॥পর্ব-৬ (ক)॥
আমার খুব ইচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের ‘বাঁশিওয়ালা’ কবিতাটি বিনির্মাণ করি। অথবা ‘রূপ নারানের কূলে’, অথবা ‘প্রথম দিনের সূর্য’, অথবা ‘সাধারণ মেয়ে’ কিংবা ‘হঠাৎ দেখা’ বা ‘কৃষ্ণকলি’—এসব পড়ি। সাদামাটা রিনিরিনি কিনিকিনি কণ্ঠ আমার নয়। সাধারণত নারীর কণ্ঠ যেমন হয় বা মানুষ যেমন ভেবে থাকে, তেমন নয়। আমার ভয়েজে কবিতাগুলো কেমন আসবে, সে সম্পর্কে আমি সন্দিহান থাকি বরাবর। কিন্তু আমাকে এসব কবিতার একটিও দেওয়া হয় না। বিনির্মাণ করার জন্য দেওয়া হয় ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’। দেওয়া হয় ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের শেষ অংশেজুড়ে থাকা ‘নির্ঝরীনি’। প্রয়োজনাটির পরিচালক স্বয়ং স্রোত আবৃত্তি সংসদের কর্ণধার মাহিদুল ইসলাম। যিনি এ যাবতকালে আমার কবিতা আবৃত্তির একমাত্র গুরু। আমি তার সঙ্গে কোনো ডুয়েট তখনো পড়িনি। গ্রুপে শান্তা আপা, শিলাদি, বিজু আপা, রোজী আপা, তন্দ্রাদিরা অনেক পড়েছেন। সবচেয়ে বেশি শুনেছি শিলাদির (শিলা মোস্তাফা) সঙ্গে তার দ্বৈত আবৃত্তি। কী অসাধারণ সব প্রেমের কবিতা পড়া আছে তাদের দুজনের! না শুনলে বোঝা যাবে না। কিন্তু আজ মাহিদুল ইসলামের সঙ্গে আমি! পূরাণ আশ্রিত পৃথিবীব্যাপী বহুল পঠিত মহাভারতের বীরযোদ্ধা কর্ণ চরিত্রটি করবেন মাহিদুল ইসলাম। আমাকেই নির্বাচিত করলেন কর্ণের আসল জন্মদাত্রী, পঞ্জপাণ্ডবের মা, রাজমাতা কুন্তীর চরিত্রে। ওই বয়সের জন্য ভীষণ মারাত্মক আর ভারবাহী একটি চরিত্র কুন্তী। জানতে হবে মহাভারত। জানতে হবে কৌরব পাণ্ডবের যুদ্ধের বৃত্তান্ত। জানতে হবে কর্ণের জন্মরহস্য। জানতে হবে রাজমাতা কুন্তীর রাজনৈতিক কূটচাল-কূটকৌশল। আর তা যদি মাহিদুল ইসলামের মতো গুরুগম্ভীর দুর্দান্ত ভরাট কণ্ঠের একজন পরিণত মানুষের সঙ্গে পারফর্ম করতে হয়, পরিণত আর সুপরিচিত আবৃত্তিকারের সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে হয় একই কবিতায় একই মঞ্চে, তাহলে তো রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং। আমি চ্যালেঞ্জটি নিলাম। বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে কিছু ধারণা তো ছিলই কুরুপাণ্ডব কিংবা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বিষয়ে। এবার শুরু হলো কবিতার ডিসেকশন, পর্যালোচনা-আলোচনা, নতুন করে আবার মহাভারত ওলটপালট করা, মহাভারতের যাবতীয় চরিত্র ঘেঁটে ঘেঁটে পড়া। একেকটি চরিত্রের সম্পর্ক- জটিলতা-কুটিলতার সঙ্গে দিনরাতের আপস। সে এক ব্যাপক আর বিস্তৃত কর্মযজ্ঞ। একদিকে একা একা নিজে নিজে ঘরে বসে, অন্যদিকে প্রতিদিন টিএসসিতে বিকেলে প্র্যাকটিস। প্র্যাকটিস তো নয়, এ যেন গভীর ধ্যান, গভীর চিন্তা, যুদ্ধ বোঝা, মাতৃহারা হৃদয়ের হাহাকার বোঝা, নারীর ছলনা-মায়া-রাজনীতি; যুদ্ধ-কূটকৌশল-রাজ্যলোভ-রাজ্যলাভ, জয়-পরাজয়, যশ-খ্যাতি-লালসা-বাসনা অমানবিক নারীমাতৃহৃদয়ের অনুতাপবিহীন, সন্তাপহীন সুতীব্র আত্মহনন আত্মদংশনের ওপরে অধিষ্ঠিত দুর্বার কামনার জয়, দুর্দান্ত