আধুনিক কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য—যাবতীয় তারল্য এড়িয়ে চলেন কবিরা। ফলে ভাবালুতা তেমন আর গ্রাহ্য হয় না তাঁদের কাছে। আধুনিক যুগের কবিরা উপস্থিত কালের সংকট ধারণ করতে গিয়ে আপন রুচির পক্ষেই নিজেদের মাঠ তৈরি করেন। তাঁরা প্রায় পূর্ববর্তীদের তৈরি পথ আত্মস্থ করে নিজেদের জন্য সৃষ্টি করেন নতুন পথ। অন্তত নতুন পথ নির্মানের চেষ্টা থাকে তাঁদের। যে পথ ধরে তাঁরা দীর্ঘকাল হেঁটে আসেন, একটা সময় সে পথকেই অস্বীকার করেন। এ অস্বীকারের মধ্যে রয়েছে এক ধরনের আবিষ্কারের নেশা, সৃষ্টির উন্মাদনা। গত শতকের শেষ প্রান্তে যারা কবিতার সঙ্গে প্রজ্ঞা-অভিজ্ঞতা ও কল্পনার মিথস্ক্রিয়ায় গৃহস্থালির স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠলেন, তাদের একজন হেনরী স্বপন।
শিল্পীর সাধনার যেমন বিষয় থাকে, তেমনি থাকে নির্দিষ্ট অঞ্চলও। শিল্পী সে অঞ্চলেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ওই নির্দিষ্ট অঞ্চল ভৌগলিক, বৈষয়িক; নান্দনিকও। নিজের চিন্তা, কল্পনা, প্রতিভা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটিয়ে সৃষ্টিকর্মকে শিল্প রসিকদের সামনে উপস্থাপন করাই তাঁর কাজ। হেনরি স্বপন কবিতায় কেবল কল্পনাকে প্রাধান্য দেননি, কেবল আবেগের ফল্গুধারাকেই প্রশ্রয় দেননি, তাঁর কবিতায় অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার সম্মিলন ঘটিয়েছেন সবচেয়ে বেশি।
কল্পনাকে যে পরিমাণ প্রজ্ঞার শাসনে পরিমিতি দেওয়া সম্ভব, তার পুরোটাই করেছেন হেনরী স্বপন। ফলে তাঁর কবিতায় ভাবালুতা প্রশ্রয় পায়নি। শব্দগুলো হয়ে উঠেছে, ধারালো, শ্লেষাত্মক। কখনো-কখনো একেবারে নিরলঙ্কার শব্দগুচ্ছও সালঙ্কৃত শব্দের চেয়ে বেশি ব্যঞ্জিত হয়ে ওঠে। এর কারণ, বাকসংযম ও আবেগের সংহতি। যে কথা উপমান-চিত্রকল্পের সাহায্য ছাড়াই, সরাসরি অভিব্যঞ্জিত হওয়ার যোগ্য, ওই কথাকে অপ্রয়োজনীয় অলঙ্কারে চাপা পড়তে দেননি কবি।
তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য
১। বিবৃতিমূলক বাক্যের ভেতর শ্লেষোক্তি
২। ছন্দের নিয়মিত বন্ধন থেকে মুক্তি
৩। বাক সংযম ও পরিমিতি
৪। বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞার শাসন
৫। আবেগের সংহতি ও অভিজ্ঞতার সংশ্লেষ
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কীর্তন খোলা’ মূলত দীর্ঘ কবিতা। একটি বিবৃতিমূলক আখ্যান। তবে হেনরী স্বপনের আখ্যানকাব্য কোনোভাবেই জসীমউদ্দীনীয় নয়। বরং এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’-এর একটি দূরাগত পদধ্বনি এখানে শুনতে পাওয়া যেতে পারে। অবশ্যই তা কীর্তন খোলা অর্থাৎ বরিশাল অর্থাৎ বাংলাদেশের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে। তবে এখানে নেই কোনো ভাবালুতা সর্বস্ব কাহিনির ঘনঘটা। আবার এলিয়টীয় নৈরাশ্যও পুরোপুরি এখানে গ্রাহ্য হয়নি। পোস্টমডার্নিজমের সঙ্গে হেনরী স্বপনের উত্তরাধুনিক চেতনার সুক্ষ্ম পার্থক্য এখানে সুস্পষ্ট। পোস্টমডার্নিস্টদের মতো মডার্নিজমকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন না তিনি। পরন্তু মডার্নিজমকে গ্রহণ করেই, তার সঙ্গে উত্তরাধুনিকতার সমন্বয় ঘটান। তাঁর সমসাময়িক কবিদের কবিতা পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় প্রতিভাত হবে— সতীর্থ কবিদের মধ্যে তিনিই প্রথমে বঙ্গীয় উত্তরাধুনিকতার সফল কৃষক। এই অর্থে প্রথম যে, তার উত্তরাধুনিতা সম্পূর্ণ রূপে পশ্চিমের পোস্টমডার্নিজমকে উপেক্ষা করেছে। এবং বাংলায় নতুন রূপে তার প্রবর্তন ঘটেছে।
