[পর্ব-৩২]
অফিসে একদম মন বসে না আজকাল। অস্থির লাগে খুব। শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না মোটেই। ধকলটা কাটতে সময় লাগছে বেশ। অনেক রক্ত গেছে শরীর থেকে। তারচে বেশি গেছে মানসিক চাপ। সবকিছু মিলিয়ে তিতলির সময়টা যাচ্ছে ভীষণ টানাপোড়েনে। দীপনটা সেই যে দেশ ছেড়েছে,তারও ফেরার নাম নাই আর। ভাল্লাগে না কিচ্ছু। অসহ্য লাগে তিতলির। হাতের কাছে থাকা কাগজ-কলম নিয়ে অর্থহীন আঁকিবুকি টানে, হাবিজাবি লেখে, আবার নিজেই একটানে খসখস কাটে। জীবনের সবগুলো ভুল, সবগুলো শোচনার দাগ যদি এমনি একটানে কেটে ফেলা যেতো! যদি এমনি করে মুছে ফেলা যেতো সব!—ভাবে, আর আরও বেশি অস্থির, অশান্ত হয়ে ওঠে মনে মনে। হঠাৎ মনে হয়, অনেক দূর থেকে চেনা একটা মিউজিকের সুর ভেসে আসে। অনেক চেনা, কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারে না সহসা। কান পাতে তিতলি। কোথায় বাজছে মিউজিকটা? কোথায়? মনে মনে স্মৃতি হাতড়ায় দ্রুত, কোথায় শুনেছে মনে পড়ে না, কিন্তু কোথায় বাজছে সেটাই বা কেন ধরতে পারে না সে? মন কি বিকল হয়ে গেলো তবে! ভেবে, মাথাটা জট পাকিয়ে যেতে চায় আরও। তারপর টের পায়। হঠাৎই। হাসিও পায় ভীষণ। মিউজিকের শব্দটা আসছে টেবিলের পাশে রাখা তারই ব্যাগ থেকে। রিংটোন। মোবাইল বাজছে। নিজের ওপর রাগও হয় খুব। নিজেরই ফোন বাজছে, অথচ বুঝতে এতটা লম্বা সময় লাগলো! নিজেই নিজেকে ধমকায় তিতলি। ফোনটা বের করে। অচেনা নাম্বার। অনেকগুলো মিসড কল উঠে আছে। কলব্যাক করে। কিছুক্ষণ রিং হতেই ওপাশ থেকে কণ্ঠ ভাসে। হ্যালো, তিতলি!
চমকে ওঠে। শরীর বেজে ওঠে ঝনঝন। চেনা কণ্ঠ! ভীষণ চেনা! তরুণ! তার পাগলা ভাইটা!
কিছুক্ষণ কোনো শব্দ করতেও ভুলে যায় তিতলি। ওপাশে তরুণের শান্ত, নিরুদ্বেগ, ভরাট গলা শোনা যায় আবার। হ্যালো, তিতলি! শুনতে পাচ্ছিস?
ভাইয়া! কেমন আছিস? -উত্তেজনায় গলা কেঁপে যায় ভীষণরকম। ততক্ষণে বুকের ভেতর কোথায় একটা বান ডেকেছে, টালমাটাল দুলে উঠেছে বোধের সাঁকো।
ভালো আছি। তুই কোথায় এখন? অফিসে?
হুঁ। তুই?
তোর অফিসের নিচে!
