি। আমাদের বহুমাত্রিক বিস্ময়ের বুদবুদ থাকবেই। কিছুক্ষণ পর আবারো প্রভাতকালীন নাস্তা এসে গেছে। ট্রলিতে করে পায়েস, চা-সহ আরো বিভিন্নরকম উপাদেয় খাবার খেয়ে নাস্তা পর্ব শেষ হলো।
কবিতার পথে পথে-১॥ ফারুক সুমন
আমরা আর ঘন্টাখানেক পরে দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করবো। দিল্লি ভারতের একটি সুপ্রসিদ্ধ প্রদেশ এবং রাজধানী। আয়তনে বিশাল একটি দেশ ভারত। আয়তনে বিশ্বের ৭ম এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারত। এখানে আছে মরুভূমি, আছে পাহাড়, আছে সমুদ্রের বিচিত্র সমন্বয়। পাহাড়, অরণ্য, মরুভূমি এবং সমুদ্রের সমন্বয়ে এমন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ পৃথিবীতে দুর্লভ। শুধু তাই নয়; জনসংখ্যা ১২১ কোটির বেশি। এরা ৪৬৩৫টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। আহারবিহার, ধর্মপালন, জীবনযাপন, ভাষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। চন্দ্রবংশীয় পৌরাণিক হিন্দু রাজা দুষ্মন্ত-শকুন্তলা-সুত বিখ্যাত নৃপতি ‘ভরত’ শব্দ থেকে ‘ভারত’ নামকরণ করেন। ‘দিল্লি হচ্ছে অতীত আর বর্তমান ভারতের প্রতীক।’ দিল্লি সম্পর্কে এমন মর্যাদাপূর্ণ মন্তব্য লোকসমাজে প্রচলিত আছে। প্রাচীন নগরী Dhillika বা কিংবদন্তি রাজা Dillu থেকে ‘দিল্লি’ শব্দটি এসেছে। সেভাবেই দিল্লির নামকরণ।
চলবে…