আত্মা যেন সেই স্বর্গীয় পবিত্র খাদ্য মান্না, যা বর্ষিত হতো ভোরের শিশিরের মতো, জমাট ও ঠাণ্ডা। এ ছিল ইহুদিদের জন্য স্রষ্টার পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিশেষ ধরনের রুটি। প্রত্যেক সকালে তারা কুড়াতো এই পবিত্র মান্না এবং প্রয়োজনমতো খেত। অবশিংষ্ট অংশ বাষ্পীভূত হয়ে মিলিয়ে যেত হাওয়ায়। মান্নার মতো, আত্মাও যেন সংকুচিত ও জমাটবদ্ধ অবস্থায় থাকে পৃথিবীতে। কিন্তু অচিরেই তার যাবার সময় হয়ে আসবে, ছেড়ে যাবে সে মর্তের জগৎ, ফিরে যাবে তার চিরসুখের স্বর্গে :
Such did the Manna’s sacred Dew destil;
White, and intire, though congeal’d and chill.
Congeal’d on earth : but does, dissolving, run
Into the Glories of th’ Almighty Sun.’
‘A Dialogue Between the Soul and Body’ কবিতায় মারভেল মানবাত্মা ও মানবদেহের দ্বন্দ্বদীর্ণ চিত্র উপস্থাপন করেছেন। সংলাপের কাঠামোয় রচিত এই কবিতায় আত্মা ও দেহ যেন এমন দুটি স্বতন্ত্র সত্তা যাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে একত্রে বসবাস করতে। তারা আকণ্ঠ ঘৃণায় নিমজ্জিত একে অপরের প্রতি। এই দ্বান্দ্বিক সত্তা দুটির মধ্যে আত্মাই প্রথমে কথা বলে। শুরুতেই আত্মার আহাজারি ধ্বনিত হয়, কে কাকে মুক্ত করবে দেহরূপ এই অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে। সে অনুভব করে, দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন তাকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে কারারক্ষীর মতো। দেহের এই মরচক্ষুই তাকে অন্ধ করে রেখেছে উচ্চনিনাদী বিক্ষিপ্ত শব্দরাজি তার কানকে করেছে বধির।
Here blinded with an Eye; and there
Deaf with the drumming of an Ear.
আত্মা নিজেকে এমন এক অপরাধী হিসেবে ভেবে নিয়েছে যার ফাঁসি কার্যকর হতে চলেছে। সে যেন নির্যাতিত দেহের অন্তঃসারশূন্য মস্তক দ্বারা। আধ্যাত্মিকতার আলোহীন দেহের অন্ধকার অন্তরটি দ্বৈত প্রবণতায় সদা দোদুল্যমান :
Tortur’d besides each other part,
In a vain Head, and double Heart.
কবিতার দ্বিতীয় উক্তিতে মানবদেহ তার নিজের কথা বলছে, তার দুঃখের কথা বলছে আত্মার বিরুদ্ধে। দেহও তার ওপর আত্মার আরোপিত পীড়ন বা অবদমন থেকে মুক্তি কামনা করছে। তার কাছে আত্মা যেন একটি স্বৈরাচারী, নিষ্ঠুর সত্তা যার দাসত্ব শৃঙ্খলে সে আবদ্ধ। আত্মা এমন একটি তীক্ষèধার শূলদণ্ড, অত্যাচারের এমন এক সুতীক্ষè যন্ত্র যা দেহের মধ্যে লম্বমান হয়ে তাকে বাধ্য করে অস্বাভাবিক অনমনীয় ভঙ্গিমায় অবস্থান করতে। যার ফলে দেহ ইচ্ছেমতো নমনীয় হতে পারে না। সে যেন পরিণত হয় ধাবমান সুউচ্চ গিরিপবর্তের (প্রেসিপাইস) মতো আত্মার ইচ্ছের কাছে। তাই তাকে নিম্নœগামিতা ও মৃত্যুর ভয়াবহ আশঙ্কায় গুনতে হয় নিরন্তর প্রমাদ। দেহের প্রতি বিদ্বেষবশতই আত্মা তাকে দান করেছে জীবন, অবশেষে তার মৃত্যু ঘটানোর উদ্দেশ্যেই। একটি মুহূর্তের জন্যেও তার শান্তি নেই, নেই বিশ্রাম আত্মা নামক এই অশুভ সত্তার অবিরাম পীড়নে :
A body that could never rest,
Since this ill Spirit it possest.
