[পর্ব-তিন]
আব্দুল করিমের কাছে ড. ফারজানা শান্তিদায়িনী শৈল্পিক সুন্দরী এক রমণী। তিনি তাকে যেভাবে প্রত্যাশা করেন, তার থেকে অনেক বেশি করে তার মন আর শরীর ভরিয়ে দেয় ড. ফারজানা। আব্দুল করিম ড. ফারজানাকে নিয়ে কল্পনাতীত এক সুন্দরের ভেতর বুঁদ হয়ে থাকে। ড. ফারজানা কোনভাবেই আব্দুল করিমকে বুঝতে দেয় না ড. শাহেদ জাহানের নিয়মিত সঙ্গদায়িনী সে।
ড. ফারজানা শুধু বিভাগে নয়, পুরো বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে অঘোষিত ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। কেউ বলে ভিসি ম্যাডাম, কেউ বলে সিসি ম্যাডাম। চিফ কোঅর্ডিটেরকে অফিসে সবাই সিসি বলে। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শক্তিটা এই ট্রাস্টি বোর্ড। ফলে এই বোর্ডের যিনি প্রতিনিধিত্বি করেন, তার ক্ষমতা ভিসির থেকেও অনেক বেশি। তিনি বোর্ডকে যা বোঝাবেন, যেভাবে বোঝাবেন, বোর্ড তাই বুঝবে, সেভাবেই বুঝবে। ফলে সবারই একটা চেষ্টা থাকে আব্দুল করিমকে তেল দিয়ে চলার। খুশি করে চলার। যে নিজের যোগ্যতায় ও ব্যক্তিত্বে মাথা উঁচু করে চলার চেষ্টা করে, আব্দুল করিমকে মান্য না করে, বা মনে করে ভিসি স্যারই তো প্রধান, ট্রাস্টিবোর্ড তো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কেউ নয়, তাহলে সিসিকে কেন গুনে চলতে হবে! তাহলেই বিপদ! হুট করেই একদিন তার টেবিলে বিদায়ের চিঠি পৌঁছে যায়। ড. ফারজানা এ হিসাবটা আরও ভালো জানেন। ট্রাস্টি বোর্ড ভিসিকেও অনেক সম্মান করে, ফলে ভিসির কথারও অনেক মূল্য আছে। সে কারণে ড. ফারজানা দুই পুরুষেরই এক নারী হয়ে চলে।
আব্দুল করিমের রোমান্সের পুতুল হয়ে থাকে, তাকে খুশি রাখার সব ধরনের চেষ্টা করে। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিশেষ একটা ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। কাউকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করে না। দেয়ও না। ভিসি তো তার আঁচলে বাঁধা সিকি আধুলি। আব্দুল করিমকে খুশি করার জন্য ভিসির নামে বদনাম করতেও কম যান না তিনি। ভিসি নিজেই তাকে এটা শিখিয়ে দিয়েছে।
ৎভিসির রুমে বসে আব্দুল করিম জরুরি একটা আলাপ করছিলেন। এ সময় ড. ফারজানা রুমে ঢুকতেই ভিসি তো রেগে আগুন। বললেন, ড. ফারজানা, আপনি জানেন আপনার ডিপার্টমেন্ট কেমন চলছে? টিচাররা ঠিকমতো ক্লাস নেন না। টিচারদের সঙ্গে স্টুডেন্টদের কোনো কাউন্সিলিং হয় না। আপনার ডিপার্টমেন্টে ছাত্র ভর্তি হয় না। আপনি কী করেন কোথায় থাকেন? এভাবে চললে তো আমরা বাংলা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো।
ড. শাহেদ জাহানের নাটকটা ভালো করেই বুঝলেন ড. ফারজানা । তিনিও বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করছি স্যার।
আপনাকে তো যখুনি কিছু বলি, তখুনি বলেন, সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। শোনেন এভাবে ডিপার্টমেন্ট চলবে না।
আব্দুল করিম ড. ফারজানার পক্ষ হয়ে বললেন, স্যার, ড. ফারজানা অনেক কাজ করেন। চেষ্টা করছেন। বাংলা এমনিই কেউ পড়তে চায় না। তারপরও দুতিন জনের জয়গায় এখন
তো সেমিস্টারে চার পাঁচজন করে ভর্তি হচ্ছে। একসময় ডিপার্টমেন্ট দাঁড়িয়ে যাবে স্যার।
ফারজানা কি কাজ নিয়ে এসেছেন?
