॥কিস্তি-সাত॥
ইউসুফ সাহেব দেখতে ফর্সা গোলগাল চেহারার। বয়সে আমার ছোটই হবেন। মাথায় চুল কমে সামনের পুরোটাই টাক। কিন্তু মুখে হাসি লেগেই আছে। যদিও হাসিটা দেখলে তাকে বেশ বোকা বোকা লাগে। কিন্তু ভেতরে শেয়ালের মতো ধূর্ত। তার একটি স্কুল আছে আমার বাসার ঠিক দুটো বাসার পরে। নিচ তলায়। নাম চাইল্ড গার্ডেন ইন্টান্যাশনাল স্কুল। বাংলা মিডিয়াম। স্কুলে যখন ক্লাস চলে, তখন তার নিজের রুমে কোনো কাজ না থাকলে তিনি বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। সারাক্ষণ তার মুখে ওই বোকা হাসি ঝুলতেই থাকে। কারণ না থাকলেও হাসেন তিনি। কখনো এর-ওর সঙ্গে কথা বলেন। মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসার পথে প্রিন্সিপাল ইউসুফ সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয় মাঝে সাঝে। হাসতে হাসতে প্রশ্ন করেন, কী ভাবি, মেয়েদের স্কুল থেকে নিয়ে এলেন?
—জি। আমি অল্পে কথা শেষ করার চেষ্টা করি।
—এই ছুটি হলো মেয়েদের?
—হ্যাঁ। এই তো।
—কত করে বললাম, আমার স্কুলটাতে জয়েন করেন।
—মেয়েদের দেখবে কে? স্কুল থেকে আনবে কে? আমি উত্তর দেই হেসে।
—কী বলেন ভাবি? মেয়েরা স্কুলে থাকতে থাকতেই তো আমার মর্নিং শিফ্টের সব ক্লাস শেষ হয়ে যায়। মর্নিং শিফট্ সকাল আটটা থেকে বারোটা। যদি ডে শিফটে কাজ করেন, তাহলে বেলা এগারোটা থেকে শুরু করে তিনটেতে শেষ।
—মেয়েদের তো স্কুল ছুটি দেড়টায়।
—ওদের বাবা যদি একটু এনে দেয়। তাহলে তো আর চিন্তা নেই। না?
আমি কথা বাড়াই না। বলি, আমি ভাববো।
—আপনার মতো উচ্চতর বিদ্যাপীঠে শিক্ষা গ্রহণ করা একজন শিক্ষক পেলে আমার স্কুলটা জাতে উঠে যেতো ভাবি।
—হুম।
—ঠিক আছে প্রিন্সিপাল সাহেব। আমাকে ভাবতে দিন।
আমি হাঁটতে থাকি। আবার পেছন থেকে ডাকেন তিনি, ভাবি, আমার ফোন নম্বরটা রাখুন।
—হুম আচ্ছা, বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি ফোনটা বের করে তার নম্বর সেইভ করি।
—ঠিক আছে। আমি তাহলে যাই।
আমি কোনোমতে ইউসুফ সাহেবকে কাটিয়ে আসি। এমনটাই ঘটে প্রায়। আজ অসময়ে দুর্ভিক্ষের কালে ইউসুফ সাহেবের কথাই মনে পড়ে সবার আগে। ঠিকই তো। এই চাকরিটা হলে তো আমার বেশ হয়। একদম বাসার কাছেই। মেয়েদেরও খবর রাখতে পারবো। মাস কাবারে কম করে হলেও যদি ৫০০০ টাকা পাবো। তবু তো মেয়েদের খাবারটার ব্যবস্থা করতে পারবো। আর যদি এর মধ্যে ওদের বাবার চাকরি হয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই। পড়ে থাকা বাড়িভাড়া আর স্কুলের বেতন পরে না হয় শোধ করে দেব। রানিং মাস থেকে বেতন আর বাড়িভাড়া দিতে শুরু করবো। আর বাকিটা আমার বেতন থেকে জমিয়ে জমিয়ে শোধ করে দেবো। ইউসুফ সাহেবের ফোন নম্বরটা তখনই ডায়াল করি। সঙ্গে সঙ্গে অন্যপ্রান্ত থেকে উত্তর আসে।
—হ্যালো
—জি, আমি জয়শ্রীর মা বলছি।
—ও ভাবি? জি বলুন।
—না মানে আমার একটা চাকরি দরকার। আপনার স্কুলে কি ভেকেন্সি আছে?
