‘দ্বিধাদীর্ণ সময় ও সমকালীন চিন্তার বৈপরীত্য, রাজনীতির স্ববিরোধী সত্তাকে যিনি ধারণ করেছিলেন কাব্যিক শরীরে, অন্তর্বাসে ও মননে, শব্দ ও প্রতীকী দেয়ালের খিলানের কারুকার্যে, বাক্যের বেশভূষায়, বাংলাদেশের ষাটের সেই কবি হুমায়ূন কবিরের জন্ম বরিশালের জীবনানন্দীয় এক রূপমগ্ন ও ইন্দ্রিয়জ পরিমণ্ডলে। প্রায় স্বাধীনতার সমান বয়সি (জ. ১৯৪৫) সেই বিরলপ্রজ প্রতিভাভাস্বর তরুণ কবির দুর্বার রক্তিম যৌবন, তাঁর উদ্যত চৈতন্য ও জাগ্রত প্রাণশক্তিকে ১৯৭২ সালে অসহায়ভাবে স্তব্ধ করে দিয়েছিল শত্রুর একটি নিষ্প্রাণ অনুভূতিহীন বুলেট। প্রতিভার নিশ্চিত উত্তাপে উঞ্চিত উদ্যত তারুণ্য, দীপ্র বুদ্ধিবৃত্তি, অপরিমিত প্রতিশ্রুতি ও প্রোজ্জ্বল দেশপ্রেমের এমন বলিষ্ঠ স্বাক্ষর ষাটের আর কোনো কবির মধ্যে পাওয়া যাবে না।
কালখণ্ডের দ্বিধাগ্রস্ত সত্তা, যুগীয় স্ববিরোধী বাস্তবতা তাঁর অন্তর্লোক, বরং বলা ভালো মর্মলোককে সবচেয়ে বেশি দ্বন্দ্ববিস্রস্ত করেছিল এবং তিনি সবচেয়ে সচেতনভাবে এই স্ববিরোধিতার স্বরূপটিকে জ্ঞানত অনুভব করেছিলেন। এই বৈপরীত্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে সজাগ ছিলেন বলেই তিনি অমন অস্বস্তভাবে ইস্পাত ও কুসুমের সুস্থিত, সমন্বয় অন্বেষণ করেছিলেন তাঁর প্রথম ও একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘কুসুমিত ইস্পাত’-এ। দ্বান্দ্বিক সত্তার চক্রমনশীলতার মধ্য দিয়ে তাঁর মর্মলোকের যেমন পরিবর্তন ঘটেছে, বিশেষত ষাটের প্রথম বলয়ের অর্থাৎ ১৯৬৭ সালের আগ পর্যন্ত যে বাকরুদ্ধ সামরিক শাসন ও নিষ্পেষণে চল্লিশের ও পঞ্চাশের বয়স্ক বুর্জোয়া মানবতাবাদী কবিদের কণ্ঠ এবং সংগ্রামী চৈতন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল; কিংবা অংশত দাসখত লিখেছিলেন সময়ের, শোষণের ও অর্থনৈতিক লোভের কাছে এবং ছয়ের দশকের কবিকণ্ঠে যখন এলোপাতাড়ি গরল উগরে পঙ্কিলতা ছড়াচ্ছিল, হুমায়ূন কবিরের রক্তে ছিল তখন রাজনৈতিক সচেতনতা, যা একাত্ম সংলগ্নতার উত্তাপে অনুভব করা যায়। তাঁর কবিকণ্ঠ বিশ্লেষণ করলে ছয়ের দশকের সামাজিক দৃশ্যপট ও সমসাময়িক মানসবৃত্তের বিবর্তনের স্পষ্ট স্বাক্ষর মেলে। ষাটের সামাজিক বন্ধ্যা দশার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সংগ্রামী চৈতন্যের প্রতিরোধী সত্তার আগুন গণ-আন্দোলনের ও যুদ্ধের রক্তস্নাত ভুবন মননের পটপরিবর্তন ঘটিয়েছে, যা হুমায়ূন কবিরের আসল মূর্তি। তাঁর কাব্যিক ক্ষেত্র নির্মাণ করলে কতগুলো বিষয় চোখে পড়ে, আনুষঙ্গিক তা বিশ্লেষণযোগ্য :
