॥পর্ব: এক॥
খুব সম্ভবত দুজনের পরিবার আর বেড়ে ওঠার নৈমিত্তিক ঘটনাবলি কাছাকাছি পরিবেশে হওয়ায় কথাসাহিত্যিক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক আবুল ফজলের প্রতি আমার অনুরাগ বেশি—এটা এতটাই বেশি যে, তার লেখায় প্রবাহিত বোধ আমার বুকের ভেতরে অনুরণিত হয়। আর বড় হয়ে ওঠার সময়ের শুরু থেকে তিনি পাঠ্য হয়ে উঠেছেন ক্রমশ। পরবর্তী সময়ে অবশ্য-পাঠ্য আর অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। মানবজীবনের রাজনৈতিক তাৎপর্য উপলব্ধিতে ক্ষণজন্মা এই কথাশিল্পীর লেখার সঙ্গে পরিচয় না হলে মানুষ হিসেবে হয়তো নিজের কাজ সম্পর্কে অজ্ঞই থেকে যেতাম। কি সৌভাগ্য আমার! ইলিয়াসের নিদারুণ অক্ষরে বোনা কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধসমগ্র আমার বোধের জগতে উন্মোচন করেছে অর্থপূর্ণতা। কখনো-কখনো খুব একা থাকলে-তার শারীরিক অনুপস্থিতি পীড়া দেয়। এক্ষেত্রে শুধু তিনিই নন, অধ্যাপক আহমদ শরীফ বা হুমায়ূন আজাদ বা আহমদ ছফা—তাদের যেকোনো একজনকেও সরাসরি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে ব্যক্তিগত জীবনের তাৎপর্য হয়তো আরও অনেক গুণ বেড়ে যেত। এটা বিজ্ঞানসম্মত বা বাস্তবসম্মত কি না, জানি না; শুধু আবেগের জায়গা দিয়ে হলেও এই মানুষগুলোর অনুপস্থিতি টের পাই। এই অনুভব আরও তীব্র হয়, চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় যখন মানুষের ওপর ক্রমাগত নিপীড়ন অনিবার্য হয়ে উঠছে; তখনো।
বর্ণিত মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচয় তো ঘটেছে জীবনের প্রায় প্রথম পর্ব শেষ করার পর। এই প্রথম পর্বে আমার চিন্তা, বোধ আর বিবেচনার নায়ক হিসেবে আছেন আমার পাড়া-প্রতিবেশী আর পরিচিতজনেরাও। শৈশবে রুক্ষ্ণমেজাজি আব্বার কথা বাদ দিয়ে রাখলে—যিনি জীবনের তৃতীয় পর্বে আমার দেখা সেরা মানুষগুলোর অন্যতম হয়েছেন; তাকে বাইরে রেখে আমার কাকা তাজুল ইসলাম, বিশ্বজিৎ স্যার, ছোটগল্পকার তাহের উজ জামান, কাওছার আহমদ, কালন ভাই, মোশাররফ ভাই, হুমায়ুন ভাই, গেদু কাকা, এনাম হুজুর, শিব্বির দুলাভাই, দুলাল কাকা, মাজহার সাব হুজুর বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তাঁদের প্রত্যেকেই আমার শৈশবের নায়ক, আমার শৈশবের বিস্ময়।
সম্পর্কের দিক দিয়ে তাজুল ইসলাম কাকা, যিনি আমাদের ধর্মঘর ইউনিয়নে সাউথ কাশিম নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। স্কুলের মাঠের চারপাশে যিনি রোপন করেছিলেন জামগাছ। যেগুলো তার মৃত্যুর বছরই কাটতে শুরু করে স্কুল কমিটি। আমি বা আমাদের গ্রামে তাজুল ইসলাম কাকাকে আমরা তাজন কাকাই ডাকতাম।
স্কুলের পড়াশোনা চুকে যায় ক্লাস ফাইভের পর। ধর্মঘর আদর্শ বিদ্যালয়ের আগে দুই বছর ধর্মঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার স্মৃতি খুব কম। এই দুই বছরে নখ বড় রাখার কারণে আবদুল হাই স্যারের ডাস্টার দিয়ে মারের কথা মনে আছে। বাকি দুয়েকজন স্যারকে দেখলে চিনি, কিন্তু নাম ভুলে যাওয়ার মতো ধৃষ্ঠতাও হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। তবে স্কুলে প্রবেশের ঘটনা স্মরণীয় এই কারণে যে, জাকিয়া আপা আঙুল ধরে স্কুলে নিয়ে গেছিলেন। এখন তিনি বাচ্চা-কাচ্চার মা হয়ে ঢাকাতেই স্বামীর সংসার করছেন।