—কী যে বলেন না ভাবি? আপনার জন্য ভ্যাকেন্সি লাগবে না কি? হা হা হা।
কেমন যেন ক্রুর লাগে আজ তার হাসি আমার কাছে। নাকি বিদ্রূপ! কে জানে।
—না মানে।
— হা হা হা। কবে জয়েন করতে চান?
আজকে তার হাসিটা অনেক বেশি উচ্ছ্বাসে ঠাসা। আর প্রলম্বিত লাগে আমার কাছে। কে জানে আমার দুর্বল সংকোচে ভরা মনে হয়তো ভুলই শুনছি ভেবে কথা আগাই।
—কবে সম্ভব হবে?
—আপনি কালই জয়েন করুন। কোনো অসুবিধা নেই।
—আচ্ছা।
—রাখি ভাবি।
আমি আমতা আমতা করি। বেতন বিষয়ে ইউসুফ সাহেব কোনো কথা বলেন না। আমিও খুব লজ্জিত বোধ করি এসব বিষয়ে কথা বলতে। তবু দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে আমার। তাই কিছু করারও নেই।
—না মানে। বেতন কত?
—আহহারে ভাবিই-ই-ই। টাকা-পয়সা হাতের ময়লা। আপনার মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে এসব কথা বলতে আমারই লজ্জা লাগে। হা হা হা। ভাবি, আপনার এসব ভাবতে হবে না। আপনার যোগ্যতা অনুযায়ীই বেতন আপনি পাবেন।
—না মানে। তবু জানতে পারলে ভালো হতো।
—হা হা হা। তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। কিছু মনে করবেন না ভাবি। এসব স্কুল তো নন প্রফিটেবল অর্গানাইজেশন বুঝলেন না? আমরা দেশের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে স্কুল চালাই। মানুষ গড়ি।
আমার এসব কথা শোনার মতো মনের অবস্থা নয় তখন। আমি তার কথার মাঝখানেই বলি,
—জি। তাহলে কত বেতন?
—আপনি মাসে ১০০০ টাকা পাবেন।
আমি কথা খুঁজে পাই না। মনে ভাবি, একটা বুয়া কাজ প্রতি ৫০০ টাকা নেয়। এটা ২০১৪ সাল। আমি ২০০১ এ চাকরি ছেড়ে এসেছি ২৫০০০ টাকা বেতনের। আর এই অসময়ে বিপদে পড়া মানুষের সঙ্গে এই আচরণ।
আমার আর একটা মন বলতে থাকে, তোমার মেয়েদের কিন্তু খাবারের জোগাড় নেই এটা ভুলে যেও না। ভোলো না ঘরে তোমার অবিবেচক কর্মবিমুখ স্বামী।
—ভাবি। ভাবি…কিছু বলবেন না?
ওদিক থেকে প্রিন্সিপাল ডাকেন। আমি শুনি না। আমার বুকে ব্যথা। চোখে সমুদ্র। মনে ধূলির ঝড়। এই ১০০০ টাকায় আমার কী কী কাজ হতে পারে, তারই হিসাব করতে চেষ্টা করি মনে মনে। কিন্তু জানি না। কিছু জানি না।
—হ্যালো। হ্যালো ভাবি। ভাবি হ্যালো। হ্যালো। হ্যালো। হ্যালো…
প্র্রিন্সিপাল ফোন নামিয়ে রাখেন। আমি ভাবতে থাকি ১০০০টাকা আমায় কে দিয়ে যায়? এছাড়া যদি বলে-কয়ে আর একটু বাড়ানো যায়। আমি আবার ফোন করি। অন্য প্রান্ত থেকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন তোলেন।
—বলুন ভাবি। আমি ভাবলাম আপনি বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন।
—না না। আমি বলছিলাম আর একটু কি বাড়িয়ে দেওয়া যায় না? ধরুন ৫০০০টাকা?