ক. মানবতার দ্বৈতরূপ এবং বিপরীতমুখিনতা : কুসুম ও ইস্পাত = নৈসর্গিকতা ও মানবিকতা> অন্তবৃত্তি >রোমান্টিকতা ও বাস্তবতা।
খ, কাব্যিক আবহ : রোমান্টিকতা, নস্টালজিয়া বিষাদমগ্নতা, নারী প্রকৃতির অন্তর্মর্মিতা।
গ. বিষয়ানুরাগ : নৈসর্গিকতা > প্রকৃতি, নারী, প্রেম, স্মৃতিচারণা; মানবিকতা > জীবনসংগ্রাম, স্বদেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ।
ঘ. চাবিশব্দ : ফুল পাখি তরু নারী স্মৃতি প্রেম যুদ্ধ ইত্যাদি।
কবির অন্তর্লোকের গতিবেগ দুই মেরুকেন্দ্রিক এবং তা বিপরীতমুখিন। তার একদিকে নৈসর্গিকতা এবং যেখানে প্রকৃতি ও নারী অভিন্ন, প্রেম তার সংলগ্ন-সহচরী। অন্যদিকে আছে মানবিকতা, যা জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, জাতীয় যুদ্ধ এবং স্বদেশপ্রেমের রূপ নিয়েছে। কিন্তু এই দুই মেরুর ওপর দাঁড়িয়েই কবিসত্তার বিকাশ; যুগীয় বৈপরীত্য তাঁর মানসিক পটকে দুটি বিপরীত ভিন্নখাতে বইয়ে দিয়েছে, তবুও সমন্বয় ও সংঘাতের মধ্য দিয়েই কালের সেই গতিবেগ, যা দ্বান্দ্বিক সত্তারই প্রতীক, কবি হুমায়ূন কবির তাঁর সারা জীবনের কাব্যেও সেই দ্বান্দ্বিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বিষয়বস্তুতে সংঘাত সত্ত্বেও, কাব্যিক আবহ অর্থাৎ রোমান্টিকতা, গীতিধর্মিতা, নস্টালজিয়া এবং বিষাদমগ্নতা দুই মেরুকে একটি স্থির বিন্দুতে ছুঁইয়ে রেখেছে। এখানেই বৈপরীত্যের সেতুর একদিকে কুসুম ও অন্যদিকে ইস্পাত। তাঁর নৈসর্গিকতা যেমন স্নিগ্ধ, যুদ্ধ সংগ্রামও তেমন পেলবতায় আশ্লিষ্ট। উগ্রতার চেয়ে বিনম্রতা, বজ্রের চেয়ে গীতিময়ী কিন্নরকণ্ঠী সরবতার কাব্যিক ব্যঞ্জনা। তাঁর সংঘাত ও সমন্বয়ের মৌল বিন্দু রচিত হয়েছে কড়ি ও কোমলে। সমান্তরাল বৈপরীত্য, রাজনীতির দ্বিধাদীর্ণতাই তাঁর কবিমানসের চালচিত্র।
প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ : ১
একথা গোড়াতেই বলেছি যে, হুমায়ূন কবিরের ‘কুসুমিত ইস্পাত’-এর কবিতাগুলোর একদিকে আছে নিসর্গের প্রতি প্রগাঢ় আকর্ষণ, অন্যদিকে জীবন সংগ্রাম, চেতনতর বোধ, সুখস্বপ্ন এবং সৌন্দর্যের প্রতি অমলিন ভালোবাসা। তাঁর এই ব্যক্তিত্বের দুই সত্তার প্রতিভাস আকীর্ণ তিনটি বিষয়ে :
ক. নামকরণ : কুসুমিত ইস্পাত = কুসুম >< ইস্পাত
খ. বিষয়ভাবনা : নৈসর্গিকতা >< স্বদেশপ্রেম এবং
গ. শব্দ ব্যবহার : নরম স্নিগ্ধ মায়াবী শব্দ > দৃঢ় কঠোর এবং বদ্ধাক্ষরযুক্ত।
