॥পর্ব-৬॥
ইমদাদুল হক মিলনের প্রকাশিত শেষ উপন্যাস ‘মায়ানগর’, যা বিচিত্র দিনের অনুপুঙ্খ চিত্র নিয়ে, মায়ার নিদারুণ কুহকের গভীর ঐকতান নিয়ে পাঠকের মনে নাড়া দিয়ে যায় বিচিত্র স্বাদের।
অক্ষর দিয়ে সাজানো জীবনের প্রতিবিম্বের কাছে আমরা কী চাই? কাহিনি? ধারাবিবরণী? সংকটের চিত্র? সমাধানের সূত্র? গুজব? ভাষার মারপ্যাঁচ? সরল গরল কথামালা? আধো বাস্তবতার আলেখ্য? কোনো একদিনের বিচিত্র রোদের ভেতরে গেয়ে যাওয়া বাতাসের গান? আমাদের স্বপ্নগুলো কী রূপে স্বপ্ন হয়ে যায় কিংবা আমাদের স্বপ্নগুলো কী রূপে কষাঘাত করতে থাকে তার হাহাকার? কী? কী চাই? এই সিরিজ প্রশ্নের শেষ নেই। এই অন্তহীন প্রশ্নমালার শেষ বিন্দুর পরেও যে মহাশূন্যতা বিরাজ করে সেখান থেকে উঠে আসে জীবনের আলো।
জীবনের ওই আলো এমনি এমনি আসে না। এজন্য থাকতে হয় বীক্ষণযোগ্য চোখ। থাকতে হয় অনুভবযোগ্য অনুভূতি। থাকতে হয় দেখানোর সুনিপুণ ভঙ্গি। থাকতে হয় নিজের সুখগুলোকে অন্যের সুখ করে তোলার আন্তরিকতা। থাকতে হয় নিজের দুঃখগুলোকে অন্যের দুঃখ হিসেবে তুলে আনার প্রকৃত সহানুভূতিশীল হৃদয়। এগুলোর সমপাতনতায় যে যত কুশলী, সে তত আত্মাগ্রাহী, সে তত হৃদয়বেদী।
মায়ানগর। উপন্যাসখানি পড়তে গিয়ে উপর্যুক্ত কথাগুলো মনের ভেতরে খেলে গেলো বারবার। কারণ একজন প্রকৃত কথাসাহিত্যিকের সব শিল্পগুণ যেন প্রয়োগ করা হয়েছে ‘মায়ানগর’ উপন্যাসে। উপন্যাসটির পটভূমি পুরান ঢাকা এবং বিক্রমপুর। কালখণ্ড বিগত শতকের ষাটের দশক। কথক মিলু। একজন দশ বারো বছরের শিশু। তার চোখেই দেখা হয়েছে সে-সময়ের সব চালচিত্র। তার জবানিতেই চলিষ্ণু হয়েছে উপন্যাসের ধারা। তার দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা হয়েছে সব সঙ্গতি-অসঙ্গতি, অভাব, দুঃখ, সুখ এককথায় সব চিত্র। পাঠকের ভাবতে একটুও কষ্ট হয় না যে এই মিলু লেখকের স্বয়ং শৈশব। কিন্তু এই শৈশব এতই সৎ যে, একজন পরিপূর্ণ ইমদাদুল হকের মানস সেখানে প্রভাব ফেলে না। মিলু এখানে নির্লিপ্ত। লেখক ইমদাদুল হক মিলন এখানে কেউ না।
এই দুইয়ের ভেদরেখা এমনতর স্পষ্ট যে দশ বারো বছরের বালক মিলু যা বলে, যা ভাবে, যা করে, তা যেন মিলুই করতে পারে। লেখক এখানে মিলুকে একটুও প্রভাবিত করে না। তাতে কী হয়? তাতে উপন্যাসের বিশ্বস্ততা বাড়ে। তাতে চরিত্রগুলোকে যথার্থ জীবন্ত মনে হয়। তাতে ঘটনাগুলো অধিকতর বাস্তবানুগ হয়ে ওঠে। এতই বাস্তবানুগ হয়ে ওঠে যে, পাঠক নিমিষেই চলে যায় তার শৈশবে। চলে যায় ফেলে আসা সময়ের বাস্তবতায়। এই যে পাঠককে নিমিষেই তার জীবনে অতীত হয়ে যাওয়া একটা পর্বে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, তা একজন প্রকৃত লেখকের পক্ষেই সম্ভব। জীবনের ভেতরে জীবনকে যাপিত না করতে পারলে সেটা হয় না। লেখক ইমদাদুল হক মিলন তার ‘মায়ানগর’ উপন্যাসে এটা যেন খুব বেশি করে দেখিয়েছেন।
