॥কিস্তি-আট॥
দিনের আলো ফুটেছে অনেক্ষণ। ঘুম শেষ আজকের মতো। ক্লান্ত বিষণ্ন সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার বুকটা ভেঙে যেতে চায়। দেখি আমার গৃহকর্তাও দিব্যি ঘুমে বিবশ। মাস কাবারে ১ হাজার ৭০০ টাকার জন্য আজ আমার ১৭ লাখ কাজের বোঝা পিঠে। না হলে আমার মেয়েদের মুখে ভাত জুটবে না। ভোর বেলায় ছাত্র পড়াই। স্কুল করে টিউশনে যাই। বাড়িতে ফিরে এলে আবার ২০ জনের আরও দুটো করে ব্যাচ ছাত্র পড়াতে পড়াতে রাত ১২ টা বাজে। তবু আমার ক্লান্তি নেই। ছাত্র না পড়ালে ১ হাজার ৭০০ টাকায় চারজনের সংসার চলবে কী করে? আমিও খানিক শুয়ে পড়ি। কিছুটা অন্তত বিশ্রাম হোক। শরীরেরও তো ফুয়েল দরকার! ঘুম আসে না। চোখে মানিকের মুখ ভাসে। মানিকের মায়ের মুখ ভাসে। ওসির হাতে ধরে রাখা মানিকের জোড়া হাতে ক্ষমা চাওয়ার মতো ভঙ্গিটা চোখে ভাসে। বুটের লাথিটা ওর বুকে কতটা জোরে লেগেছে, সেই ব্যথা ভাসে। চোখে জল আসে। আমার মেয়েদের মুখ ভাসে। তাদের বাবার মুখ ভাসে। বাড়িওয়ালার মুখ ভাসে। রিফাতের বাবার মুখ ভাসে। পুলিশের মুখ ভাসে। দারোয়ান নানা আর নানির মুখ দেখি। একসঙ্গে এত পরস্পরবিরোধী মুখের ছায়া কিংবা মায়া কোনোটাই আমি বুঝতে পারি না। কোনোটাই মেলাতে পারিনা। ভুলতেও পারি না কোনোটাই। কোনটা মানুষ, কোনটা পশু বুঝতে পারি না। কোনটা মানুষ কোনটা পুতুল, তাও বুঝতে পারি না। কোনটা মানুষ কোনটা মুখোশ সবই তালগোল পাকে। আমি হন্যে হয়ে একটা মানুষের মুখ খুঁজতে থাকি। একটা মানুষেরও মুখ পাই না। কেবল দিশেহারা লাগে সব। অজানা মনে হয় সামনের পথ। বিভ্রান্ত মনে হয় জীবনের সাধনা। প্রচ্ছন্ন মনে হয় চলার গতি আর পথরেখা। আর কল্পনায় নিজেকে কেবল ভারবাহী এক উটের মতো দেখতে পাই। চলছে ছুটে ধূসর মরুপথে একা।
দুই
স্কুল সেরে দুপুরে মেয়েদের খাইয়ে আবার টিউশনে যাওয়ার পথে একবার মানিকদের বাসার দিকে যেতে গিয়েও থামি। মানিকের কী হলো খুব জানতে ইচ্ছে করে। না থাক। এখন যেতে গেলে দেরী হয়ে যাবে। আজ বিকেলের টিউশনের ছুটির দিন। সন্ধ্যায় যাব জানতে।
তবু মন মানে না। আগেরই মতো কান পাতি দরজায়। সুনসান নীরবতা। কিন্তু তার মাঝে ভেসে আসছে সেই চোতবোশেখের ঘুঘুর কান্না। খুব মৃদু স্বরে। সেই ঘুঘুর ব্যথা আমাকেও দিনে দিনে ভর করে। সেই ব্যথা নিয়েই টিউশনে যাই। কাজ শেষ করে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকি না। মানিকদের বাসায় ঢুকি-ভাবি কী খবর? রুনু পাপিয়া পিউ তোমরা খেয়েছ? কথাটা জিজ্ঞেস করতে বুকে ব্যথা করে ওঠে। লজ্জা পাই্ নিজেরই কাছে। আমার মেয়েদের খাবার অনেকদিন মানিকের মা পাঠিয়েছেন। কিন্তু আজ ওদের বিপদের দিনে আমি কাজ করি। সকাল সন্ধ্যা বাইরে ছুটি। সারাদিন দেখা নেই। সেই ভোররাতে থেকে শুরু করেছিল হৈ চৈ। আর সকালে মানিককে ধরে নিয়ে নিচে নামলো। তারপর কী হলো, সে খবর আমি সারাদিনে একবারও নিতে পারিনি। ওই মানুষগুলো খেয়েছে কী খায়নি জানিনি। অথচ আমার উচিত ছিল, এই বিপদের দিনে ওদের দুটো খাবারের ব্যবস্থা করে দেওয়া। আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে গিয়েও প্রশ্ন করি-পিউ, মা কিছু খেয়েছে? খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে?