এক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ইতিহাসে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ি আমি বারেবারে। মহাপরাক্রম একজন বীরের নিজেকে গড়ে তোলার পথে অজস্র উপহাস উপেক্ষা ক্রুরতা শঠতা আত্মদহন অভিমান আর আত্মহননের বিপুল বৈভবে ভরা আপাত পরাজয়ের বিপুল কাহিনীর উত্তাল স্রোতে পড়ে আমি যেন নির্বাক দিশেহারা। রিনিকিঝিনিকি সুরে প্রেমের ডায়লগ পড়া আর ছলনায় সন্তাপে আবেগে হারানো সন্তানকে বুকে টেনে নিয়ে বাকি পাঁচ সন্তানকে যুদ্ধে জয়ী করার অভিসন্ধি নিয়ে উচ্চারণ করা রাজমাতার একেকটি শব্দ আর বাক্যের প্রয়োগ এককথা নয়। এই সুদীর্ঘ কবিতাটির অন্তরালে যে মানবিক বোধের প্রচ্ছায়া পরিব্যপ্ত রয়েছে, যা প্রকৃত মহাভরতের থেকে বেশ খানিকটা ভিন্নরূপে কবিতার অলক্ষে প্রবাহিত হয়েছে। সূর্যের ঔরসে কুমারীমাতা কুন্তীর গর্ভে মহাবীর কর্ণের জন্ম। আমরা কে না জানি? কিন্তু সেই জন্ম, জন্ম নেওয়া সন্তান আর তার মায়ের মিলনের মুহূর্তটিতে কী কী ঘটে গিয়েছিল আমরা কে কতটা জানি? পুরনোকে নতুন করে নতুন অবয়বে নতুন অধিষ্ঠানে আহ্বান করা কিংবা অধিষ্ঠিত করা, এই তো চিরায়ত সাহিত্যিকের কাজ। কবির নতুন ভূমির খোঁজ, নতুন ফসল উৎপাদনের কলকাঠিই তো কবিতা—চিরায়ত সাহিত্য। তারই গভীরতা আর ব্যাপকাতার এক অনুসন্ধান ছিল ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ কবিতাটির বিনির্মাণ।
মহাভারতের বীর অথচ কুখ্যাত কর্ণকে যেভাবে এঁকেছেন কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যে মানবিক আখ্যান এর পেছনে প্রলম্বিত রয়েছে, তা বুঝতে হলে প্রথমে খুব সংক্ষেপে হলেও কিছুটা ধারণা দিয়ে যেতে হবে আমাকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ন্যূনতম ইতিহাস সম্পর্কে। মহাভারতের কর্ণ শরীরে বসু অর্থাৎ স্বর্ণ নিয়ে জন্মেছিলেন বলে তার আর এক নাম বসুষেণ। শিশুকাল থেকেই ধর্মপরায়ণ সত্যবাদী কর্ণ মহাবীর কিন্তু যৌবনে উপনীত হতে হতে তিনি ব্যক্তিত্বহীন ধৃতরাষ্ট্র আর তার প্রতিহিংসাপরায়ণ পুত্র দুর্যোধনের প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন শঠ, কখনো কখনো প্রতারক, কখনো উন্নাসিক, কখনো নিজস্ব তেজের দীপ্তিতে অতি অহঙ্কারী, এমনকি দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণেরও ইন্ধনদাতা। কিন্তু জননীর প্রার্থনা তিনি ফেরাতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও তিনি মহাবীর। কিন্তু মা বেটার পারস্পরিক সংলাপের ভেতরে ভেতরে গুমরে ওঠা অভিমান আর কান্নার যে ব্যাপক জল প্রবহমান, তার একটা সারবস্তু দাঁড় করাতে গেলে প্রথমে সেই বিশাল আখ্যানের কিয়দংশ হলেও আমাকে জানিয়ে যেতেই হবে।