স্যার, ডিপার্টমেন্ট থেকে কবিতাপাঠ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে চাই। আপনি অনুমতি দিলে কাজটা শুরু করতে পারি।
আপনার ডিপার্টমেন্টে তো ছাত্রই নেই। কাদের নিয়ে কবিতাপাঠ প্রতিযোগিতা করবেন? আগে ছাত্র বাড়ান।
স্যার, যে কয়জন আছে তাদের নিয়েই করুক না! আর এসব না করলে ছাত্র বাড়বে কিভাবে!
সিসি সাহেব অবশ্য ঠিকই বলেছেন। ঠিক আছে করেন।
ড. ফারজানা বের হয়ে যায়।
শিক্ষকদের ভগবান মানে। বাস্তবের ছবিটা যদি মানুষ জানতো! আর আমিও তো সেই জঘন্যতায় ডুবে আছি—বেরুনোর আর সুযোগ কোথায়! কতো আদর্শ চেতনা ধারণ করে বাংলায় পড়েছিলাম। এই হলো বাংলার অবস্থা— এই বাংলার শিক্ষকের অবস্থা!
আব্দুল করিম বললেন, স্যার, ড. ফারজানা কিন্তু কাজের মেয়ে। অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানদের থেকে অনেক বেশি অ্যাকটিভ। স্যার আর একটা কথা বলি, ও তো একটা ডক্টরেট করা মেয়ে। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। বেতন দেয়া হয় মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা। যেখানে অর্থনীতি বা ইংরেজি বিভাগের একজন প্রভাষককে শুরুতে চল্লিশ হাজার টাকা দেয়া হয়। ওদের তো মন থাকে না কাজে। নিজের কাছেও তো অপমান লাগে।
আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু বোর্ড তো বাংলার কথা শুনতেই পারে না। বেতন বাড়ানোর কথা বললেই ক্ষেপে যাবে। বলবে, ডিপার্টমেন্ট বন্ধ করে দেন।
আমি বোর্ড মিটিংয়ে বিষয়টা তুলবো। অন্তত ড. ফারজানার বেতনটা বাড়ানো হোক। আমি কিন্তু স্যার ত্রিশ হাজার টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেবো। আপনি সমর্থন করবেন।
আপনি পাগল হয়েছেন! কোনদিন একবাওে এতো টাকা বাড়াবে না। ফার্মেসি বা বিজনেস ডিপার্টমেন্ট হলেও না হয় একটা কথা ছিল।
না, এটা বোর্ডে তুইলেন না। ডিপার্টমেন্টই তো রাখতে চান না।
স্যার আমার ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেন। আপনার কাছে যদি ডিপার্টমেন্ট বা ড. ফারজানা সম্পর্কে বোর্ড কিছু জানতে চায়, আপনি পজেটিভ বলবেন। তারপর হলে ভালো, না হলে না হলো। চেষ্টাটা তো করে দেখি। ডক্টরেট করা একটা মেয়ে সারাদিন কী পরিশ্রমটা করে। দেখে তো মায়াও লাগে।
ঠিকই বলেছেন। ঠিক আছে বোর্ড মিটিংয়ে এজেন্ডা দিয়ে দেন।
বোর্ড মিটিংয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারপারশন ড.ফারজানার বেতন বৃদ্ধির এজেন্ডা উঠতেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তৌফিক চৌধুরী একরকম বিরক্তই হলেন। বললেন, এসব এজেন্ডা কেন আনেন? আমি তো ব্যবসা করি এটা তো জানেন। যে ডিপার্টমেন্টে একটা পয়সা লাভ তো দূরে থাক, প্রতি মাসে আমাকে একগাদা করে টাকা লোকসান গুনতে হয়। সেই ডিপার্টমেন্টের টিচারের আবার বেতন বৃদ্ধি কিসের? লাভ না হোক সমান সমান হলেও তো একটা কথা ছিল। অন্য আর কি এজেন্ডা আছে, সে বিষয়ে কথা বলেন।
আব্দুল করিম অন্য এজেন্ডা না এনে বাংলার এজেন্ডা নিয়েই কথা বলতে থাকেন। বোর্ডকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন। বললেন, স্যার, সরকারের একটা বাধ্যবাধকতা আছে বাংলা চালুর বিষয়ে। ইউজিসি থেকে চিঠিও দিয়েছে। আমাদের এখানে বাংলা বিভাগ আছে এটা তো সরকারের কাছে আমাদের একটা প্লাস পয়েন্ট।
বাংলায় তো কেউ পড়ে নারে ভাই। আর বাংলায় পড়েইবা কী হয়! বাংলায় পড়ে কোন চাকরি হয়? আপনিই বলেন বাংলায় পড়ে কী চাকরি হয়?
