(পর্ব-৬)
ড. ফারজানা বাসায় ফিরে বিষয়টা অনেক ভাবলেন। আব্দুল করিম আমাকে একা ডেকে ব্যাপারটা বলতে পারতেন! ড. এলিনার সামনে তাকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে, আমাকে তো তার কাছে ছোট করে ফেললেন। তিনি নাকি আমাকে এত ভালোবাসেন, মুখে বলতে বলতে কথার খই ফুটিয়ে ফেলেন, কিন্তু আজ এটা কী করলেন! মাথায় কোনো কিছুই কাজ করছে না ড. ফারজানার। ড্রয়িং রুমে গিয়ে টিভি ছাড়লেন। দুই-চার মিনিট পরে আবার বন্ধ করে দিলেন। বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। ঘুমের কোনো লক্ষণই নেই। রাতও তো তেমন হয়নি। মাত্র সাড়ে এগারোটা। ঘুম হবেই কিভাবে! তারপর আবার মাথার ভেতর টেনশনের আগুন! সিসি স্যারের সঙ্গে এতটা করা তো আমারও ঠিক হয়নি। আবার ড. এলিনাকে তো অন্যায়ভাবে ক্লাসও দেওয়া যায় না।
আবার ভাবে, অন্যায়ই বা কী! আমি আর সিসি যে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছি, বা সিসি আর ড. এলিনা দুজনে আমাকে আজ যা দেখালেন এসব কী ন্যায়—এসব কী ভালো কিছু! আমি আর ভিসি স্যার যা করি, তা কি ঠিক! সবই তো অন্যায়ের ভেতর দিয়েই চলছে। আমার প্রতি বেশি দরদ দেখিয়ে ভিসি সিসি দুজনে, আমার যে বেতন বাড়ালেন, এটাও তো কোনো নিয়মের ভেতর দিয়ে নয়। তো ড. এলিনা সায়েন্সে গ্রাজুয়েশন করে ভাষাতত্বে এম এ করে সাহিত্য পড়ালে আমার কী সমস্যা!
সিসি যে ড. এলিনার রূপের দিকে গড়ে গেছে, তাও তো আজ ভালো করেই বুঝে গেছি। আমাকে তো এখন অনেক হিসাব করে পা ফেলতে হবে। এখন যদি আমি বাড়াবাড়ি করি, আমার চেয়ারটাই তো থাকবে না। তার থেকে সিসির সঙ্গে মিলিয়ে—তার মতো হয়ে চলাই তো ভালো। বাংলা বিভাগের কী হলো, না হলো তাতে আমার কী! আমার তো চাকরিটা দরকার। চাকরিটা ঠিক থাকলেই হলো। আবার ভাবে, ক্লাস দিলেও এই মহিলা আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। সিসির সঙ্গে সম্পর্ককে সে বহুদূর নেবে—সে অবশ্যই এখানে বড় কোনো টার্গেট নিয়েই এসেছে। সিসির চরিত্র যে কচুর পাতার পানির মতো—তাও তো আগে বুঝিনি। শরীরী সৌন্দর্যই যদি বড় যোগ্যতা হয়, সেটা তো আমারও কম নেই! সিসিকে এতদিন যে মুগ্ধতায় ডুবসাঁতার খেলিয়েছি, এখন সেই সৌন্দর্যের সমুদ্রে একদম ডুবিয়েই রাখবো—নাকানিচুবানি খাওয়াবো।
একদিকে তাকে পুরো নিয়ন্ত্রণে রাখার জিদ তৈরি হয়, আর একদিকে ভাবে, খেলাটা সাবধানে খেলতে হবে! প্রয়োজনে ড. এলিনাকে ক্লাসটা দেবো। না দিলে শুরুতেই বৈশাখের কালোমেঘভরা ঝড় উঠতে পারে—সব এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। আবার ড. এলিনা যদি ওরকম অর্ধনগ্না হয়ে ভিসি স্যারের কাছে যায়, তখন আবার তার মতিগতি কী হয়! দেখা যাবে ব্লুবার্ডে আমিই নেই! তখন তো আমার চেয়ারই থাকবে না। ভাবে, ড. এলিনাকে ক্লাস দেবো। আগে চেষ্টা করবো, ইংরেজিতে জিইডি কোর্স আছে, সেখানে ক্লাস দিতে। সেটা হয়ে গেলে তো হয়েই গেলো। না হলে বাংলাতেই দেবো।
এসব ভাবতে ভাবতে বারান্দায় গিয়ে বসে ড. ফারজানা। ভাবে, সিসিকে ফোন দিয়ে নিজের থেকে ‘সরি’ বলি। না হলে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়ে যেতে পারে। আর ড. এলিনা যে একদমই সুবিধার নয়, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। ভিসি স্যার মুখে যতোই বুলুক সিসির সঙ্গে আমার জন্য সম্মুখ যুদ্ধে তিনি যাবেন না। নিজেকে বাঁচিয়েই তিনি চলবেন। ফলে সিসি স্যারের সাথে এখুনি কথা বলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক করে নেওয়াই ভালো।
আব্দুল করিমকে কল দিতে কোনোদিন তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হননি। যখন তখন কল দিয়েছেন—উপচানো নদীর সুখের উচ্ছ্বাসের মতো করে কথা বলেছেন। কিন্তু আজ দ্বিধাটা তাকে বেশ খানিকটা আঁকড়ে ধরে—ফোন করা ঠিক হবে কি না! দ্বিধা নিয়েই ফোন করলেন।
আব্দুল করিম কোন উত্তর না দিয়ে রাগে ফুলতে ফুলতে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরায়।
আব্দুল করিম আর তার স্ত্রী সাবিহা করিম এসময় একসঙ্গে বসে টিভি দেখছিলেন। ফোনটা বাজতেই স্কিনে নাম দেখে সাবিহা করিম বললেন, তোমার প্রিয় সহকর্মী ফোন করেছেন। রাতে বোধ হয় ঘুম হচ্ছে না! তোমাকে মনে পড়ছে!
