॥পর্ব-সাত॥
ইমদাদুল হক মিলন এমন কিছু গল্প লিখেছেন যেগুলো নিয়ে গৌরব করা যায়। যেমন ‘গাহে অচিন পাখি’, ‘রাজার চিঠি’, ‘নিরন্নের কাল’, ‘জোয়ারের দিন’ প্রভৃতি। তার সিরিয়াস গল্প হিসেবে এগুলোরই পরিচিতি বেশি। বোদ্ধা মহলে ঘুরেফিরে এগুলোই আলোচিত হয়। কিন্তু এসবের বাইরে অনালোচিত আরও কিছু ছোটগল্প-বড়গল্প রয়েছে, যেগুলো বিশেষ আলোচনার দারি রাখে। প্রকৃত ইমদাদুল হক মিলনকে চিহ্নায়নে এগুলো স্মারক হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘রেশমী’ নামের একটি গল্পগ্রন্থের কথা।
মানবিক সত্তা যদি কোনো কারণে লুণ্ঠিত হয় তখন মানুষের অপরাধী মন স্বস্তি নামক আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা হয়ে ওঠে। মানবিক বোধগুলো যদি জেগে ওঠে, তখনই কেবল তা সম্ভব। তখনই কেবল ভুল বা অপরাধ শোধরানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন। শোধরাতে পারলে তবেই-না স্বস্তির কুলে গিয়ে মুক্তি। নতুবা নয়।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের যাপন-পরম্পরায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর নানামুখী দিক থাকে। থাকে যেকোনো ঘটনার একাধিক পক্ষ। একটি ঘটনা কোনো পক্ষের জন্য হতে পারে নিতান্তই তুচ্ছ, বিপরীতক্রমে তা অন্য পক্ষের জন্য ভয়ঙ্কর। যে খেলাটি শিশুদের জন্য আনন্দের তাই-ই কোনো প্রাণীর (যেমন ব্যাঙ, ফড়িঙ, ইঁদুরের বাচ্চা, প্রজাপতি) জন্য জীবনসংহারী। ইমদাদুল হক মিলন এই দুটি দিকে বিশেষভাবে আলোকপাত করেছেন তার সংবেদী দৃষ্টি দিয়ে। যেখানে দুই পক্ষই মানুষ। শুধু পার্থক্য মানবিকতায়। মানবতাকে বিজয়ী করে তোলায়।
‘রেশমি’ গল্পগ্রন্থে সাতটি গল্প রয়েছে। গল্পগুলো হলো, ‘দেবশিশু’, ‘মানুষ ও খাঁচার পাখি’, ‘রেশমি, ‘শিশুহত্যা’, ‘ঘুঘু পাখিটা কাঁদছিল’, ‘ঝরা পাতাটুকু’ ও ‘জীবনবেলা’। একমাত্র জীবনবেলা বাদে বাকি ছয়টি গল্পই ওপরের বক্তব্যের সারবত্তা বহন করে।
যেমন ‘দেবশিশু’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। একটি ভুলের জন্য বিশাল মাসুল দিতে হলো সাদেক সাহেবের। মার্কেটিং অফিসারের কালেকশনের টাকা অ্যাকাউন্টসে জমা দিতে গিয়ে তিনি একলাখ টাকা নিজের কাছে রেখে দিলেন ছোটভাইকে ধার দেবেন বলে। কিন্তু হলো না। তার আগেই তিনি ধরা পড়ে গেলেন। কঠিন নিয়মের মানুষ এমডি এই অনিয়ম একেবারেই সহ্য করতে পারলেন না। এক নোটিশে বিদায় করে দিলেন পনেরো-ষোলো বছরের পুরনো কর্মকর্তাকে। এরকম এক অস্থির সময়ে চাকরি হারিয়ে সাদেক সাহেব দিশেহারা হয়ে গেলেন। একদিন সকালবেলা তিনি একা ছিলেন। তিনি ড্রয়িংরুমে এসে দেখেন বছর পাঁচেকের মতো বয়সের একটি ন্যাড়া মাথার ফর্সা ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাদেক সাহেব ভাবলেন স্ত্রী বাহিরে যাওয়ায় দরোজা তো খোলাই ছিল। এই সুযোগে অন্য ফ্ল্যাটের কোনো বাচ্চা ঢুকে পড়েছে। তিনি বাচ্চাটির সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। বাচ্চাটি কথা বলল না। তিনি ভাবলেন প্রতিবন্ধী। তিনি তাকে চকোলেট দিতে চাইলেন। বাচ্চাটি নিলো না। বাচ্চাটিকে ধরতে