স্যার, বাংলায় পড়ে কেউ তো বেকারও থাকে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে এতো নাম, সেটা তো বাংলার জন্যই।
বাংলার জন্য? কিভাবে?
বাংলা বিভাগ থেকে যে সব অনুষ্ঠান করা হয়, সেসব অনুষ্ঠানে দেশবরেণ্য কতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা আসেন। অন্য কোন বিভাগের অনুষ্ঠানে কি তাদের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা আসবেন? আসবেন না। এটা কিন্তু স্যার আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার।
আপনার কথায় যুক্তি আছে। আমি তো অতকিছু ভাবিনি। চিন্তাও করিনি। হাসিনা সরকার বাংলা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করেন, বাংলা চালুর কথা বলেন, সেজন্য খুলে রেখে দিয়েছি। কোনভাবে থাকলেই হলো। ভিসি সাহেব আপনি কি বলেন?
স্যার, সিসি সাহেব ঠিকই বলেছেন। বাংলা বিভাগকে আরো ডেভেলপ করা দরকার। ডিপার্টমেন্টটা বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। অন্য আরো কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ও তো বাংলা চালু করতে যাচ্ছে। ফলে একটু গুরুত্ব না দিলে ডিপার্টমেন্টটা নষ্ট হয়ে যাবে।
এসময় আব্দুল করিম বেশ জোর দিয়ে বললেন, ড. ফারজানাকে নেয়ার জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় চেষ্টা করছে। তারা তাকে অনেক বেশি স্যালারির প্রস্তাবও দিয়েছে।
দেখুন করিম সাহেব, আগেও বলেছি। আমি ব্যবসা করি ব্যবসা বুঝি। যে ডিপার্টমেন্টে প্রত্যেক সেমিস্টারে লোকসান দিতে হয়, এবং সারাজীবনই দিতে হবে, সে সব ডিপার্টমেন্টে হাই-স্যালারির ফ্যাকাল্টি প্রয়োজন নেই। নামমাত্র স্যালারি দিয়ে কয়েকজন ফ্যাকাল্টি রেখে দেন, বাংলা বিভাগ এখানে আছে, সরকার এটা জানলেই আমার চলবে। এটা দিয়েই দেশপ্রেম দেখানো যাবে। আমরা যে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ লালন করি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ আছে, এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কে কয় টাকা বেতন পান, কে এখানে পড়ান না পড়ান, এসব কে দেখতে আসবে। ড. ফারজানা যদি হাই-স্যালারি পেয়ে কোথাও চলে যেতে চান, যাবেন। আরো তো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ আছে, সবখানেই কী ড. ফারজানা আছেন?
আব্দুল করিম অনেকটা হতাশ হয়ে বললেন, স্যার, ড. ফারজানা কিন্তু অনেক কোয়ালিটিসম্পন্ন ফ্যাকাল্টি। ডিপার্টমেন্ট আজ যে পর্যায়ে এসেছে, সেটা কিন্তু তার কারণেই। এভাবে আর দুই তিন সেমিস্টার গেলে, লোকসান থাকবে না। আর উনি যদি চলে যান, এই ডিপার্টমেন্ট এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর আব্দুল করিম ভিসি স্যারের দিকে মুখ করে বললেন, স্যার আমি কি ভুল বলছি?
