॥কিস্তি-তিন॥
চার.
এলাকার ১৫ বছরের ছেলেটির নাম তুফান। এক বোতল ডেটল ঢেলে দিলো গলায়। গলায় স্টমাকে সবকিছু পুড়ে একাকার। ডাক্তাররা কোনোভাবেই সারিয়ে তুলতে পারছেন না। স্টমাক ওয়াশ করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু কোনো ওষুধই কাজ করছে না। চিকিৎসা করতে গিয়ে ধরা পড়লো ছেলেটি ছিল নেশাখোর। তার বাবা গিয়াস আলী। দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে দিন দশেক হলো দেশে ফিরেছেন। এই সেদিনই তো গল্প করছিলেন ছেলের সঙ্গে।
—আর যাবো না ওই বিদেশ-বিভুঁইয়ে।
—ক্যান বাবা?
—আমার দায়িত্ব এইবার শ্যাষ হইছে বাপ।
—কী দায়িত্ব বাবা?
—শোনরে বাপ। আমার বাপ মরছে আমার বয়স তখন ঠিক তুমার মতো। পনেরো কী ষোলো।
—আচ্ছা।
—ভাইবোনগো মধ্যে সবচেয়ে বড় আছিলাম। আমার পরে তোর তিন মামা। দুই খালা। সবই ছোড ছোড। ক্যামনে জীবন চলেরে বাপ? ভাড়া একটা বাড়িত থাকি। ক্যামনে কি খাবার জোগাড় করে আমার মায় একলা? মার মুখের দিক তাকাবার পারিনারে বাপ।
—দাদীর কথা কও বাবা?
—হ বাপ। বিদিশা দেখি দুই চোখে। আমি ড্রাইভিং শিখ্যা বিদেশে পাড়ি জমাই। মাস-কাবারে টেকা পাঠাই। তয় ভাইবোনগো জীবন চলে। এইভাবে আমি আর আমায় মা দুইজনে মিল্যা তোর সব মামা খালাগো বড় করি। তোর দুই খালার বিয়া দেই। তোর বড় মামা সেজ মামারে আমিই বিদেশে লইয়া যাই। আমার মা খুব বুদ্ধিমতি। ঠিকমতো টাকা পয়সা খরচ করতে জানে। ওই টাকা জমাইয়া এই বাড়িটা মায় কিন্যা ফালায়। এর মাঝখানে আমি বিয়া করি। বুবু ও তুই দুই জন আইলি আমাগো জীবন উজালা কইরা। তারপরেও তো গেল ১৫ বছর।
—হ, খুব ভালা হইবো বাবা। তয় আমারে কিন্তু একটা মোটর বাইক কিন্না দিবা কইলাম।
—হ, দিমু দিমু। সবই দিমু। তুই ১০ কেলাস পাশ দিলেই আমি তরে হোন্ডা কিন্না দিমু একটা।
—না এহনি দিতে হইবো।
দূর থেকে খিস্তি করে ওঠেন তুফানের মা মোমেনা।
—এহনি তুমার হোন্ডার কী কাম শুনি? হ্যাঁ? দুই দিন পর মেট্টিক পরীক্ষা। পড়াশোনার নাম নাই। সারাদিন তো বাইরে বাইরে আড্ডা পিটাও। এখন আবার হোন্ডার বায়না ধরছ।
—থাক থাক আমি ওরে বুঝাইতাছি মোমেনা।
—না। আমারে হোন্ডা কিনার টাকা দেওন লাগবো এহনই। নাইলে আমি ভাত খামুনা কইলাম।
—হ তোমার যা যখন চাই তখনই তা আইন্যা দেওন লাগে। আর পড়াশোনা লাটে।
তুফান ভীষণ রেগে যায়। মায়ের দিকে রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে চলে যেতে লাগে। বাবা হাতটা ধরে থামায়।
—বাপ এতদিনের সব সঞ্চয় লইয়া দেশে আসছি। প্রায় সব টাকাই তুমার মামার লগে ব্যবসায় খাটামু ঠিক করছি। বেশিরভাগ ট্যাকা দেওয়া হইয়া গেছে। গাড়ি কিনমু তিনটা। ইন্টারসিটি চলবো। টাকার অভাব হইবো না। ইনশাল্লাহ আগামী বছর তুমি হোন্ডা চইড়া কলেজ যাইবা।
—না
ঝটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় বাবার হাত থেকে তুফান। নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। কাথাটা টেনে মাথা অবধি ঢেকে দিয়ে শুয়ে পড়ে। গিয়াস সাহেব মাথা নিচু করে বসে থাকেন। মোমেনা গজগজ করে। ছেলের মতিগতি ভালো না। সামনে পরীক্ষা। বাপ দেশে ছিল না। সারাদিন তুফান বাইরে কাটায়। কই যায় কী করে মাকে কোনোকিছু জানায় না। গিয়াস সাহেবকে চিন্তিত দেখায়। তবু সারাজীবন স্ত্রী সন্তানদের একা রেখে বাইরে বাইরে কাটিয়ে দেয়া গিয়াস সাহেবকে অনুশোচনায় দগ্ধ করে।
—ওর আর কী দোষ তুফানের মা। বাপের আদর পায় নাই ছোড বেলা থিকা। অভিমান তো করবোই।
—না না। আপনে ব্যাপারডা স্বাভাবিকভাবে নিবেন না কইলাম। আমার সন্দেহ লাগে কেমুন জানি। বুবুর পোলা মানিকরে দেখছেন না?
