[পর্ব-২৮]
কদিন থেকেই মনে হচ্ছে, মাথার ভেতর আবার ঝিঁঝিপোকাটা ডেকে উঠবে যেকোনো সময়। যেকোনো সময় আবার ফিরে আসবে সেই ভোঁতা যন্ত্রণা, যা পুনরায় পাগল করে দেবে তাকে। পাগল হওয়ার আগে আগে টের পায় রতন, তখন সে পুরোপুরি গুটিয়ে যায় নিজের মধ্যে। রুমকীকেও সহ্য হয় না তখন আর। কাউকেই সহ্য হয় না তখন। অস্থির লাগে খুব। মাথায় শুরু হয় অসহ্য যন্ত্রণা। তারপর হুট করে সিনেমার দৃশ্যের মতো একের পর এক সব স্মৃতি এসে গুনগুনিয়ে ওঠে মাথার ভেতর, শুরু করে একসঙ্গে সুরসাধা। আর তখনই তারস্বরে মাথার ভেতর ডেকে ওঠে একটি ঝিঁঝি। অনবরত ডাকে, ডাকতেই থাকে। আবার পাগল হয়ে যায় রতন পাঁচ-সাত মাসের জন্য। আবার সে হয়ে যায় অন্য মানুষ। এবারও ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তার। ভালো লাগছে না কিছু। রুমকীর সঙ্গে কথা বলছে দায়সারা। তুলির বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তরে হয় চুপ থাকছে, নয়তো মাথা ঝাঁকিয়ে কথা সারছে।
সে টের পাচ্ছে, মাথার ভেতরে একটু একটু করে ফিরে আসছে পুরনো স্মৃতি, জোড়া লাগছে সেলুলয়েডের তার। পুরোপুরি জোড়া লাগবে যেদিন, সেদিনই আবার পুরো পাগল দশা শুরু হবে তার। প্রতিবার এমন হয়। পাগলামির শেষদিকে সে একটু একটু করে কাছের মানুষদের ভুলতে থাকে, চারপাশের জগৎ ভীষণ বাঙ্ময় হয়ে ওঠে তখন তার কাছে, স্মৃতিগুলো ফিরতে থাকে পরপর। প্রথম প্রথম স্মৃতিগুলো থাকে এলোমেলো, খাপছাড়া। যেদিন স্মৃতিগুলো ধারাবাহিকভাবে মনে পড়ে তার, সেদিনই ঝিঁঝিটাও ডেকে ওঠে মাথার ভেতর। আর তারপরই পাগল হয়ে যায় সে, পুরোপুরি। কিন্তু এবার আর পাগল হতে চায় না রতন। রুমকীকে সে কথা দিয়েছে, পাগল হবে না আর। রুমকী! রুমকী! আচ্ছা, রুমকীটা যেন কে? তার মা? কিন্তু ফ্রক পরা, বেণী দোলানো মাকে তো কই মনে পড়েনি কখনো! তাহলে কে রুমকী? কে? নিজের মনেই বিড়বিড় করে রতন। উত্তর খোঁজে নিজে নিজেই। নাহ্। মনে পড়ে না। রুমকীটা যে কে, কিছুতেই মনে পড়ে না আর।
শুধু মনে পড়ে, বাচ্চা একটা মেয়ে আছে এ বাড়িতে, রুমকী নাম তার, ভারি মিষ্টি দেখতে। মেয়েটাকে কথা দিয়েছে, আর সে পাগল হবে না কিছুতেই। এপাশ ওপাশ মাথা দোলায় রতন। না, কিছুতেই আর পাগল হওয়া চলবে না তার। কিন্তু মাথাটা কেমন ভার-ভার লাগে। কী যেন একটা মনে পড়তে চেয়েও পড়ে না। স্মৃতির দরজায় উঁকি দিয়েও হুট করে মুখ সরিয়ে পালিয়ে যায় আবার। অস্থির লাগে রতনের। হাতে থাকা বইটা ছুড়ে ফেলে টেবিল থেকে মেঝেয়। মাথার চুল টেনে ধরে, মুখ গুঁজে দেয় টেবিলে। ইচ্ছে করে ভীষণ জোরে চিৎকার করে, দৌড়ে বের হয়ে যায় এ বাড়ি ছেড়ে। কিন্তু বাস্তবে সেসব কিছুই করে না রতন।
টেবিলে মাথা গুঁজে বসে থাকে চুপচাপ। এ বাড়িতে কারা যেন থাকে সব। চিৎকার করলে, অস্থিরতা দেখালে তারা বেঁধে রাখে তাকে, দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়। ভীষণ কষ্ট হয় তখন। দমবন্ধ লাগে। বন্দি থাকতে ভালো লাগে না তার। কষ্ট হয়। ভীষণ।
বরাবর তেমনই হয়ে আসছে। কী একটু ভাবে তুলি। দ্বিধান্বিত দেখায় তাকে। তারপর এগিয়ে যায় রতনের দিকে।
ভাইয়া, আপনার চা–বলে কে ঢুকলো ঘরে? শাড়ি পরা, দারুণ সুন্দর একটা মুখ। কেমন মা মা একটা গন্ধ পেলো রতন। মা! তার মা খুশবু বেগম! লাল চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে রতন। খানিকক্ষণ পরে দুদিকে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায়। চা খাবো না, মা। চা ভালো লাগে না। চলো আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই এবার। বাড়ি যাবো মা। আমি বাড়ি যাবো!