ভিসি স্যার উত্তর দেয়ার অগেই তৌফিক চৌধুরী বললেন, কি ভিসি সাহেব, করিম সাহেব যা বলছেন, তা কি ঠিক আছে?
মেয়েটা ভালো। অনেক কাজ করে। ছোট করে উত্তর দিলেন ভিসি।
ঠিক আছে আপনিও যখন বলছেন। বলেই তৌফিক চৌধুরী ড. ফারজানার ফাইলে স্বাক্ষর করে ফাইলটা আব্দুল করিমের দিকে ঠেলে দিয়ে আবার বললেন, আমরা তো এর আগে এতো টাকা আর কোন ফ্যাকাল্টির জন্য বাড়াইনি। তারপর আবার বাংলা ডিপার্টমেন্টের একজন ফ্যাকাল্টির জন্য এত টাকা! আপনারা শিক্ষিত মানুষ; ন্যায়-অন্যায় ন্যায্য-অন্যায্য আপনারাই ভালো বুঝবেন। তৌফিক চৌধুরীর চোখেমুখে একটা বিরক্তভাব শক্ত হয়ে জমে থাকলো।
ড. ফারজানা জানতেন আজ চেয়ারম্যান মহোদয়ের কাছে তার বেতনে বৃদ্ধির ফাইলটা যাবে। তার মধ্যে বেশ টেনশন কাজ করছিল। কয়েকবার আব্দুল করিমকে ফোন দিই দিই করেও আর দেয়নি। ভিসি স্যারকেও ফোন দিতে যেয়েও দেয় নি। চেয়ারম্যান স্যার বুঝতে পারলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
মিটিং শেষ করেই ড. শাহেদ জাহান বের হয়ে গাড়িতে উঠেই ভাবলেন, সুখবরটা ফারজানাকে দিই।
ফারজানা, টেনশন করছো?
তা তো একটু করছিই। স্যার, আমার বেতনের ফাইলটা চেয়ারম্যান স্যার সিগনেচার করেছেন?
হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত করানো গেলো আর কী! বহুত ঝুক্কিঝামেলা শেষে প্রস্তাবিত ত্রিশ হাজার টাকাই পাশ হয়েছে। কী এবার খুশি তো!
স্যার, অনেক। অনেক। অনেক খুশি আমি। ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। শোনো, তোমার সিসি লোকটা ভালো না। সে তো তোমার ফাইল নিয়ে এত বাধা দিচ্ছিল, যা হোক শেষপর্যন্ত করাতে পেরেছি এটাই বড় কথা।সিসির সাথে এসব বিষয়ে কোনো কথা বলো না। আমি যে তোমাকে জানিয়েছি, তাও বলো না।
না, স্যার, কিচ্ছু বলবো না। আমার ভরসা তো আপনি স্যার।
তা আমি জানি। শোনো, কাল পরশু তো আমি খুব ব্যস্ত থাকবো। আজ হলো রবিবার। তুমি বুধবারে দুপুরে ব্লুবার্ডে আমার সাথে লাঞ্চ করো। পারবে?
অবশ্যই পারবো, স্যার।
সময়টা বেশি নিয়ে আসবে। এই ধরো রাত দশটা এগারটা পর্যন্ত এনজয় করবো।
স্যার, কোনো সমস্যা নেই। আপনি যা বলবেন, যেভাবে বলবেন, আমি সেভাবেই সব করবো। যদি আপনি চান সারারাতও আপনার সাথে আমি কাটাতে পারবো। আমি হাজবেন্ডকে ম্যানেজ করতে পারবো। কোনো সমস্যা হবে না। স্যার, আপনি আমার ভগবান। আপনার আনন্দের জন্য, আপনার খুশির জন্য আমার সব পূজা তো আপনারই।
তুমি খুব ভালো মেয়ে। একদম লক্ষ্মী মেয়ে। শোনো, সিসি তোমাকে ফোন করতে পারেন বেতনের খবরটা দেওয়ার জন্য। যদি জানতে চান আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম কি না! বলবে, না, স্যার ফোন করেননি। বলেই লাইন কেটে দিয়ে ভাবেন, ফারজানা, মেয়েটা আসলেই ভালো। কত মেয়ের জন্য কত কিছু করলাম, সবাই তো পাবার আগে কতরকম ফুলের মতো নিজের সৌন্দর্য ছড়ায়, ঘ্রাণ দেয়। স্বার্থ উদ্ধারের পর চেহারা পাল্টে যায়। চেনা ফুলের সৌন্দর্য ঘ্রাণ কোথায় যে অচেনা হয়ে যায়! ভাবে, ফারজানার ক্ষেত্রে করিম সাহেব একটা বিষকাঁটা হয়ে আছে। আসলে তাদের ভেতর কিছু একটা আছে কি না, বোঝা মুশকিল!