কবিতা প্রত্যহিক জীবনের অবিকল চিত্র নয়। দিনানুদিনের ঘটনাবলির সঙ্গে আরও কিছুর সংযোগ ঘটতে পারত কি না, তাও কবিতার অনুষঙ্গ হতে পারে। যদি কবির কল্পনা-অভিজ্ঞতার যথাযথ রসায়ন ঘটে। এক্ষেত্রে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির সঙ্গে কবি হৃদয়ের সম্পর্কের স্তরভেদে তা কবিতার অনুষঙ্গে রূপ নেয়। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, প্রবুদ্ধি ও হৃদয়াকুতির সম্মিলনে যে কবিতার সৃষ্টি, সে কবিতা পাঠকের মনকে সহজে আকৃষ্ট করে না। তবে তার চিন্তার অঞ্চলকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে। হেনরী স্বপনের কবিতা বিশেষভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন মনের সৃষ্টি। কোনোভাবেই আকস্মিক ঘটনা কিংবা তাৎক্ষণিক অনুভূতির তরল প্রকাশ নয়।
এ কারণে কবি অতীত-চারণার পাশাপাশি বর্তমানে এসে থামেন। দেখে নেন তার চারিপাশ। পাশাপাশি দেখেন, এখানে ‘চাদ্দিকে আলোর কৃষ্ণপক্ষ’। সময়কে ভীষণরকম ব্যঙ্গ করেন, মাত্র তিনটি শব্দে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এ কবিতায় বাক্য-চরণ-পঙ্ক্তি কোনোটাই কবিতার প্রথাসম্মত নয়। প্রতিটি বাক্যেই গদ্যের চাল। চরণগুলো প্রবহমান নয়। এ কারণে সাধারণ পাঠক কবিতা পাঠে স্বস্তি বোধ করবেন না। বাক্যগুলো এত ছোট এবং অব্যয় ও ক্রিয়াপদ মুক্ত যে, এর মধ্যে কোনো গীতিময়তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু গভীরভাবে, ধীরে-ধীরে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে পাঠ করলে উপলব্ধি করা সম্ভব, সম্পূর্ণ কবিতায় একটি মৃধু সুর বেজে উঠেছে। যা মনোযোগ প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত ধরে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। একটি দীর্ঘ কবিতায় কবি তুলে এনেছেন, দেশের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, ইতিহাস ঐতিহ্য। একই সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ও। পুরো কবিতায় আশা-নিরাশায় দোলায় দুললেও শেষপর্যন্ত কবিকে আশাবাদীই মনে হয়। তাঁর দৃঢ় উচ্চারণ-
ভাটিয়ালি মন-
তীর্থস্থান
আশ্চর্য অমরতার পার্বণ প্রস্তুতিহীন
উর্মিময় জনমনুষ্যের জীবন অপার।
মানবজন্ম সম্পর্কে কবি সংশয়হীন। তাঁর চিত্তের দৃঢ়তা, তাঁকে নিয়ে যায় অস্তিত্ববাদের দিকে। যেখানে মানুষ টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে, নিজের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, ব্যক্তির সঙ্গে, এমনকি প্রকৃতির সঙ্গেও। তবে এ দীর্ঘ আখ্যান পড়তে পড়তে প্রথম কাব্যের পর কবি বিষয় ও আঙ্গিকে ব্যাপক পরিবর্তনকামী। দ্বিতীয় কাব্য ‘মাটির বুকেও রৌদ্রজ্বলে’। এই কাব্যের কবিতাগুলো ৩ থেকে ৫ পঙ্ক্তির মধ্যেই সমাপ্ত। কিন্তু গভীর ব্যঞ্জনা ধারণ করেছে প্রতিটি কবিতা। আর এই কাব্য থেকেই তাঁর শুরু গীতিকবিতার দিকে। তবে প্রথম কাব্যের আশাবাদিতা থেকে কবি কিছুটা সরে এসেছেন। এ কাব্যে কবি দেখেছেন, ‘চতুর্দিকে ধূর্ত অসভ্য রোদ্দুর’। ‘রোদ্দুর’ কবিতায় এই হতাশার কারণ রয়েছে। তার প্রমাণ রেখেছেন ‘জমিন’ কবিতায়। এখানে কবি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন, ‘অনাবাদী আলোর পিদিম-তেভাগায় তপ্ত, / রঙিন কেশর ম্যাজিক দোলায় অলৌকিক সার্কাসের খেলা।’ হেনরী স্বপন জীবনকে দেখেছেন নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। ফলে তার কবিতায় তীব্র আগেরে ঝলকানি নেই, কিন্তু জীবনের রূঢ়বাস্তবতার দহন আছে।
কবিতা প্রত্যহিক জীবনের অবিকল চিত্র নয়। দিনানুদিনের ঘটনাবলির সঙ্গে আরও কিছুর সংযোগ ঘটতে পারত কি না, তাও কবিতার অনুষঙ্গ হতে পারে। যদি কবির কল্পনা-অভিজ্ঞতার যথাযথ রসায়ন ঘটে। এক্ষেত্রে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির সঙ্গে কবি হৃদয়ের সম্পর্কের স্তরভেদে তা কবিতার অনুষঙ্গে রূপ নেয়। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, প্রবুদ্ধি ও হƒদয়াকুতির সম্মিলনে যে কবিতার সৃষ্টি, সে কবিতা পাঠকের মনকে সহজে আকৃষ্ট করে না। তবে তার চিন্তার অঞ্চলকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে। হেনরী স্বপনের কবিতা বিশেষভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন মনের সৃষ্টি। কোনোভাবেই আকস্মিক ঘটনা কিংবা তাৎক্ষণিক অনুভূতির তরল প্রকাশ নয়।