একছুটে বের হয় তিতলি। সিঁড়ি ভাঙে হুড়মুড়। সাদা আলখাল্লা পরা, কাঁধে ঝোলা, জটাজুট মাথায় পাগড়ি পেঁচানো সাধুবাবাকে জড়িয়ে হাউমাউ কাঁদে। দারোয়ান আর পিয়ন ছেলেটা এ ওর মুখ চায়। অবাক চোখে তিতলির কাণ্ড দেখে। তরুণ অপ্রস্তুত। সস্নেহে হাত রাখে তিতলির মাথায়।
কাঁদে না বোকা। কাঁদতে নেই।—বলে ম্লান একটু হাসে।
অফিস থেকে বাসার পথটুকু নীরবেই কাটে তাদের। তিতলির চোখে তখনও স্পষ্ট জলের দাগ। দু চোখ ভেজা। তরুণের চোখ সামনে, রাস্তার চলমান যানে, স্থির, শান্ত। আড়চোখে ভাইকে দেখে তিতলি। মুচড়ে ওঠে ব্যথা। কী ভীষণ শুকিয়ে গেছে তরুণ! দেখলেই বোঝা যায় নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নাই কোনো, শরীরের ওপর ইচ্ছেমতোন অত্যাচার চলে তার। বাবার মুখটা মনে পড়ে। কান্না উছলে উঠতে চায়। বাবা মানে তো সেই শেকল বাঁধা উন্মাদ লোকটা! তবু তার প্রতিই একবুক ভালবাসা কেন যে টলটল করে এমন, কেন যে যখন তখন ঢেউ ওঠে সেই ভীষণ স্বচ্ছ জলে! অরুন্ধতীর নামটা তবু বাবাই দিয়েছিলেন। একটা প্রশ্ন আজকাল তিতলির মাথার ভেতর আলপিনের মতো ফুটতে থাকে প্রায়ই। আচ্ছা, বাবা যদি অতটাই উন্মাদ ছিলেন, অতটাই যদি পাগল ছিলেন লোকটা, তাহলে তিনি অরুন্ধতীর নামটা কী করে দিয়েছিলেন? আর হঠাৎ হঠাৎ অমন সুস্থ মানুষের মতো পুরনো দিনের স্মৃতিচারণই বা কী করে করতেন? তিতলির স্পষ্ট মনে আছে, অরুন্ধতী হওয়ার দিনকতক আগে, বাবা তাকে একাত্তরের সেই দিনটির গল্প শুনিয়েছিলেন, যেদিন ছোটকাকাকে মুক্তিসেনারা ধরে নিয়ে গেছিলো পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে এলাকার লোকদের ওপর অত্যাচারের অপরাধে। বাবা বলেছিলেন, মনে আছে তিতলির, একমাত্র বাবার অনুরোধেই সেদিন ছাড়া পেয়েছিলো ছোটকাকা, সে কারণে মুক্তিবাহিনীর অনেকেরই বিরাগভাজন হয়েছিলেন বাবা, যে জন্য পরবর্তী সময়ে বাবার চরম দুঃসময়েও তাদের কেউই প্রায় বাবার পাশে দাঁড়াননি পর্যন্ত, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, চলে গেছিলেন আড়ালে। বাবা সেদিন সেই বিশেষ স্মৃতিটাও মনে করতে পেরেছিলেন, উজাড় করেছিলেন তিতলির কাছে নিজেকে। পাকিস্তানী সেনাটির মুখে মৃত্যুভয় কী গাঢ় ছায়া ফেলেছিলো, কী ভীষণ কাতরতায় সে লোকটি জীবন ভিক্ষা চাইছিলো বাবার কাছে, বাড়িতে শিশুসন্তানের প্রতীক্ষাকাতরতা কী দুঃসহ আকুলতায় ব্যক্ত করতে চাইছিলো লোকটি, আর তার চোখদুটো! কী করুণ আর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে নিবদ্ধ ছিলো বাবার চোখে! বলতে বলতে, দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলেছিলেন বাবা। থরথর কাঁপছিলেন।
বিশ্বাস কর মা, আমি লোকটাকে মারতে চাইনি একদম। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে এত করুণা হলো আমার! এত মায়া হলো তার অপেক্ষাকাতর সন্তানটার কথা ভেবে! আমার চোখে ভেসে উঠলো তরুণের মিষ্টি, আদুরে মুখটা! আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, লোকটাকে ছেড়ে দেবো! দেশ তো স্বাধীন করবোই আমরা, আজ না হোক কাল! লোকটাকে ছেড়ে দিলে কী আর বেশি ক্ষতি হবে এমন! বরং একটা শিশু ফিরে পাবে বাবার স্নেহ!