একদিকে কুসুম, অন্যদিকে ইস্পাত। এ-যেন তাঁর সত্তারই দুই অংশ, পরস্পরের সঙ্গী ও প্রতিদ্বন্দ্বী : সমন্বয়ধর্মিতা ও সংঘাতমুখরতারই চিত্রায়ন। তাঁর চেতনায়ই জড়িত ছিল বিপ্রতীপ এই বিশ্বাস। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর এই সত্তার নাম দিয়েছেন ভিতরভূমি ও বাহিরভূমি কিংবা অন্তবৃত্তি ও বহিবৃত্তি। তিনি বলেছেন :
‘হুমায়ূন কবির আমার ধারণায়, ছিলেন, মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘আন্তর-বহির্বৃত্ত। যেন লোহার দেয়াল ঘেরা বাগানে ফুল ফুটে উঠেছে—এই তাঁর কবিতা, এই তিনি। কুসুম ও ইস্পাত, ভিতরভূমি ও বাহিরভূমি, অন্তবৃত্তি ও বহিবৃত্তি—এরকম বহু অংশে তাঁকে বিভক্ত করে ফেলা চলে, যে-দুই অংশ হুমায়ূন কবিরের মনোপৃথিবীর জলস্থল। কুসুম ও ইষ্পাত আসলে হুমায়ূনের নৈসর্গিক ও মানবিক ভাবনা-বেদনার দুই চাবিশব্দ, যে চাবিশব্দ, যুগের ব্যবহারে খুলে ফেলা যায় তাঁর মানসসত্তা।’
বিষয়ভাবনা : বিশ্লেষণ ২
এই দুই সত্তার আত্মসংলগ্নতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে হুমায়ূনের কবিকণ্ঠ। হুমায়ূন কবিরের ভিতরভূমির ভিত নির্মিত হয়েছে প্রকৃতি শ্যামলিয়া নিয়েই। ‘ফুল, পাখি, তরু, নারী, কৈশোরিক স্মৃতি কিংবা প্রেম ইত্যাদি’ নিয়েই তাঁর রোমান্টিক পরিমণ্ডল। এই রোমান্টিকতার শরীর তৈরি হয়েছে নস্টালিজিয়া অর্থাৎ অতীতমুখিনতা এবং বিষাদ বাতাসে। আবদুল মান্নান সৈয়দ কাব্যিক ব্যঞ্জনা, উপমা-রূপকে চমৎকার এক বর্ণনা দিয়েছেন এই রোমান্টিক পোশাকের : ‘এই রোমান্টিকতা, কাব্য সাম্রাজ্যের এই অমর সম্রাজ্ঞী, বিষাদ যার পোশাক, হুমায়ূন চিরকালের সেই বিষণ্ণ সুন্দরীর প্রেমে পড়েছিলেন।” নিসর্গের প্রতি তাঁর এই বিমুগ্ধতার পটভূমি মনন নয়, হৃদয়বৃত্তি।
কিন্তু ইস্পাত-অংশ তাঁকে মোটেও ‘প্রতি-রোমান্টিক করেনি। কারণ, প্রতীপাংশে ছিলো নিসর্গ-প্রকৃতির প্রতি দীপিত মুগ্ধতা।”
শব্দের প্রতীক : বিশ্লেষণ ৩ হুমায়ূন কবিরের কিছু চাবিশব্দ আছে, যাকে তিনি বারবার ব্যবহার করেছেন, কখনও প্রতীকের শরীর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এবং কলম, কবিতা তাই রাইফেলের মতোই একই সঙ্গে অস্ত্র হয়ে উঠেছে। রক্তাক্ত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক তাঁর কবিতাক্রম অজস্র : ‘ডিসেম্বরের বঙ্গদেশ’, ‘রক্তের প্রতিবেশী জন্মভূমি’, ‘স্বাধীনতা’, বধ্যভূমির নিসর্গ’, ‘কুড়ি আনার বিলে’, ‘লাল বলের মতো গ্রেনেড’, ‘এপ্রিলে রচিত কবিতা ১৯৭১’, ‘আরশীনগর’, ‘মার্চে প্রথম কারফ্যু’, ‘আমার ভাই’, ‘মুক্তিযুদ্ধে কবি’ ইত্যাদি।