সমাজে নানা সঙ্গতি-অসঙ্গতি তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ। সমাজকে অনুধাবন করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের অভিমত ব্যক্ত করা ব্যক্তির স্বতসিদ্ধ অভিপ্রায়। কিন্তু সবাই একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারেন না। কারও প্রকাশ উচ্চকণ্ঠে, কারও বা সোচ্চার, কারও কণ্ঠে বিনয়, আবার কারও কণ্ঠে ঝরে পড়ে তীব্র শ্লেষ। এই শেষোক্তদের মধ্যে পড়েন নিশ্চিতরূপে শিল্পীরা, কবিরা। ‘বাল্যকাল ও মোমের শরীরে আগুন’ কাব্যের একটি ছোট কবিতার নাম ‘সোয়াদ মাখানো ফেনভাত’। এ কবিতায় দহনকালের চিত্র অঙ্কিত। তীব্র হাহাকার আর ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে, একই সঙ্গে রয়েছে শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাসের প্রকাশও।
কুণ্ডুলি পাকানো ধোঁয়া; উড়ে যাচ্ছো কেন?
গতরে আমোদ উতলানো-হাঁড়ির ভেতর টগবগে
আউশের চা’লে লাল কামিজের ভাঁজ।সোঁদামিঠা সোয়াদ মাখানো ফেনভাত সানকিতে তুলে রাখা।
কবি যখন ধোঁয়াকে উড়ে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেন, তখন প্রান্তিক মানুষের বুক ফাটা আর্তনাদ শোনা যায়। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করেন, তাদের জন্য অবশিষ্ট থাকে মূলত ভাতের ফেন, তাতেই হৃদয় রক্তাক্ত হয়। সমাজপতি, আর ক্ষমতাবানদের লালসার শিকার যে কিশোরী, তার জন্য রাখা ভাত সানকিতেই পড়ে থাকে। একমুঠো অন্নের জন্য তাকে ‘লাল কামিজের ভাঁজে’ হারাতে হয় কুমারিত্ব। সময়, সমাজের রুচি ও রূঢ়চিত্র এভাবে তুলে ধরেন কবি। আপাতত এই কবিতাকে মনে হতে পারে সাধারণ ঘটনার বিবৃতিমূলক। কিন্তু আদতেই তা নয়। সমাজের অনিয়ম, অত্যাচারের বিরুদ্ধে মৃদুকণ্ঠের শ্লেষোক্তিই এখানে ফুটে উঠেছে।
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো হেনরী স্বপন যুক্তিনিষ্ঠ এবং বিজ্ঞান-মনস্ক। প্রমাণ ছাড়া অন্তঃসারশূন্য বিষয়ের প্রতি তার মোহ নেই। বস্তুসত্যের ওপর কল্পনার প্রলেপে তাঁর কবিতা সৃষ্টি। নিজের অভিজ্ঞতা, উপলব্ধিকেই সততার সঙ্গে কবিতায় রূপান্তর করেছেন। তাঁর কবিতার বিষয়-আশয় অনেক সময় তুচ্ছাতিতুচ্ছ হলেও প্রকাশের আভিজাত্যে তিনি অনঢ় থেকেছেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য, হেনরী স্বপন শতভাগ নেতিবাদী শিল্পী নন, আবার সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো ক্ষণবাদী জীবনদর্শনেও তাঁর আস্থা দেখতে পাই না।
হেনরী স্বপন জীবন, সংসারকে দেখেছেন কখনো-কখনো দার্শনিকের চোখে। তখনই নিজেকে যেন কিছু সমাজ থেকে আলাদা করে দূরে স্থাপন করেছেন। অনেকটা রাবীন্দ্রিক ও জসীমউদদীনীয় ঘরানার কাছাকাছি। এই দুজনের সঙ্গে তাঁর কোনোভাবেই মেলে না। কিন্তু দর্শন মেলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, আখ্যান যায় জসীমউদ্দীনের সঙ্গে। তবু শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র হেনরী স্বপন। কবি ধূলিতে জং ধরতে দেখেন। তাই কাব্যের নাম হয়, ‘জংধরা ধূলি’। আর কবিতার শিরোনাম ‘জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় আক্রোশ’।
জন্মান্তর গেছে শিকারীর দলে। মুখস্ত রেখেছে বহু—
প্রস্তর প্রাচীন হাতিয়ার—
পোড়ামাংস মুখরিত হবে—ধান উড়ানী উড়ন্ত ডানা;ঝলমলিয়ে উঠবে প্রস্তরীয় জীয়নকাঠির ছোঁয়া।