গেলেন। তখন দেখলেন তার হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে। শেষে বাচ্চাটিই তার হাতে এক ঝলক স্পর্শ দিয়ে চলে গেলো। তিনি ভাবলেন কয়েক দিনের মানসিক চাপে বিপর্যস্ত মনের খেয়াল হতে পারে এটি। বাচ্চাটি চলে যাওয়ার পর অফিস থেকে ফোন পেলেন তিনি। এমডি তাকে অফিসে যেতে বলেছেন। যাওয়ার আগে বিল্ডিং-এর কেয়ারটেকারকে বললেন এরকম শিশুর কথা। কেয়ারটেকার নিশ্চিত করে জানালো এরকম কোনো শিশু এই বিল্ডিং-এর কোনো ফ্ল্যাটে নেই।
অফিসে গিয়ে তিনি জানলেন তাকে আবার চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। কেন করা হয়েছে সে বিষয়ে এমডি একটি গল্প বললেন। গল্পটি আজ সকালে হাঁটতে গিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা। তিনি অন্যান্য দিনের মতো আজও সকালে হাঁটতে বেরিয়েছেন। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই তিনি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তিনি পার্কের এক বেঞ্চিতে আধাশোয়া হয়ে থাকলেন। তখনই গাছের আড়াল থেকে একটি শিশু বের হয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। তিনি শিশুটিকে ধরতে চাইলেন। তখনই তার হাত প্রায় অবশ হয়ে গেলো। তিনি শিশুটিকে ধরতে পারলেন না। তখনই তার সাদেক সাহেবের কথা মনে পড়লো। মনে হলে তার প্রতি অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। ঠিক তখনই শিশুটি তার হাতে স্পর্শ দিয়ে দিলো। তারপর শিশুটি যে ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে এসেছিলো সে দিকে চলে গেলো। শিশুটি চলে যাওয়ার সময় মোবইল ফোন বের করে একটি ছবি তুললেন।
এমডি ছবি দেখালেন। সাদেক সাহেব বলতে চাইলেন, এই শিশুটিকেই তিনি আজ তার ফ্ল্যাটে দেখেছিলেন। কিন্তু সাদেক সাহেব কিছুই বললেন না।
না, এটা মোটেই ইচ্ছেপূরণের গল্প নয়। মানব জীবনের চারপাশে বিরাজমান অসংখ্য রহস্যের একটিকে লেখক তুলে এনেছেন। যা ব্যখ্যার অতীত। যা সচরাচর চোখে দেখা যায় না। যা দেখতে বিশেষ চোখ লাগে। যা ভাবতে মনের ভেতরে থাকতে হয় বিশেষ সংবেদন। যা তুলে আনতে লাগে বিশেষ সৃজনশীলতা। যা জাদুবাস্তবতার ইঙ্গিত দিয়ে যায়। আর বাস্তবের জাদুতে জয়ী হয়ে ওঠে মানবতা।
‘মানুষ ও খাঁচার পাখি’ গল্পটিতে খাঁচার পাখি প্রতীকে মানুষেরই নিরন্তর বেড়াজালে আবদ্ধ পড়ার কথা বলা হয়েছে। ছোট্ট শালিকছানা বাসা থেকে পড়ে গেলে তার আশ্রয় হয় এক বাসাবাড়ির খাঁচায়। একসময় সেখান থেকে মুক্তি পায় সে। কিন্তু মুক্ত হয়ে ঘুরতে পারে না। আবার বন্দি হয়ে যায় আরেক খাঁচায়। সেখান থেকে খাঁচাসহ সে চালান হয়ে যায় আরেক বাড়িতে। পাখি হয়ে সেও ভাবে শুধু পাখিরই নয় মানুষের জীবনও এক অন্যরকম খাঁচার। ‘পৃথিবী ভর্তি শুধু খাঁচা। এক খাঁচা থেকে আরেক খাঁচায় ঢোকার নামই হয়তো জীবন।’ মানব জীবনের ক্ষেত্রে এর চেয়ে সত্য আর কী হতে পারে! নামগল্প ‘রেশমি’ গল্পটি খুব করুণ। রেশমির সংসারে সন্তান আসার কথা ছিল। সন্তানের জন্য ঘরও সাজিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সে-সন্তান আসেনি জীবন্ত হয়ে। মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার কয়েক বছর পরও তিনি সন্তানহীন থাকেন। একরাতে স্বামী আবিষ্কার করে রেশমি পাশের ঘরে কার সঙ্গে যেন কথা বলে। রেশমির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে তার সন্তান আসে রোজ রাতে। তার সঙ্গে সে গল্প করে। ডাক্তার সহজ সমাধান দেন। গাইনির ভালো ডাক্তার দেখান। দ্রুত বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করুন। বাসাটা ছেড়ে দিন। কিন্তু কোনোটাই করা হয়না রেশমির স্বামীর।
‘শিশুহত্যা’ গল্পটিও করুণ বেদনার। সিরিয়ার বোমা হামলায় নিহত শিশুর ছবি ছাপা হয়েছে খবরের কাগজে। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পের কথক সেই ছবির দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন। ঠিক তার বড়মেয়ের ছোটবেলার ছবি। গ্রামের বাড়ি দেখভাল করে বারেক। সে খুব সকালে এসে হাজির। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তার নাতনীর মৃত্যু সংবাদ দেয় সে। প্রায়ই না খেয়ে থাকা শরীর মেয়েটির। এক বাড়িতে জেয়াফত খেয়ে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। তারপর মৃত্যু। গল্প কথাক স্তম্ভিত হয়ে যান। এক দিকে সিরিয়ার বোমা হামলায় নিহত শিশুর ছবি, গাজা উপত্যকায় রক্তাক্ত শিশু, পেশোয়ারে স্কুলে নিহত শিশু, তার পরিবারের কাছের একজন মৃত শিশু। তিনি দিশেহারা হয়ে যান। তিনি তার অজান্তেই নিজের শিশুকে আরো শক্ত করে ধরে থাকেন। লেখক প্রতীকের আড়ালে এখানেও এক ধ্বস্ত মানবতার চিত্র এঁকেছেন। ‘ঘুঘু পাখিটা কাঁদছিল’ গল্পটিতেও মানবতার জয়গান গাওয়া হয়েছে। অফিসে হঠাৎ করে ঘুঘুর ডাক শুনতে পাওয়া যায়। কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায় অফিসের এক ক্লিনার ঘঘুর ছানাগুলোকে সরিয়ে রেখেছে। এজন্য ঘুঘু ডাকছে। অফিসের কর্তা নির্দেশ দেন ঘুঘুছানাগুলোকে যথাস্থানে রেখে আসতে। তারপর দেখা যায় মা ঘুঘুর পরম আদর। ঘুঘু আবার ডাকতে থাকে। অমিত বলে, আগে ঘুঘু কাঁদছিল। এখনও কাঁদছে। তবে এই কান্না আনন্দের। সন্তান ফিরে পাবার আনন্দ। ‘ঝরা পাতাটুকু’ গল্পটিও আরেক করুণ গল্পের উজ্জ্বল উদাহরণ। সিরিয়ালের প্রডিউসার এখন একাকী জীবন কাটান। রান্নার জন্য আছে কাজের বুয়া। একদিন তিনি লক্ষ করেন কাজের মেয়ের ঘরে এক কিশোরী। তাকে না বলে গ্রাম থেকে কিশোরী নিয়ে আসার জন্য কাজের বুয়াকে খুব ধমক দেন তিনি। রাতে ঘুমুতে পারেন না। তার বিবেক জাগ্রহ হয়। তিনি সকালে এসে বুয়াকে বলেন, মেয়েটিকে এখানেই রাখতে। বুয়া জানায়, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বকা দেওয়ায় নিজেকে সে খুব অপমানীত বোধ করে নিঃশব্দে চলে গেছে।
ইমদাদুল হক মিলন এভাবে বিজয়ী মানবতার জয়গান গেয়েছেন। স্থান কাল পাত্র আলাদা। বিষয়ও ভিন্ন। আলাদা চরিত্র। প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কিন্তু কেন্দ্র তো একটাই। মানবতা। ইমদাদুল হক মিলন সেই মানবতার কোমলতর জায়গায় বড়ই সংবেদী হয়ে হাত বুলিয়েছেন গল্পের মাধ্যমে।
চলবে…
ইমদাদুল হক মিলনের কথাসাহিত্য-৬॥ এমরান কবির