(পর্ব-১২)
ভিসি ড. সাদিক আহসান কলা অনুষদের ডিন ড. আব্দুল হামিদকে বললেন, ডিন সাহেব, আপনার সাথে বিশেষ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এর মধ্যে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, সেগুলো এজেন্ডা করে মিটিংয়ে আনবেন। কিন্তু আপনি তার আগে এ বিষয়গুলো নিয়ে কারও সাথে আলোচনা করবেন না। বিষয়টা আমার আপনার মধ্যেই থাকবে।
সমস্যা নেই স্যার। আপনি নিশ্চিন্তে আমাকে তা বলতে পারেন। কারও কাছে এ কথা যাবে না।
একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করতে চাই। অন্তত দশ বারোটা দেশের প্রতিনিধি সেমিনারে অংশগ্রহণ করবেস। এটা তিন দিনব্যাপী হবে। আমাকে বলেন তো, এটা করা সম্ভব কি না? আপনাকে আমার খুব নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত মনে হয়। বোর্ডও আপনাকে পছন্দ করেন।
স্যার, আমি আমার সাধ্যমতো কাজ করে যাই। আপনি কোনো কাজ দিলে আমি তা সম্পূর্ণভাবে পালন করার চষ্টা করবো। আপনি যেটা বলছেন, এটা সম্ভব এবং খুবই সম্ভব। আপনি অনুমতি দিলে এ দায়িত্ব আমিই নিতে চাই। বিভিন্ন দেশের সাথে আমার ভালো যোগাযোগ আছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে আগেও আমি এ ধরনের সেমিনার অনেক করেছি। এখানে করতে পারি নাই, বিভিন্ন কারণ আছে।
থাক। সেসব কারণ আমিও শুনতে চাই না। আচ্ছা, এটা করতে তো অনেক ফান্ড লাগবে। বোর্ড তো অত ফান্ড দিতে রাজি হবে না। আমরা অন্য কোনোভাবে ফান্ড সংগ্রহ করতে পারি কি না?
তাও পারা যাবে। ফান্ডের সমস্যা হবে না। বিভিন্ন ব্যাংক-এনজিও প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলে আমি আপনাকে আপডেট জানাবো। স্পন্সর হিসেবে দুই-তিনটা প্রতিষ্ঠানকে পেলেই আমাদের হয়ে যাবে।
তারপর নিয়ম মেনে বোর্ড বসিয়ে এক্সপার্ট এনে পরীক্ষা নিয়ে তাদের প্রমোশন দিতে হবে। বোর্ড কি এসবে রাজি হবে?
ডিন সাহেব, আমি নিজে একটা হিসাব করেছি, তাতে তিন দিনের একটা আন্তজার্তিক সেমিনার করতে ন্যূনতম বিশ লাখ টাকা লাগবে। বাইরের ডেলিগেটদের বিমানের টিকিট, হোটেল ভাড়া; এসবেই বেশি টাকা যাবে।
স্যার, টাকা সমস্যা হবে না। বোর্ড তো কিছু দেবে।
আমি বোর্ডে হাল্কাভাবে একটু আলোচনা করেছি। তাতে যা বুঝেছি। তা দেবে।
তাহলে হয়ে যাবে। আমি নিজেই পনের লাখ টাকার স্পন্সর নিয়ে আসবো। আমি নিজেও এরকম কিছু করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু এখানকার পরিবেশটা কয়দিন আগেও সে রকম অনুকূলে ছিল না।
আমি জেনেছি আপনার সম্পর্কে। সে কারণে আপনার সাথেই আগে আলোচনা করছি। আর একটা বিষয়, এখানে অনেকের প্রমোশন পাওনা হয়ে আছে। অনেকদিন প্রমোশন দেওয়া হয় না। কয়েক বছর ধরে বেতনও বাড়ানো হয় না। কয়েক মাস আগে বাংলার চেয়ারপারসনের বেতন বাড়ানো হয়েছে। তা কোনো নিয়মকানুনের ভেতর দিয়ে নয়। অথচ তার চেয়েও সিনিয়র অনেকেই আছেন, দুই-তিন বছর তাদের বেতন বাড়ানো হয়নি। এ ধরনের বিষয়গুলো আমাদের দেখতে হবে। এসব অনিয়ম অব্যবস্থাপনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড কখনোই এগুবে না। সুনামও তৈরি হবে না। এভাবে চললে ভালো শিক্ষক আমরা পাবো না। যারা আছেন তারাও থাকতে চাইবেন না।