মানুষের বেড় ওঠা, তার পারিপার্শ্ব এভাবেই পরিবর্তিত হয়। এভাবেই অতীতের কোনো-কোনো ঘটনারাশি আকস্মিক উপস্থিত হয় মানুষের কল্পনায়। তিনি সমাজকে দেখেন পর্যবেক্ষকের চোখে, নিখাদ শিল্পীর চোখে। তার দেখার মধ্যে সমাজকর্মীর চাতুর্য কিংবা রাজনীতিকের প্রতারণা নেই। এ কারণে সমাজে যা ঘটে, তার সঙ্গে যা ঘটানোর স্বপ্ন কবি দেখেন, এই দুয়ের সমন্বয়ে একটি চিত্র আঁকেন। সঙ্গত কারণে বর্তমান সমাজের সঙ্গে তার চিত্র হুবহু মেলে না।
পৃথিবীতে যত প্রপঞ্চ আছে, তার মধ্যে ধর্ম সবচেয়ে বেশি প্রভাবসঞ্চারী। যখন কোনো একটি বিশেষ প্রপঞ্চ প্রবল হয়ে ওঠে, তখন ওই প্রপঞ্চের প্রতি বিমুখ-আস্থাহীন-নিরপেক্ষ মানুষের শ্বাসরোধ হয়ে আসে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবসঞ্চারী প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে নিকটবর্তী প্রভাবসঞ্চারী প্রপঞ্চের অনুগামীরা হয়ে ওঠে প্রতিবাদমুখর। এ তথ্য অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, জাদু, ধর্ম, কবিতা ও শিল্পকলার তাবৎ অঞ্চল সম্পর্কে সত্য। ধর্মের সত্যকে চ্যালেঞ্জ করা শিল্পীদের জন্য অনেক সময় কঠিন। কারণ তারা সমাজের অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে বসবাস করেও সম্পূর্ণ ‘নিজের মুদ্রা দোষে’ আলাদা থাকেন। তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের বিপরীতে সত্য উচ্চারণ করতে গেলে শিল্পীকে, কবিকে বারবার ভাবতে হয়। দার্শনিক-প্রত্যয় ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমর্থন করলেও শিল্পী সেখানে প্রশ্ন তোলেন। এ কারণেই শিল্পীকে সমাজ মাঝেমাঝে বিতাড়িতও করে। বিষয়টা হেনরী স্বপনের অজানা নয়। হয়তো এ কারণেই ঈশ্বর বিষয়ে তাঁর প্রশ্ন অনেকটা দ্রোহীর মতো। দুঃসাহসীর মতো। ‘কাস্তে শানানো মোজার্ট’ কাব্যের ‘হাইব্রিড ঈশ্বর’ কবিতায় ঈশ্বরের প্রতীকে সমাজপতি, পুঁজিপতিদের চরিত্র কবি বিশ্লেষণ করেছেন নিরাসক্ত পর্যবেক্ষকের চোখে।
নিষ্ঠুর চাবুকে ফাটা শরীরের দাগ
গড়িয়ে নামছে এসিডের খরদাহ;
বিষের পাউডার স্প্রে ওঠা রাগ…
ফসলের ভাগ কেটে ক্রুস কাঁধে নিতে,
হাইব্রিড ঈশ্বর! সর্বাগ্র আসিলেন, এই পৃথিবীতে।
‘হননের আয়ু’ কাব্যের একটি কবিতা ‘মোছালে রুমাল টেনে’। সমাজের ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধের প্রসঙ্গ চিত্রিত হয়েছে, তেমিন ব্যঙ্গ করা হয়েছে বিকারগ্রস্ত মানসিকতাকে এ কবিতায়। লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন জীবনের গ্লানি মানবসমাজকে নিয়ে যায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মানুষ একবার লক্ষ্যচ্যুত হলে সহজে আর খুঁজে পায় না, ঠিকানা। কারণ মানুষের সামনে তখন কোনো আদর্শ থাকে না, এমনকি কোনো স্থিও বিশ্বাসও তাকে আর ভরসা দিতে পারে না।
বিহঙ্গেও স্নিগ্ধডানা লেগে ছড়িয়ে পড়লে—
উপদ্রুত কূলে এসে ট্যুরিস্ট উল্লাসে ঝাঁপ দেয়
সোনালি কর্কট উপমা লুকিয়ে;
ঈানীয় বোতলগুলো ভাসতে ভাসতে
তীরে আসে নাবিকবিহনী।
যে দ্বীপে আলাদিনের জিন চেরাগবন্দী জ্বালানিতে
পলিথিন মোড়ানো বিষাক্ত খনিজ খুলে বেরুচ্ছে দৈত্য…
সময় ও সমাজ— এ দুটি প্রপঞ্চ হেনরী স্বপনকে ভাবিয়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে সময়ে চিত্র অঙ্কনে তিনি যতটা সময় নেন, সমাজের ছবি চিত্রায়নে ততটা নেন না। এ কারণে সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কোনো অনিয়ম-বিচ্যুতি যখনই তাকে ব্যথিত করে, তখনই কবি শ্লেষোক্তিতে তাকে ব্যঞ্জিত করেন শব্দে-বাক্যে-পঙ্ক্তিতে। বিভিন্ন সামাজি আন্দোলনকে যুক্তিহীন আবেগে কবি সমর্থন করেন না। উল্টো প্রশ্নবিদ্ধ করেন যুক্তিনিষ্ঠ সমালোচকের মতো। ‘মোছালে রুমাল টেনে’ কবিতার শেষ হয় এভাবে—
সিলমাছের চর্বিতে আলো জ্বালিয়ে দিতে
কখনো লেনিন; কখনো ম্যান্ডেলা-ক্যাস্ট্রো
উলঙ্গ চোখে বিপ্লবের আয়ু দেখে:
মানুষ রয়েছে কতটা বিসৃত তরঙ্গের কাছে।