১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভৃতি ঐতিহাসিক সংগ্রামী স্মৃতিও বহুলভাবে আলোড়িত করেছে কবিকে। ‘জানুয়ারি ১৯৬৯’, ‘ফেব্রুয়ারি’ ‘এক গঞ্জের গল্প’-তে হুমায়ূন কবিরের ইতিহাস-চেতনা পরিস্ফুট। এইভাবে সমাজবিন্যাস তাঁর কবিতার ভাষায় ধরা পড়ে।
স্বদেশচেতনা ও স্বাধীনতাসংগ্রামবিষয়ক কবিতাবলিতে মুক্তিযুদ্ধের মর্মস্পর্শী চিত্র যেমন প্রতিফলিত, তেমনি চিত্রভাসিত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের আত্মত্যাগ। ‘মুক্তিযুদ্ধে কবি’ কবিতায় কবির আত্মপরিচয়-জিজ্ঞাসার সন্ধান মেলে। শৈশবের ভীতি কাটিয়ে ক্রমশ কীভাবে একজন কবি সাহসী হয়ে ওঠেন, তার ইতিবৃত্ত ধৃত আছে এই কাব্যবিন্যাসে। এই সাহসী কিশোর মূলত বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করছে। স্বজনহারা কিংবা ভাইয়ের মৃত্যুতে কবির তাই অহংকার।
হুমায়ূন কবিরের নাগরিকবোধের সঙ্গে মিলেছে গ্রামীণ সত্তা। কখনও নাগরিকতা ছেড়ে বাংলা ও স্বদেশপ্রীতি; নিসর্গদর্পণে ভাস্বর মনস্কতা। কবি সুস্থজীবনবোধ জাগাতে চেয়েছেন সমাজে। ষাটের বিষণ্ণতা কাটিয়ে তিনি যখন নিসর্গপ্রীতিতে ঐতিহ্যমগ্নতায় আচ্ছন্ন এবং এই নগ্নতায় যখন তিনি আইয়ূবী দশকের গরলগাথার দুঃখবোধ ভুলতে চান, তখন কবিতার ইতিবাচক দিগন্ত আরও মনোহর হয়ে ওঠে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবি অস্ত্র ধরেন। যুদ্ধ-বিরোধী চেতনা তাঁর মধ্যে প্রলম্বিত হয়। তিনি আশাবাদী বলে ভস্ম ও কদম যুদ্ধ দিয়ে ঢেকে দিতে চান। অবশ্য সে যুদ্ধ শ্রেণিসংগ্রাম। ছয়ের দশকের অন্ধকার বিপন্ন সময়ের ফসিল ছুড়ে ফেলে তিনি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চেতনতর সত্তার অভিজ্ঞানে ক্রমশ গণ-সংলগ্নতা অনুভব করেন। সমাজচৈতন্যে ব্যক্তিসত্তার উপলব্ধিকে বিশ্বজনীনতায় রূপান্তর করেন। এখানেই তাঁর সাফল্য।
বিশ্লেষণ : ১ রবীন্দ্রনাথ। বিষয়ভাবনা : রাজনীতি ও দায়বদ্ধতা
‘কুসুমিত ইস্পাত’ কাব্যে ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবিতায় হুমায়ূন কবির একজন কবির দায়বদ্ধতার কথা ব্যক্ত করেছেন; যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশের চিত্র নির্মাণ করেছেন। আলোচনার কারণে এখানে মূল কবিতাটি উপস্থাপন করা হল :
রবীন্দ্রনাথ
তুমি ত ঋষির বিভা পেয়েছিলে এবং পোষাক