ৎট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তৗফিক চৌধুরীর সাথে কাজ শেষ করে আব্দুল করিমের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেলো।
আব্দুল করিম ড. ফারজানাকে ফোন দিয়েই প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, ভিসি আপনাকে ফোন করেছিলেন নাকি?
কিচ্ছু না জানার ভান করে উল্টো তাকেই বললেন, আমি টেনশনে মরে যাচ্ছি! কখন থেকে আপনার ফোনের অপেক্ষা করছি। খুব মন খারাপের ভান করে বললেন, জানি আমার বেতনের ফাইলটা তো সিগনেচার হয়নি। হলে তো আরো আগেই ফোন পেতাম।
আব্দুল করিম ড. ফারজানার অভিনয় একটুও বুঝতে না পেরে তিনিও নাটক করে বললেন, কী আর করা চেষ্টা তো কম করিনি। চেয়ারম্যান সিগনেচার না করলে আমার মতো কেরানির কী আর করার আছে! আর আপনার যে ভিসি! আপনার প্রতি তো খুব পিরিত দেখান, আপনিও নাকি ভেতরে ভেতরে ডুবে তার পানি খান—সবই তো কানে আসে। উনি তো আপনার পক্ষে একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলেন না।
ড. ফারজানা ভাবেন, মানুষের কত রঙ—ভিসি স্যার ভিসি স্যারের মতো বলে আমাকে ব্যবহার করতে চান। সিসি স্যার সিসি স্যারের মতো কৃতিত্ব দেখিয়ে আমাকে নিয়ে মজা খেতে চান। ক্ষমতার কতো চাতুর্য—আমাকে দুজনকেই সামলিয়ে চাকরিটা বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কোনভাবেই বুঝতে দেয়া যাবে না দুজনের সাথেই আমার ঘনিষ্ঠতা—মধুসম্পর্ক। আবার ভাবে, এটা কী সত্যি মধুসম্পর্ক নাকি বিষসম্পর্ক—বিষের পেয়ালা হাতে নিয়ে খেলছি না তো! একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই এই মধু বিষ হয়ে আমাকেই শেষ করে দেবে না তো! এক নিঃশ্বাসেই চাকরিটা খেয়ে ফেলবে না তো! একসময় কতো স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হবো। হলামও। কখনো কি ভেবেছি ভেতরে এতো জঘণ্য কদর্যরূপ! অথচ বাইরে থেকে মানুষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মন্দির মসজিদের মতো পবিত্র মনে করে। শিক্ষকদের ভগবান মানে। বাস্তবের ছবিটা যদি মানুষ জানতো! আর আমিও তো সেই জঘণ্যতায় ডুবে আছি—বেরুনোর আর সুযোগ কোথায়! কতো আদর্শ চেতনা ধারণ করে বাংলায় পড়েছিলাম। এই হলো বাংলার অবস্থা— এই বাংলার শিক্ষকের অবস্থা!
কী ড. ফারজানা চুপ করে আছেন যে? অনেক মন খারাপ! আরে শোনেন, আপনার ফাইলটা তো সিগনেচার হয়ে গেছে।
কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে ড. ফারজানা বললেন, তাই! আপনি যে কী! আমাকে কষ্ট দিতে আপনার ভালো লাগে বুঝি! রিয়েলি আই লাভ ইউ করিম।
আই লাভ ইউ টু, ড. ফারজানা।
সাবিহা করিম বারান্দায় গিয়ে গ্রিল ধরে দূরের দিকে তাকায়। শহরের রাতের আলোছায়া আর বড় বড় বিল্ডিংয়ের বাধায় চোখ দুটো বেশি দূর এগোয় না। এমনকি বারান্দার বাইরেও না।
আপনি আমার জীবনে আশীর্বাদ। আমি চরম ভাগ্যবতী, আপনার মতো একজন মানুষকে আমার জীবনে পেয়েছি। এর বেশি আর কী বলা যায়, আপনিই বলুন!