অসুখটা ঠিকই ধরেছেন। চিকিৎসা আরও আগেই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চিকিৎসা যিনি করবেন, তিনিই যদি রোগ আরও বেশি করে বাঁধিয়ে দেন, তাহলে অবস্থাটা যা হবার, হয়েছেও তাই। যা হোক স্যার, এটা ঠিক করে ফেলতে পারলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগতমান পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগবে না। কিছু দলবাজি এখানে আছে। এটাও ঠিক করে নিতে হবে।
শোনেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। যার যা প্রাপ্য তাকে তা দিতে হবে। না দিলে সমস্যা তো হবেই। দলবাজি তো হবেই। যাদের দু বছর বেতন বাড়েনি, পারফরমেন্স দেখে বেতন বাড়ানোর যে ব্যবস্থা আছে, তা অঅমরা করবো। যাদের প্রমোশন পাওনপ হয়ে আছে, রেজিস্ট্রারকে দিয়ে একটা নোটিশ জারি করার ব্যবস্থা করেন, তাদের আবেদনের জন্য। তারপর নিয়ম মেনে বোর্ড বসিয়ে এক্সপার্ট এনে পরীক্ষা নিয়ে তাদের প্রমোশন দিতে হবে।
বোর্ড কি এসবে রাজি হবে?
আমি কথা বলেছি। বোর্ডই আমাকে উল্টো জিজ্ঞেস করেছে, এতদিন এসব হয়নি কেন! আপনি দ্রুত এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য আপনাকে সবধরনের সহযোগিতা করতে চাই।
তাহলে তো খুব ভালো হবে, স্যার।
বোর্ড আমাকে এও বলেছে, কোয়ালিটি শিক্ষক বেশি করে নিয়োগ দেন। কোনো আত্মীয়করণ কিংবা তদবরি শুনবেন না। স্বয়ং চেয়ারম্যান বললেও শুনবেন না। আমার কাছে তো কতজনই সুপারিশ তদবিরের জন্য আসে। আমি তো কাউকে সামনের ওপর না করতে পারি না। সুপারিশ করে দেই। আপনারা এসব সুপারিশ গুরুত্ব দেবেন না। কোয়ালিটি গুরুত্ব দেবেন।
স্যার, আমরা এতদিন কিন্তু এর উল্টোটা শুনে এসেছি। সবকিছুতে বোর্ডের চেয়ারম্যান স্যার হস্তক্ষেপ করেন। নিজের লোকজনকে চাকরি দেন।
চেয়ারম্যানের নাম ভাঙিয়ে এসব চলেছে।
আমি দেখছি স্যার। বলেই উঠে যাচ্ছিলেন ড. আব্দুল হামিদ। ড. সাদিক আহসান বললেন, কফিটা শেষ করে যান।
চেয়ারম্যান নিজেও তা জানেন না। বোর্ড সবসময় চায়, বিশ্ববিদ্যালয়টা ভালো চুলুক। ভালো নাম করুক। সুনার অর্জন করুক। কোয়ালিটি ফ্যাকাল্টি আসুক।
স্যার, সিসি তো সবকিছুতে প্রভাব বিস্তার করেন। যে কারণে আমরা অনেক কাজ করতে পারি না। উনি তো বোর্ডের লোক। বোর্ডের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন। বোর্ডও তার কাছ থেকেই সব ইনফরমেশন নেয়। সে মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ নেয়।