কিন্তু আমার হাত! সে কথা শুনলো না! সে লোকটার বুকে আমূল গেঁথে দিলো ছুরি! এত রক্ত মা! এত রক্ত! কী ভীষণ লাল যে! কী গাঢ় লাল!—বলতে বলতে দুহাতে মাথা চেপে ধরেছিলেন বাবা। ভয়ানক চিৎকারে আবার শুরু করেছিলেন সেদিন পাগলামি। রক্ত! রক্ত! -বলে চিৎকার করতে করতে ঘুমিয়ে গেছিলেন একসময়। সেদিনই শেষ সজ্ঞানে তিতলির সাথে কথা বলেছিলেন বাবা। তারপর আবার আগের মতো উন্মাদ অবস্থায় ফিরে গেছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তন হয়নি আর। তিতলির আজকাল মনে হয়, যদি এখনকার মতো অবস্থা থাকতো তখন তিতলির, যদি আর্থিক সামর্থ্য থাকতো তখন তার, তাহলে, সুচিকিৎসা পেলে, বাবা নির্ঘাত ভালো হয়ে যেতেন, সুস্থ হয়ে যেতেন পুরোপুরি! কথাটা মনে হলেই ভয়ানক এক মানসিক যন্ত্রণা তাকে জাপটে ধরে ভীষণ, বাবার জন্য কিছু করতে না পারার গ্লানি তাকে তাড়া করে বেড়ায় হিংস্র হায়েনার মতো। তবু, বেকার, অসহায় তিতলি তখনও চেষ্টার তো কম করেনি কিছু! তার ক্ষুদ্র সামর্থ্যে যতটা পেরেছিলো, করতে চেয়েছিলো। পারেনি। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম ছিলো না বাবার, ছিলো ছোটকাকার নাম! আড়াল থেকে তিনি কলকাঠি নেড়েছিলেন, ফলে উপরমহল থেকে সাড়া মেলেনি বাবার চিকিৎসার ব্যাপারে। ছোটকাকা মুক্তিযোদ্ধা সেজে বাগিয়ে নিয়েছিলেন স্থানীয় আওয়ামিলীগের লোভনীয় পদ, তার ইঙ্গিত ছাড়া কিছু হওয়া ছিলো অসম্ভব। কিন্তু, যদি হাতে পয়সা থাকতো তিতলির, কে আর পথ চেয়ে থাকতো সরকারি দাক্ষিণ্যের! সে বরং ব্যক্তিগত উদ্যোগেই চিকিৎসা করাতো বাবার। সংসারে টাকা যে কত দরকারি, কত যে প্রয়োজনীয়, যত দিন যাচ্ছে ততই সেই সত্যিটা যেন প্রকট হচ্ছে আরও তিতলির চোখে, আরও বেশি ঘন হচ্ছে জীবনের প্রতি ক্ষোভ। আর শেষে, সব ক্ষোভ, ক্রোধ, গিয়ে জমা হচ্ছে ছোটকাকার ওপর। লোকটা কী করে এতটা নীচ, এতটা ঘৃণ্য হয়ে উঠলো, যখন তারই বাবার আপন ভাই সে! ঘৃণায়, রাগে বিকৃত হয়ে ওঠে তিতলির মুখ। তরুণের দিকে তাকায়। নির্বিকার, নির্লিপ্ত মুখে রাস্তার জটলা দেখছে তরুণ। মুখে উদাস বিষণ্নতার মৃদু পর্দা দুলছে।
ছোটকাকার খবর জানিস ভাইয়া?
উঁ?
চমকে তিতলির দিকে তাকায় তরুণ, চোখে জিজ্ঞাসা। অন্যমনস্কতায় তিতলির প্রশ্নটা ধরতে পারেনি সে। প্রশ্নটা আবার করে তিতলি, একই সুরে।
উপর-নিচ মাথা নাড়ে তরুণ।
হুঁ। হার্টে সমস্যা শুনেছি। ইন্ডিয়া গেছে। খুব বেশি সময় নেই সম্ভবত।
হবেই তো! কর্মফল যাবে কোথায়! ভোগ করতে হবে তো!
ছিঃ তিতলি। এসব বলতে নেই। বাদ দে।
তরুণের মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখে তিতলি। রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা, কিছুই নেই। অথচ থাকার কথা। ছোটকাকার ঘৃণ্য, স্বার্থপর ভূমিকায় যে ক্ষতি হয়েছে তাদের, যে মাশুল তারা গুণেছে, গুণছে দিনের পর দিন, সেটা কোনোভাবেই ক্ষমার্হ্য নয়। কোনো পাল্লায় তুলেই হালকা করা যাবে না সেটাকে কিছুতেই। তবু তরুণ কী করে এতটা নিস্পৃহতায় তাকে ক্ষমা করে দেয়! কী করে এতটা সহনশীলতা দেখায় সে ছোটকাকার প্রতি! যেখানে তরুণের নিজের পুরো জীবনটাই উচ্ছন্নে চলে গেছে, এলোমেলো, তছনছ হয়ে গেছে তার সবকিছু! দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করতে চায় তিতলি, সাবধানে। ভিউ মিররে চোখ রেখে বলে, এবার কিন্তু অনেকদিন আমার কাছে থাকতে হবে ভাইয়া। সহজে যেতে দেবো না তোকে।
তিতলির চোখে চোখ রেখে কোমল, মৃদু একটু হাসে তরুণ। স্নেহ উথলায়। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আস্তে, প্রায় শোনা যায় না এমনস্বরে বলে, তোকে এমন ফ্যাকাসে লাগছে কেন রে? শরীর খারাপ তোর? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস না, না?
