( পর্ব-আট )
ড. ফারজানার চালচলন কথাবার্তায় হঠাৎ করেই ব্যাপক পরিবর্তন আসে। আগের ড. ফারজানার সঙ্গে বর্তমানের ড. ফারজানার কোনো মিল নেই। নিজের বাংলা বিভাগে না গিয়ে প্রতিদিন সোজা আব্দুল করিমের রুমে যান। সেখানে দীর্ঘ সময় গল্প করেন, দুপুরে কখনো বিভাগে যান, কখনো যান না। তবে প্রতি সোমবারে দুপুর বারোটার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভাগেই থাকেন। নিজের রুমে প্রায় পুরোটা সময় ভেতর থেকে রুম বন্ধ রাখেন।
আব্দুল করিম বললেন, আপনি সপ্তাহের একটা দিন নিয়ম মেনে বিভাগে থাকেন। আমার কাছে আসেন না। কারণ কী, বলেন তো?
চাকরিটা তো করতে হবে। এই একটা দিন আমি সারা সপ্তাহের কাজ গুছিয়ে নেই।
কেন? আপনার প্রোগ্রাম অফিসার নেই? আপনি বোঝেন না আমি আপনাকে একটা দিনের জন্যও ছাড়তে চাই না। আপনার প্রোগ্রাম অফিসার, কী যেন মেয়েটার নাম?
ফারিয়া।
ফারিয়াকেই সব কাজ করতে বলবেন। আপনি প্রতিদিন অফিসে আসা বা যাওয়ার সময় একটু ঢুঁ দিলেই হবে। আর ক্লাসটা মাঝেমধ্যে নেবেন। ওতেই চলবে। আপনার অফিস হচ্ছে আমার রুম।
স্যার, ফারিয়াই সব করে। তারপরও কিছু কাজ তো থাকে, তা তো প্রোগ্রাম অফিসারকে দিয়ে হয় না। নিজেকেই করতে হয়। আর সোমবারে আমার শিক্ষক প্রফেসর ড. তপোবন বিশ্বাস ক্লাস নিতে আসেন।
প্রফেসর ড. তপোবন! উনি তো ন্যাশনাল ফিগার। উনি আমাদের বাংলা বিভাগে ক্লাস নেন?
হ্যাঁ।
এটা কিন্তু বিরাট ব্যাপার, ড. ফারজানা।
আপনার কাছে কি আমি এখনো ডক্টর ফারজানা? আপনার কাছে আমি শুধুই ফারজানা।
অবশ্যই। কিন্তু এটা তো অফিস। যাই হোক, ড. তপোবন বিশ্বাস ডিপার্টমেন্ট তো বটেই, বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই এটা একটা বড় ব্যাপার। তিনি তো রাষ্ট্রীয় অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। আপনি রিয়েলি ট্যালেন্ট। দারুণ একটা কাজ করেছেন।
তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আমাকে পিএইচডি করিয়েছেন। আমি স্যারকে কোনো রিকোয়েস্ট করলে তা ফেলে দেওয়া তার জন্য কঠিন। তিনি ডিপার্টমেন্টে এলে তাকে সময় না দিলে খুব মাইন্ড করেন।
এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিরাট একটা সম্মানের ব্যাপার। আপনার জন্য গ্রেট অ্যাচিভমেন্ট। আমি বোর্ডকে ব্যাপারটা জানাবো। আপনার ভাবমূর্তি এতে অনেক বেড়ে যাবে।
বোর্ডকে আর কিছু জানাবেন না?
আর কী জানাবো বলেন তো?
আপনি আর আমি যে প্রেম করছি, বোর্ডকে তা জানাবেন না?
আব্দুল করিম এবার সশব্দে হেসে ওঠেন। ভালোই বলেছেন। এক খাঁড়ার নিচে দুজনেরই মুণ্ডু যাবে।
গেলে যাবে। সমস্যা কী! আমি স্বামীকে ছেড়ে আপনাকে বিয়ে করে ফেলবো। পারবেন না বিয়ে করতে?