আপনাকে পেয়ে আমি খুব শান্তি পেয়েছি। আমার অন্তরের ভেতরে—মনের ভেতরে এখন অন্যরকম একটা শান্তি কাজ করে। এতোটা শান্তি নিজের ভেতর আগে কখনো অনুভব করিনি। জানেন, আপনার ফাইল নিয়ে আমি চেয়ারম্যান স্যারের সাথে তো আজ রীতিমতো বাকযুদ্ধ করেছি। ভিসি যে কী মানুষ! একটু সাপোর্ট করলেই কাজটা অনেক সহজেই হয়ে যেতো। সাপোর্ট তো দূরের কথা, পারলে ফাইলটাই আটকে দেয়। এরা হলো উপরে উপরে দরদ দেখিয়ে মধু খাওয়া লোক—জায়গামতো গিয়ে নিজের স্বার্থের বাইরে একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। কারণে অকারণে চেয়ারম্যানকে খালি তেল মারে।
আমার তো ভিসি স্যারকে দরকার নেই। আমার জন্য আমার সিসি স্যার আছেন—যে আমার দেবতা—যে আমার ভগবান।
একথার আবেগী উত্তর দিতে খুব ইচ্ছে করলো আব্দুল করিমের। কিন্তু দিতে পারলেন না। পাশে বউ বসে আছেন। গলাটা একটু ভারি করে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, যা হোক আপনার ফাইলটা সই করাতে পেরেছি, এটিই বড় কথা। আপনি আগে পেতেন চল্লিশ। এর সাথে ত্রিশ যোগ করুন। আপনার স্যালারি এখন সত্তর হাজার টাকা। আর একটু বলি, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগে আর কোন ফ্যাকাল্টির একবারে এতো টাকা কখনো বাড়েনি। আপনিই প্রথম, যার একবারে এতো টাকা বাড়লো। তো ঠিক আছে। কাল কথা হবে। অভিনন্দন।
ড. ফারজানা ভাবেন, চাকরিতে কতো অলিগলি চোরাগলি হেঁটে চলতে হয়! সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিই কি একই রকম! নাকি যারা শুধু বাংলায় পড়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এরকম! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চয় বাংলার ম্যাডামদের এতো নাটক করতে হয় না! আচ্ছা, তারাও কি যোগ্যতায় চাকরি পান! নাকি চাকরি পেতে আমার মতো অনেক চোরা গলি তাঁদেরও পার হতে হয়! ফার্স্ট ক্লাস পেতেই কতো জলে কতো কাপড় ভেজাতে হয়েছে, কতো জনকেই তো কতো জলে নামতে দেখেছি, কাপড় ভেজাতে দেখেছি। আর চাকরি, সেটা তো আরো বড় ব্যাপার! কী জানি! কিছুই মাথায় ঢোকে না। ভিসি আর সিসি—দুজনকে একসাথে সামলিয়ে কিভাবে যে চাকরিটা করে যাবো! মাথাটা ঘুরতে থাকে। ড. ফারজানা বেতন বৃদ্ধিতে আনন্দ যতোটা অনুভব করে, তার চেয়ে বেশি চিন্তা এখন—বেতন বাড়ানোর কৃতিত্ব এখন দুজনই দেখাচ্ছে—দুজনই আমাকে নিজের মতো করে খেলার পুতুল বানিয়ে রাখবে। আবার নিজেই নিজেকে বলে, নতুন করে খেলার পুতুল বানিয়ে রাখবে কী! করেই তো রেখেছে—খেলছেই তো। আমার শরীরে কোন মেরুদণ্ড থাকবে না—হাড়-হাড্ডি থাকবে না। সার্কাসের মেয়েদের মতো। আবার ভাবে, আমার মেরুদণ্ড আছে নাকি! শরীরে হাড়-হাড্ডি আছে নাকি! একবার তার মনে ঝড়োহাওয়ার মতো চিন্তা আসে, আচ্ছা আমি এটা করি কেন! এ চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ব্যক্তিত্বের সাথে সাধারণ অন্য কোন কাজ করেও তো খেতে পারি! আবার ভাবে, তাহলে বাইরে এতো সম্মান আমি কোথায় পাবো! এটা তো আর কেউ জানছে না। আমার অখ্যাত কবি-স্বামী সারামুখে আলো ছড়িয়ে গর্ব করে বলে, আরে আমার কবিখ্যাতি না থাকতে পারে, কজন বড় কবি আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ম্যাডামকে নিয়ে ঘুমোতে পারে! ভাবনার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে ভেসে গেলো।
আব্দুল করিম ড. ফারজানার সাথে কথা শেষ করে মোবাইলটা রাখতেই তার স্ত্রী সাবিহা করিম বললেন, তোমাকে একটা কথা বলবো?