দেখিয়েছেন ষাটের দশকের পুরান ঢাকাকে। দেখিয়েছেন পুরান ঢাকার বিচিত্র মানুষগুলোকে। দেখিয়েছেন সেই বিচিত্র মানুষগুলোর বিচিত্র জীবন প্রণালীকে। অনেক ভাইবোনের মধ্যে বেড়ে ওঠা মিলুর পরিবারের এক অংশ থাকে পুরান ঢাকায়। আরেক অংশ থাকে বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডলে। মিলু যখন পুরান ঢাকায় থাকে তখন তার চোখ দিয়ে দেখা যায় এই অংশের চালচিত্র। মিলু যখন মেদিনীমণ্ডলে থাকে, তখন তার চোখ দিয়ে দেখা যায় এই অংশের চালচিত্র। শুধু তাই নয় তার পুরান ঢাকার জীবনেও মেদিনীমণ্ডল গ্রামখানি উঠে আসে। তেমনি সে যখন মেদিনীমণ্ডলে থাকে তখনও তার স্মৃতিতে উঠে আসে পুরান ঢাকা। এভাবে দুই অংশের সমপাতনে উঠে আসে মিলুর ব্যক্তিগত সংকট। এই ব্যক্তিগত সংকটই প্রতিনিধিত্ব করে পুরো উপন্যাসের চিত্রকে। একজন মিলুর জীবনে দেখা এবং ঘটে যাওয়া ঘটনাই তুলে আনে সে-সময়ের চালচিত্রকে। সে-সময়ের সংস্কৃতি, পারিবারিক আলেখ্য আর সামাজিক সংস্কার।
কিন্তু এটা সম্ভব হলো কী করে। একজন দশ বারো বছরের শিশুর চোখ দিয়ে দেখা একটা সময়, সে-সময়ের পুরো চিত্রকে কিভাবে উপস্থাপন করে! করে। কারণ এই শিশুর চোখের পেছনে রয়েছেন ইমদাদুল হক নামীয় একজন শিল্পী। পুরো চিত্র উপস্থাপিত হয় কারণ এই শিশুর সঙ্গে সঙ্গী হিসেবে আছে লুৎফন। লুৎফন পুরান ঢাকার এমন কোনো জায়গা নেই যে চেনে না। কিন্তু লুৎফনও এক সময় হারিয়ে যায়। তবু মিলুর ঘোরা থামে না। তারপর পেয়ে যায় আলীকে। এত পথ, এত মানুষ এত সম্পর্ক, এত ভাঙা গড়া, জীবন নিয়ে এত সিদ্ধান্ত—সবকিছু মিলে তৈরি করে এক কুহক। এই কুহকের এক গভীর ঐকতান ‘মায়ানগর’ উপন্যাসটি।
ইমদাদুল হক মিলনের আরেকটি উপন্যাস পারুলকন্যা। কবি সিরিজের এই উপন্যাসটি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে।
হুমায়ূন আহমেদ-এর ‘কবি’ জোসনার ফুল ধরতে চেয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদের ‘কবি’ ছিলেন প্রচলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক নিয়ত সংগ্রামী। তারাশংকরের কবি ছিলেন আমগ্ন শিল্প সংবেদী। এই তিন কবির মধ্যকার সাধারণ মিল হলো তারা লেখকের স্বত্তা ও স্বরূপ নিয়ে উপস্থাপিত হন এবং তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন নিয়ে কবিতার চর্চা করেন। হুমায়ূন আহমেদ-এর কবি হূমায়ুনীয়, আজাদের কবিও আজাদীয়। হুমায়ুন আজাদ অন্য দুই কবিকে কবি হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে চাননি। তিনি বলেছিলেন, তারা কবি নয়, কবিয়াল।
বাংলা সাহিত্যে কবিতা-নিমগ্ন এই তিন কবির পরে আমরা আরেক ‘কবি’র সন্ধান পাই। ইমদাদুল হক মিলনের এই কবি কবিতানিমগ্ন নন। তাহলে তিনি কেমন? সেটা জানতে হলে যেতে হবে ‘পারুলকন্যা’ উপন্যাসের গভীরে।
ধানমন্ডি লেকের ধারে মৃতপ্রায় এক কিশোরী পড়ে আছে। শরীরে ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন। ভোরবেলা হাঁটতে আসা লোকজন ধরে নিয়েছে মেয়েটি মৃত। কবি আবিষ্কার করে, না, মেয়েটি বেঁচে আছে। সে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ধীরে ধীরে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু সেরে ওঠার পরও মেয়েটি কথা বলে না। নানারকম চেষ্টায় ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় এই নির্যাতনের কাহিনী।
