পর্ব-দুই
‘পদ্য বাউল’ প্রোডাকশনটি করতে করতে আমার নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সঙ্গে। বস্তুত ব্যক্তি শক্তির সঙ্গে, তার অন্তর্জগৎ, ভাবনা, ব্যথা, প্রেম ও তার বিরহের সঙ্গেও। হয়তো এমন বিশদ ব্যাখ্যা, কবিজীবনের এমন দারুণ ব্যবচ্ছেদ না হলে আমার এই ভালোলাগার বোধটা তৈরিই হতো না। তার যাতনার সঙ্গে আমার যাতনার বোধ এক না হলে হয়তো এমন করে অত আদরে কবিতাটি বিনির্মাণ করা সম্ভব হতো না। হয়তো আবৃত্তি করা সম্ভবই হতো না। আজকাল প্রায়ই কবিদের বলতে শুনি আবৃত্তিকাররা কবিতা নষ্ট করে ফেলে। কবিতার অন্য রূপায়ণ করে দেয়। আবৃত্তিকারদের আজকালকার কবিরা বলতে গেলে শত্রু স্থানীয় করে রেখেছে, অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, ঠিক তারই উল্টো এক রূপ। কবিতার মতো কবিতা হলে প্রাণে প্রাণে যোগ হয়। কবি ও আবৃত্তিকারের যোগ হয়। জীবিতের আর মৃতের যোগ হয়। কবি ও সাধারণ শ্রোতা অর্থাৎ বলতে চাই কবি ও সাধারণ মানুষের যোগ হয়। একাল-সেকালের দারুণ সেতুবন্ধন তৈরি হয়। আর কে না জানে, যোগ মানেই সমৃদ্ধি। যোগ মানেই সমৃদ্ধতর। যোগ মানে এগিয়ে যাওয়া। যোগ মানেই উচ্চতর মার্গে অধিষ্ঠান। এ সম্পূর্ণ আমার একার উপলব্ধি। কারণ আমি দীর্ঘ ২৬ বছর আবৃত্তি নিয়ে সঙ্গে কাজ করেছি।
সেই ১৯৯২ সাল থেকে শুরু হয়েছিল। চলেছে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ে আমি স্টেজে পারফর্ম করতে উঠেছি হাতেগোনা কয়েকটি কবিতা নিয়ে। যা ভালো লাগেনি, যে বেদনার সঙ্গে আমার বেদনা মেলেনি, সে বেদনার কথা আমি শ্রোতার সামনে তুলে ধরার সাহস করতে পারিনি। যে কবিতা ভালো লাগেনি, ভালোবাসতে পারিনি যে কবিতা, সে কবিতায় বিহার আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এ দীর্ঘ সময় ধরে আমি যেসব কবির কবিতা আবৃত্তি করেছি, তাদের প্রতি আমার দারুণ ভালোবাসা আর তাদের জীবনবোধের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা বেড়েছে। কারণ, যে কবিতার ব্যবচ্ছেদ হয়নি, সে কবিতা আমি বুঝতে পারিনি। সে কবিতা পড়তেও আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছি। সেসব কবিতা আমি মুখস্থও করতে পারিনি। আর তাই যে কবিতা ভালো লেগেছে, সে কবিতাটি আমার কখন যে মুখস্থ হয়ে গেছে, জানতেও পারিনি। স্টেজে নিঃশঙ্কচিত্তে পড়ে গেছি একটানা। সামনে রাখতে হয়নি কোনো কাগজ। ভালো লাগার সেসব কবিতাই কেবল আমি আবৃত্তি করতে পেরেছি। তেমনই একটি কবিতা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘চাবি’। এই কবিতাটি আমাকে তৈরি করতে সার্বক্ষণিক সাহায্য করেছিলেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ইশরাত নিশাত। তিনি চেয়েছিলেন এই কবিতাটি পড়া কিংবা আবৃত্তি হবে একেবারে হুইসপার টোনে। একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো করে। নিজের হাস্কি ভয়েজে যেটা আমার কাছে মনে হয়েছিল দুঃসাধ্য। তিনিই সম্ভব করে তুলেছিলেন সেটা।
