[পর্ব-২]
‘আজ থেকে বিশ বছর পর আপনি এই ভেবে হতাশ হবেন যে, আপনার পক্ষে যা যা করা সম্ভব ছিল, তা করতে পারেননি। তাই নিরাপদ আবাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ুন। আবিষ্কারের জন্য যাত্রা করুন, স্বপ্ন দেখুন আর শেষমেশ আবিষ্কার করুন।’ [মার্ক টোয়েন]
অবশেষে বিকেল ৫টা নাগাদ পৌঁছলাম। আমাদের ফ্লাইট সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় হলেও বিশেষ কোনো কারণে বিমান আকাশে উড়াল দিয়েছে বিলম্বে। বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পেরেছি এই ফ্লাইটে কবি সেঁজুতি বড়ুয়াও যাচ্ছেন। ভালোই হলো। আমরা তবে তিন জন কবিতার মুখরতায় ভ্রমণ করবো।
ইমিগ্রেশনে একটা মজার ঘটনা ঘটে। আমি ও কবি কামরুল হাসান; দু’জন ইমিগ্রেশনের দুই কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। অফিসারের বাতচিত শেষে কামরুল ভাই কাউন্টার পেরিয়ে যান। আমার কাউন্টারে বসে আছেন বয়সে তরুণ ইমিগ্রেশন অফিসার। তিনি আমার পাসপোর্ট দেখছেন। এই ফাঁকে আমি ভাবলাম তরুণ অফিসারকে একটু বাজিয়ে দেখি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বললাম, আমরা তিন জন একসঙ্গে দিল্লি যাচ্ছি। যদি সম্ভব হয়, বিমানে আমাদের সিট পাশাপাশি দেবেন প্লিজ। একথা শুনে তার মুখে একগাল উপহাসের হাসি। তিনি তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কনস্টেবলকে ডাক দিলেন। আমাকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে কিছুটা উপহাসের ভঙ্গিতে বললেন, ‘পাশাপাশি সিট চায়। দিতে পারবেন?’ এবার পুলিশ কনস্টেবলও আমার দিকে তাকিয়ে হো হো করে হাসলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করেন আপনি?’ বললাম, একটা কলেজে পড়াই।
-তাহলে এটা জানেন না? সিট দেবে বিমানের লোকেরা?
-ও আচ্ছা।
এবার জিজ্ঞেস করলেন, কোন কলেজে পড়ান?
বললাম বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ। এবার তরুণ অফিসার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমি তো এই কলেজের ছাত্র ছিলাম। ২০০৮-এ এইচএসসি পাস করেছি।
তিনি আমার সারল্যভরা কথা শুনে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক ঠিক গুছিয়ে…
আমি বললাম, তাই নাকি? আমি ২০১২ সালে এখানে যোগ দিয়েছি। ফলে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এবার তিনি প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন অধ্যক্ষ ও বিভিন্ন স্যারের কথা জানতে চাইলেন। আমিও বললাম। কাজ শেষে তিনি আমার পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘সরি স্যার। আপনার সাথে বেয়াদবি করে ফেলেছি।’
-ব্যাপার না। তবে আমাদের মতো যাত্রীদের সঠিক তথ্য জানানো আপনাদের দায়িত্ব। কিন্তু আপনারা উপহাস করলেন। এখানে শিক্ষিত অশিক্ষিত বহু মানুষ আসবেন। আর যাই হোক আপনারা তাকে উপহাস করতে পারেন না। এবার তিনি আবারও সরি বলে হ্যান্ডসেকের জন্য হাত বাড়ালেন। আমিও হ্যান্ডসেক করার সময় হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললাম, আপনাকে আরও ধৈর্যশীল হতে হবে অফিসার। তিনি মৃদু হাসলেন।
এবার লাগেজ ও সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি হবে। সেজন্যে চেক-ইন কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম।
সেখানেও আরেক ঘটনা ঘটে। স্ক্যানিং মেশিনে দেওয়ার পরেও কনভেয়ার বেল্ট থেকে আমার ব্যাগটি আলাদা করে পাশের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। এবার আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। আসামির মতো আমাকেও ডেকে নেওয়া হলো সেই কক্ষে। আমার সমবয়সী একজন আমাকে বললেন, ‘ভয়ের কিছু নেই স্যার। চাবি দিন এদিকে। ব্যাগের লক খুলতে হবে।’ আমি চাবি দিলাম। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। বাসা থেকে আমার স্ত্রী এত যত্ন করে নিপুণ হাতে ব্যাগটি গুছিয়ে দিয়েছেন। সেই ব্যাগ এখন এলোমেলো হয়ে যাবে! আমি তাকে বললাম, ভাই আমি ব্যাগ গোছাতে পারি না। ভীষণ আনাড়ি। আমার স্ত্রী যত্ন করে ব্যাগটি গুছিয়ে দিয়েছেন। প্লিজ, বেশি এলোমেলো যেন না হয়।’ তিনি আমার সারল্যভরা কথা শুনে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক ঠিক গুছিয়ে দেবো।’
এবার এক এক করে ব্যাগে থাকা কাপড়-চোপড় নামিয়ে রাখলেন। ব্যাগের তলায় হাত দিয়ে বের করে আনলেন আমার নিজের লেখা বই। বললেন, ‘এগুলো কী?’ বললাম, দেখতেই তো পাচ্ছেন। তিনি পৃষ্ঠা ওল্টাতে লাগলেন। গ্রন্থের শেষে কভারে আমার ছবি দেখে মুখের দিকে বারবার তাকাচ্ছেন। বললেন, ‘এটা আপনার ছবি?’
