কৌতূহল জাগিয়ে রেখে কবিতাকে পাঠকের কাছে নিয়ে আসার কৌশল জানেন হেনরী স্বপন। চৈতন্য ও সৃষ্টির দ্বৈরথ বেশ ভালোভাবেই তিনি নিজের ভেতরে মানিয়ে নিয়েছেন। ফলে নিজের কবিতাভুবনে শুধু বিষয়নির্ভরতাকেই পথ প্রদর্শকের আসনে রাখেননি। সময় ও সমাজমানসের ভেতর থেকে উঠে আসার যে জটিল আত্মদ্বন্দ্ব, গভীর সংকটের যে ভূগোল—তাকে ব্যক্তিস্বরূপের মধ্যে ধারণ করেই হেনরী স্বপন কবিতাকে নিজের বিকাশের মাধ্যম করে তুলেছেন। এতে করে একজন কবির বিপন্ন স্বপ্ন আলোকের সন্ধান যেমন মেলে তেমনি তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভেতর দিয়ে পাঠকের অভিযাত্রা ঘটে— সেই রাজ্যে, যেখানে শব্দরা ঠিক-ঠাক কবিতাই হয়ে ওঠে।
নিজের উন্মেষকালের বিক্ষোভ, অস্তিত্ব সংকটকে কাটিয়ে উঠে রাজনীতির বিশাল ময়দানে সম্ভাবনার যে আলো, ফিরে আসার বিপুল আবেদন, সংবদেনশীলতা ও অভিজ্ঞতার সেইসব উপাদানকে নিজের ভেতরে উপলব্ধির অনুষঙ্গে জারিত করেই উন্মোচিত হয়েছেন হেনরী স্বপন। ফলে সব অসহায়তার ভেতর থেকেও এক মায়াবি সুরের উপস্থিতি জানান দেন তিনি। যেখানে স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার মিশেলে তৈরি হয় কবির আত্মপ্রতিভাস।
একটি লেখা বাঁচবে কার অভিজ্ঞতা ভেবে?
ফের শতাব্দিতে—শব্দের অঘ্রাণে;
ধুলোট হলে লঙ্কাচাষের মাটিতে লুটিয়ে
বেনারসি রঙের ফসফেট সার বুনে দিতে।
রক্তাক্ত খড়ির রেখা—ভুলে যাওয়া চাপে
কার্পাসে শুভ্র হবে ভাতের উত্তাপ… দুই বুকে নিতে।আছড়ে ভাঙলে; দুটো দেশ তা-ও পারে
ভাগাভাগি করে নিয়ে,
কতটা কার ভাগ্যকে আটকে রাখবে—ক্রশকাঁটাতারে…
(দুই বুকে দিতে)
হেনরী স্বপন কবিতায় শব্দের বিচিত্র এবং বহুমুখী ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ঐশ্বর্যময় করে তুলেছেন নিজের ভুবন। শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে দূরে রেখে অবলীলায় তার নবতর অর্থের দিকটি স্পষ্ট করতেই তিনি মনোনিবেশ করেছেন। তবে স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল এক বাক্যবিন্যাসের ভেতর থেকে নতুন দ্যোতনা নিয়ে উঁকি মারে তার কবিতায়। বোঝাবার চেষ্টা করে—শিল্পের বহুমাত্রিকতা। শব্দ, শেষ বিচারে শব্দই, তবে অভিব্যক্তির প্রকাশে সেই একই শব্দ প্রকাশ করতে পারে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ। কখনো নেতিবাচক, কখনো ইতিবাচক অর্থে একই শব্দের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় শব্দের প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গি। কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গীকার নয়, বরং যার যেখানে যতটুকু প্রাপ্য, তাকে ব্যক্ত করে তোলার মধ্য দিয়েই আপন মুন্সিয়ানা প্রকাশ করেন হেনরী স্বপন। কখনোবা খুব বিখ্যাত কোন বাক্য—তাকেও অবলীলায় নিজের ভেতরে নিয়ে সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলেন পরিণতি। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের কপিলার একটি স্মরণীয় বাক্য। হৃদয় নিঙ্ড়ানো অভিব্যক্তিতে কপিলা যখন কুবের মাঝিকে বলে—‘আমারে নিবা, মাঝি?’ সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাক্য, যা কিনা হতে পারতো ধ্বংসোন্মুখ ঘটনার সাক্ষী, তাকেই সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিতে উজ্জ্বল করে তোলেন হেনরী স্বপন। স্মৃতি, বেদনা, প্রাপ্তির আনন্দ, অপেক্ষায় তাকেই নবতর কাব্যশৈলীতে রাঙিয়ে ফুটিয়ে তোলেন আদিম উপলব্ধি।
‘দেহো বাইনছি উঠাইবা—নাওয়ের সুধা রাঙে
—আমারে নিবা, মাঝি?
বেদনগঞ্জের মোকামে… যৈবন দিমু ভাসান কূলে
ডুব সাঁতারের গাঙে!
কত রঙের পসরা সাজাও ঢঙে হইয়া রূপের গোপন কারবারি…—যাও ছাড়িয়া মাঝি—রে…
পাঞ্চালী নয়—শরীর সিনায়, ছল-ছলায় অঙ্গে বারোয়ারি…।
(নাওয়ের সুধা রাঙে)
হেনরী স্বপন তার কবিতায় স্মৃতিকাতর। তবে হতাশ নন। অস্থির নন। বেদনায় জীর্ন হয়ে হাহাকারকেই মূল সুর করে তোলেননি। বরং বহমান জীবনকে আধুনিক মন নিয়ে দেখেছেন। নিজেকে প্রকাশ করেছেন—জীবনসংক্রান্ত উপলব্ধির ভেতর দিয়ে। প্রকৃতির সাহচার্য তিনি পেয়েছেন। তার ছাপও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তার কবিতার ভেতরে। জীবনানন্দ দাশের শব্দবন্ধও অসঙ্কোচে ব্যবহার করেছেন নিবিড় মমতায়। আবার নিখাঁদ আধুনিক সাম্প্রতিক শব্দাবলিকেও অবলীলায় তিনি ঢুকিয়ে দেন কবিতার শরীরে। তাতে একইসঙ্গে তার কবিতা হয়ে ওঠে ঐশ্বর্যময় এবং বৈচিত্র্যময়। আধুনিক মন ও মননের অনুষঙ্গকে হেনরী স্বপন কবিতার ভেতরে সঞ্চারিত করার মধ্য দিয়ে নিজেকে স্বতন্ত্র করে তোলার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টায় পাঠক থাকে গ্রহণ করেছে, বারবার প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই সত্যই প্রতিষ্ঠিত।