হুমায়ূন আহমেদ মানুষের মন ও আচার-আচরণ নিরিক্ষার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। হিমু, মিসির আলি, শুভ্র—এরমক যেত চরিত্র তিনি বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাদের সবাই লক্ষণীয়ভাবে পুরুষ। এই প্রধান প্রবণতার বাইরে গিয়ে হুমায়ূন সৃষ্টি করেছেন অজস্র নারী চরিত্র। যাদের স্বভাব, বৈশিষ্ট্য, চরিত্র হতে পারে এই অঞ্চলের নারীদের স্বাভাবিক ভূমিকা অন্বেষণের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় এমন নারী চরিত্রদের নিয়েই।
হুমায়ূনের একটি সাধারণ অভ্যাস হচ্ছে, তিনি বড় ক্যানভাসে যে ক’টি উপন্যাস লিখেছেন, তার বেশিরভাগের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী। এটি কেবল উপন্যাসেই নয়, ধারাবাহিক নাটকেও। ‘কোথাও কেউ নেই’-এর মুনা, ‘এইসব দিনরাত্রি’র নীতু, ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর রাবেয়া—এমনকি ধারাবাহিক ‘আজ রবিবার’-এর মীরাও হচ্ছে এমন চরিত্র, যারা মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে মধ্যবিত্ত সমাজের উত্থান ঘটেছে, তার অতি পরিচিত অঙ্গ। গত পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে এই সব চরিত্র ছিলেন পরিবারের আপাত আড়ালে থাকা শেকড়, যাদের ওপর নির্ভর করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো গড়ে উঠেছে।
দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ভূমিকায় তাদের না হলে চলে না। কিন্তু সাফল্যের বিভায়, কৃতজ্ঞতার পাশে তারা আবেষ্টিত হয়েছেন কমই। এমনকি ঢাকার আধুনিক সাহিত্যে তারা ছিলেন। এখনো আছেন গৌন ভূমিকায়। কিন্তু হুমায়ূন যেহেতু যা আছে তার সাহিত্যিক, যা ঘটা উচিত তার নন; তাই তার নিপুণ সমাজদর্শনে এই চরিত্রেরা গুরুত্ব পেয়েছেন। সঙ্গত কারণেই হুমায়ূনসাহিত্যে তাদের উপস্থিতি ঘটেছে বিপুল পরিমাণে।
তারা হয়তো কোনো গল্পে বড়ভাবী, কোথাও বড়বোন, কোনো রচনায় গৃহিণী আবার কোথাও কেবলই আউটসাইডার। কিন্তু সব কাহিনীতে তাদের চরিত্র হচ্ছে এমন একটি ভূমিকায়, যার ওপর ভিত্তি করে কাহিনী দাঁড়িয়ে থাকে। একটি নির্মাণের ভিত্তিমূল যেমন আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়, তেমনই এসব দয়া ও মমতার আধারেরা থাকেন পাঠকশ্রেণীর দৃষ্টির আড়ালে। হুমায়ূনসাহিত্যের বিপুল পাঠকসংখ্যা থাকার পরও নিত্যদিনের আলোচনায়, গল্পে-আড্ডায় একজন নীতু-রাবেয়া উঠে আসার নজির খুবই কম।
আর কখনো নিজের চেনা জগৎ থেকে বেরিয়ে এলেও তা হয় প্রয়োজনমাফিক। কেবলই প্রথাবিরোধিতার জন্য কোনো ‘নারীবাদী’ চরিত্র তৈরি করা, অবাস্তব কাহিনীর আশ্রয় নেওয়া, এমন কোনো রাস্তায় হুমায়ূন হাঁটেননি।
হুমায়ূনমানসে নারী চরিত্র যেসব গুণসমেত বিরাজ করে, তার সঙ্গে ঢাকার সাহিত্যে প্রচলিত অন্য নারী চরিত্রের বিস্তর তফাত। হুমায়ূন সর্বদা নারীকে দেখেছেন শান্তি-শৃঙ্খলার প্রতীক রূপে। তার এমন অসংখ্য গল্প আছে, যেখানে পরিবারের সব পুরুষ সদস্য খানিক মাথাখারাপ ধরনের, আর সেসব পরিবারের হাল ধরা থাকে এমন কিছু চরিত্রের হাতে, যারা নারী কিন্তু বুদ্ধি বিবেচনায় ঠাণ্ডা মাথার। ধরা যাক ‘বহুব্রীহি’র মিলি কিংবা ‘আজ রবিবার’র মীরা, যাদের কাঁধে ন্যস্ত থাকে একটি পুরো পরিবারের আপাত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে শান্ত ও বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব।