‘চাবি’—যেখানে কবি তার মনের গভীর অনুভবের বর্ণনা করেছেন, হারিয়ে গেছে যে প্রিয়া, তার কাছে চিঠি লিখতে বসেছেন। যেখানে প্রিয়ার ফেলে যাওয়া একটি চাবি ফেরত দেওয়ার অনুষঙ্গ নিয়ে চিঠিটির লেখা শুরু। কিন্তু চাবির কথা লিখতে বসে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে প্রিয়ার মুখ, তার তোরঙ্গের রঙ, থুতনির ওপর প্রিয় তিল। যে কথা বলা যায় না আর কাউকে। যে ছবি মুছে ফেলা যায় না মন থেকে। যা অবান্তর এখন। প্রিয়া দূর দেশে। এখানে দূর দেশের অর্থ ব্যাপক। দূরমন, দূরপ্রেম, দূরমানুষ, দূরসঙ্গ, দূরলিপ্সা। এই যে গোপন ব্যথা—এই যে গোপনে স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে অবিস্মরণীয় প্রিয়ার মুখ দেখার গোপন বাসনা, হারিয়ে যাওয়া চাবি ফেরত দেওয়ার অজুহাতে চিঠি লিখতে বসার ছল, এ কি চিৎকার করে বলার? এ কি জোরে জোরে জানানোর? এ যে একার। এ নিজের। এ ভেতরের। এ দৃশ্যমান হওয়ার নয়। এ শ্রবণযোগ্য করার নয়। তাই এর টোন হবে একার। নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো। এর আবেদন হবে চিরন্তর ব্যথার। শাশ্বত রোমান্টিক ভাবের অসাধারণ সরঞ্জামের যোগে এ কবিতাটি লিখিত। পড়তেও হয় তেমন করে।
‘চিঠি তোমায় হঠাৎ লিখতে হলো’—এই বাক্যটিকে সাদা চোখে দেখা যায়, এটি একটি ইনফরমেশনের মতো করে। কিন্তু ভেতরে কী যে এক আর্তি রয়ে গেছে, তা কেবল ব্যবচ্ছেদেই বোঝা সম্ভব। তা কেবল একজন সহৃদয়বান আবৃত্তিকারই বুঝতে পারেন। যখন একটি কবিতা নিয়ে দিনের পর দিন আবৃত্তিকার ভাবতে থাকেন, জপতে থাকেন, তখন মাথার ভেতর প্যাথিড্রিনের মতো সম্মোহন তৈরি করে একটি কবিতা। কবি এখানে বিক্ষুব্ধ। তার মন অন্য আর কাউকে চাইছে না। অন্য কারও সঙ্গ তাকে সুখী করে না। তখন প্রিয়ার সঙ্গে কথা বলাটা তার জন্য বাধ্যকর হয়ে ওঠে। কিন্তু নেই সে। কোথাও নেই। না সামনে। না কোনো যোগাযোগে। তাই চিঠি এখনই লিখতেই হলো। এক্ষণই না হলে বুঝি প্রাণওষ্ঠাগত।
‘লিখিও, উহা ফেরত চাহো কিনা’—পঙ্ক্তিটি কবিতার দুই জায়গায় আছে। এই যে দুটি বিষয়ের বোধ প্রকাশের আর গ্রহণের আকাশ আর পাতাল পার্থক্য, তা আবৃত্তিকার ছাড়া কে ফুটিয়ে তুলবে? এক জায়গায় লিখেছেন তোরঙ্গ খোলার যে চাবিটি প্রিয়া ভুল করে ফেলে গেছেন, তা কি তিনি ফেরত চান? এটি একটি সাধারণ প্রশ্ন। আর একটি জায়গায় লেখা আছে স্মৃতির ভেতর প্রিয়ার নিজের ফেলে যাওয়া মুখ রয়ে গেছে কবির কাছে। যেটি অবান্তর। অর্থাৎ যার কোনো প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো প্রাপ্তি। সেই শেষ সম্পদ সবিশেষ সম্বল কবির, সেটিও প্রিয়া ফেরত চান কি না! এই যে দুটো লাইনে প্রাণের আকাঙ্ক্ষার ব্যাপক ফারাক, দুস্তর ব্যবধান, দুরন্ত কামনার প্রতীক্ষা আর অভিমানের প্রকাশ, তা কেবল আবৃত্তিতেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। আর এই কবিতার ডিসেকশন করতে করতেই তৈরি হয়েছিল এক অসাধারণ শ্রবণযোগ্য দারুণ ব্যথাতুর অসাধারণ উপস্থাপনা।
আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোল?থুৎনি ’পরে তিল তো তোমার আছে
এখন? ও মন, নতুন দেশে যাবি?
চিঠি তোমায় হঠাৎ লিখতে হলো।চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো-
লিখিও, উহা ফেরত চাহো কিনা?অবান্তর স্মৃতির ভেতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু ঝলোমলো
লিখিও উহা ফিরৎ চাহো কিনা?
(চাবি: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
তারপর বহুদিন পড়েছি কবিতাটি। নানা জায়গায়, নানা অনুষ্ঠানে। বরাবর এক কথা শুনেছি—এত ছোট এত অল্প, মুগ্ধ হতে হতে কখন যে শেষ হয়ে গেলো। কবিতাটি আর একটু বড় হলে কী হতো! এরই নাম সাবলিমিশন। ক্রমোর্ধ্ব সত্তায় নিয়ে চলা কবিতা পাঠক-স্রোতাকে বেঁধে দেয় এক শাশ্বত বেদনায়। এরই নাম কবিতার আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণ, এরই নাম সম্মোহন।
চলবে…
কবিতার ডিসেকশন: নির্মাণ-১ ॥ শাপলা সপর্যিতা