কবিতা রচনায় যাবতীয় তারল্য এড়িয়ে চলেন যে কবি, তাকে আধুনিক কবি বলা যেতে পারে। এই উপলব্ধির সঙ্গে আধুনিক ও অনাধুনিক শব্দ দুটিরও যোগসূত্র রয়েছে। তবে কবিতার সন্ধানী পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, কালের সংকট ধারণ করতে গিয়েই কবিরা আপনাপন রুচির পক্ষে নিজেদের ক্ষেত্র তৈরি করেন। কেউ পূর্বসূরিদের তৈরি পথে হাঁটেন, কেউবা তা উড়িয়ে দেন অবলীলায়। এই প্রক্রিয়ায় কবিতায় বাঁক পরিবর্তনের বিষয়টিও পাঠকের সামনে আসে। আধুনিক বাংলা কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে আঙ্গিক-প্রকরণে কবিতা রচনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ তা আত্মস্থ করে নিজের পৃথক পথ নির্মাণ করেছেন। আবার এ কথাও সত্য যে, রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে গিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে কবিতা রচনার দুর্দমনীয় যে প্রবণতা ত্রিশের কবিরা লালন করেছেন, তার সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও জীবনানন্দ দাশই যে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছেন, তা বলাই বাহুল্য। আর এভাবেই কবিতার সন্ধানী পাঠকের কাছে কবিতার ‘বাঁকবদল’ ধারাটি পরিচিতি পেয়েছে। বাস্তবতা হলো, এরপর দীর্ঘদিন ওই ত্রিশের ধারণা-ধারা নিয়েই চর্চিত ও সম্প্রসারিত হচ্ছে বাংলা কবিতা। কেউ কেউ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও শেষ পর্যন্ত ওই ধারার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেনি। এর ভেতর এসে ঢুকেছে নানা ‘ইজম’ ও ‘আন্দোলন’। এসেছে পাশ্চাত্যের কবিতা বিষয়ক নানা ধারণা ও ধারা। তবে বাংলা কবিতা তার নিজস্ব ধারা— পেলব, গীতিময় বা মন্ময় ধারার মধ্যেই চক্রাকারে আবর্তিত।
স.ম. শামসুল আলমও বাংলা কবিতার এই সনাতন ধারার কবি। তার হিংসার নক্ষত্র এক, দুঃখের কাছে আশ্রিত আমি, দাঁড়াবার পা কোথায়, সোনার বাসর পাঠে প্রতীয়মান হয় তিনি জীবনের কোনো প্রান্তরই উপেক্ষা করেননি। তার কবিতায় যেমন রয়েছে প্রেম তেমনি বৈরাগ্যেরও দেখা মেলে। কখনো কবিকে পলায়নপর মানসিকতা পোষণ করতে দেখা যায়, আবার তিনি স্বপ্নও জাগিয়ে তোলেন কবিতায় ব্যবহৃত উপমা এবং চিত্রকল্পে। তবে সার্বিক অর্থে তার কাব্যরস শান্ত ও গীতিধর্মী, যা জীবনাভিজ্ঞতার নির্যাস বলেই প্রতীয়মান হয়। কবি স.ম. শামসুল আলম বহুমাত্রিক লেখক। একাধারে লিখে চলেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, রম্যরচনা, কলামসহ সাহিত্য ও মুক্তচিন্তার নানা শাখায়। তবে কবিতা-সাহিত্যে তার আবিষ্কারের নেশা রয়েছে, রয়েছে সৃষ্টির উন্মাদনা। কবিতা রচনায় ‘কল্পনা প্রতিভা’র বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তবে কল্পনাকে যে পরিমাণ প্রজ্ঞার শাসনে পরিমিত দেওয়া সম্ভব, তার পুরোটাই করতে সক্ষম হয়েছেন স.ম. শামসুল আলম। ফলে তার কবিতায় ভাবালুতা প্রশ্রয় পায়নি। একেবারে নিরলঙ্কার শব্দগুচ্ছ কখনো কখনো সালঙ্কৃত শব্দের চেয়ে বেশি ব্যঞ্জিত হয়ে উঠেছে।
পালাবার পথ নেই খুলে রাখি সমগ্র জীবন
নবাগত ইভাদম স্বচ্ছ কাচে জড়ানো শরীর
কালাগ্নির সুচে করি দুঃখে ক্ষত হৃদয়ে সীবন
অন্ত্রে-পিত্তে অনন্ত চুম্বন কোন অধরা পরীর