-হ্যাঁ, আমার ছবি।
-আপনি কবিতা লেখেন? আপনি কবি?
-লিখি। তবে কবি হতে পেরেছি কি না, জানি না।
আমরা লাউঞ্জ থেকে দুর্দান্ত আপ্যায়ন এবং খোশগল্প শেষে ধীরেসুস্থে বিমানে গিয়ে বসি। এই প্রথম বিমানে চড়েছি
ব্যাগ চেক করা শেষ। এবার তিনি আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছেন। দেখে খুশি হলাম। আমার ব্যাগটি তিনি যত্ন করেই গুছিয়ে দিলেন। বললাম, ধন্যবাদ আপনাকে। এবার তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আপনি ফেসবুক ব্যবহার করেন?’ হ্যাঁ করি। কিন্তু কেন ভাই? তিনি বললেন ‘আমিও টুকটাক কবিতা লিখি। তাই আপনার সাথে যুক্ত থাকতে চাই।’ বললাম ইংরেজিতে ফারুক সুমন লিখে খুঁজলেই পাবেন। ধন্যবাদ।
ইমিগ্রেশন ও বোডিংপাস সেরে অপেক্ষা করছি। বিমান ছাড়ার দেরি বিধায় কবি কামরুল হাসান আমাকে ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে গেলেন। এতক্ষণে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জৌলুসপূর্ণ অঞ্চল চোখে পড়েছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক তাদের ক্রেডিট কার্ডধারী ব্যক্তিদের জন্য এই জমজমাট ও জম্পেশ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে। মোটেও মাগনা নয়। কবি কামরুল হাসান আমাকে নিয়ে যান ইস্টার্ন ব্যাংকের স্কাই লাউঞ্জে। এখানে আমি তার অতিথি। নিয়ম হচ্ছে একজন কার্ড হোল্ডার কেবল একজন সঙ্গীকে অতিথি হিসেবে নিতে পারবেন। যিনি বুফে আয়োজনে ইচ্ছেমতো খেতে পারবেন। সুসজ্জিত কক্ষে আমরা মুখোমুখি বসি। প্রথমেই আমরা আপেলের জুস নিলাম। পান করতে করতে কামরুল ভাই সেল্ফি তুললেন। আমিও তুললাম। তাৎক্ষণিক একটি ছবি আমার স্ত্রীকে ভাইবারে পাঠিয়ে দিলাম। আপেল জুস দেখে স্ত্রী সন্দেহ করলেন। অন্য কোনো দামি লালপানি ভেবে সন্দেহের তীর সোজা ছুড়ে দিলেন। খোঁচা দিয়ে ফিরতি ম্যাসেজ পাঠালেন, ‘কী ব্যাপার, দেশের বাইরে না যেতেই লালপানি শুরু হয়ে গেছে?’
তিনি ভালো করেই জানেন ওসবে আমার আগ্রহ নেই। তবু বিমানে ওঠার আগে আমার সঙ্গে কিঞ্চিৎ রসিকতা করলেন। একমুঠ সমপরিমাণ ভাত ও কয়েক টুকরো গরুর মাংস নিলাম। ডিনারের আগে হালকা খেয়ে নেওয়া ভালো। সত্যি, ভ্রমণের শুরুতে এমন অপ্রত্যাশিত আপ্যায়ন পেয়ে আমি আপ্লুত হলাম। আমার মনে ভর করেছে ঈদের সকাল। সেঁজুতি বড়ুয়া ইতোমধ্যে কামরুল ভাইকে কল দিয়ে জানিয়েছেন। তিনি এয়ারপোর্ট এসে গেছেন। যাই হোক, ইচ্ছেমাফিক অন্যান্য খাবার খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। সেঁজুতি বড়ুয়া কিছুটা বিলম্বে এলেন। তার স্বামী ও সন্তান তাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। আমরা লাউঞ্জ থেকে দুর্দান্ত আপ্যায়ন এবং খোশগল্প শেষে ধীরেসুস্থে বিমানে গিয়ে বসি। এই প্রথম বিমানে চড়েছি। আমার মনে অন্যরকম অনুভূতি। উৎসুক চোখে দেখছি সবকিছু।
চলছে…