আনন্দের মহাগানে নিখিলের নানান পুলকে
কাটিয়েছ। শচীশ দামিনী, তারা যন্ত্রণার
আঁধার বিবরে একবার গিয়েছিল।
পদ্মার অনার্য স্রোত সাধের সে গ্রীণবোট খানা
কিছুদূর নিয়েছিল চরের কাঁকালে দুখিরাম
চন্দরার গরীব সংসারে।
নিরর্থক তেজে ভুগে মধ্যবিত্ত লিভারে অসুখ
বানায়, কখনো ভাবে সে অতি দূরে যাওয়া যায় যদি
পৌষের ডাক শুনে। তোমার সোনার ছেলে |
অভীক যেমন পেল উড়োজাহাজের মাঝিগিরি।আমাদের বাঙলাদেশ আগুন ও বুলেটের যে দীক্ষা
পেয়েছে, মানুষের দেহ পেয়ে পথের কুকুর
উচ্ছিষ্ট ভোজন ভুলে গেছে। ভাবি তুমি
ছাতিমতলার মৃদু প্রার্থনার বেদী ছেড়ে
যেতে কিনা ধুলোর সংসারে। যেতে কি
যশোর রোডে, মেলা ঘরে হাসনাবাদে দুঃখ
ও ক্রোধের তাঁবুর নীচে। শোনাতে এমন গান
যোদ্ধার তরুণ দেহ পিন খোলা গ্রেনেডের মত
বিপজ্জনক হয়ে ছুটে যায় শত্রুর ঘাঁটিতে
অথবা শেখাতে তুমি পলায়নপর কবিদের
কি করে নির্ভুল গুলি ছোঁড়া যায় এল.এম.জি.
মাটিতে না রেখে।
[হুমায়ূন কবির রচনাবলী : কুসুমিত ইস্পাত, পৃ. ৯১]
কবিতার বহিরাঙ্গের দৃশ্যপট
বাংলাদেশ জুড়ে ১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, যে আগুনের লেলিহান শিখায় রোমের মতো পুড়েছে বাংলাদেশ, বুলেট বিঁধেছে দেহ, পচাগলা শবদেহের পরিমান এত বিশাল যে কুকুর ভুলেছে উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ। যশোর রোড, মেলাঘর, হাসনাবাদে উদ্বাস্তুশিবির-এর দুর্দশা, তরুণ যোদ্ধার দেহে গ্রেনেড। শত্রুর ঘাঁটিতে আত্মত্যাগী বাঙালি জওয়ান। এ-ভাবেই কবি বাংলাদেশের রাজনীতিক বাতাবরণ তৈরি করে রবীন্দ্রনাথের স্নিগ্ধতা মোহাবিষ্ট দীপ্রতাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং একজন কবির দায়বদ্ধতার জবাবদিহি চান রবীন্দ্রনাথের কাছে। পলায়নপর কবিরা দায়িত্বহীনতার জামা পরে বসে জাবর কাটে, তাদের গুলি ছোড়া কিংবা এল. এম. জি. নামক শীতল কিন্তু তীক্ষ্ণ অস্ত্র চালাতে রবীন্দ্রনাথ শেখাতেন কিনা এসব প্রশ্ন কবি করেছেন। আসলে সামাজিক বা রাষ্ট্রিক সংকটে আর পাঁচটা মানুষের মতো কবি দায়িত্বপালন করবে কি না, এই জিজ্ঞাসার উত্তর কবি রবীন্দ্রনাথের প্রতিচ্ছায়ায় পেতে চেয়েছেন।
বিশ্লেষণ ২ : রবীন্দ্রনাথ। স্ট্রাকচারালিজম
কবিতাটির ভিন্নার্থক ব্যবচ্ছেদ, শবদেহের মতো। রচনা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। রচনাটিতে ৩ স্তবক, চরণ সংখ্যা ২৩ (৭+৪+১২); প্ৰথম স্তবকে ৭ চরণ, দ্বিতীয় স্তবকে ৪ এবং শেষোক্ত স্তবকে ১২ চরণ। শব্দ সংখ্যা ১৩৫ (৩৬+২৬+৭৩)।