পৃথিবীর স্বাভাবিক রীতি— কোনো একটি সমাজবদলের আন্দোলনে সমাজপতিরা তীব্র বিরোধিতা করে। সমাজপতিদের সঙ্গে সুবিধাভোগীরাও সুর মেলায়। কিন্তু ওই আন্দোলন যখন মানবসমাজের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনে, তখন সবার আগে তা ভোগ করতে এগিয়ে আসে সমাজপতিরাই। আর তাতে যথানিয়মে সুর মেলায় সুবিধাবাদীরা।
আধুনিক কবিরা কেবল দেশপ্রেমের নামে ক্ষুদ্রগণ্ডিতে নিজেদের আবদ্ধ করে রাখেন না। তাঁরা হয়ে ওঠেন বিশ্বনাগরিক। এবং একইসঙ্গে স্বদেশিও। কারণ কবিতায় বৈশ্বিক চেতনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উগ্র জাতীয়তাবোধ কবিকে সংকীর্ণ ভৌগলিক সীমায় আবদ্ধ রাখে। আবার দেশপ্রেমহীন বিশ্বনাগরিকবোধও কবিকে উন্মুল জীবন-যাপনকারীতে পরিণত করে। করে তোলে উদ্বাস্তুও। শেকড়বিহীন বৃক্ষ যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি নির্দিষ্ট ভূখ- ব্যতিত কবির অস্তিত্ত্বও বিপন্ন। ভূখ- ব্যতিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। হেনরী স্বপন বিষয়টি আত্মস্থ করেছেন এবং তাঁর কবিতায় তার স্বাক্ষর রেখেছেন।
আধুনিক বাংলা কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো- স্বভাব কবিতার বিপরীতে অবস্থান নেওয়া। আর একাজটি করতে গিয়ে কারও কারও কবিতা হয়ে উঠেছে কিছু দুর্বোধ্য। হেনরী স্বপন ‘ঘটনার পোড়া মাংস’ কাব্যের ‘পুরাণেশ্বরের গ্লামারাস’ কবিতায় ‘বাঁকাঅঙ্গে পরালে এমোন রৌদ্র অলংকৃত’ ‘এসএমএস’, ‘ঘাতক চিনে নিতে হবে’, ‘ভুষু-ি ব্লাউজ রঙে’,’ ব্যাকটেরিয়া’, ‘হাস্যোজ্জ্বল সাজে’ কবিতায় সমাজ ও সমাজের মানুষের নানা চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার ‘ভ্যানঘঘ’, ‘তন্ত্রে ওঠা তাপ’, ‘অতীতের ক্ষতে’, ‘আণবিক আঁধার’, ‘তালেবান সেজদায়’ কবিতায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা, বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক মন্দাজনিত প্রভাব, সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে ব্যক্তিজীবনের অনিশ্চিয়তা প্রসঙ্গও বাদ যায়নি। ‘মেহনত’ কবিতায় স্পষ্ট উচ্চারণ— ‘হাওয়ায় অর্বাচীন ডাইনোসরের পথ/ আগলে কেবল আবহ সম্ভব বাখতেনের সুরে/ অতীত অবজ্ঞা করে—জাগরণ ঢেলে/ রেখে গেছো শিহরণ—/ তবু; মাতাল বিদ্রোহ নকশাল সময়ের’। তার এ উচ্চারণে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে সময় নিরপেক্ষ ধারণার জন্ম দেয়।
মানবিকতার নামে ভাবালুতা স্থান পায়নি কোথাও। চিত্রকল্প-উপমা সৃষ্টিতে কবি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। দৃশ্যগ্রাহ্য বিষয়ে সঙ্গে মিলিয়েছেন ঘ্রাণপ্রাপ্ত ও স্পর্শযোগ্য অভিজ্ঞতার ছাপ। এভাবে হেনরী স্বপন গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজস্ব কাব্যভুবন। যে ভুবনে সাধারণের প্রবেশাধিকার কিছুটা সীমিত। এছাড়া তাঁর একটি বিশেষ কৌশল হলো— কবি সচেতনভাবেই পূর্ণ উপমা সৃষ্টি করেন না। তাঁর কবিতায় সর্বনাম বাচক শব্দ— আমি, তুমি যেমন উহ্য তেমনি উপমার ক্ষেত্রে সাদৃশ্যবাচক শব্দ ‘মতো’ও অনুপস্থিত। কয়েকটি উদাহরণে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক।
আধুনিককাল ব্যক্তির মনোজগতকে করেছে ক্ষতবিক্ষত। একইসঙ্গে দিয়েছে রোমান্স, কৌতূহল ও বিস্ময়। ফলে প্রেম, হিংসা, বিদ্বেষ, ভালোবাসা, মান-অভিমান এই সময়ে কবিতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। কিন্তু রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক অস্থিরতার বিষয়গুলো কবিতায় অঙ্গীভূত হতে পারেনি। একথা সত্য যে, উপস্থিতকালের যুগযন্ত্রণা সবাইকে সমানভাবে ব্যথিত করে না। সমকালীন বিশ্ব রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধবিগ্রহসহ নানা ঘটনার ফলে কবি মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে তাৎক্ষণিক অনুভূতি প্রকাশের তাড়নায় কাতর হয়ে ওঠেন। একই সঙ্গে দ্রুত