চমকে রতনের মুখের দিকে তাকায় তুলি। প্রমাদ গোনে মনে মনে। রতনের চোখ লাল। সম্ভবত ঘুমায়নি সারারাত। পাশের টি টেবিলে নাস্তা পড়ে আছে অমনি। খায়নি রতন। মনে মনে হিসাব করে তুলি। না, এত তাড়াতাড়ি রতনের পাগল হওয়ার কথা নয় এবার। হিসাব অনুযায়ী আরও অন্তত মাসতিনেক সুস্থ থাকার কথা তার। বরাবর তেমনই হয়ে আসছে। কী একটু ভাবে তুলি। দ্বিধান্বিত দেখায় তাকে। তারপর এগিয়ে যায় রতনের দিকে। দীপন দেশে নেই। এসময় কিছুতেই রতনকে পাগল হতে দেওয়া যাবে না। এখন তেমন কিছু হলে সে একা সামলাতে পারবে না রতনকে। এছাড়া এই সময় রতন অসুস্থ হলে দীপনকেই বা কী জবাব দেবে তুলি! রতনের কপালে হাত রাখে তুলি। গরম। ভীষণ গরম। জ্বরে পুড়ছে রতন। কখন জ্বর এসেছে কে জানে! হয়তো কাল রাতে!
নাস্তার প্লেট হাতে নেয় সে। দ্রুতহাতে রতনের মুখের কাছে একটুকরো রুটি নিয়ে বলে, ভাইয়া হা করুন তো। নাস্তা খাননি কেন এখনো? খেয়ে নিন।
-খাবো না মা। আমার ভালো লাগে না। বাড়ি যাবো।
-এইতো ভাইয়া, খেয়ে নিন, তারপর যাবো।
লক্ষ্মীছেলের মতো হা করে রতন। খেতে থাকে গোগ্রাসে। কেমন এক অপরাধবোধে ছেয়ে যায় তুলির মন। দীপন থাকলে ঠিক খেয়াল রাখতো ভাইয়ের। যতরাত হোক, বাসায় ফিরে একবার হলেও রতনের ঘরে উঁকি দেয় সে। রতন খেয়েছে কি না, ঘুমিয়েছে কি না, খোঁজ নেয়। অন্য ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে রতনকে জ্বরের ওষুধও খাইয়ে দেয় তুলি। সঙ্গে একটা ঘুমের ওষুধ। বিছানাটা ঠিকঠাক করে দেয়। এবার শুয়ে পড়ুন ভাইয়া। ঘুমান একটু-বলে রতনকে বিছানার দিকে দেখিয়ে দেয় তুলি।
প্রত্যেকটি মুহূর্ত মূল্যবান এখন। তাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। মা, আর দীপনের দায়িত্ব নিতে হবে। আবেগের হাওয়ায় পাল তুলে ভেসে যাওয়ার সময় নেই একদম। রতনের রাগী, গম্ভীর মুখের আড়চোখে তাকায় মাধবী।
বাধ্য ছেলের মতো কোনোরকম আপত্তি না করেই শুযে পড়ে রতন। কাঁথাটা গায়ে টেনে নিতে নিতে তুলিকে বলে, তুমি কিন্তু কোথাও যেও না মা। ঘুম ভাঙলেই আমরা বাড়ি চলে যাবো। এখানে ভালো লাগে না। এখানে দীপন নাই। কেউ নাই।-বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে রতন।
ওষুধ কাজ শুরু করেছে। কপালে চিন্তার রেখা ফোটে তুলির। ময়নাকে বলে রতনের মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করতে হবে। জ্বরটা বাড়তে দেওয়া যাবে না একদম। ওষুধগুলোও খাওয়াতে হবে সময়মতো, যতটা সম্ভব। রতনের মৃদু নাকডাকার আওয়াজ পায় তুলি। সে আস্তে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ঘুমাক। ঘুমালে হয়তো ছেড়ে যাবে জ্বরটা।