-জি আন্টি। নিচে খালাম্মা রান্না করে পাঠাইছে। মা খায়নি কেবল।
-ভাবি।
ফ্লোরে লম্বা করে পা মেলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিলেন মানিকের মা। লম্বা। চুলগুলো এলোমেলো ছড়িয়ে পড়েছে ঘাড় বেয়ে। পিউ সেগুলো গুছানোর চেষ্টা করছে। বড় বড় ডাগর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। এই আলুথালু বেশেও বোঝা যায় একসময় সুন্দরী ছিলেন তিনি। আমার ডাকে চোখ মোছেন। অবাক করা মানুষ তিনি। এই সময়েও তিনি আমার চোখের প্রশ্ন পড়তে পারেন। জিজ্ঞেস করা লাগে না।
-ভাবি। মানিকরে থানায় লইয়া গেছে। অস্ত্রমামলার চার্জশিট দেব। অস্ত্রমামলা মানে বুঝেন তো ভাবি? কঠিন মামলা আর তার শাস্তি। আপনে জানেন তো?
-জানি।
আমি শঙ্কিত হই।
-তাহলে কী উপায়?
-কোনো উপায় নাই ভাবি। আমি আপনারে কইয়া দিলাম আমি এইবার আর নরম হমু না। আমি মা না, এইবার শয়তান হমু। ওই পোলারে আমি অনেক বুঝাইছি। ও কোনো কথা শোনে নাই। বইনগুলার কথাও ভাবে নাই। পাপিয়ার বিয়ার সম্বন্ধ আসতাছে। আর কী আইবো কোনো ভালো ঘরের সম্বন্ধ অইবো মানিকের এইসব কথা কাহিনী শুনলে? হ্যাঁ। আপনেই কন?
-হুম, আমি মাথা নাড়ি।
-আর একবার অস্ত্রমামলায় ধরা খাইছিল। ১০ বছরের জেল। টাকা পয়সা ভাঙতে ভাঙতে শেষ। আমি ৩ বছরে কোনোমতে জেলের বাইরে আনতে সর্বস্বান্ত হয়েছি। আর না। আমি ওরে দেখতেও যামু না আপনারে কইয়া দিলাম। যামু না।
-আচ্ছা সে হবে। দেখা যাবে। আগে তো চার্জশিট কী দেয়, দেখি।
-আরে নানা ভাবি। আপনে তো বুঝতাছেন না। আইন আদালত তো করছেন না মনে হয় কুনোদিন।
-না তা করিনি। লাগেনি কখনো।
-চার্জশিট হইলেই তো কাজ হইলো।
-ওইডাই তো বদলাইতে হইবো।
-মানিকের বাপে ফোন করছিল। কুত্তার বাচ্চা ওসি ১০ লাখ টাকা চায়।
আমি আঁতকে উঠি-১০ লাখ!