ঝরঝর কাঁদে তিতলি। আহা। এমন করে কেউ তো কই বলে না তাকে! তরুণ কেন বলে! তার ভাই বলে! ভাই! ভাই! শব্দটা নিয়ে সাবধানে মনে মনে উল্টে-পাল্টে দেখে তিতলি। কাগজ-কলমে তার বাবা হাবিবুর রহমান খান। সে অর্থে তরুণ তার ভাই, সহোদর। কিন্তু গ্রামের মানুষের সুবাদে কানাঘুষাটাও তার কানে বহুবার এসেছে বৈকি! গ্রামের মানুষের ভাষায় সে ‘জারজ’! শিক্ষিত, রুচিবানেরা হয়তো দয়া করে বলতো ‘যুদ্ধশিশু’! কিন্তু তিতলি এসব নিয়ে পারতপক্ষে ভাবে না। বাবা তাকে সন্তানস্নেহে আগলে রেখেছিলেন, যতটা পেরেছিলেন। তরুণ কখনও, কোনোদিনও অবহেলা, অপমান করেনি তাকে। ভাইয়ের স্নেহ, মমতা সবটুকু সে বরাদ্দ রেখেছিল তিতলির জন্য, সবসময়। তরুণকে তাই আপনার ভাই বলেই জানে তিতলি, নির্দ্বিধায়।
আমি অসুস্থ ছিলাম ভাইয়া। অনেক রক্ত গেছে শরীর থেকে। রক্ত লেগেছে ছয় ব্যাগ। মরতে মরতে বেঁচে গেছি এবার।
কী হয়েছিলো রে? -তরুণের কণ্ঠের উদ্বেগটুকু নজর এড়ায় না তিতলির। অচেনা একটা সুখ গলার কাছে হামাগুড়ি দেয়। মোচড় দেয় ভীষণ। বারবার কেন যে জল ছুঁয়ে যায় চোখ! নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয়ে ওঠে সে।
অরুন্ধতী মামাকে পেয়ে নেচে ওঠে আনন্দে। পড়াশোনার নামও মুখে নেই তার আর। তিতলি অফিস থেকে ফেরে তাড়াতাড়ি, তারপর তরুণ, সে, আর অরুন্ধতী মিলে চলে খুনসুটি,গল্প, আড্ডা। অরুন্ধতী তরুণকে বলে, মামা! তুমি কিন্তু যেতে পারবে না আর! এখন থেকে একসাথে থাকবো আমরা, বুঝেছ?
তরুণ হাসে। অরুর ঝাঁকড়া চুলের গোছায় আদর বোলাতে বোলাতে বলে, হ্যাঁ মামা। খুব বুঝেছি।
ফান না কিন্তু মামা! সত্যি সত্যি আর যাওয়া হবে না তোমার! তাই না, মা?