হিসেবে, কখনও উপমা চিত্রকল্প বানাতে। এই চাবিশব্দ তাঁর সমগ্র কাব্যসাধনার অন্তর্গত বোধের প্রকৃত মুখচ্ছবি তুলে ধরতে সক্ষম।
পর্যালোচনা
নিসগপ্রীতি হুমায়ূন কবিরের মানসিক বিলাস নয়। প্রকৃতিতে তিনি খুঁজে ফেরেন ‘বিশুদ্ধ বাতাস’, অন্তত ষাটের অবক্ষয়িত ধুলিধূসরিত নষ্ট সময়ে। তাই বিশুদ্ধতার অন্বেষায়-ই তাঁর জিজ্ঞাসা : ‘কোথায় ভরাভয় / কোনদিকে ফুল পারুল বকুল কোথায় বাতাস বয়/।’ কিন্তু হুমায়ূন কবিরের এই নিসর্গ, সুখময় স্বপ্নের সাধ বাস্তবের সুকঠিন সংঘাতে ভেঙে গুড়িয়ে যায়।
জীবনানন্দ দাশের উদ্দেশে তিনি উচ্চারণ করেন যখন আবেগ : ‘কী বোধ তোমার, প্রেমী, আজীবন রক্তের ভিতরে,/ তৃষ্ণাদীর্ণ হয়েছিলে, পেয়েছিলে বিশাল যন্ত্রণা/উটের গ্রীবার মত কিমাকার গোপন বিনাশ। তোমাকে যন্ত্রণা দিত মধ্যরাতে, ক্লান্তি দিত খুব / … নিসর্গ তোমাকে, কবি, দিয়েছিল কেমন লবণ/যাদের কণক স্বাদে ভীষণ শহর তার মাধবী নিধন / ক্রুদ্ধ কথকতা নিয়ে হয়ে যেত হলুদ সংসার / না হলে কেমন করে তুমি ছিলে জরামৃত্যুমারী ভরা আমাদের নীরব নিখিলে।’
পাখি, পাতা এবং একটি বিদগ্ধ নৈসর্গিক প্যাস্টোরাল ছবির আবহের মধ্যেই সারাজীবন অনুক্ষণ কাটাতে চেয়েছেন হুমায়ূন। কিন্তু অভিজ্ঞতার নির্মম বাস্তবতা তা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। পাশবিক শহর সেই বৈদগ্ধতার পরিচয় মেলে তাঁরই ‘ইস্পাত’-এ। কুসুম ও ইস্পাতের দ্বৈতসত্তার পরিচয় মেলে তাঁর ‘বাগান’ ও ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবিতায়। ‘বাগান’ কবিতায় তিনি বলেন : ‘ঝাউয়ের ডালে নরম কোমল সাপ।’ নিসর্গমগ্ন এই কবির কাছে সাপ নিফর্ণ ও অকুটিল। অঁরি রুশোর অঙ্কিত সর্পের মতো তা মনোহর ও চিত্রল। অথচ এই গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘রবীন্দ্রনাথ’-এ তিনি যখন রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে বলেন : ‘লেখাতে তুমি পলায়নপর কবিদের/কি করে নির্ভুলগুলি ছোঁড়া যায় এল. এম. জি./মাটিতে না রেখে,’ তখনই হুমায়ূন কবিরের আর-এক সত্তার পরিচয় মেলে।