আব্দুল করিম কোনো উত্তর না দিয়ে ফোনটা ধরবেন কি না, ভাবলেন। ভাবতে ভাবতেই কল রিসিভ করে একটু মোটা গলায় তিনি বললেন, ড. ফারজানা, বলুন।
আব্দুল করিমের চেনা যে কণ্ঠ ড. ফারজানার, আজকের এ কণ্ঠের সঙ্গে তার মিল নেই বললেই চলে। আব্দুল করিম কখনো এরকম বাজেকণ্ঠে কথা বলেননি। বোঝা গেলো ভয়ঙ্করভাবে ক্ষেপে আছেন। খুব নরম ও অনুতপ্তকণ্ঠে ড. ফারজানা বললেন, স্যার, সরি। আজকে আমার কোনো কথায় আপনি কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। ড. এলিনার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলে ক্লাসের একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো। প্লিজ স্যার, আপনি আমার ওপর কোনো রাগ বা ভুল ধারণা রাখবেন না।
ঠিক আছে।
স্যার, এখনো ক্ষেপে আছেন? আমি তো নিজের থেকে সরি বলেছি!
না না। সব ঠিক আছে। আমি জানতাম আপনি ভুল করছেন। ভালো লাগলো আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন। আসলে আমি সবার উপকার করতে চাই। এটাকে একেকজন একেকভাবে নেন। সমস্যাটা ওখানেই হয়। ভালো লাগলো। রাখছি।
স্যার, অনেক ধন্যবাদ। ফোন রেখে যেন হাফছেড়ে বাঁচে ড. ফারজানা, মনে মনে বললো, যাক আপাতত সম্পর্কটা স্বাভাবিক তো হলো। প্রথমে যে রকম বাজেকণ্ঠে শুরু করেছিলেন, এখন ঠিক আছে। এখন থেকে খেলাটা ঠাণ্ডা মাথায় খেলতে হবে।
সাবিহা করিম বললেন, কী করিম সাহেব কী হয়েছে অফিসে? কিছুক্ষণ আগে ড. এলিনা নামে কে যেন একটা মেয়ে ফোন করে ঘণ্টা ধরে কথা বললো, তাকে নিয়ে কোন সমস্যা হয়েছে? এক কৃষ্ণের দুই রাধা নাকি!
এভাবে বলছো কেন! আসলে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। কেউ কারো ভালো সহ্য করতে পারে না। কেউ কারও জন্য কিচ্ছু করতে চায় না। খালি জেলাস ফিল করে।
তা তো স্বাভাবিক। এতদিন তোমার এক রাধা ছিল, এখন নিশ্চয় আর এক নতুন রাধা যুক্ত হয়েছে—দখলের একটা ব্যাপার তো থাকেই! কে কত বেশি ছলাকলা দিয়ে—কে কত বেশি রূপের পশরা সাজিয়ে কৃষ্ণকে খুশি করবে! সে চেষ্টা তো দুজনেই করবে। আমি হলে আমিও করতাম।
খুব মজা নিচ্ছো! আমি আছি জ্বালায়! আর তুমি রসিকতা করছো!
সিসি স্যার যদি অফিসে নিজেকে বস থেকে কৃষ্ণ বানিয়ে ফেলে, রসিকতা শুধু আমি কেন দিনে দিনে দেখবে সবাই করছে। তোমার পিয়ন পর্যন্ত করবে। শোনো একটা কথা বলি তোমাকে, সিরিয়াসলি বলছি, এসব নারীরা সুবিধা নেওয়ার জন্য তোমাকে ব্যবহার করতে চায়, কেউ তোমাকে ভালোবাসে না। তোমার চেয়ারটাকে ভালোবাসে। তুমি তা বোঝো না।
ধ্যাৎ! তুমি অফিসের বিষয় নিয়ে দিন দিন বাসাটা নরককুণ্ডু বানিয়ে ফেলছো।
অফিসের প্রেমালাপ অফিসেই রেখে এসো। বাসায় এনো না—বাসা একটা পবিত্র জায়গা—আমার কাছে পৃথিবীর সবকিছুর থেকে থেকেও পবিত্র আমার ঘর—আমার সংসার। তুমি তা অপবিত্র করে ফেলছো। আমার সামনে ফোনে এসব নারীদের সঙ্গে মান-অভিমানের খেলা আর খেলো না। খেলাটা অফিসেই খেলো। এই ভার্সিটিতে চাকরি করতে গিয়ে এসব ছলাকলা নারী পেয়ে তুমি নিজেকে ভুলে গেছ—পাগল হয়ে গেছ।
আব্দুল করিম কোনো উত্তর না দিয়ে রাগে ফুলতে ফুলতে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরায়।
চলবে…