কুন্তীকে বর দিয়েছিলেন মহর্ষী দুর্বাসা। সেই বরের সত্যাসত্য পরীক্ষা করতে গিয়ে কুন্তী আহ্বান করেন সূর্যদেবকে। তারপরই হতবিহ্বল চিত্তে সূর্যদেবের হাত থেকে মুক্তি চাইলেও মুক্তি পাননি। ফলে সূর্যের ঔরসে গর্ভধারণ করেন এবং কুমারী অবস্থায়ই জন্ম দেন কর্ণকে। অসাধারণ রূপ লাবণ্যে পূর্ণ, সূর্যের ত্যাজ ও দীপ্তি চাঁদের কান্তি দুটোই ছিল কর্ণের জন্মগত প্রাপ্তি। কুন্তী ধাত্রীর সহায়তায় জন্মের পরপরই কর্ণকে গোপনে ভাসিয়ে দেন গঙ্গার জলে। ভাসতে ভাসতে সে এসে পড়ে চম্পাপুরীতে রাধা আর অধিরথের কোলে—যারা ছিলেন নিঃসন্তান, দরিদ্র। সূত অধিরথ ধৃতরাষ্ট্রের প্রিয় বন্ধুও বটে। তাদেরই আদরে ভালোবাসায় দিনে দিনে বেড়ে ওঠেন কর্ণ। ক্ষত্রিয় রক্ত শরীরে ধারণ করে বড় হতে থাকেন আর তার চরিত্রে ফুটে উঠতে থাকে ক্ষত্রিয়ের সমস্ত লক্ষণ। কর্ণও একসময় ব্রহ্মাস্ত্র বিদ্যা শেখার জন্য আযার্য দ্রোণের কাছে প্রার্থনা জানান। কিন্তু দ্রোণ তার প্রিয় শিষ্য অর্জুনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কর্ণকে শিক্ষা দিতে অস্বীকৃতি জানান। সঙ্গে তিনি এও জানিয়ে দেন ক্ষত্রিয় না হলে আর নীচু জাতের কেউ এই বিদ্যা শিক্ষা করতে পারবে না। এই থেকে কর্ণ অবহেলা অপমান আর উপহাসের পাত্র হতে শুরু করেন। এই উপহাস অবহেলা আর বঞ্চনা তাকে পাণ্ডবদের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ ও জিঘাংসু করে তোলে। অন্যদিকে, পরবর্তী সময়ে হস্তিনার রাজা পাণ্ডুকে স্বামী হিসেবে বরণ করে কুন্তী হয়ে ওঠেন রাজমাতা। পাণ্ডুর অভিশপ্ত হয়ে বনবাসে পাড়ি জমান। পাণ্ডুর সঙ্গে কুন্তী আর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রীও বনবাসে পাড়ি জমান। অভিশপ্ত পাণ্ডু রমণে কিংবা কামেপ্রেমে সন্তান জন্মদানে বিপন্ন। কিন্তু পুত্রলাভে তিনি তৃষাতুর। অবশেষে পাণ্ডুর ইচ্ছেতে কুন্তী আবারও দুর্বাসার মন্ত্র পড়ে ধর্মদেব পবণদেব ও ইন্দ্রদেবকে আহ্বান করে ক্ষেত্রজ সন্তান হিসেবে যথাক্রমে যুধিষ্ঠির, ভীমসেন ও অর্জুনকে পুত্র হিসেবে জন্ম দেন। পরবর্তী সময়ে তারই সতীন মাদ্রীও দুই ক্ষেত্রজ সন্তান নকুল ও সহদেবের জন্ম দেন। মুণির কথা অমান্য করে কামে প্রবৃত্ত হওয়ার কারণে পাণ্ডু মারা যান। নকুল ও সহদেবকে কুন্তীর কাছে সঁপে দিয়ে পাণ্ডুর সঙ্গে সহমরণে চিতায় ওঠেন মাদ্রী। এই হলো পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম আখ্যান। অন্যদিকে জেষ্ঠ্যপুত্র কর্ণ হস্তিনা রাজ্যে ধৃতরাষ্ট্রের প্রিয়পাত্র। কিন্তু তার জন্ম পরিচয় অজানা। সবাই জানে সূতপুত্র সে। অথচ তার প্রজ্ঞা যুদ্ধচালনা অস্ত্রচালনা রূপ সৌন্দর্যে মুণি ঋষিরা তাকে ক্ষত্রিয় বংশের বলেই সন্দেহ পোষণ করেন। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্যোধনের অনুগত কর্ণ। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর যখন কুন্তী বনবাস থেকে ফিরে আসেন পঞ্চপাণ্ডবকে নিয়ে হস্তিনানগরে, ততদিনে তাদের অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা যশ আর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। অর্জুনের সমকক্ষ যুদ্ধবাজ কিংবা বীর আর কেউ নেই। ধৃতরাষ্ট্র তাই পঞ্চপাণ্ডবকে সুনজরে দেখতে পারেননি। জন্মান্ধ হওয়ার কারণে ধৃতরাষ্ট্র রাজা হওয়ার ক্ষমতারহিত। তারই বৈমাত্রেয় ভাই পাণ্ডুর উত্তরাধিকার হিসেবে পাণ্ডবেরাই রাজ্যের উত্তরাধীকারী। এই রাজ্যলোভ আর যশলোভ নিয়েই মহাভারতের যাবতীয় কূটচক্র–কূটকৌশল।
চলবে…
কবিতার ডিসেকশন: নির্মাণ-৫॥ শাপলা সপর্যিতা