[পর্ব-৩৭]
পানাম নগরে যখন নামি, তখন হিজল গাছের পাতায় দিনের শেষ ভাগের আলো গলে পড়ছে। তার সোনালি আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের মুখে। আর সেই সোনারঙের বিভা ছড়িয়ে পড়ছে মেঘনা শীতলক্ষ্যার জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে। বিলাতি থান কাপড় আর বাংলার মসলিন কাপড়ের পাতলা ফিনফিনে কোমলতার ধার ঘেঁষে, ভেঙে ক্ষয়ে যাওয়া ইটের দেওয়াল ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা বৃক্ষের হাহাকারের সীমানা ছাড়িয়ে, রাজসভা পেরিয়ে, রঙমহল, নাচমহল পার হয়ে চলেছি আমরা দু’জনে। তাই প্রতিক্ষণে অন্য আবেশ, রোমাঞ্চিত অনুভব। ইতিহাস-প্রকৃতি-মোঘল আর গ্রিক আর্কিটেকচারের মিশ্রণে তৈরি বাড়িগুলোর মাঝখানের সর্পিল রাস্তা ধরে যেন আমরা চলেছি কত না কত যুগ ধরে-ভালোবেসে, হাতে হাত ধরে আছি, অনুভবে কতকাল।
এই প্রকৃতি এই ভগ্নস্তূপ ভালোবাসার অন্য আর এক রূপ মেলে ধরে এখানে। কেউ নেই পরিচিত চারপাশে। রাস্তার দু’পাশে ব্রিটিশ আমলের নির্মিত শ্যাওলা ধরা, পলেস্তারা খসে পড়া সারি সারি প্রাচীন বাড়িগুলো যেন আমাদের পাহারায়। এত বিরুদ্ধ পরিবেশ, চারপাশে যখন জিঘাংসার মাত্রাতিরিক্ত প্রকোপে তপ্ত বাতাস, চুমু খাওয়ারও তিলমাত্র জায়গা নেই কোথাও, তখন পানাম নগরী আমাদের খুলে দেয় ভালোবাসার চূড়ান্ত অবসর। সে কবি, নিজেকে ‘বাউল’ নামে ডাকে। ঘর-সংসার করার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই যে মানুষটির, সে কিভাবে এতটা ভালোবাসতে পারে! কতটা গভীরতা তার ভালোবাসায় সে আমার চেয়ে আর কে-ই বা বেশি জানে! আমি বিস্মিত হয়ে থাকি। আমার বুকের গভীরেও তখন কবিতার ফুল ফোটে নিয়ত।
ঠাকুরের কবিতা পড়ি, কাদম্বরীর দুঃখে বুক ফেটে যায়, নজরুলের কবিতা পড়তে পড়তে ডুবে যাই নার্গিসের প্রেমে, রফিক আজাদের কবিতা পড়তে পড়তে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠি আমিও—‘ভাত দে হারামজাদা/তা না হলে মানচিত্র খাব’। শামসুর রাহমানের কবিতা পড়তে পড়তে চোখে জল আনে-‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। আবুল হাসানের ঊনত্রিশ বছরের ছোট্ট জীবনের প্রেম আর বিরহের করুণ রসে ডুবে যেতে যেতে জপি, ‘আমাদের প্রেম হোক বিষে জর্জর/কাব্য চূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা। কিংবা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নীল হয়ে থাকা বেদনার পঙ্ক্তিমালা—কেন আর এই রক্ততিলকে তপ্ত প্রণাম/জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়? রুদ্রকে লেখা তসলিমা নাসরীনের চিঠির জলে ভিজে যায় চোখ কত কত রাতে। কাজী রোজির কবিতায় আবিষ্ট হয়ে পড়ি গভীরতর বিরহে, ‘তুমি না থাকলে কাছে জীবন বাঁচে/সেখানে সুরের পাখি দেয় না উঁকি হৃদয়ভরে/তোমারি প্রতীক্ষাতে নিথর রাতে অশ্রু ঝরে।’ এইসব কবি আর কবিতার ডিসেকশানে আমি ক্ষত-বিক্ষত আবিষ্ট আর নিয়ত স্নান করে পরিশুদ্ধ হয়ে উঠি বেদনায়।