ফাইভের আগ পর্যন্ত গ্রামের বিদেশ ফেরত হুমায়ূন ভাই তো রীতিমতো বিস্ময়! সৌদি আরবফেরত এই চাচাতো ভাইয়ের কাছেই প্রথম টিস্যু পেপার দেখেছি। শৈশবে গামছার বদলে পানি মুছতে তিনি টিস্যুর ব্যবহার করছেন, তাও একটা পেপারের বক্স থেকে কি দারুণ করে বেরিয়ে পড়ে জিনিসটা! হুমায়ূন ভাই ধর্মঘর বাজারে কাপড়ের ব্যবসা করছেন।
মোশাররফ ভাই তখন পুকুরে গোসল করতে এলে ফা স্যোপ নিয়ে আসেন। তিনিও কোরিয়া ফেরত। গোসলের সময় দেছি মোশাররফ ভাই গায়ে দেওয়ার সাবান দিয়ে গামছা ধুচ্ছেন—ব্যস আর যায় কোথায়? ঘরের একশ পার্সেন্ট আ্যরোমেটিক সাবান দিয়ে আমিও কেজি স্কুলের ইউনিফর্ম ধুতে শুরু করি। সকালে ঘরের তোয়ালে আর বিকালে স্কুল থেকে ফিরে লাক্স সাবানে (গ্রামে গায়ে মাখার সাবান তখনো লাক্স সাবান নামে পরিচিত) ইউনিফর্ম ধুই। মোশাররফ ভাই সকাল-সকাল গোসল করেন, ফর্সা শরীর আমাদের মনুর বাড়ির এ পার-ওপার থেকে গায়ের লোমও চোখে পড়ে। তখনো বুঝতে পারি না—কোনো নারীর চোখ মোশাররফ ভাইয়ের ফর্সা শরীরে পড়ে কি না। সর্বশেষ মোশাররফ ভাই চেয়ারম্যান নির্বাচন করে হেরেছেন। নিজের প্রতিষ্ঠিত কিন্ডারগার্ডেন বন্ধ করে দিয়েছেন।
ধর্মঘর কেজি স্কুলে ভর্তির পর অধ্যক্ষ গেদু স্যার (এখলাছুর রহমান, আব্বার আপন মামাতো ভাই) হয়ে ওঠেন আমার প্রিয় অনুসরণ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লুঙ্গি পরা স্যারদের থেকে কমবয়সী-তরুণ গেদু কাকাই হয়ে ওঠেন আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। এই রকম অসংখ্য ব্যক্তিত্ব দেখে-দেখে আমাদের শিশুকাল কেটে যায়। খুব অজান্তেই তারা হয়ে ওঠেন প্রারম্ভিক জীবনের নায়ক। আমরা হয়তো বয়সের ভারে এই নায়কদের কথা ভুলে যাই বেমালুম। গেদু কাকার ইন করা কাপড় পরিধান, স্কুলে নীল-সাদা ইউনিফর্ম; এসব মিলিয়ে শৈশবের প্রথম দিককার নায়ক বনে গিয়েছেন অধ্যক্ষ এখলাছুর রহমান।
একই স্কুলে অঙ্ক করাতেন আকতার স্যার। ক্লাস ফাইভে ক্যাপ্টেন ছিলাম; ওই বছর বুধবার ছিল এককথায় প্রশ্নোত্তর পর্বের ক্লাস। পড়া না পারায় পিটিয়েছিলেন আকতার স্যার; বলেছিলেন, ক্যাপ্টেন হইছো, পড়া পারো না, শেখো না কেন?
ক্লাস ফাইভের পরের বাকি সময়টুকু জার্নির। এক ভীষণ মর্মন্তুদ, মর্মান্তিক। আমার শৈশবের পুরো উচ্ছ্বাস কেড়ে নেওয়ার সময়। সেই হারানো শৈশবের চিৎকার ফিরে পেতে এখনো মাঝ-মাঝে উতলা হয়ে উঠি। পরের সময়টিতে নেই কৈশোরের বন্ধু, শৈশবের সম্পর্কগুলো। এক বিরোধী সময়ের মধ্যে বেঁচেছি, কাটিয়েছি ত্রিশটি বছর। যদিও কালে-কালে বন্ধুত্ব এসেছে; কিন্তু নেই শৈশবের বন্ধু, ডা. আসাদুজ্জামান রকিব ছাড়া। একেবারে নেংটাকালের বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায়—পৃথিবীতে বাস্তব হয়ে বেঁচে রয়েছেন তিনি।
আমাদের মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে খোলা ক্ষেত ছিল তাজন কাকার। ওই জমিতে পিচ বানিয়ে ক্রিকেট খেলছিলাম বাড়ির শিশুরা সবাই। এই খেলা থেকে ডেকে আনে বাড়ির কাজের মেয়ে (নাম মনে নেই)। ডাকে ভাইজান, আপনারে চাচি ডাকতাছে। দৌড়ে বাড়িতে যাই; বাজারের ব্যাগে মা আমার পোশাক ভরছেন। পাশের চৌকিতে আব্বা বসা। বললেন, ‘পাঞ্জাবি পর।’ আমি পাঞ্জাবি পরে ব্যাগ হাতে নিয়ে আব্বার পেছন-পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। খেলতে থাকা বাল্যবন্ধুদের চোখের সামনে দিয়েই আব্বার পেছনে হাঁটতে লাগলাম। ওরা তাকিয়ে থাকলো। এই ছিল, জন্মভূমি থেকে বেরিয়ে পড়ার শেষ গল্প। এরপর আর বাড়ি ফিরিনি। সেই যে আব্বার পেছন-পেছন বেরিয়েছিলাম, আর ফিরিনি। আমার আর কোথাও বাড়ি হয়নি।
চলবে…