চোখ-মুখ ঘুরিয়ে, দারুণ উত্তেজিতভাবে অরুন্ধতী তরুণকে বোঝানোর চেষ্টা করে সত্যিই তার আর যাওয়া হবে না কোথাও। এখানে, এই অরুন্ধতী নামক স্নেহের শেকলে, তিতলি নামক মমতার ডোরে বাঁধা পড়তে হবে এবার তাকে। সংসারের দারুণ মোহন আঁচলে শীতল, থির হতে হবে তরুণকে এবার। অরুন্ধতী মাকে সাক্ষী মানতে চায়, পাছে তার অনুরোধ উপেক্ষা করে, তার কথাকে গুরুত্বহীন ভেবে শেকল কেটে উড়ে যায় তরুণ, পাছে সে চলে যায় আবার অজ্ঞাতবাসে, আগের মতোই! তরুণ ভেতরে ভেতরে পুলকিত হয় খুব। তিতলির ভালবাসায়, অরুন্ধতীর নিখাদ সারল্যের ছোঁয়ায় তরুণের ভেতরটা ভরে ওঠে কানায় কানায়, লোভী হয়ে উঠতে চায় তার রুক্ষ, শুষ্ক মন, কাঙাল হয়ে উঠতে চায় আরও বেশি। সাবধানে লাগাম টানে তরুণ। মনকে শাসন করে খুব। তিতলির কাছে, অরুন্ধতীর কাছে, এই যে অমৃত জমে আছে তার ভীষণ তিয়াসি মনের জন্য, দূর থেকে, অনেক অনেকদিন পর পর এসে, সে আকণ্ঠ পান করে যাবে এই অমৃতবারি, ভরিয়ে নেবে তার শূন্য মন। নিত্য পানে অমৃতও বিষ হয়ে ওঠে, হারায় তার অমূল্যতা, নিজেকে বোঝায় তরুণ। অরুন্ধতী যতক্ষণ বাসায় থাকে, আঠার মতো লেগে থাকে সাথে। গল্প শুনতে চায়, হাজারও গল্প জমা আছে তার নিজের ভাঁড়ারেও, তরুণকে বলতে চায় সেসব। সময়টা দারুণ উপভোগ করে তরুণ। তিতলি অফিস থেকে ফিরলে জমিয়ে গল্প করতে বসে। মার কথা তেমন মনে নেই তার, তরুণের মুখ থেকে সে শুনতে চায় মার কথা, তার হারানো শৈশবের কথা। তরুণ বলে, যতটা মনে পড়ে তার। সে নিজেও তো খুব ছোট তখন, স্মৃতির ভাঁড়ার তারও শূন্যই প্রায়। তিতলি তবু কাঙালের মতো শোনে। মার মুখটা মনে করার চেষ্টা করে খুব। বারবার জানতে চায়, কীভাবে মারা গেছিলো মা! তরুণ কেঁপে ওঠে মনে মনে। তিতলির এই ভীষণ সহজ আর স্বাভাবিক প্রশ্নটার মধ্যে যে অনেক অনেক ধাঁধার উত্তর আছে, সে কি আজও বোঝেনি তিতলি! তিতলিটা সত্যি বোকা! অসম্ভব বোকা! নইলে কেন সে তরুণের কাছে জানতে চায় মার মৃত্যুরহস্য! মার মৃত্যুরহস্য উন্মোচিত হলে যে নগ্ন হয়ে ধরা দেয় তিতলির জন্মরহস্যও, বের হয়ে পড়ে সেই একাত্তরের ভয়াল স্মৃতি, পাকসেনাদের হাতে মার দুর্বিসহ অপমানের দাগ, সমাজের কাছে দিনের পর দিন মার লাঞ্চনার উপাখ্যান, আর সেসব সহ্য করতে না পেরে কোনো এক রাতের অন্ধকারে মার শূন্যে ঝুলে পড়া! তিতলি কি সত্যিই জানে না সেসব! নাকি সে বিশ্বাস করে না সেসব আদৌ! মার শূন্যে দোদুল্যমান শরীরটা এখনও চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসে তরুণের, কাঁটা দিযে ওঠে শরীর!
একা পেয়ে তরুণকে বোঝানোর চেষ্টা করে তিতলি। বলে, অনেক তো হলো রে ভাইয়া, এবার একটা বিয়ে করে নে। বলিস তো মেয়ে দেখি তোর জন্য।
তরুণ হাসে। তিতলির মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে গোপনে। মেয়েটা! একমাত্র বোনটা তার! মেয়েটা ভালো নেই। একদম ভালো নেই। এই কদিনে তিতলির সাথে থেকে, তার মুখের গোপন রেখা পড়ে ঠিক বুঝে নিয়েছে তরুণ, তিতলি ভালো নেই। বাদলের সাথে তার সম্পর্কটা দানা বাঁধেনি একদম। কোথায় যেন ভীষণ আলগা আছে বাঁধন, পলকা আছে সুতোর টান। সামান্য আঘাতেই ছিঁড়ে যাবে যে কোনো সময়, ভেঙে যাবে মুহূর্তেই। কিসের অভাব তিতলির? কেন সে অসুখি এতটা? তিতলির মুখের দিকে তাকিয়ে তন্ন তন্ন করে উত্তরটা মনে মনে খোঁজে তরুণ, হাতড়ে মরে। সংসার মানেই ধাঁধা। না বাপু, নিজে সে জেনেশুনে পা দেবে না এই ধাঁধায়। তিতলির ড্রইংরুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে সে গুনগুন করে আনমনে, গুরু ঘর বানাইলা কী দিয়া…
চলবে..