প্রতিদিন মাইক্রোফোন স্টেজ রিহার্সেল কবিতা আর কবিতার মানুষ ঘিরেই যত গল্পবাজি, আড্ডা আমার। সঙ্গে আরও আরও যোগে নানা ফুল নিয়ত ফুটতে থাকে লাল নীল রঙে। আমাদের ভালোবাসার রকম আর সংজ্ঞাটা অন্য আরও অনেকের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। একজন স্বভাবত কবি আর একজন কবিতামুখর মানুষের প্রেম কতটা অনন্য হতে পারে, তাই দেখতে থাকি দু’চোখ মেলে। অনুভব করি হৃদয়ে হৃদয়ে। ৪৫০ বছর আগের বার ভুঁইয়ার রাজত্বের, আজকের প্রকৃতিলগ্ন আর বিশুদ্ধ স্কেলিটোনের মাঝখানে, প্রাচীন বাংলার এই রাজধানীর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকার একটি প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা দু’জন। তাই ইতিহাসের বহু সফল আর ব্যর্থ প্রেমের, ভালোবাসার, বহুগামিতার, নর্তকীর যাতনার কিংবা উল্লাসের, উন্মুখ রাজা আর শাহজাদাদের উন্মাতাল জীবনযাপনের সাক্ষীগুলোর মাঝখান দিয়ে আমরা দু’জন নির্ভয়ে হাত ধরে হাঁটি। ঝিলের জলের দিকে ঝুঁকে পড়ে থাকা হিজলের ফুল দেখতে দেখতে আমরাও কাছে আসি। জলের আলস্যে বিকেলের নরম রোদে তপ্ত বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে আজ আমাদের ভালোবাসাও। আমরা স্বভাবতই কাছে আসি। ভালোবাসার বিশুদ্ধতায় কাছে আসি। প্রকৃতি আমাদের কাছে এনে ছেড়ে দেয় একান্তে। নাচঘরের সুরু গলি দিয়ে ঢুকে পড়ি আরও কোন ইতিহাসে জানা নেই আমাদের।
তার ডান হাতটা আমার পিঠের ওপর রাখে। আমি ভয় পাই না। বিরক্ত হই না। আশঙ্কায় কেঁপে উঠি না। সে আমার মুখটা টেনে নামায় তার বুকের ওপর।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে মনে হয় এক্ষুণি ভেঙে পড়তে পারে সিঁড়ির সাঁকো কিংবা দেয়াল। তবু ভয় নেই, নেই কোনো জৈবিক তাড়নাও। মুগ্ধ বিস্মিত প্রথম যৌবনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই নিরালা একাকি নিভৃতে পাওয়া দু’জন মানুষের মধ্যে নেই কোনো উন্মত্ততা। নেই কোনো অধিরতা। যেখানে জনবিরল পেলেই খানিক জড়িয়ে ধরা কিংবা ঘন অন্ধকার পেলেই ঠোঁটে ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন, আরক্ত বেদনার প্রক্ষিপ্ত ধারা বয়ে চলে সদাই সেখানে আজ এসবের কিছু নেই। বরং আমার কানে বাজতে থাকে নূপুরের ধ্বনি। ওপর থেকে খুলে পড়ে আসতে থাকা ছাদের দিকে তাকিয়ে শঙ্কিত না হয়ে দেখতে থাকি কোথায় জ্বলে উঠতো ঝাড়বাতি!
কখন কোথায় সুরের মূর্ছনায় ছাপিয়ে উঠতো নর্তকীর বেদনার জল! কোন তক্তপোষে বসে বাদশাহ ছুড়ে দিতেন গলার মোতির মালা! কোনো এক দেয়ালের কিনারায় কান পাতলে শোনা যাবে অবহেলায় রাজেন্দ্রানীর পড়ে থাকা কান্নার ধ্বনি। আমার মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর কথা! আমি লোভ সামলাতে পারি না। কান পাতি ভাঙা দেয়ালের ভাঙা ইটের বুকে শুনবো কান্না। দেখে নেব কালের ক্যানভাসে আঁকা সকল ছবি, আজই।
— কী করছ, এই?
—শুনছি।
—কী শুনলে?
—নূপুরের শব্দ।
—আর?
—কান্নার শব্দ।
—কান্নার শব্দও শুনতে পেলে?
—হুম পেলাম তো!
