॥কিস্তি-দুই॥
তিন.
রাত ভোর হয় হয়। সেহেরি খেয়ে শুয়েছি কিছুক্ষণ। আবছা ঘুমের ঘোরে শুনছি কিছু অস্পষ্ট গোলযোগ। অনেক লোকের একটানা গোলমেলে শব্দে। ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছিল অনেক অনেক লোক কোথাও জটলা করে কিছু একটা আলোচনা করছে। বেশ খানিকটা উঁচু স্বরে। আমি ঘুমের মধ্যে ভাবছি।
—এই রোজা রমজানের দিকে পাশের বাড়ির ব্যাচেলার ছেলেগুলো শুরু করলো কী?
ঠিক তখনই গৃহকর্তা আমাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙালো।
—ওঠো ওঠো পুলিশ।
আমার গৃহকর্তা তখন চাকরিবিহীন। সঙ্গে ব্যাংক লোনে ফেঁসে যাওয়ায় সিঁদুরে মেঘে আগুন দেখতে পাওয়া মন নিয়ে দিনযাপন করছেন। কারণে-অকারণে ব্যাংক থেকে ফোন আসে যখন-তখন।
—শুনুন এই মাসের মধ্যে সব কিস্তির টাকা দিতে না পারলে কিন্তু কেস হয়ে যাবে।
সারাদিন সে স্বপ্ন দেখে কেমন করে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে চলেছে। আচ্ছা হাতে হাতকড়া পরাবে না তো? এত্তগুলো টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে? বাপ দাদার নাম ডাক সবই যাবে। এইসব দিবাস্বপ্ন তাকে ঘুমাতে দেয় না। ততক্ষণে দরজায় দড়াম দড়াম ধাক্কা পড়তে থাকে। যতই হোক পুলিশের রক্ত কিনা। জনগণের টাকায় দাগি আসামি থেকে চোর-ধর্ষক সবাইকে বাঁচানোর মহান ব্রত কাজে যারা ব্যস্ত থাকেন অহরাত্র। দরজায় দুমদাম শব্দ।
—দরজাটা একটু খুলুন। খুলুন দরজা।
দরজা খোলার সঙ্গে-সঙ্গেই দু’জন পুলিশ ঢুকে পড়ে ঘরে। একজন থানার ওসি। হাতে রুমালে জড়ানো একটা পিস্তল, আমাদের সামনে এগিয়ে ধরে।
—আপনার পাশের বাড়ির আলমারিতে পিস্তল পাওয়া গেছে। মানিক রেখেছিল। আপনি সাক্ষী। আর এখানে নাম ঠিকানা লিখে দিন।
একটা কাগজ মেলে ধরে সামনে। আমি কী করতে হবে বুঝতে পারি না সহসা। কী ঘটে গেছে এরই মধ্যে, তাও বুঝতে পারি না। পাশাপাশি দু’বাড়ির দরজা খোলা। ওসির ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি দেই পাশের বাসায়। দেখি মানিকের হাতে হাতকড়া পরানো। ভাবি একটানা কেঁদে চলেছে। আমাকে দেখেই কান্না বেড়ে চলে। সঙ্গে বিলাপ।
—সর্বনাশ হইয়া গেলো ভাবি। ওই হারামি ইয়াবার ব্যবসায়ী সব শেষ কইরা দিলো। আমার ছেলেটারেও শেষ করলো। দেখেন ভাবি দেখেন। পোলা আমার নেশা কইরা কখন পিস্তল ঘরে আনছে। আবার রাখছেও আলমারির ভেতরে।
আমার বুঝতে বাকি থাকে না—এ রিফাতের বাবার কাজ। তার মানে আরও ভয়াবহ কিছু ঘটতে চলেছে। ঠিক তখনই ওসি মানিকের পায়ে খুব জোরে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে বলে,
—বল্। আর একটা কোথায় রেখেছিস?
—হায় হায় স্যার। এমনে মারলে মইরা যাইবো আমার ছেলেটা স্যার।
আর পাশে দাঁড়ানো ১৫/১৬ বছরের ছোট মেয়েটাকে বলতে থাকে,
—ওই পায়ে ধর। স্যারের পায়ে ধর।
আমি চমকে উঠি।
—আরও একটা পিস্তল রয়েছে ওর কাছে? কী বলছেন এসব?
—হ্যাঁ। আমরা ইনফরমেশন নিয়ে এসেছি।
—কিন্তু মানিক তো খুব ভদ্র ছেলে। ওকে তো কোনোদিন কোনো খারাপ কাজে দেখিনি।
—আপনি চুপ করুন। খারাপের কতটুকু জানেন আপনি?