হুমায়ূন-রচনায় এই কেন্দ্রীয় ভূমিকার বাইরে আপাত গৌণ আরেকটি ভূমিকায় নারীকে আবিষ্কার করা যায়, যারা বাইরের বিক্ষুব্ধ ও প্রতিকূল পরিবেশ থেকে সযতনে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। অথবা আত্মিক ও বাহ্যিক এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয় যা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাদের বাইরের পরিবেশ থেকে সরিয়ে বন্দি করে ফেলে একান্ত নিজের জগতে। ‘মৃন্ময়ী’ উপন্যাসের মৃন্ময়ী এই ধরনের আদর্শ উদাহরণ। তার বাবার লাম্পট্যের ফলে যে জীবন তার মা বেছে নিয়েছেন, সে নিজে স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী হওয়ার পরও সেই জীবন থেকে বেরিয়ে গিয়ে, পরিবার ও বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করে ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানো’র চেষ্টা করে না। বরং সেদিক থেকে একরকম মুখ ফিরিয়ে সে নিজেকে সমর্পণ করে আপাত সহজ ও নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে। অথচ সে রকম সব সুযোগ ও সামর্থ্য তার ছিল।
একই রকম ঘটনা আমরা দেখবো ধারাবাহিক ‘নক্ষত্রের রাত’-এও। সেই গল্পের প্রায় কেন্দ্রীয় চরিত্র মনীষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স করার পরও তা কাজে লাগানোর বদলে সে বেছে নেয় নিজ মা-কে খুঁজে বের করার মত আপাত নিরর্থক কাজে। যে আঘাত সে পায় বাহির কিংবা অন্য ভাষায় বললে সমাজের কাছ থেকে, তা সুদে আসলে ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ সে হাসিমুখে প্রত্যাখ্যান করে। তার কাছে নিজ ক্যারিয়ার, আপাত সাফল্যর বদলে মুখ্য হয়ে ওঠে নিজের শান্তি আর পরিবার। হুমায়ূনের এইরকম চরিত্ররা তার বহু উপন্যাসে অগৌণ চরিত্র হিসেবে বিরাজ করেছে, তাদের কেউ হয়ত সারাজীবন ভেতরে ভেতরে লালন করছে অব্যক্ত প্রেম, কারো ভেতরে আছে না বলা বেদনা। আবার কেউ কেউ কেবলি অভ্যস্ততায় বেছে নিয়েছে মসৃণ জীবন। আর মানুষের সহজাত সুখের সন্ধান করার প্রবনতার কারণে এদের কেউ কেউ পেয়ে গেছে প্রায় প্রবাদতুল্য পরিচিতি।
এছাড়া বাইরের সঙ্গে ‘মোকাবিলা’ যে হুমায়ূনের চরিত্ররা একেবারেই করেনি, এমন ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। কোথাও কোথাও সামান্য ঝলক আবার কোথাও পুরোদস্তুর ‘আধুনিক’ নারীও হুমায়ূন তৈরি করেছেন। তবে তারা বিপুল সংখ্যক সংসারী, প্রেমিকা আর সঙ্গিনীর ভিড়ে যেন ‘হংসমধ্যে বক’। এমন একটি চরিত্র ‘প্রিয়তমেষু’র নিশাত, যে শিক্ষিত, শিল্পী ও খানিকটা ঘরকুনো। হুমায়ূনের আর সব নারীর মতো সাংসারিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকার পরও তাকে দিয়ে হুমায়ূন দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের সামাজিকতায় একজন বাইরের প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে থাকা নারী কেমন বাধার সম্মুখীন হয়। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে তেমন মানসিক জোর ও যথাযথ সামর্থ্য না থাকলে নিজের ভেতর গুটিয়ে যেতে বাধ্য হয় সে। ছোট এই উপন্যাসটি একই সঙ্গে ঘর ও বাইরের বিবিধ প্রসঙ্গে আলোকপাত করে বলে হুমায়ূন রচনায় নারী দর্শন বোঝার জন্য এর গুরুত্ব অত্যধিক। এই ধরনেরর আরও চরিত্রের মধ্যে আছে জনম জনমের তিথি। যে কিনা তার পরিবারের জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয় বেশ্যাবৃত্তিতে। যে বেশ্যাপনার টাকায় তার পরিবার সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিকই, কিন্তু সে নিজে হয়ে পড়ে বিষণ্ন ও সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। লক্ষণীয় বিষয়, বাংলাসাহিত্যের সাধারণ প্রবণতা হিসেবে তিথি এই নিগৃহের ফলে প্রতিবাদী বা বিদ্রোহী কোনো চরিত্রে পরিণত হয় না, বরং এই পেশা তৈরি করে তার মধ্যে এক গভীর আন্তরিক ক্ষত, তাকে নিয়ে যায় নিজের ভেতরে অন্তর্লীন হওয়ার এক গহীন পথে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় উপন্যাসে সে যখন তার মাকে বলে, ‘গায়ে হাত দিও না মা।…গায়ে হাত দিলেই মনে হয় পুরুষ মানুষের হাত।’
যার থেকে হয়তো এই ধারণায় উপনীত হওয়া সম্ভব, হুমায়ূন নারীকে তার প্রথাগত ভূমিকায় দেখতেই স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। তাই তার নারী চরিত্ররা অধিকাংশক্ষেত্রে কোনো প্রতিবাদ কিংবা লড়াইয়ে অংশগ্রহণ না করেই নিজস্বতা ধরে রাখে। আর কখনো নিজের চেনা জগৎ থেকে বেরিয়ে এলেও তা হয় প্রয়োজনমাফিক। কেবলই প্রথাবিরোধিতার জন্য কোনো ‘নারীবাদী’ চরিত্র তৈরি করা, অবাস্তব কাহিনীর আশ্রয় নেওয়া, এমন কোনো রাস্তায় হুমায়ূন হাঁটেননি।
দুই.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে সম্পদের সংজ্ঞায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। যা কিছু অর্থমূল্য দেয়, কেবল তাকেই সম্পদ বলে আখ্যায়িত করার প্রবণতা বাড়তে থাকে সারাবিশ্বে। এর অবধারিত ফল হচ্ছে সমাজের এমন সব বিষয়াদী, যাকে অর্থমূল্যে পরিমাপ করা সম্ভব নয়, সেটা আধুনিককালে প্রচলিত সম্পদের সংজ্ঞার বাইরে পড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রশ্নের মুখোমুখি হয় এমন কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার আত্মিক ও নৈতিক প্রভাব অসামান্য হওয়ার পরও অর্থের বিচারে তা কোনো কিছু যোগ করে না। যেমন পরিবার, সামাজিক নৈতিকতা ইত্যাদি। এই সংকীর্ণ মূল্যায়নের অবধারিত পরিণতি হিসেবে অবমূল্যায়িত হয় স্বাভাবিক জীবনে নারীর মুখ্য ভূমিকা।
তিনি এদেশের জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনের সার্থক ও নিপুণ পাঠক ছিলেন বলেই তার পক্ষে এই সিদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছিল। হুমায়ূনের এই সাফল্য একদিকে যেমন এতদঞ্চলের জীবনপাঠে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তেমনি নতুন লিখিয়েদের পক্ষে কাজ করে দিশা দেখানো বাতিঘর রূপেও।