একথা কটা বলতে গিয়ে আমি লজ্জায় মরে যাই। যেন মারাত্মক অপরাধ করছি। যেন সাত জনমের দোষ আমার। যেন সমাজ সংসার বাবা-মায়ের মুখে চুনকালি দিচ্ছি—এমন সংকোচ আমার। অন্যপ্রান্ত থেকে কথা ভেসে আসছে।
—ছিঃ ছিঃ ভাবি কী বললেন এটা? আমরা কি বিজনেস করতে বসছি এখানে। মানুষ গড়ার কারিগর আমরা। আমাদের কি এমন বার্গেনিং সাজে?
তাই তো। আমি আরও লজ্জা পেতে থাকি। আমতা আমতা করি।
—আচ্ছা এক কাজ করেন ভাবি। আপনি কাল জয়েন করেন। ১ হাজার ৭০০ টাকা পাবেন। আর যদি টিউশন-ফিউশন করতে পারেন, তবে ভালো কামাতে পারবেন।
তার বাক্যের প্রয়োগ আমার আজীবনের পরিশুদ্ধ রুচিতে আঘাত লাগে। তবু টিউশন শব্দটাতে আমার মন নেচে ওঠে। যেন হঠাৎ আলোর একটা ঝলক দেখতে পায়। আমি নড়ে বসি। মনে মনে বলি—ঠিক। যদি স্কুলের পর টিউশনি করাতে পারি। তবে হয়তো বেশ চলে যাওয়া যাবে।
আমার খুব খুশি খুশি ভাব লাগে। বহুদিন পর যেন বসন্ত এসেছে। আমি আবার কাজে লাগতে যাচ্ছি। আমি আবার নতুন করে কাজ করতে যাচ্ছি। আমার মেয়েদের খাবার আমি জোগাড় করবো। কোনো চিন্তা নেই আর। আর কেউ আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আমি নেচে নেচে সেই কিশোর বেলার মতো কৈশোর আর যৌবনের মতো উদ্দাম স্বরে গান করতে থাকি। আমি লালমাইয়ের উঁচু টিলা থেকে জল থৈ থৈ শব্দে নামতে থাকি মাটির পৃথিবীতে—তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই। মনোহরণ চপল চরণ সোনার হরিণ চাই। আমার সোনার হরিণ চাই। আমার সোনার হরিণ চাই। তোরা যে যা বলিস…।
চোখ আটকে যায় মেয়েদের দিকে। রাজর্ষিও জেগে উঠেছে। দুই বোন দেয়ালের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ভীত চোখে আমার দিকে চেয়ে। ওরা অনেকদিন আমাকে এমন দেখেনি। আমি ওদের কাছে যাই।
—মা আমার একটা চাকরি হয়েছে।
জয়শ্রীর বয়স সাড়ে ছয়। ও কিছু হয়তো বুঝতে পেরেছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে হেসে উঠে বলে—সত্যি মা?
রাজর্ষি ততক্ষণে বুঝতে পারে ভয় পাওয়ার তাহলে কিছু নেই। এটা তার মা। সেও গলা জড়িয়ে ধরে আমার—মা।
কলিং বেল বাজে। আমি একই আনন্দের আবেশে দরজার কাছে ছুটে যাই। মনে ফড়িংয়ের মতো ওড়াউড়ি গতি। চপল আনন্দে দরজা খুলে দেই।
—আপা, সালাম।
—সালাম লিটন ভাই। আসুন।
—আপা এ মাসের বাড়িভাড়াটা…
চলবে…