সিসি বোর্ডের প্রতিনিধি। কিন্তু আমার আপনার থেকে তিনি বড় নন। আমরাও তো সবাই বোর্ডের লোক। যদি তিনি সেরকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন, নিজেকে ক্ষমতাবান দেখান, বোর্ডের সাথে বোঝাপড়া আমি করবো। যদি বোর্ড শোনে, ভালো। না শুনলে, দায়িত্ব থেকে সরে যবো। তবে চেয়ারম্যানের সাথে প্রতিদিনই আমার কথা হয়। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। তাকে আমার খুবই ভালো মানুষ মনে হয়েছে। খুবই হেল্পফুল। তাকে বিভিন্ন কর্নার থেকে ভুল মেসেজ দেওয়া হয়। মনে রাখবেন, আমরা এখানে কাজ করতে এসেছি। কাউকে তোষামোদ বা মিথ্যে কথার ফুলঝুরি দিয়ে খুশি করতে আসিনি। আমরা সবাই মিলে এক হয়ে কাজ করলে অনেক কিছু করতে পারবো।
স্যার, আপনি শুধু আমাকে বলবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নতির জন্য কী কী করতে হবে, দেখবেন আমি যেভাবেই পারি তা করে ছাড়বো।
আমি সেটাই চাই। আপনি নিজে একটা প্ল্যান তৈরি করেন, রেজিস্ট্রারের সাথে বসেন। এরপর একটা মিটিং দেন। মিটিংয়ে সাব কমিটিসহ যা যা দরকার মনে করেন, সেগুলো পাস করিয়ে নেবেন। আর একটা বিষয়, বাংলা বিভাগ নিয়ে সিসির এত মাথাব্যথা কেন বলুন তো? তিনি চেয়ারপারসন পরিবর্তনের কথা বলছেন। নতুন কাউকে আনতে চান। কী নামও যেন বললেন। তিনিও ফিমেল। বোর্ডও বাংলা বিভাগের প্রতি অসন্তুষ্ট। বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
আসলে স্যার বাংলা তো একটা লোকসান বিভাগ। সেভাবে ছাত্র ভর্তি হয় না। সে কারণে নানা সময় না কথা ওঠে।
কিন্তু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি বাংলা বিভাগ না থাকে, আমি তো সেটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ই মনে করি না। কোচিং সেন্টার মনে করি। আপনি বিভাগটার জন্য একটু বিশেষ যত্ন নেন তো। বিভাগটাকে কিভাবে ডেভেলপ করা যায়। যে মেয়েটা আছে, ড. ফারজানা, তিনি কি ডিপার্টমেন্টের কোনো ডেভেলপ করতে পারছেন না? আপনি তাকেও ডেকে আলোচনা করেন। বুদ্ধি-পরামর্শ দেন। সহযোগিতা করেন। প্রয়োজনে কিছু পরিকল্পনা দেন। বিভাগটাকে বাঁচাতে হবে। এর আগে নাকি বোর্ড দুই-তিন বার বন্ধ করে দিয়েছিল!
জি স্যার। আমরা বলে-কয়ে আবার চালু করেছি।
আপনি বিষয়টা বিশেষভাবে দেখেন। প্রয়োজনে বিভাগের যে কয়জন শিক্ষক আছেন, তাদের সাথেও মাঝেমধ্যে মিটিং করেন। কিভাবে ছাত্র বাড়ানো যায়, প্ল্যান বের করেন। তাদের কাছ থেকেও প্ল্যান নেন। চেয়ারম্যান তো ড. ফারজানার ওপর খুশি নন। বিরক্তই মনে হলো। তিনিও বললেন যাকে দিয়ে ডিপার্টমেন্ট চলবে না, তাকে রেখে লাভ কি!
আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে বলেছি, আমি কিছুদিন বিষয়টা দেখি। হুট করে আমি কাউকে বের করে দেওয়ার পক্ষে নই। ড. ফারজানা সম্পর্কে আরও কিছু কথা আমাকে চেয়ারম্যান বলেছেন। কথাগুলো ভালো না। আমি জানি না, সেসব কথার বাস্তবতা কী! আপনার সাথে এ ব্যাপারে পরে আলোচনা করবো। আপনি নিজে আগে দেখুন, বাংলা বিভাগকে কিভাবে বাঁচানো যায়!
আমি দেখছি স্যার। বলেই উঠে যাচ্ছিলেন ড. আব্দুল হামিদ। ড. সাদিক আহসান বললেন, কফিটা শেষ করে যান।
চলবে…
ঈশ্বর ও শয়তান-১১॥ রকিবুল হাসান