স.ম. শামসুল আলমের কবিতায় কিছু চাবিশব্দের দেখা মেলে। কবিতায় চাবিশব্দ থাকা দোষের নয়। কেননা, কোনো কোনো শব্দের প্রতি কবির দুর্বলতা সহজাত। কিন্তু সেই শব্দ যদি ভিন্ন ভিন্ন অর্থের দ্যোতনা নিয়ে কবিতায় প্রতিভাত হয়, তাহলে সে কবিতা প্রকৃত কবিতা মর্যাদা পায়। স.ম. শামসুল আলমের কবিতায় ব্যবহৃত চাবিশব্দের একটি হলো ‘সীবন’। সীবনের শাব্দিক অর্থ সেলাই করা। কবি জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-বেদনা, প্রেম-অনুরাগ, বিরহ-বৈদগ্ধ শব্দে-শব্দে সেলাই করে গড়ে তুলেছেন কাব্যভাণ্ডার। এছাড়া তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলো কখনো শ্লেষাত্মক ভাবও প্রকাশ করে। এর অন্যতম কারণ হতে পারে বাকসংযম ও আবেগের সংহতি। যে কথা উপমান-চিত্রকল্পের সাহায্য ছাড়া, সরাসরি অভিব্যঞ্জিত হওয়ার যোগ্য, ওই কথাকে অপ্রয়োজনীয় অলঙ্কারে চাপা পড়তে দেননি কবি।
বাংলা কবিতার বেশির ভাগের বিশেষত্ব হলো প্রেম আর প্রকৃতির সমন্বয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষ মাত্রই প্রেমিক। আর কবির হৃদয় সবসময় প্রেমে টইটুম্বর। যে কারণে কবিতার অধিকাংশ আকাশ জুড়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে প্রেম-ভালোবাসা। আবার বিরহ-কাতরতা প্রেমেই বিপরীত অংশ, আলোর পিঠে অন্ধকারের মতো।
স.ম. শামসুল আলমের কবিতার জুড়েও রয়েছে প্রেম বিরহ । কিন্তু এই প্রেম যতটুকু না নারীপ্রেম, তারও অধিক মানবপ্রেম। উচ্ছ্বাস ও আবেগের সূক্ষ্ণতা, তীব্রতা, নিবিড়তা, প্রাবল্য—সবই পাওয়া যায় প্রেম-কাব্যের ধারায়। স.ম. শামসুল আলমের কবিতায় এসব উপকরণের প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। ফলে তার কবিতার গভীর পাঠে প্রশ্ন মনে হওয়া অসঙ্গত হয় না যে, তিনি কী রোমান্টিক ধারার কবি? কবির কবিতা থেকেই পাঠ নেওয়া যেতে পারে—
তুমুল তুলেছি ফুল হাসে বিষ কাঁটা
ভালোবাসা-হৃদপিণ্ডে যত্নে ছিপি আঁটাঅনন্ত আকাক্সক্ষাগুলো জেগে থাকে কাল মহাকাল
কোথায় ছোঁয়াবো সিক্ত অনুভূতি সলজ্জ সরল
এলিয়ে ধরে না কেউ হৃদয়-চিবুক গাঢ় লাল
হারিয়েছি ভুল করে বুঝি মূল ফল ও ফসল
‘তুমুল তুলেছি ফুল’ কবিতাটির দুই পঙক্তির প্রথম পর্ব পাঠে এটি একটি নিরেট প্রেমের কবিতা বলেই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু দ্বিতীয় পর্ব-বিস্তারে এসে কবিতাটি সমগ্র মানবজীবন দখল করে নেয়। তখন কবিতার অভিব্যক্তি শুধুমাত্র কবির নিজস্ব থাকে না, হয়ে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক। কবিতা বহুস্বরের মর্যাদা পায়। আবার শেষ পর্বে—
যে তুমি কাঁদাও
কাঁদো
সৃষ্টি হয় নদী
তুমুল তুলেছি ফুল হেসে ওঠো যদি
তখন কবিতাটি হয়ে ওঠে পাঠকের নিজস্ব অনুভূতিমালা। ফলে স.ম. শামসুল আলম যে একজন নিরেট প্রেমের কবি সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে না।
প্রত্যেক শিল্পীর সাধনার যেমন বিষয় থাকে, তেমনি থাকে নির্দিষ্ট অঞ্চলও। ওই নির্দিষ্ট অঞ্চল ভৌগলিক, বৈষয়িক এবং নান্দনিকতারও। একেকজন শিল্পী পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী নিজস্ব নির্দিষ্ট অঞ্চলেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সৃজনীচিন্তা, কল্পনা, প্রতিভা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটিয়ে সৃষ্টিকর্মকে শিল্প রসিকদের সামনে উপস্থাপন করাই কবির কাজ। কল্পনার পাশাপাশি কবি স.ম. শামসুল আলম তার কবিতায় বাস্তবতাকেও প্রশ্রয় দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার সম্মিলন ঘটিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। কল্পনাকে প্রজ্ঞার শাসনে পরিমিতি দিয়েছেন। তার কবিতার কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা যেতে পারে—