-হ্যাঁ। অস্ত্রমামলার আসামিরে কম অপরাধ দেখাইয়া শাস্তি লঘু করাবে। টাকা লাগবো না? আপনি বুঝলেন না?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দেই।
কলিং বেল বাজে। মানিকের বাবা ঘরে ঢোকেন। খুব গম্ভীর। দীর্ঘদেহী কালো মাঝবয়সী রাগী পুরুষ। কিন্তু আজ ছেলের দায়ে কেমন নরম ঠাণ্ডা।
-মানিকের মা তিন লাখের ব্যবস্থা হইছে। আগামীকাল বেলা ২ টার মধ্যে আরও তিনলাখ দিতে না পারলে চার্জশিট বদলানো যাইবো না। মামলা হইয়া যাইবো।
খেকিয়ে ওঠে মানিকের মা-আমি কী করুম? আমি কী করুম? আমারে বিক্রি করোগা যাও। মানিকরে গিয়া কওনে তোর মারে বিক্রি কইরা টাকা আনছি তোরে বাঁচানোর লাইগা।
দরদর করে চোখ বেয়ে জল ঝরে পড়ে মানিকের মার। আর কোনো কথা সরে না তার মুখে। বুক ফেটে যাচ্ছে আমি বুঝতে পারি। সন্তান যদি বিপথগামী হয়, মায়ের জ্বালা কী, সে আমি নিজের চোখে দেখছি প্রথমবারের মতো। আমিও চোখের জল ধরে রাখতে পারি না। মানিকের বাবা কথা না বলে চলে যান অন্য ঘরে। শুধু রুনুকে বলেন, মানিকের লুঙ্গি টিশার্ট আর কী কী সব কাপড় ব্যাগে ভরে দিতে।
-আপনে খাইবেন না?
-না। আমি থানায় যামু এখন। রুনু ব্যাগ দে?
মানিকের মা ফ্লোর ছেড়ে উঠে পড়েন। ঋজু তার ভঙ্গি। মুখের পেশীগুলো টানটান। ধনুকের তীক্ষ্ণ ছিলার মতো ঘাড় সোজা করে দাঁড়ান মানিকের বাবার পথ রোধ করে। ঘটনা কোনোদিকে মোড় নিচ্ছে আমি বুঝতে পারি না। এই পারিবারিক দুর্ঘটনার পরের অংশে মান অভিমান আর আত্মদহনের পর্যায়ক্রমটিতে আমার থাকা উচিত কী উচিত নয়, আমি বুঝতে পারি না। আমার আজন্ম শিক্ষা-রুচি আমাকে নিষেধ করে এখানে থাকতে। আবার মানবিক বোধ আমাকে প্ররোচিত করে, এই অবস্থায় এদের পাশে অবস্থান করতে। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি।
মানিকের মা বলেন, মানিকের বাপ, আপনে থানায় যাইবেন না। আর একটা টাকাও ওর পেছনে আপনে খরচ করবেন না।
পিউ-পাপিয়া চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। রুনু বাবা আর মায়ের মাঝখানে দাঁড়ায়। বড় ভাই থানায়। মা-বাবার মানসিক অবস্থার মাঝখানে পারিবারিক এই ক্রাইসিসে এখন তারই গুরু দায়িত্ব।
-মা সরো তো। আব্বারে যাইতে দাও।
-না।
-আমার একটা কুসন্তান। ও মইরা গেলে বরং জগতের শান্তি।আমার শান্তি। আমার মাইয়াগুলার শান্তি। কিন্তু আমার আরও দুইটা মাইয়া আছে।ওগোরে বিয়া দিতে হইবো। এক মাইয়া শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাইবো ক্যামনে, সেইডাও আমারই ভাবতে হ্ইবো। তুমি ভাবো না এগোর কথা মানিকের বাপ?
বলে হাত দিয়ে এক এক করে মেয়েদের দেখান মানিকের মা। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পারেন মানিকের বাবা। তিনি দ্রুত সরে পড়ার চেষ্টা করেন। আমাকে বলেন, ভাবি আপনে একটু দেখেন মানিকের মারে। রুনু ব্যাগটা আন, বলে দুহাতে মানিকের মাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে খুব দ্রুত বেগে বের হয়ে যান মানিকের বাবা রহমত মোল্লা। মানিকের মা ধাক্কা খেয়ে এসে পড়েন আমার বুকের ওপর। আমি তাকে জাড়িয়ে ধরি প্রথমবারের মতো। তার বুকের কাঁপুনি, কান্নার তোড় তার যন্ত্রণার প্লাবন আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোনো এক অজানা অচেনা অনিশ্চিত জীবন পরীক্ষার দোরগোড়ায়।
চলবে…