একঘেয়ে নারীবাদী বয়ানের বাইরে থেকেই হুমায়ূন তার দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। হুমায়ূন তার শত শত উপন্যাসের মধ্যে খুব নগন্য সংখ্যায় এমন চরিত্র এনেছেন, যারা তথাকথিত নারীবাদী বয়ানে সফল। যদিও নব্বইয়ের দশক থেকে ধরলেও ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজে এমন নারীর সংখ্যা খুব কম নয় যারা চাকরিজীবী। এরকম ‘সার্থক’ একটি চরিত্র যদি আমরা খুঁজে বের করতে চাই, তাহলে ‘এইসব দিনরাত্রি’র নীলুকে বিবেচনা করতে পারি। যে একইসঙ্গে সংসার ও পেশা উভয়দিক সামলে টিকে থাকে। কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের এই উপন্যাসের বন্যা চরিত্রটিকে বিচার করতে হবে, যে তার পেশাগত জীবনে এবং তার ধারাবাহিকতায় ব্যক্তিগত জীবনেও ব্যর্থ হয়েছিল। এই দুটি চরিত্রকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেখলে হুমায়ূনের ঘর ও বাইরের বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে—ঢাকার সাহিত্যজগতের সাধারণ প্রবনতার বাইরে গিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন এমন একটি নারী-দর্শন, যেখানে নারী চাকরি-ক্যারিয়ারে মনোযোগী না হয়েও তার কর্মে সফল। যেখানে নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয় বরং সহযোগী।
অবশ্য সব সময় যে এই ধারণার ওপর অটল থাকতে পেরেছেন, তাও পুরোপুরি ঠিক নয়। ‘এইসব দিনরাত্রি’ উপন্যাসে যেখানে নীলু তার চাকরি চালিয়ে যেতে তেমন কোনো বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয় না, সেখানে একই নামের টিভি ধারাবাহিকে দেখা যায় এই প্রসঙ্গে নীলু ও তার স্বামী শফিকের তুমুল দ্বন্দ্ব। এর কারণ হতে পারে টিভির মতো একটি জনপ্রিয় মাধ্যমের চাহিদা হয়তো হুমায়ূন এড়াতে পারেননি, তার ওপর তখনো হুমায়ূন সেভাবে পরিচিত ও আলোচিত নন, এটি ছিল তার প্রথম ধারাবাহিক।
ঢাকাই সাহিত্যের চলতি হওয়ার বাইরে গিয়ে হুমায়ূন তার প্রায় সব নারী চরিত্রকে সৃষ্টি করেছেন এরকম মায়া, মমতা, বুদ্ধি আর অসম্ভব সৌন্দর্য দিয়ে, যারা একই সঙ্গে ভালোবাসে, স্নেহ করে আর হাজারো আনন্দ বেদনার অনুঘটকরূপে কাজ করে যায়। এই ভারসাম্যপূর্ণ নারী-দর্শন ছিল আমাদের সামাজিক বাস্তবতার উপযোগী, যা তৈরি করেছিল পরিবারের মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে জোরালো সমর্থন ও ভালোবাসা। যার প্রমাণ হচ্ছে বাংলাদেশি পাঠকসমাজের কাছে হুমায়ূনের বিপুল গ্রহণযোগ্যতা। তিনি এদেশের জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনের সার্থক ও নিপুণ পাঠক ছিলেন বলেই তার পক্ষে এই সিদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছিল। হুমায়ূনের এই সাফল্য একদিকে যেমন এতদঞ্চলের জীবনপাঠে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তেমনি নতুন লিখিয়েদের পক্ষে কাজ করে দিশা দেখানো বাতিঘর রূপেও।