এ সমাজ বড় কঠিন, ফারজানা। অনেক কিছুই সাধ জাগবে, বাস্তবে অনেক কঠিন।
এ সব দুর্বলের কথা। সাহসী মানুষরা সব পারে।
এ সময় অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান জাহিদ মণ্ডল ঢোকেন আব্দুল করিমের রুমে। কথার সুর পাল্টে বললেন, ড. ফারজানা, আপনি তপোবন স্যারকে সময় দেবেন। তার যেন কোন কিছুতে কোনো সমস্যা না হয়, ভালো করে খেয়াল রাখবেন।
অবশ্যই। আমি সেই চেষ্টাটা সবসময় করি, স্যার। স্যার, আবার এও ভাবি, এটা তো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। কখন চাকরি আছে কখন নেই; হুটহাট করে কখন কার চাকরি যায়; দেখি তো। ভয় করে নিজেও কখন চাকরিটা হারাই!
চাকরির হারানোর ভয় করেন আপনি?
তা তো করিই।
জাহিদ মণ্ডল বললেন, সিসি স্যার থাকতে আপনার চাকরি কে খাবে? স্যারই এখানে সব।
জাহিদ সাহেব, আপনি জানেন, ড. ফারজানা ম্যাডাম ন্যাশনাল ফিগার প্রফেসর তপোবন বিশ্বাসকে বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়ে এসেছেন।!
স্যার, এটা ম্যাডামের কিন্তু বিরাট কৃতিত্ব। এতে ভার্সিটির ন্যাম ভ্যালু অনেক বেড়ে যাবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় চেষ্টা করেও তাকে নিতে পারেনি। মনে মনে ভাবেন অন্যকথা, এটা যে কী বিশ্ববিদ্যালয় হলো, যাকে-তাকে ন্যাশনাল ফিগার বানিয়ে ফেলছে! আস্তে আস্তে সব বিভাগে মেয়েদের প্রধান করে ফেলছে। নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ভিসি আর সিসি স্যার মেয়েদের নিয়ে কী যে মজা খাচ্ছেন!
আমি তো সব জানি জাহিদ সাহেব।
সেদিন রাতে আপনাকে কিন্তু আমিই আগ বাড়িয়ে প্রথম কিস করেছিলাম। আপনি কিসের উত্তরে আমাকে কিন্তু সেদিন কিস করেননি। প্রায় এক সপ্তাহ পরে অবশ্য পুষিয়ে দিয়েছিলেন। আর একটা কথা বলবো?
জাহিদ মণ্ডল দুজনকে খুশি করেই কথাগুলো বললেন। মনে মনে আবার ভাবলেন, প্রফেসর তপোবন বিশ্বাসটা আবার কে! আগে নাম শুনেছি বলে তো মনে হচ্ছে না।
স্যার, আপনি তো ম্যাডামের জন্য আর একটা বিরাট কাজ করে দিয়েছেন, একবারে ত্রিশ হাজার টাকা বেতন বাড়িয়ে দিয়েছেন। সবাই এটার জন্য আপনার অনেক প্রশংসা করছেন।
চিন্তা করবেন না, একটু সময় দেন, আপনাদের জন্যও করবো। আগে তো এখানে পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার টাকাও বাড়তো না।
জাহিদ মণ্ডল মনে মনে বললেন, আমি তো আর মেয়ে নই যে, আপনি আমার বেতন বাড়ানোর জন্য পাগল হয়ে যাবেন! আর মেয়ে হলেই বা কী হতো! আরও তো কত মেয়ে এখানে আছে, যারা ছলাকলা জানে না, তাদের তো বছরের পর বছর একটাকাও বাড়ে না। মনের কথা মনে চেপেই বললেন, স্যার, আপনার কাছে আমার একটু জরুরি কাজ ছিল।
কী কাজ বলুন তো!
সামনে সপ্তাহে আমাদের ডিপার্টমেন্টের একটা সেমিনার আছে। ত্রিশ হাজার টাকার একটা বাজেট দিয়েছি। ফাইলে ভিসি স্যারের সিগনেচারও হয়ে গেছে। ফাইলটা আপনার কাছে আছে। আপনি যদি একটু ছেড়ে দিতেন, তাহলে আমরা টাকাটা আজই অ্যাকউন্টস থেকে নিয়ে কাজ করতে পারতাম।
প্রধান অতিথি কাকে আনবেন?