জনপ্রিয়তার মোহও তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর্থিক বিবেচনাও এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে অনেকটা। অগ্রজ ও সমকালীন ক্রীড়া ও চলচ্চিত্র জগতের তারকা ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের জনপ্রিয়তার সুবাদে আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রসঙ্গটি আজকের কবি মনে রেখাপাত করে। সঙ্গতকারণে ব্যতিক্রম কোনো প্রকরণ বা আঙ্গিকের উপস্থাপনায় পাঠককে চমকে দেওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠেন। কেউ-কেউ ঘঁনার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করেন, কেউ-কেউ ঘটনার অনেক পরে রেশটুকু মনে রেখে রোমন্থন করেন। শেষোক্তদের কাজ প্রথোমক্তদের চেয়ে বেশি শৈল্পিক। কারণ প্রথোমক্তরা যা করেন, তা হয়ে পড়ে সাংবাদিক প্রতিবেদন, আর শেষোক্তদের কাজ উত্তীর্ণ হয় শিল্পে। ‘গলাচিপা’ সনেট সিরিজ এমনই ঘটনাপুঞ্জের চিত্র। এখানে কবিকে আবেগকে দিয়েছেন সংহতি। প্রজ্ঞাকে দিয়েছেন যুক্তি। দুইয়ের সম্মিলনে সৃষ্টিকে করে তুলেছেন অভিজ্ঞতার স্মারক। কবির অভিজ্ঞতায় যুক্ত হয়েছে— ‘মানুষের আয়ু আজকাল কমে গিয়ে;/ দীর্ঘ হচ্ছে পথ-গঞ্জের হাটের মুদি/ মিষ্টিঘর-ভাসমান বালুর জাহাজ…।’ বিরান প্রান্তর ও কোলাহল মুখরিত জনপদের ভেতর কবি একই সঙ্গে হেঁটে যান। হাঁটেন ক্লান্তিহীন, দুচোখে তাঁর অপার স্বপ্ন। মগজে চিন্তার অপার ঢেউ, একেকটা ঢেউ উঠে, একেকটা ঢেউ ভাঙে। কবি এসবের ছবি আঁকেন নিমগ্নতার সঙ্গে। তখনই দেখেন, ‘রাখাইন পাড়ার চোলাই মত্ত ঘ্রাণে…/ মাছশিকারের লোভে জাল ফেলে কেউ।’ কিন্তু এই অচেনা সাধককে কবি চেনার চেষ্টা করেন না। ‘ঘাসের কাছে বাতাসের ক্লান্তি’ অনুভব করে কবি নিজেই কিছুটা ব্যথিত। শেষপর্যন্ত কবি স্বীকার করেন, ‘ভালোবাসা মরে গেছে নদীর কিনারে।’ হেনরী স্বপন ‘গলাচিপা’ সিরিজের ৫টি সনেটে তুলে ধরেছেন, সমাজ বদলাচ্ছে খুব দ্রুত। মানুষ সে বদলের সঙ্গে নিজেকে বদলাচ্ছে। যারা এই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না, তারা হারিয়ে যাচ্ছে সময়ে অতল গহ্বরে।
আধুনিক কবিতার একটি বিরাট সংকট আধ্যাত্ম চেতনা। বাংলা ভাষার কবিরা স্বভাবজাতভাবেই যেন কিছুটা বাউলমনা। তাদের কবিতায় আধ্যাত্মচেতনা সহজেই প্রতিভাত হয়। একুশ শতকের আজকের এই যুগেও আধ্যাত্মচেতনা কবিকে আলোড়িত করে। কবি লোকজ চেতনার সঙ্গে যোগ করেছেন মরমি চেতনাকেও। ফলে কবিতা হয়ে উঠেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরও ভাষা। ‘ঘরের মানুষ’ কবিতায় যখন বলেন, ‘অথৈ অঙ্গে তরঙ্গের ঢেউ লুকায়ে পাড়ে/ ঘরের মানুষ আইলো নারে…/ উজানি ঢল উছলায় নিঠুর—সাগর জলের ধারে।’ তখন বিজ্ঞানমনস্কতার সঙ্গে মরমিবাদীর এক নিবিড় যোগসূত্রে সাক্ষাৎ মেলে।
হেনরী স্বপন নিরূপিত ছন্দে যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন টানা গদ্যেও। তবে তার কবিতায় ছন্দের বৈচিত্র্যের চেয়ে আলঙ্কারিক বৈচিত্র্য বেশি। তার কবিতায় ত্রিবিন্দুর পাশাপাশি স্পেসের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। কবিতার ত্রিবিন্দু উল¬ম্ফনকে মূর্ত করে তুললেও স্পেস ভাবনার বিস্তারকে বিমূর্ত করে। ফলে ত্রিবিন্দু প্রয়োগের উদ্দেশ্য পাঠকের কাছে যতটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে, স্পেস ততটা নয়। ত্রিবিন্দু নিরূপিত ছন্দে বাকসংযমের দ্যোতনা এনে দেয়; স্পেস ব্যঞ্জনাঋদ্ধ করে তোলে মিতবাককে। সমকালীন বাংলা কবিতায় ত্রিবিন্দুর প্রয়োগ অনেকটা কমে এসেছে। হেনরী স্বপন ভাবনার উল¬ম্ফনকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য কবিতায় ত্রিবিন্দুর প্রয়োগকে অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলেই মনে হয়।