বলো।
আচ্ছা, এটা তো তুমি কাল অফিসে গিয়েও অফিসিয়াল সিস্টেমেই তাকে জানাতে পারতে। সারাদিন পরে বাসায় ফিরে, ফ্রেশ না হয়ে—না খেয়ে তাকে খবরটা দেয়ার জন্য এতো ব্যস্ত হয়ে উঠলে! তোমার ছোট্ট বাচ্চা আর আমি না খেয়ে তোমার জন্য বসে আছি। আর তুমি এসেই শুরু করে দিলে ড. ফারজানা..! অফিস করো নাকি নষ্টামি করে বেড়াও! আর অই মেয়েটাই বা কেমন তার স্বামী নেই—সংসার নেই! এতো রাতে অফিসের কথা কিসের! নাকি অফিসের কথার নামে পিরিতের সুখ নাও! কিসের এরা এতো শিক্ষিত—কিসের ভার্সিটির ম্যাডাম! আমার যেটুকু মনে হলো, মেয়েটা তোমাদের সবসময় তেল দিয়ে চলে! তোমার ভিসিকেও দেয়, তোমাকেও দেয়। বিষয়টা আমার কাছে ভালো লাগেনি।
যা জানো না, তা নিয়ে কথা বলো না। অই মেয়ের যোগ্যতা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা আছে? ওর ধারের কাছেও তোমার যোগ্যতা নেই।
তা তো তোমাদের কথার ভেতরেই বুঝলাম—কতো যোগ্যতা! আমি এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাইনে। ফ্রেশ হয়ে আসো। বাচ্চাটা বাবার সাথে খাবে বলে না খেয়ে বসে আছে।
আসলে তোমার মনটা ছোট। মনটা বড় করতে শেখো। তিনি একজন ডক্টরেট মহিলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একটা বিভাগের প্রধান। অনেক বড় ব্যাপার। তুমি এটা বুঝবে না।
আমি অতো বেশি বুঝতে চাইনি। অত বোঝার মতো যোগ্যতাও আমার নেই। আমি শুধু তোমাকে এটুকু বলবো, তার বেতন বাড়ায় তোমার কণ্ঠে যে আনন্দ প্রকাশ পেয়েছে, সেটা একজন বস-এর কণ্ঠ নয়, এ কণ্ঠটা অন্যরকম মনে হয়েছে।
তুমি এতোটা জঘন্য মনের, আমি এতো বছর সংসার করে তা বুঝতে পারিনি। আমার ঘৃণা হচ্ছে।
নিজেকে প্রশ্ন কর। উত্তর পেয়ে যাবে। টেবিলে খাবার আছে। খেয়ে নিও।
সাবিহা করিম বারান্দায় গিয়ে গ্রিল ধরে দূরের দিকে তাকায়। শহরের রাতের আলোছায়া আর বড় বড় বিল্ডিংয়ের বাধায় চোখ দুটো বেশি দূর এগোয় না। এমনকি বারান্দার বাইরেও না। চোখের জলে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে। গ্রিলের সাথেই যেন বৃষ্টিতে ভেজা লতার মতো চোখের দৃষ্টি জড়িয়ে যায়।
চলবে…