স্যার, বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গোবিন্দ হাওলাদার।
ঠিক আছে। কিন্তু এরপরে চেষ্টা করবেন প্রফেসর তপোবন বিশ্বাসের মতো খ্যাতিমানদের আনতে। বলেই ফাইলটা বের করে কোনো কিছু না দেখেই সিগনেচার করে জাহিদ মণ্ডলের হাতে দেন।
ফাইলটা হাতে নিয়ে জাহিদ মণ্ডল বললেন, স্যার, ভিসি স্যারের কাছে একটু জরুরি যেতে হবে। স্যার ডেকেছেন।
যান যান।
এ সময়ে ড. ফারজানাও জাহিদ মণ্ডলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বললেন, স্যার আমিও উঠি।
আপনার ফাইলটা তো একটু দেখতে হবে। দুই মিনিটি বসুন। ফাইলটা ছেড়ে দিচ্ছি। জাহিদ সাহেব অন্য একসময় ফ্রি হয়ে আসুন, একসঙ্গে চা খাবো।
জাহিদ মণ্ডল ফাইল নিয়ে বের হতে হতে মনে মনে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কী যে সব হচ্ছে! দিন দিন পতিতালয় বানিয়ে ফেলছে!
-আমার মনে হয়, এখন চলে যাওয়াই ভালো ছিল। জাহিদ স্যার আবার কিছু ভাববেন না তো!
না, ছেলেটা ভালো। অনেক কাজ করে।
আপনি জানেন না ও একটা টিকটিকি! কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে ফেলবে! বোঝা কঠিন আছে।
আমি তা টের পেলে এক মিনিটেই বিদায়পত্রও পেয়ে যাবে।
ড. ফারজানা বললেন, কোনদিনে আবার আমার বিদায়পত্র লিখে না ফেলেন! কে কোথায় কী বলে বসে, কে কোথায় কী রটিয়ে দেয়! আমার অনেক ভয় করে। আচ্ছা আপনাকে একটা কথা বলবো, আপনি আমাকে এত পছন্দ করেন, ভালোবাসেন, প্রতিদিন প্রায় সারা দিন একসঙ্গে এভাবে থাকি, ভাবি এসব জানেন?
তার আগে বলুন তো, আপনি আমাকে এত ভালোবাসেন তা কি আপনার হাজবেন্ড জানেন?
পাগল নাকি! এটা বলা যায়! বললে ঘর থাকবে? বৈশাখের ঝড় উঠবে।
তাহলে আমি কিভাবে আমার বউকে বলি?
তা ঠিক। আসলে এসব বলা যায় না। এসব হলো জলের ভেতরের গোপন জল, জলের সঙ্গেই মিশে থাকে; কিন্তু আলাদা।
ড. ফারজানা একটু অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবেন! আব্দুল করিম তা লক্ষ করে বললেন, কী ভাবছেন?
কিছু একটা তো ভাবছিই।
কী?
আপনাকে ভাবছি।
আমাকে?
জি, আপনাকেই।
তাই! আমাকে ভাবেন আপনি?
অনেক। অনেক ভাবি। আমার স্বামী সন্তান না থাকলে আপনাকে বিয়ে করতাম। আপনাকে আমার খুব পছন্দ। মনভরা পুরুষ বলতে যা বোঝায়, আপনি ঠিক তাই। এটা আপনি নিজেও জানেন। কিচ্ছু ভালো লাগে না। মনে হয় স্বামী সন্তান চাকরি বাকরি সব ছেড়ে আপনাকে নিয়ে, অন্য কোথাও অন্য কোনো দেশে চলে যাই। আচ্ছা, আপনার কখনো এরকম মনে হয় না?
হয়। অনেক হয়। আসলে আমি তো সেনাবাহিনীতে চাকরি করে এসেছি। সেখানকার জীবনের সঙ্গে এখানকার জীবনের কোনো মিল নেই। এখানে জয়েন করার বছরখানেক পরে যখন আপনার সঙ্গে পরিচয় হলো, একটু একটু করে সম্পর্ক তৈরি হলো, ঘনিষ্ঠতা হলো; তখন নিজের মধ্যে অন্যরকম অপরিচিত একটা শান্তি অনুভব করলাম, যে শান্তিটার সঙ্গে আমার কোনোদিন পরিচয় ছিল না। এখন তো আপনি আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস হয়ে উঠেছেন।
বাদ দেন। আপাতত ইংরেজি বিভাগে তাকে বাংলা একটা জিইডি কোর্স দিয়ে দেন। আমি ইংরেজির চেয়ারম্যানকে বলে দিচ্ছি। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।
দুদিন পরে আবার অন্য কেউ আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস হয়ে উঠবে না তো!