কাহিনী এটুকুই। কিন্তু এখানেই তা শেষ নয়। পারুল নামের নির্যাতিত এই মেয়েটিকে ঘিরে প্রথমে সকালে হাঁটতে বের হওয়া কতিপয় মানুষ, তারপর কবি, তারপর তার চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট এবং কবি-সংশ্লিষ্ট আরও কতিপয় চরিত্রের সন্ধান পাই আমরা। যদি প্রশ্ন করা হয় কবি ও পারুলসহ এসব চরিত্রের সংশ্লিষ্টতায় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন কী করলেন? এই প্রশ্নের সীমিত একটা উত্তর হতে পারে তিনি মানুষের মানবিক অনুভূতিকে স্পর্শ করেছেন। স্বার্থপরতা যখন মানুষকে ক্রমাগত অন্ধ করে দেয় তখন অন্যের বিপর্যয়েও মানুষ সমব্যথী হতে পারে না। কিন্তু এটা তো মানুষের মানবিক দিক নয়। মিলন এই উপন্যাসের ‘কবি’র মাধ্যমে মানুষের ক্রমশ অসমব্যথী হয়ে যাওয়া মননকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। মানুষের ভেতরের কোমল নরম নিষ্পাপ মনকে জাগিয়ে তুলেছেন, দেখিয়েছেন প্রাচুর্যের ভেতরে থেকেও কিভাবে মানবিক হওয়া যায়, সমব্যথী হওয়া যায়, কিভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। আজ আমরা এমন এক সময়ের জীব হয়ে উঠছি, যখন ওপরতলার মানুষেরা নিচতলার মানুষকে মানুষই জ্ঞান করছে না। এরকম এক সময়ের ভেতরে বেড়ে ওঠা ধনাঢ্য কিন্তু স্বার্থ-উদাসীন ব্যক্তির দ্বারা সমাজের সবচেয়ে নির্যাতিত অনাথের পরিচর্যা করানোর মাধ্যমে কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন প্রথমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে নিচতলার এই মানুষগুলোও প্রথমত, মানুষ। দ্বিতীয়ত, তারাও সমবেদনা পাওয়ার যোগ্য এবং এটা তাদের মৌলিক-মানবিক অধিকার। তৃতীয়ত, ওপরতলার মানুষেরাও মানবিক হতে পারে ও হওয়া উচিতও।
পারুলকন্যা উপন্যাসের ‘কবি’র নামই কবি। তিনি কবিতা লিখে কবি হন না। আমরা কৃষককে বলি ফসলের কবি। পারুলকন্যার কবি কবিতা লেখেন না। ফসলও ফলান না। কিন্তু তিনি এমন কিছু করেন যা জীবনকে ফিরিয়ে দেয় জীবনের ভেতরে। যদি পৃথিবীর সবকিছু জীবনের জীবনবোধ জাগানোর জন্য হয়ে থাকে তাহলে মিলনের ‘কবি’ই শ্রেষ্ট কবি। এই কবি’র মুখ দিয়েই বের হয় ‘ শুধু নিজেকে বুঝলে মানুষ হওয়া যায় না।’
এই অন্যকে বুঝে ওঠার, অন্যের জন্য হয়ে ওঠার এক মানবিক আখ্যান ইমদাদুল হক মিলনের পারুলকন্যা। ভোরবেলা হাঁটতে আসা লোকজন যখন ভেবে নেয় যে মেয়েটি মৃত। কবি ঠিকই তার ভেতরে জীবনের সন্ধান পান। ‘সামান্য কিছু জলজ গুল্ম দেখেই জানতে পারেন তিনি/ সমুদ্রের সমস্ত সংলাপ,/ লিখতে পারেন তিনি এক টুকরো সবুজ শৈবালে/ সাগরের সকল গল্প; (কবি: সৈয়দ আবুল মকসুদ, সৈয়দ আবুল মকসুদের কবিতা)।
পারুলকন্যা’র প্রতি পরতে পরতে বিস্ময়। লেখক রহস্যাবিষ্ট করে রাখেন পাঠককে। পাঠককে ধরে রাখেন তিনি, ধরে রেখে রেখে পিপাসা বাড়িয়ে দেন। এই পিপাসা প্রতিটি শব্দকে পান করে করে শেষ শব্দে এসেও থামতে দেয় না। আপসস হয়। ইশ! শেষ হয়ে গেলো!
তবু শেষ তো করতেই হয়। কিন্তু এটাই তো শেষ নয়। এই শেষ থেকেই শুরু হবে আবার। কারণ ইমদাদুল হক মিলনের পারুলকন্যা উপন্যাসটি ‘কবি’ সিরিজের। আগের পাঁচটি উপন্যাস ‘বন্ধুয়া’, ‘আয়না’, ‘তোমার সঙ্গে’, ‘নায়িকার নাম আয়না’, ‘আয়না কেমন আছো’, ‘কবি ও একটি মেয়ে’।
চলবে…
ইমদাদুল হক মিলনের কথাসাহিত্য-৫॥ এমরান কবির