কিন্তু আত্মা আবার তীব্রতর অভিযোগে আবির্ভূত হয় দেহের বিরুদ্ধে। সে যেন কোনো এক মায়ায় বা যাদুবলে আবদ্ধ হয়ে আছে দেহ-পিঞ্জরে। তার দুঃখ, দেহকে সে রক্ষা করে চলে কিন্তু তাকে সয়ে যেতে হয় দেহের ক্ষতিকর প্রভাব। দেহের রোগমুক্তি তাকে আরও যত্রণাবিদ্ধ করে। রোগমুক্তি মানেই হলো আত্মার বন্দীত্বের দীর্ঘসূত্রিতা। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা শেষে প্রতিটি জাহাজ যেমন নির্বিঘেœ গন্তব্যে, বন্দরে, ফিরতে সচেষ্ট হয়; তেমনি অসুস্থ শরীরও নিরাময় প্রত্যাশা করে। কিন্তু আত্মার জন্যে গন্তব্য কিংবা বন্দর হলো স্বর্গ। সেখানে সে পৌঁছতে পারে শুধু দেহের মৃত্যুও মধ্য দিয়েই। শরীরের সুস্থতা তাই আত্মার প্রত্যাশিত নয়। তার দূরযাত্রা আশাহত হয় দেহের আরোগ্যলাভের কারণে। আত্মার কণ্ঠে সেই বিপন্ন নাবিকের আর্তনাদ, যার জাহাজ হয়েছে লয়প্রাপ্ত :
And ready oft the Port to gain,
Am Shipwreck into Health again.
দেহের প্রত্যুত্তর দানের মাধ্যেমে কবিতার যবনিকা টানা হয়েছে। তার মতে, আরোপিত অসুখে আরোগ্যলাভ অসম্ভব। আত্মার আশা ও নিরাশার অনুভূতিতে দেহে বিনাশের ঢেউ জাগে। তার ভয় দেহে আনে স্থবিরতা, ভালবাসায় অস্থিরতা। আত্মার আনন্দ ও বেদনায় দেহ হয়ে ওঠে প্রমত্ত, উন্মত্ত। আসলে, মানবজীবনের আশা-ভয়-ভালোবাসা-ঘৃণা-আনন্দ-দুঃখ নিতান্তই দেহের ওপর আত্মার আরোপিত অনুভূতি। শরীরকে অবধারিতভাবে মেনে নিতে হয় সেই অনুভূতিগুলো যা আত্মার একান্ত নিজস্ব। তাই শরীর নিতান্ত অনিচ্ছুক আত্মার এ সব মানবীয় অনুভূতির ভাগী হতে। দেহের ধারণা, আত্মার মতো মেকি একটা জিনিসই তাকে পাপের সুখ-গৃহে পরিণত করেছে। সে যে অন্যায় কাজে প্রবৃত্ত হয় তা যেন আত্মারই নিরন্তর অনিবার্য প্ররোচণায়:
What but a Soul could have the wit
To build me up for Sin so fit?
এখানে আত্মা যেন এমন এক কুশলী নির্মাতা যে সবুজ বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহ করে শুকিয়ে প্রয়োজনমতো নির্মাণকাজে নিয়োজিত করে। A Dialogue Between the Resolved Soul, and Created Pleasure কবিতায় মারভেল অঙ্কন করেছেন একটি সংকল্পবদ্ধ আত্মা ও পৃথিবীর সৃষ্ট আনন্দ সম্ভারের একটি সংগ্রামী চিত্র। সৃষ্ট বলতে মানুষের জন্যে স্রষ্টার যাবতীয় পার্থিব সৃষ্টি নিচয়কেই বোঝানো হয়েছে। আত্মার রুচি ও প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই স্বর্গীয়, কিন্তু আনন্দ নিতান্তই পার্থিব। কবিতার শুরুতে বক্তা তার আত্মাকে সাহসে ভর করে রণসাজে সজ্জিত হতে বলছে। বিশ্বাসের ঢাল মোক্ষলাভের বর্ম এবং স্রষ্টার চিরন্তন অমিয় বাণীর তরবারী নিয়ে তার প্রস্তুত হওয়ার এখনই সময়, কারণ স্বর্গীয় আত্মার শত্রু শয়তান তার শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে বাতাসে রেশমী ব্যানার উড়িয়ে যুদ্ধের জন্য সম্মুখগামী :
See where an Army, strong as fair,
With silken Banners spreads the air.
আনন্দ ও আত্মার বাকযুদ্ধের শুরুতে আনন্দই প্রথমে তার প্রলোভনের সুমিষ্ট কথামালা নিয়ে আসে। আত্মাকে সে স্বাগত জানায় মর্তের প্রভূ, স্বর্গের উত্তরাধিকার ও সমগ্র সৃষ্টির কাক্সিক্ষত অতিথি সম্মোধনে। এই ফলরাজি ও পুষ্পশোভিত সমুদয় সৃষ্টির মহাভোজসভা যেন সাগ্রহে অপেক্ষা করছে তারই জন্য। কিন্তু আনন্দের আমন্ত্রণে সাড়া দিতে পারে না সে। কারণ তার জন্য মজুদ রয়েছে স্বর্গের চিরন্তন উপাদেয় খাদ্যসামগ্রী।
চলবে…