মানিকের হাঁটুতে আর একটা ঘা পড়ে। অদ্ভুত লাগে আমার কাছে। এত জোরে পুলিশের লাঠির বাড়িটা খেয়েও ছেলেটা একটা শব্দ করে না। শুধু চোখ দিয়ে জল টলটল করে ঝরে পড়ছে। ওর মা চিৎকার করে ওঠে,
—এমনে মারলে তো ওর পা ভাইঙ্গা যাইবো স্যার।
এরই মাঝে একজন বোরখা পরা ২৮ কী ৩০ বছর বয়সী মহিলা উঠে আসেন হন্তদন্ত হয়ে। ভীষণ চিন্তিত আর দ্রুতগামী তিনি। বেশ তাড়াহুড়ো তার,
—এটা চারতলা তো? তাই না? রিফাতদের বাসা? তাইতো?
একবার প্রশ্নটা করেই তড়িঘড়ি করে ঢুকতে যান আমার বাসায়। আমি বুঝতে পারি চারতলা ভেবে টেনশনের কারণে তিনি পাঁচতলায়ই উঠে এসেছেন। কারণ চারতলায় ঠিক আমার বাসার নিচেই রিফাতদের বাসাটা। আমি তাকে আটকাই,
—না না। এটা তো পাঁচতলা।
কেমন অপ্রস্তুতের মতো তাকান তিনি।
—আপনি ঢুকলেন কেমন করে? এখানে তো পুলিশ।
—নিচে হারামি নানিটা নেই দেখেই ঢুকে পড়েছি। কিন্তু পুলিশ এখানে কেন? চারতলায় তো সব কাজ কারবার।
—কী বলেন? কী কারবার?
—আপনি জানেন না, চারতলায় রিফাতের বাবা নেশার দ্রব্যের ব্যবসা করে? কত কত সংসার যে ধ্বংস করে ফেলছে। কত কত ইয়ং ছেলে নেশায় পড়ে নিজের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে দিচ্ছে। দেশটাকে এক ঘোর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কারা? এরাই তো। একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন।
—আমার স্বামী এখানে ইয়াবা নিতে আসে। সবাই জানে। আজও ঢুকেছে। হাতে নাতে ধরবো বলে আজ পিছু পিছু এলাম। প্রায়ই আসি। কিন্তু বজ্জাত নানিটার জন্য ঢুকতে পারি না। জানেন না, ওই নানি তো টাকা খেয়ে সব ইয়াবাখোরগুলোরে সাহায্য করে। ওই হারামি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের পাহারা দিয়ে রাখে। আমি কতদিন বলেছি যে, আমি ওনার ওয়াইফ। তবু আমাকে ঢুকতে দিন। দেয় না।
আমার মনে পড়ে যায় নানি কিভাবে রিফাতের বাবার বাজারের ব্যাগটা ওপরে উঠিয়ে দিয়েছিল—চির পদানত ভক্ত ভৃত্যের মতো। ঠিক তখনই সেই পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক পাঁচতলার দিকে উঠছিলেন। বোধ করি তার স্ত্রী তাকে খুঁজতে এখানে এসেছেন, এ খবর নানির মারফত তার জানা হয়ে গেছে। তাই পালিয়ে বাঁচার জন্য হয়তো ছাদের দিকে যাওয়ঙার ইচ্ছেতেই এদিক উঠছিলেন। স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি এখানেই দাঁড়িয়ে আছেন তার স্ত্রী। তাকে অকস্মাৎ দেখেই চিৎকার করে উঠলেন তার স্ত্রী,
—ওই তো দেখুন। দেখুন। ওই যে পাঞ্জাবির পকেটে হাত, দেখেছেন? দেখেছেন? আপনারা দেখুন। ওসি সাহেব দেখুন এদিকে। বাচ্চা ছেলেগুলোকে ধরে ধরে পেরেশানি করছেন। আর এদিকে নাটের গুরু নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে নিচের তলায়। এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো পায় কোথা থেকে এইসব সেদিকে কোনো খেয়াল নেই আপনাদের।
ওসি তীব্র কটাক্ষে তাকায় ওই নারীর দিকে। কারও বুঝতে বাকি থাকে না—পুলিশ মহলের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে আছে রিফাতের বাবা। আড়চোখে আমার দিকেও একবার তাকান তিনি, যেটা আমারও দৃষ্টি এড়ায় না। উল্টো দৌড়ে ততক্ষণে ভদ্রলোক নিচে নামছেন। তার পিছু পিছু—ওকে ধরুন, ওকে ধরুন, বলে চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছেন তার স্ত্রীও।
চলবে…