—বাদশাহ-রাণীকে ফেলে রাত কাটাচ্ছেন নাচঘরে। আর অবহেলায় বিরহে রাত্রি যাপনের কান্নার শব্দ তুমিও শোনোনা, এসো, এখানে কান পাতো।
—হা হা হা।
সে হাসতে থাকে। আমার কথা শুনে। ভুবন ভোলানো হাসিতে কেঁপে কেঁপে ওঠে পোড়খাওয়া বাড়ির দেয়াল। তবু আমি তাকে টেনে আনি। সে কান পাতে না। বরং আমাকে টানতে টানতে সিঁড়ি ধরে টেনে নিয়ে চলে যায় যেখানে, সে জায়গাটা আরও নীরব। ওটা এই নাচঘরেরই ছাদ। কেমন যেন চারপাশ থেকে ঢালু হয়ে আসা।
পুরনো অযত্নে অবহেলায় বাড়িগুলোর মাঝখান থেকে যে গাছগুলো দেখছিলাম পথে আসতে, সেগুলো যে অত পুরনো আর অতবড়, সেটা টের পাই এখানে এসে। দোতলা বিল্ডিংটার ছাদের বেশ কিছু অংশে গাছের ডালপালা হেলে পড়ে আড়াল করেছে আকাশ এখানে। এই ছাদে, এই নির্মল আকাশের নিচে আর কেউ নেই। দর্শনার্থী যারা এসেছিলেন, তখন ফিরতে শুরু করেছেন। নিথর হতে শুরু করেছে সভ্যতার প্রাচীন নগর। এ বিশ্ব নিখিলে আজ এইক্ষণে আমি আর সে, দু’জন প্রাচীন মানব-মানবী যেন। আমি ঝুঁকে পড়ি। চেয়ে দেখি নিচে। বার্ডস আই ভিউতে অদ্ভুত সুন্দর দেখায় পানাম নগরীর এক প্রান্ত। সে কখন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে ছাদে, খেয়াল করিনি। তার ডাকে ফিরে তাকাই।
—এদিকে এসো।
কাছে এসে উপুড় হয়ে কুনুই দু’টো মাটির ওপর রেখে দু’হাতের কব্জির পিঠের ওপর মুখ রাখি আমি। মুখোমুখি দু’জন।
—ডেকেছিলে কেন বলো।
তার ডান হাতটা আমার পিঠের ওপর রাখে। আমি ভয় পাই না। বিরক্ত হই না। আশঙ্কায় কেঁপে উঠি না। সে আমার মুখটা টেনে নামায় তার বুকের ওপর। আমি নিভৃতে নিশ্চিন্তে তার বুকে মাথা রাখি। ওপরে তখন এক আকাশ বিছানো নীল। আকাশের কোণে কোণে আবির ছড়াতে শুরু করেছে দিনের শেষভাগ। সন্ধ্যা তারা জ্বলে উঠবে কিছু সময় পর। আমাদের প্রেম রাতের অন্ধকারের মতো গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে এই ক্ষণে, এই প্রাচীর নগরীর বুকের নিভৃত ক্ষরণের ফাঁকে ফাঁকে। খুব গোপনে টের পাই, আমি ভুলে যেতে বসেছি পালতোলা নৌকার পাল। ব্রহ্মপুত্রের খোলা জল। আমি ভুলতে শুরু করেছি নদীর ধারের কাশফুলের সাদা। বিশাল নীল আকাশের চাঁদোয়ায় ঢাকা সম্ভুগঞ্জ ব্রিজ। ভুলে গেছি কে যেন একদিন চোখের কালো কাজলে ডুবে যেতে যেতে আমাকেও চুবিয়ে মেরেছিল তার নোনা জলে। টানা চোখের ঘনকালো পাপড়ির বনে খুঁজে মরেছিল জীবন।
কবে কোনো এক নিঝুম দুপুরে কালো চোখের কোমল উপত্যকায় লেখা হয়েছিল নিষিদ্ধ প্রেমের বেদনা। কবে লেখা হয়েছিল কোনো এক গভীর কবিতার শ্লোক। সব ভুলে আজ একজন কবি আর একজন কাব্যসর্বস্ব মানব-মানবীর ঠোঁটের মাঝখানে একফাঁলি চাঁদ ওঠে প্রকাশ্যে পানাম নগরের আকাশে। ভেঙে পড়ে যেতে থাকে পৃথিবীর সব প্রাচীন ইহিতাস, হয়তো লেখা হতে শুরু করেছে অন্য আরও এক নতুন গাথা। এই ক্ষণে, এই মন্ত্রমুগ্ধ সন্ধ্যা তারার নিচে আমরা জড়িয়ে থাকি আমাদের শরীর–প্রেমে, আবেশে, মুগ্ধতায়। দু’জনের পাঁজরের শব্দ শোনা যায় মধ্যরাতের নিরালায় ঘড়ির শব্দের মতো। তবু কোনো আদিম জৈবিকতার গন্ধ নেই কোথাও। খানিক ধোঁয়া উঠে ঘুরে ঘুরে পাক খেয়ে শূন্যে মিলায় সকল বস্তুগত অনুভব। খোলা আকাশ খোলা বাতাস মিশে যায় জটিল সম্পর্কসূত্র আর অনুভব। হয়তো চারদেয়াল পেলে সেটা পৌঁছুতে পারতো কোনো এক উন্মার্গ আদিম প্ররোচনায়। তখন সন্ধ্যা পা বাড়িয়ে দিয়েছে রাত গভীরের সীমানায়। উঠে দাঁড়াই দু’জনে। যেতে হবে বহুদূরের পথ।
চলবে…
অ্যা হান্ড্রেড ফেসেস অব উইমেন-৩৬॥ শাপলা সপর্যিতা