দুপুর নাগাদ ঘুম ভাঙে রতনের। মাথাটা ভারী লাগে ভীষণ। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে সে। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করে। কে যেন এ ঘরে এসেছিলো না খানিক আগে? কে এসেছিল? মা? ভারি সুন্দর দেখতে। তাকে খাইয়ে দিয়েছিল। হ্যাঁ, মা-ই তো! তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে বলেছিল না? তাহলে চলে গেলো কেন? চোখ খুলে ঘরের চারপাশে দেখে নিলো রতন। না। কেউ নেই। চলে গেছে। অভিমান জমে যায়। মাথাটা ব্যথা করে আরও। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকে সে। চোখ বেয়ে জল গড়ায়। থাকে না। কেউ থাকে না তার পাশে।
সেই যে, কে যেন একজন বলেছিল না, ভীষণ ভালোবাসে তাকে? কে বলেছিলো যেন? মাধবী না? হ্যাঁ! হ্যাঁ! মাধবী-ই তো! জ্বালিয়ে মারতো মেয়েটা থাকে। ক্লাসে, ক্লাসের বাইরে, হলে, ক্যান্টিনে আঠার মতো লেগে থাকতো তার সঙ্গে। যত তাকে এড়িয়ে যেতে চাইতো রতন, তত সে আরও সেঁটে যেতো রতনের সঙ্গে। রতনের বই নিয়ে আটকে রাখতো, নোট নিয়ে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতো অকারণে। না, অকারণেও নয় তো! চাইতো রতন তাকে কাছে ডাকুক, কথা বলুক তার সঙ্গে, করুক হৃদয়ের লেনাদেনা। একসময় রতনও কি দুর্বল হয়ে পড়ছিল তার প্রতি, মনে মনে? একটু ভালোলাগা কি তৈরি হচ্ছিল না তারও মনে? সময় গড়ালে একসময় হয়তো রতন সত্যিই প্রেমে পড়তো মাধবীর। কিন্তু মাধবীর সবকিছুতেই ছিল ভীষণ তাড়া। বড়লোক বাপের আদুরে কন্যা ছিল সে। না চাইতেই সবকিছু পাওয়া মাধবীর তাই রতনের দেওয়া অবহেলা সহ্য হয়নি, পছন্দ হয়নি তার উপেক্ষার ভাষা। সে তাই ফল পেতে চেয়েছে ত্বরিত। প্রত্যুত্তর চেয়েছে দ্রুত। না পেয়ে রোখ চেপে যাচ্ছিল তার। পাগলামি শুরু করেছিলো প্রায়। হঠাৎই সেই বিকেলটা ঝাঁপিয়ে পড়লো রতনের স্মৃতিতে। দুহাতে মাথা চেপে উঠে বসলো রতন। চিৎকারটা প্রাণপণ চেষ্টায় গিলে নিলো সে। না, পাগল হতে চায় না সে আর।
সামনে ঝলমল হাসিতে উজ্জ্বল মাধবীর ফর্সা মুখ। টেবিলে অর্ডার দেওয়া ফাস্টফুড তেমনি পড়ে আছে। মাধবী খেয়ে এসেছে, রতনেরও খিদে নেই। নাছোড়বান্দা মাধবীর যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে বের হয়েছে সে। নইলে আজ, এই অসময়ে বের হওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না তার। দুদিন পর থার্ড ইয়ার ফাইনাল। নষ্ট করার মতো একমুহূর্ত সময় নেই হাতে। প্রত্যেকটি মুহূর্ত মূল্যবান এখন। তাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। মা, আর দীপনের দায়িত্ব নিতে হবে। আবেগের হাওয়ায় পাল তুলে ভেসে যাওয়ার সময় নেই একদম। রতনের রাগী, গম্ভীর মুখের আড়চোখে তাকায় মাধবী। খিলখিল হাসে। রাগে গা জ্বলে যায় রতনের। রুক্ষভাবে বলে, তোমার জরুরি কথাটা কী, তাড়াতাড়ি বলো। আমাকে রুমে ফিরতে হবে। দুদিন পর পরীক্ষা।
তুমি এমন স্বার্থপর কেন বলো তো? নিজেকে ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারো না, না? দুদিন পর তোমার পরীক্ষা, আমার না?
