আধুনিক সব একেশ্বরবাদী ধর্মের গোড়াপত্তনে হিব্রু ধর্মের অবদান অসামান্য। এটি পৃথিবীর প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্ম। খ্রিস্ট ধর্মের প্লাটফর্ম তৈরিতে হিব্রু ধর্মের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। সৃষ্টিতত্ত্ব, ঈশ্বরের একাত্মা, সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, আইনপ্রণেতা ও পরম বিচারক হিসেবে ঈশ্বরের অবস্থান সম্পর্কিত ‘বাইবেলের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে হিব্রু ধর্মের প্রভাব।’ স্টুয়ার্ড সি. ইস্টন বলেন—Both Christianity and Islam have adopted a considerable portion of the Hebrew religions insights as their own. তবে হিব্রুরা আধিবিদ্যা ও সৃষ্টিতত্বের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিল না। এর চেয়ে তারা তাদের দর্শনচর্চা অব্যাহত রেখেছিল নিজেদের জীবন ও অদৃষ্টকে কেন্দ্র করে। তাদের গভীর দর্শন চিন্তার ব্যাপক প্রভাব আমরা লক্ষ করি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের বিভিন্ন স্থানে। হিতোপদেশ (Book of Proverbs) ও উপদেশক (Book of Ecclesiastes)-এ ইব্রীয়দের দর্শন চিন্তার প্রতিফলন রয়েছে।
হিতোপদেশ কাব্যে মানুষকে জ্ঞানবান হওয়ার ও ধার্মিকের জীবনযাপন করার জন্য উৎসাহ দান করা হয়েছে। পুরো বইটির মূল কথা বলা হয়েছে এই কাব্যের প্রথম কবিতার ৭ নং পদে।
ঈশ্বর ভয় থেকেই শুরু হয় জ্ঞান
মূর্খরা জ্ঞান ও উপদেশ তুচ্ছ করে।
ইব্রীয়দের মৌলিক শিক্ষাগুলোও যেমন, জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা (৪ : ১-১৯), সুশৃঙ্খল গৃহ পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা (১ : ৮-১৯), জ্ঞানপূর্ণ ব্যবহার, ইত্যাদি এই কাব্যের অন্তর্গত। হিতোপদেশকে তাই ইব্রীয়রা বলে মেশাল অর্থাৎ যা দিয়ে রাজত্ব করা বা শাসন করা যায়। এজন্য ইব্রীয়রা জ্ঞানের সাধনা করতে তাদের সন্তানদের উৎসাহ দিত।
জ্ঞানীর সহচর হও, জ্ঞানী হবে;
যে হীন বুদ্ধির বন্ধু সে হতাশ হবে।
আবার
জ্ঞানবানের শিক্ষা জীবনের উৎস
তা মৃত্যুর ফাঁদ চিনতে সাহায্য করে।
অথবা
যে শাসন ভালোবাসে সে জ্ঞান ভালোবাসে
কিন্তু যে অনুযোগ ঘৃণা করে সে পশুর মতো।
শুধু জ্ঞান আহরণে উৎসাহ প্রদানই নয় অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের কথাও বলা হয়েছে এ কাব্যে।
একটি উপদেশে আছে:
দীনহীনকে যে উপহাস করে
সে নিজের নির্মাতাকে অপমান করে।
অন্যের বিপদে যে আনন্দ পায়
সে অদণ্ডিত থাকবে না কিছুতেই।
(হিতো ১৭ : ৫)
উপদেশকের একস্থানে বলা হয়েছে—
যে অর্থ ভালোবাসে
তারপক্ষে অর্থ কখনই যথেষ্ট হয় না;
এবং যে বিলাসিতা ভালোবাসে
তার অর্থ লাভ হয় না ।
(উপদেশক-৫ : ৯০)
উপদেশকে ইব্রীয়দের দর্শন চিন্তার সবচেয়ে বেশি পরিচয় পাওয়া যায়। একমাত্র এই বইটি থেকে ইব্রীয় দর্শনের চারটি শাখা সম্পর্কে জানা যায়। এগুলো হলো ১. যান্ত্রিকবাদ, ২. অদৃষ্টবাদ, ৩. দুঃখবাদ বা হতাশাবাদ ও ৪. মধ্যপন্থী।
যান্ত্রিকবাদ:
ইব্রীয় দর্শনে বিশ্ব হচ্ছে একটি যন্ত্রের মতো এই যন্ত্র নিজ বলয় চলছে তো চলছেই কোনো পরিবর্তন নেই। পৃথিবী একটি বৃত্তের চারিদিকে ঘুরছে, সূর্য উঠছে এবং ডুবছে। সূর্যের এই নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম নেই—কোনো নতুনত্বও নেই। তাই কাব্যের শুরুতেই কবি বলছেন, ‘অসারের অসার! সবই অসার।’
সূর্যের নিচে পরিশ্রান্ত মানুষ কি কখনো তার কর্মের সুফল দেখতে পায়? প্রজন্মের পর প্রজন্ম যায় কিন্তু পৃথিবী নিত্যস্থায়ী। সূর্য ওঠে আবার ডুবে যায়—সে পুনরায় ওঠার জন্য ক্রমাগত দৌড়ায়। বাতাস দক্ষিণে বয়ে যায় এবং আবার উত্তর দিকে ঘুরে আসে; তা ঘুরতে থাকে ঘুরতে থাকে বারবার নিজের কক্ষপথে ফিরে আসে; সব কিছু ক্লান্তিজনক এর কারণ ব্যাখ্যা করার সাধ্য কারো নেই (১: ১-৮)।