তাঁর এই দুই সত্তার মধ্যে নিসর্গ প্রীতিতেই তিনি ছিলেন অতিমাত্রিক আবিষ্ট। কিন্তু বাস্তবতা সেই কবি-চৈতন্যে এনেছে পরিবর্তন : ‘শহর বিধ্বস্ত আজ, জনপদ ভেঙ্গে পড়ে ঘুমে / বিরল বসতি পথে চলাচল থেমে যায়, ইতস্তত : হাত নাড়ে ভয় / … রক্তহীন গল্পবলি, মঞ্জুভাষ শোনার সাহস / সুরভি জ্যোৎস্নার সাথে সুকঠিন অন্তর্ধানে গেছে।’ বাস্তবের এই ছবি হুমায়ূন কবিরকে সংগ্রামী জনতার পাশাপাশি নিয়ে এসেছে। তাই তাকে দেখা যায় এল.এম. জি হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে; ভাইকে শহিদ হতে হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে, কুড়ি গ্রামের রণক্ষেত্রে। ইস্পাত তখন বাস্তবতার প্রতিকল্প হয়ে ওঠে। তিনি তাই প্রতিরোধ সংগ্রামের সওয়ারি হয়ে পড়েন : ‘রাজপথে জনপথে লাল লাল রক্তের চিহ্ন / বুক দিয়ে রুখছি যে রুখছি বর্বর পদাঘাত / নারীর চারদিকে ব্যারিকেড টলমল জ্বলছে উজ্জ্বল ব্যারিকেড।’ হুমায়ূন কবিরের রক্তের ঋণ কিংবা অগ্রন্থিত কবিতা-য় ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ষাটের অন্ধকার, আলো, গণ-অভ্যুত্থান, প্রতিরোধ, যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতির ইতিহাস। নিসর্গপ্রীতি, ঐতিহ্যসংলগ্নতা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার প্রতি গভীর ভালোবাসার মধ্য দিয়েই তার ইতিহাস-চেতনাই পরিস্ফুট হয়েছে। হুমায়ূন কবিরের কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে উনসত্তরের দুর্বার সংগ্রাম, আসাদের শহীদান, শহিদ মিনার চূর্ণিত হলে, এককথায় গোটা সমকাল। তাঁর ‘কুসুমিত ইস্পাতেও মুক্তিযুদ্ধের কথা বহুবার উচ্চারিত – হয়েছে; এসেছে স্বাধীনতার স্মৃতি, বাঙালি যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা ও আত্মত্যাগের অমোঘ মহিমা। তাঁর অন্যান্য কবিতায়ও হানা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। কেননা, হুমায়ূন কবির নিজে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।
কবিতাটিতে প্রথম দুই পর্ব রাবীন্দ্রিক। শব্দগত বিন্যাসে কোমলতা আছে। রোমান্টিকতা ছেড়ে বাস্তবতাগামী হওয়ার ফলে কবিতার শব্দবিন্যাসে রাজনীতি এসেছে। শব্দবিন্যাসে ও পরিকাঠামোয় ব্যাপ্তি এসেছে। শব্দরাজী দিয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধক্ষেত্রের আভাস মেলে। কবিতাটিতে বৈপরীত্য রয়েছে।
যুদ্ধরত বাংলাদেশ : বাস্তবতা, অস্ত্রের ঝঙ্কার লাশ, বুলেট, এল.এম.জি. শত্রু-ঘাঁটি।
সব মিলিয়ে একই কবিতার যে বিষয় বৈপরীত্য ধরা পড়েছে, তা আসলে ছয়ের দশকের দ্বিধাদীর্ণ বাংলাদেশেরই চালচিত্র।
পাদটীকা
১। হুমায়ূন কবির : আবদুল মান্নান সৈয়দ, কণ্ঠস্বর, সপ্তমবর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, ১৯৭২, সেপ্টেম্বর, পৃ. ১৮।
২। ঐ
৩। ঐ। পৃ. ১৯।