সমাজে বিভিন্ন সময়ে বিত্তবান ও ক্ষমতাবানদের আচরণে সাধারণ ও নিম্নবিত্ত অবদমিত থাকে। এই অবদমন থেকে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ। সময়ে এই অসন্তোষই ক্ষোভে পরিণত হয়। ক্ষোভ থেকে জš§ নেয় বিদ্রোহের। যা সময়ে চিত্রিত হয়েছে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সিকান্দার আবু জাফর, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ থেকে শুরু করে রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ প্রমুখের কবিতায়। এভাবে প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক কালসচেতন কবির রচনায় মূর্ত হয়ে ওঠে। হেনরী স্বপন তাঁর কালকে দেখেছেন নির্মোহ-নিরাসক্তির ভেতর। ফলে সমসাময়িক অনেক বিষয়ই চিত্রকল্প-উপমার আশ্রয়ে চিত্রিত হলেও রাজনৈতিক মতাদর্শও কখনো বড় হয়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক মত প্রকাশে কবি কিছুটা নিরাসক্ত। নিজের অভিমত চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে তাঁর রুচি সায় দেয় না। রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত তাঁর কবিতা। তাঁর কাব্যচর্চা-কাল এবং সিদ্ধি বিবেচনায় তাঁর কবিতার মূল্যায়ণ করতে গেলে মনে রাখতে হবে, এই কবি জন্মেছেন বাংলাদেশের জন্মের কিছুদিন আগে। বেড়ে উঠেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে। এরপর দেখেছেন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নামে একাধিকবার বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড, সেনাক্যু, গণঅভ্যুত্থান। লেখালেখি শুরু করেছেন স্বৈরশাসনকালেই। দেখেছেন কীভাবে শ্যামলিমা বাংলা ধীরে ধীরে ইটপাথর-সিমেন্টের নিচে চাপা পড়েছে। কীভাবে মানুষের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে, যান্ত্রিক সময়ের যাঁতাকলে। তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব বসুর সতীর্থ কবি সমর সেনের আশ্রয় নিতে হয়। এই কবি তার স্বকালের কবিতা সম্পর্কে ‘সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন— ‘আমাদের অভিজ্ঞতা এখনও অনেকটা ধার করা, বই পড়া; দেশের মাটির, দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বলতে গেলে সবেমাত্র শুরু হয়েছে, আত্মীয়তায় এখনও পরিণত হয়নি। ফলে নতুন প্রভাবে বাগাড়ম্বরের দিকে বাঙ্গালীর স্বাভাবিক ঝোঁক আরও প্রখর হতে পারে, মানবিকতার নামে কীর্তনের ভাবালুতা আবার আসতে পারে এবং কবিরা ভুলে যেতে পারেন যে বুদ্ধি ও আবেগের সমন্বয়ই সার্থক কবিতার উৎস।’ সমর সেনের আশঙ্কা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। জীবনানন্দ-উত্তর অধিকাংশ কবিই ভাবালুতাকে কবিতায় প্রকাশ করেছেন ক্লান্তিহীন সাধনায়।
কিন্তু হেনরী স্বপনের সমস্ত কবিতা পাঠ করে মনে হয়, সমর সেনের ভবিষ্যদ্বাণী এই কবির ক্ষেত্রে ফলেনি। হেনরী স্বপনের কবিতায় তাঁর সময়-সমাজ-রাষ্ট্রের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এবং সে চিত্রে প্রতিভাত হয়ে কেবল নিজস্ব অভিজ্ঞতা। পাঠাভিজ্ঞতার বদলে এখানে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটেছে। মানবিকতার নামে ভাবালুতা স্থান পায়নি কোথাও। চিত্রকল্প-উপমা সৃষ্টিতে কবি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। দৃশ্যগ্রাহ্য বিষয়ে সঙ্গে মিলিয়েছেন ঘ্রাণপ্রাপ্ত ও স্পর্শযোগ্য অভিজ্ঞতার ছাপ। এভাবে হেনরী স্বপন গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজস্ব কাব্যভুবন। যে ভুবনে সাধারণের প্রবেশাধিকার কিছুটা সীমিত। এছাড়া তাঁর একটি বিশেষ কৌশল হলো— কবি সচেতনভাবেই পূর্ণ উপমা সৃষ্টি করেন না। তাঁর কবিতায় সর্বনাম বাচক শব্দ— আমি, তুমি যেমন উহ্য তেমনি উপমার ক্ষেত্রে সাদৃশ্যবাচক শব্দ ‘মতো’ও অনুপস্থিত। কয়েকটি উদাহরণে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক।
১.