হ্যাঁ, আমি স্বার্থপর। তোমার পরীক্ষা, তো বের হয়েছ কেন? আমি কি ডেকেছি তোমাকে? নিজেই এসেছো, নিজের পড়ার ক্ষতি করছো, আমার পড়ারও বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছ।
অপমানে লাল হয়ে ওঠে মাধবীর ফর্সা মুখ। থমথমে দেখায় তাকে। আহত, নিচু গলায় বলে, মানুষকে অপমান করে, কষ্ট দিয়ে খুব আনন্দ পাও, না? খুব সুখ তাতে?
কী বলবে বলো তো। বাজে বকার সময় নেই আমার।-অসহিষ্ণু, অস্থির হয়ে ওঠে রতন। মাধবী অসহ্য লাগে এই মুহূর্তে। এমন ছেলেমানুষীর কোনো মানে হয়!
কবে যে দীপন দেশে ফিরবে! ভয়ে বুক কাঁপে তার। মনে মনে বলে, দীপন না ফেরা পর্যন্ত ভাইয়া যেন সুস্থ থাকে, ঈশ্বর!
থাক রতন। কিছুই বলবো না আজ আর। তোমার সময় নষ্ট হবে শুধু শুধু। পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপর বলবো, যদি শোনার সময় হয় তোমার।-বলে হ্যান্ডব্যাগ থেকে পেয়ারা বের করে মাধবী। রতনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, খাও। বাবা গ্রাম থেকে এনেছে। ভালো খেতে।
হাত বাড়িয়ে পেয়ারাটা নেয় রতন। ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে মাধবী। বলে, চলো তোমাকে হলে পৌঁছে দেই।
গাড়িতে বসে কোনো কথা বলে না মাধবী। রতনও চুপ। মাধবীর প্রতি সম্ভবত একটু বেশিই রুক্ষ হয়েছে সে আজ। অতটা না হলেও চলতো। থাক, এখন আর অত ভাবার সময় নেই। পেয়ারা খেতে সত্যিই খুব ভালো। আনমনে পেয়ারাটা শেষ করে রতন। হঠাৎ মাথাটা কেমন করে ওঠে তার। মনে হয় হাজারটা ঝিঁঝিপোকা একসঙ্গে ডেকে ওঠে মাথার ভেতর। স্থান-কাল ভুলে সজোরে মাথা চেপে ধরে রতন। চিৎকার করে ওঠে ভয়ার্তস্বরে। চমকে ওঠে মাধবী।
লোকটা বলেছিল, পেয়ারার মধ্যে জিনিসটা সাবধানে ঢুকিয়ে খাইয়ে দিলেই কাজ হবে। রতন চিরদিনের জন্য তার হয়ে যাবে। কিন্তু রতন অমন ভয়ানকভাবে চিৎকার করছে কেন? কী হলো তার? আতঙ্কে রতনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাধবী। রতন তখনো চিৎকার করছে সমানে।
রতনের চিৎকারে দৌড়ে আসে তুলি। বিছানায় নেতিয়ে পড়ে আছে রতন। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। চোখ বন্ধ। গায়ে হাত দিয়ে দেখে, জ্বর আছে আগের মতোই। দ্রুতহাতে গায়ে-মাথায় ভেজা তোয়ালে দিয়ে স্পঞ্জ করে দেয় তুলি। সম্ভবত প্রচণ্ড জ্বরে এমন হয়েছে রতনের। নয়তো পুরনো কোনো স্মৃতি মনে পড়েছে তার। পুরনো কথা মনে পড়লে মাঝে মাঝে এমন চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায় রতন। কবে যে দীপন দেশে ফিরবে! ভয়ে বুক কাঁপে তার। মনে মনে বলে, দীপন না ফেরা পর্যন্ত ভাইয়া যেন সুস্থ থাকে, ঈশ্বর!
চলবে…
আরও পড়ুন: উজানে গড়াই-২৭॥ শিল্পী নাজনীন