কী যে বলেন! ফারজানা আমার একজনই। তার মতো আর কেউ নয়।
আপনি আর্মিতে ছিলেন কিন্তু আপনার সাহসটা ওরকম নয়। আপনাকে ওয়েস্টিনে কিন্তু আমিই প্রথম ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আপনি সেদিন কিন্তু আমতা আমতা করছিলেন। আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন কি না, দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন।
ঠিকই বলেছেন।
আমি সেদিন কি বলেছিলাম মনে আছে?
আছে। আসলে আমি তো দীর্ঘ একটা কঠিন নিয়মের ভেতরে থেকেছি, এভাবে কখনো কেউ বলেনি, যাইওনি। প্রেম ভালোবাসা; এসবের কোনো সুযোগ বা পরিবেশ ওখানে ছিল না। চাকরি শেষে এখানে জয়েন করে এখন বুঝতে পারছি জীবনটা প্রজাপতির মতো কী সুন্দর! সেকারণে সেদিন বুঝতে পারছিলাম না, কী করবো?
সেদিন রাতে আপনাকে কিন্তু আমিই আগ বাড়িয়ে প্রথম কিস করেছিলাম। আপনি কিসের উত্তরে আমাকে কিন্তু সেদিন কিস করেননি। প্রায় এক সপ্তাহ পরে অবশ্য পুষিয়ে দিয়েছিলেন। আর একটা কথা বলবো?
বলেন।
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। অফিসে পিয়ন ছাড়া সবাই চলে গিয়েছিল। একটা অতবড় ফ্লোরে শুধু আপনি আর আমি ছিলাম। একটু বসেন আর একটু বসেন, এভাবে করে করে প্রায় সাতটা পর্যন্ত আমাকে বসিয়ে রেখেছিলেন। সেদিনের সেই সাতটা আমার কাছে মধ্যরাতের থেকেও গভীর মনে হচ্ছিল।
আপনার থাকতে ইচ্ছে ছিল না?
ইচ্ছে না থাকলে তো চলেই যেতাম। সত্যি বলি, সেদিন আপনার পাগলামিগুলো আমার খুব ভালো লেগেছিল। স্বপ্নের থেকেও বেশি সুন্দর ছিল।
আব্দুল করিম কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু স্ফীত হাসলেন। প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললেন, ভিসির সঙ্গে আপনি ড. এলিনাকে কোর্স দেওয়া বিষয়ে কথা বলেছিলেন?
বলেছিলাম তো।
আমাকে উনি বললেন। আপনি আমাকে আগে থেকে একটু বলে রাখতেন ভিসির সঙ্গে আপনার ড. এলিনার ব্যাপারে কথা হয়েছে।
ভুলে গেছি, ডিয়ার।
ভিসি বলছিলেন, বিওটির চেয়ারম্যান স্যার ড. এলিনাকে ক্লাস দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন।
ও মাই গড! সামান্য একটা ক্লাসের জন্য উনি চেয়ারম্যান স্যার পর্যন্ত গেছেন! আপনি তো সেদিন আমাকে বলেই দিলেন। ভিসি স্যারকেও জানিয়েছি। তাকে কিভাবে ক্লাস দেওয়া যায়; সেটা তো আমরা দেখছিলামই।
বাদ দেন। আপাতত ইংরেজি বিভাগে তাকে বাংলা একটা জিইডি কোর্স দিয়ে দেন। আমি ইংরেজির চেয়ারম্যানকে বলে দিচ্ছি। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।
ঠিক আছে স্যার। আপনি যেভাবে বলবেন, সেভাবেই হবে।
চলবে…
ঈশ্বর ও শয়তান-৭॥ রকিবুল হাসান