ছায়াবীথি আদিম কার্পাস
অনিশ্চিত ভবিষ্যত
নানা-খালেবিলে
কাজলি মাছের
মখমল;
কালো ধোঁয়ায় মেলালো স্পষ্ট সব
প্রতারণা।
(কীর্তন খোলা)২.
প্রজাপতি মুগ্ধ অনুভূতি; কুমারী উন্মত্ত কোমল অঙ্গের
নক্সীকাপড় শুকায় ঘাসে; চতুর্দিকে ধূর্ত অসভ্য রোদ্দুর।
(রোদ্দুর : মাটির বুকেও রৌদ্রজ্বলে)৩.
নগর অলিতে পাষাণ জীবন ভাঙ্গে নদীপাড়
বিপাশায় ডোবানো অলীক নিয়তির জাল।
(নিয়তির জাল: বাল্যকাল ও মোমের শরীরে আগুন)৪.
ঢেঁকিছাটা চালের রঙিন ছবি
পিকাসোর তুলিতে তামাক পোড়ানোর গন্ধ নিরবধি
সুলতানের রমণীরা কোনোদিন অপুষ্ঠিতে
শাড়ির আঁচল ফেলে স্তন
দেখায়নি বুকের বুভুক্ষু—নিস্তেজ ধমনী জুড়ে
কামরুলের ন্যুড, উইমেন অয়েল ক্যানভাসে রমণীরা
ফেরিওয়ালি; বেদেনী বেড়াচ্ছে মিডিয়ায় ঘুরে
(কামরুলের ন্যুড : ঘটনার পোড়ামাংস)৫.
বেদনা কুড়িয়ে নেবে শারদীয় অর্ঘ্য ভেবে—
শিউলি-কাঞ্চন ভেবে; আপনজন ঢেকে দেবে
মৃত্যুর সতেজ দৃশ্যগুলো;
বাগানের শুভ্রতা ঢেলে উপচে পড়বে
মুখের ফেনিয়ে ওঠা কফ! যন্ত্রণার থুতু! লালায় উন্মদ!
(মৃত্যুর সচেত দৃশ্যগুলো: হননের আয়ু)
এখানে উদ্ধৃত প্রথম ও দ্বিতীয় কবিতাংশ ক্রিয়াপদ ও অব্যয়মুক্ত বাক্যগঠনের উদাহরণ। তৃতীয় উদাহণের উপমায় সাদৃশ্যবাচক শব্দ ‘মতো’ অনুপস্থিত। প্রথম পঙক্তি— ‘নগর অলিতে পাষাণ জীবন ভাঙ্গে নদীপাড়’। সাধারণত এই পঙক্তিটি হতে পারত ‘পাষাণের মতো ভাঙে’। কিন্তু কবি সচেতনভাবে ‘মতো’ ‘যেন’ শব্দ এড়িয়ে চলেছেন। চতুর্থ ও পঞ্চম উদাহরণের পুরোটায় চিত্রকল্পময়। আবার উপমার ব্যবহারও রয়েছে। কিন্তু কোথায় সাদৃশ্যবাচক শব্দ নেই।
ক্রিয়াপদ ও অব্যয়হীন শব্দ গঠন ও নির্বাচন, বাক্যের বুননের কারণে তাঁর কবিতাকে দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। এ কারণেই সাধারণ পাঠককে খুব বেশি কবিতা পাঠে উৎসাহিত করে না। এ স্বভাব তাঁর মজ্জাগত। এ সঙ্গে জড়িয়ে আছে কবির সমাজ-মানসগঠনের ক্ষেত্রে আভিজাত্যের মোহ। হেনরী স্বপন কবিতা লিখেছেন হৃদয়ের ক্ষরণ থেকে, কিন্তু প্রকাশ করেছেন মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণে। সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি-দর্শন অনেকের কবিতারই অনুষঙ্গ হয়েছে। কিন্তু হেনরী স্বপনের কবিতায় এসব এসেছে দার্শনিক প্রত্যয় নিয়ে। এ কারণে তাঁর কবিতা ভাবালুতায় ভেসে যায়নি, হয়ে উঠেছে সময়ের কাছে মনীষার দান। যে মনীষা ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রকে ধারণ করে বিশেষ তাৎপর্যে, বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে একটি মস্তবড় বিস্ময়সূচক চিহ্ণের মতো।