যান্ত্রিকতাবাদ একঘেয়ে জীবনে নতুনত্বের কোনো সাধ দিতে পারে না। মানুষের জীবনে তাই উৎফুল্ল হবার মতো কিছুই থাকেনা, শেষ পর্যন্ত সে ক্লান্ত হয়, হতাশ হয়।
অদৃষ্টবাদ:
চিরকাল মানুষ তার ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে পথ চলে এসেছে। ইব্রীয়রাও-এর ব্যতিক্রম নয়। এজন্য কবি বলেন, ‘মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে যেমন উলঙ্গ আসে তেমনি উলঙ্গই চলে যায়। পরিশ্রম করলেও এমন কিছুই নাই যা সে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারে। এও বিরাট অনিষ্ট; সে যেভাবে আসে সেভাবেই চলে যায়।‘ এ তার ভাগ্য, বিধিলিপি।
বায়ুর নিমিত্ত পরিশ্রম করে যখন কোনো লাভ নেই তখন কবির সিদ্ধান্ত ‘ঈশ্বর মানুষকে বরং যে কটাদিন বাঁচতে দেন সে ক’টাদিন সে সমস্ত পরিশ্রমের মধ্যে পানাহার করে সুখভোগ করুক। (৫ : ১৮)।
অন্যত্র কবি বলেন, ‘আমি ফিরলাম, সূর্যের নিচে দেখলাম দ্রুতগামীদের দ্রুতগমন, বীরদের যুদ্ধ, জ্ঞানবানদের অন্ন, বুদ্ধিমানের ধন। বিজ্ঞরাই যে কেবল অনুগ্রহ পায় এমন নয়—সবার প্রতিই কাল ও দৈব যোগ আছে।’ (৯ : ১১)
দুঃখবাদ বা হতাশাবাদ:
উপদেশকের আশাহীন নৈরাশ্য, জীবনের অসারতা ও হতাশা শান্তির অভাবের জন্য বইটি দুঃখবাদের উৎকৃষ্ট গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত। ‘হিতোপদেশে’ কবি যখন জ্ঞানী হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন তখন উপদেশকের হতাশারবাণী:
জ্ঞান বাড়লে দুঃখ বাড়ে
যে বিদ্যার বৃদ্ধি করে সে
ব্যথা বৃদ্ধি করে।
(১ : ১৮)
সন্দেহবাদের কারণে ইব্রীয় বা ইহুদিদের জীবনে নেমে আসে কঠিন হতাশা। পার্থিব জীবনের মূল্য তখন তাদের কাছে কিছুই নেই। অতিরিক্ত উচ্চাশা, অর্থাকাঙ্ক্ষা, লোভ, কামনা ও পরিশ্রম মানুষকে বিভ্রান্ত করে। যদিও কবি বলেন:
পৈত্রিক সম্পদের মতো প্রজ্ঞা ভালো
জ্ঞান সূর্যস্পর্শী লোকের জন্য উত্তম।
কেননা পৈতৃক সম্পদ যেমন আশ্রয়
তেমনি জ্ঞানও তার নিজ অধিকারীর
জীবন রক্ষাকরে।
(৭ : ১১-১২)
তারপরও হতাশাপ্রযুক্ত উপদেশকের কবি বলেন:
অতিশয় ধার্মিক হয়ো না
অতিমাত্রায় প্রজ্ঞাবানও হয়ো না।
কেন তোমার নিজের বিনাশ চাও?
(৭ : ১৬)
উপদেশকের কবির জীবনের প্রতি যে হতাশা তার মূল কারণ ‘মৃত্যু’। মৃত্যু মানুষের সমস্ত কাজের ফল চুরি করে। এখানে এসে সমস্ত যুক্তি, বিশ্বাস ও কর্ম অর্থহীন এবং অসার হয়ে যায়।
কবি জীবন ভালোবাসেন বলেন—‘মৃত সিংহের চেয়ে জীবিত কুকুর ভালো’ (৯ : ৫)। কেননা মৃতেরা কিছুই জানে না—তাদের ঈর্ষা, দ্বেষ ও প্রেম সব কিছুই বিনষ্ট হয়। এই চিন্তাই আবার ইব্রীয়দের জীবনকে হতাশায় পূর্ণ করে দেয়। তাই সে বলে, ‘মৃত্যুর পরে কী ঘটবে, তা যখন সে জানে না, তখন নিজ কাজে আনন্দ করা ছাড়া মানুষের আর কিছুতেই কোনো মঙ্গল নেই।(৩ : ২২)।
মধ্যপন্থী: এই ধারায় বলা হয় সংযম অথবা অসংযম দুটিই পরিত্যাগ করা উচিত। অতিরিক্ত ভালো এবং অতিরিক্ত মন্দ উভয় কাজই ত্যাগ করে মধ্যবর্তী পথ অনুসরণ করা শ্রেয়। আর তাই উপদেশকের বাণী:
অতি তুষ্ট হয়ো না,
অজ্ঞানও হয়ো না
অসময় কেন মরতে চাও?
কবি বলেন:
অতিশয় ধার্মিক হয়ো না
অতিমাত্রায় জ্ঞানবান হয়ো না
কেন নিজের বিনাশ চাও?
ইব্রীয়দের সমাজে সন্দেহবাদ অদৃষ্টবাদ ব্যাপক ছড়িয়ে পড়লেও নীতি দর্শন চর্চায় তারা বিশেষ অবদান রাখতে পেরেছিল।
ওল্ড টেস্টমেন্ট-এর বিভিন্ন স্থানে তাদের নৈতিক দর্শনের উল্লেখ রয়েছে। হিতোপদেশ বা বেন-সিরা কাব্যে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি, বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য, শালীন ব্যবহার, বন্ধুত্ব, একের প্রতি অন্যের সম্পর্ক, হিংসা ও লোভ পরিহার, ইত্যাদি বিষয় উপদেশ দেওয়া হয়েছে।