মোমেনার আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ গিয়াস। তারও বুকে ভয় যে হয় না তা নয়। তবু নিজেকে আর মোমেনাকে প্রবোধ দেয়।
—না না তুফানের মা। পোলা আমার অতডা বেবুজ না। তুমি চিন্তা কইরোনা। আিমতো আইস্যা পড়ছি।
—হ এইডাই আমার ভস্যা। আমি একলা আর ওরে সামলাইতে পারতাছিলাম না তুফানের বাপ।
—অত চিন্তা কইরো না আর।
রাতের খাবার খেতে আসে না তুফান। মা রাগ করে ডাকেন না। অবশেষে বাবা তুফানের ঘরে আসেন। রাত প্রায় দেড়টা বাজে।
—তুফান। বাপ আমার। ঘুমাইছ? ও বাপ?
গায়ে ধাক্কা দেয়। তুফান কথা বলেনা। রাগে অভিমানে ফুলতে থাকে।
—শুন তুমার মা যাই কউক না ক্যান আমি তুমারে হোন্ডা কিন্না দিমুই। তুমি চিন্তা কইরো না।
ঝট করে কাথা থেকে মুখটা বের করে তুফান।
—কাল সকালেই তাইলে?
ওর কপালে বাবা একটা চুমু খায়। হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে বলে।
—এখন এইডা রাখ। তুমার যা খুশি খাও। কাপড় কিনতে চাইলে কিনো। ঠিক আছে বাপ আমার? আস। টেবিলে আস। ভাত খাও আগে। তুমার মা ভাত লইয়া বইস্যা রইছে। সে বেচারি এহনও খায় নাই। তারপর এখন শান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়ো।
বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দেন গিয়াস সাহেব। বাবা চলে গেলে এক ঝটকায় উঠে বসে তুফান। হাতে গুজে দেওয়া টাকাটা গুনে।
—দশ হাজার? মোটে দশ হাজার টাকা? আইচ্ছা। মজা বুঝবা আইজ। হোন্ডা কিন্না দেওনা লাগবো না আর। তুমার সব ট্যাকা ব্যবসায় খাটাইছ বাবা। তুমার ছেলের শখটার কথা তুমি ভাবলা না!
রাগে অভিমানে ১৫ বছরের কৈশোরের বুকে বুঝি আগুন জ্বলতে থাকে। এক দৌড়ে মায়ের ঘরের বাথ রুমটাতে ঢুকে পড়ে। ওর চলার গতি দেখে মোমেনা হকচকিয়ে যান। চিৎকার করতে করতে ছেলের পেছন পেছন ছোটেন।
—কই যাস? এমনে কই যাক তুফান? ওই তুফান।
দেশে এসে অবধি গিয়াস সাহেবের বিশ্রাম নেই। এতকাল পর দেশে ফিরেছেন। কিভাবে গুছিয়ে উঠবেন। স্ত্রী সন্তানদের দায়িত্ব এদেশে এসে ঠিকঠাক মতো নিতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। তিনটি গাড়ি কিনবেন। আজ সারাদিন মানিকের বাবার সাথে এখানে ওখানে গাড়ি দেখছেন। তারপর আছে পারমিশন। ঘুষ। গাড়ি মালিক আর শ্রমিক সমিতির সাথে লিয়াজোঁ। যদিও মানিকের বাবা তার ছোট বোনের স্বামী শ্রমিক সমিতির সভাপতি। গিয়াস সাহেব এইমাত্র শুতে যাচ্ছিলেন। বিছানায় শরীরটা এলিয়েও দিতে পারেননি তখন। চিৎকার শুনে ছুটে নিজের ঘর ছেড়ে আবার বাইরে আসেন। বড় মেয়ে ময়না স্বামীসহ বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। চিৎকার শুনে সবাই ছুটে আসে। ময়নার স্বামীও। বাথরুমের দরজা ধাক্কাতে লাগে ময়না।
—তুফান ওই তুফান। দরজা খোল।
ভেতর থেকে কোনো শব্দ আসেনা। মোমেনা কাঁদতে থাকেন। ময়নার স্বামী এক লাথিতে দরজা ভাঙে। তারপর এক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা। সবাই নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে বাথরুমের মেঝেতে পড়ে থাকা তুফানের তড়পাতে থাকা শরীরটার দিকে। ময়না আর মোমেনা চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন,
—ও তুফানের বাপ। আমার পোলায় এমন তড়পায় ক্যান?
ময়নার স্বামীই প্রথম দেখতে পায় তুফানের হাত থেকে ছিটকে কাছেই পড়ে আছে বাথরুম পরিষ্কার করবার এক লিটারের ডেটলের বোতলটা। হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে,
—মা, এটা কী ভরা আছিল?
—হ। গত পরশুদিনই তো কিন্যা আনলাম।
—আচ্ছা
তুফানের মুখের কাছে নাক দিয়ে ময়নার স্বামী ডেটলের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ পায়।
—আব্বা। ওরে ধরেন। হাসপাতালে নেওয়া লাগবো।
—কী হইছে? ভাই আমার? কী হইছে?
ময়না চিৎকার করে মাটিতে পড়ে থাকা তুফানের মাথাটা কোলে নিয়ে বসে পড়ে। মোমেনা বাকরহিত। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন।
—ময়না ছাড়ো ওরে। আব্বা আপনে ধরেন আমার সাথে। ওরে হসপিটালে নিয়া যাই। ও ডেটল খাইছে। মোমেনা এতক্ষণে চিৎকার করে ওঠেন। রাত তিনটে বাজে। ম্যধরাতের আকাশ মোমেনার চিৎকারে কেঁপে কেঁপে ওঠে—আল্লাগো…হায় হায় হায়…আমার কী সর্বনাশ হইলো?
চলবে…