১। জীবন ঘষে-ছেকে তোলা বাস্তবতা
২। ছন্দের নিয়মিত বন্ধন ও ছন্দ মুক্তি
৩। পরিমিত বোধ ও প্রজ্ঞার শাসন
৪। আবেগের সংহত প্রকাশ
৫। অভিজ্ঞতার নানামাত্রিক রূপায়ণ
স.ম. শামসুল আলমের কবিতায় ভারতীয় পুরাণকল্পের দেখা মেলে, যা তিনি স্বাদেশিক ঐতিহ্যের মিথস্ক্রিয়ায় নবরূপায়ণের চেষ্টা করেছেন। দেশের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, ইতিহাস—ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন কবিতায়, একই সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ও। মানবজন্ম সম্পর্কে কবি সংশয়হীন। তার চিত্তের দৃঢ়তা, তাকে অস্তিত্ববাদের দিকে টেনে রাখে। যেখানে প্রতিনিয়ত মানুষ সংগ্রাম করছে নিজের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, ব্যক্তির সঙ্গে, এমনকি প্রকৃতির সঙ্গেও। তার ‘যে দেশে নিষিদ্ধ আমি দেশপ্রেম দোষে’ কবিতাটি এ বক্তব্যের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে—
ঢিল দিলে ঢেউ তোলে অচঞ্চল জল
আমাকে ক্ষ্যাপালো বুঝি হৃদপিণ্ড খুঁড়ে
মাতৃগর্ভ স্বর্ণখনি সুষম সরল
কুটিল কিরিচে কেটে কারা খায় কুরে
প্রতিবাদে হয়ে গেছে প্রেমিক ঘাতক
ভাঙা পোড়া কষ্ট দাগ হৃদয়ে দহন
শাসকের শক্তি নেই ঠেকায় শোষক
পরাস্ত প্রেমের নামে হুলিয়া সমনফুলে কীট ফলে বিষ বিষাক্ত উদ্ভিদ
বাঁচার অস্তিত্ব নিয়ে কানামাছি খেলা
শিকড় তুলেছে বলে বুকে এত জিদ
আপন মাটিতে বৈরী শুধু অবহেলাথাকি তবু জীবন্মৃত কোপানল রোষে
যে দেশে নিষিদ্ধ আমি দেশপ্রেম দোষে
গোটা কবিতায় একজন সত্যভাষী কবি উপস্থিত থাকেন, কবিতাটি চৌদ্দ বছর আগে রচিত হলেও বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা যা আজও প্রাসঙ্গিক। এজন্যই কবিকে স্রষ্টা এবং দ্রষ্টা বলা হয়। তবে দেশপ্রেমের কথা বললেই তা কোনো না কোনো ভাবে শাসককের বিপক্ষে যায়, ফলে কবিকে হতে হয় নিষিদ্ধ, পদদলিত। কিন্তু প্রকৃত কবি কখনো সত্যভাষণ থেকে বিচ্যুত হন না, না কোনো ধরনের ভয়ে ভীত থাকেন। বাংলা এবং বিশ্বসাহিত্যে সত্য উচ্চারণ করে রাজরোষের শিকার হওয়া কবিদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। তবে ‘যে দেশে নিষিদ্ধ আমি দেশপ্রেম দোষে’ কবিতাটি আশা-নিরাশায় দোদুল্যমান হলেও সংগ্রামের কথাটিই যেন স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
কবি স.ম. শামসুল আলম-এর কাব্যপ্রতিভা ছড়িয়ে রয়েছে তার কবিতার শব্দ-সমবায়ে। কবিতাকে করে তুলেছেন প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবচিত্র। কখনো জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিকে কবিতার অনুষঙ্গ করে তুলেছেন। কেননা, তিনি সমাজকে দেখেন পর্যবেক্ষকের চোখ, নিখাদ শিল্পীর চোখে। তার দেখার মধ্যে সমাজকর্মীর চাতুর্য কিংবা রাজনীতিকের প্রতারণা নেই। একারণে সমাজে যা ঘটে, তার সঙ্গে যা ঘটানোর স্বপ্ন কবি দেখেন, এই দুয়ের সমন্বয়ে একটি চিত্র আঁকেন।
স.ম. শামসুল আলম নিরূপিত ছন্দে যেমন কবিতা লিখেছেন তেমনি লিখেছেন মুক্তক অক্ষরবৃত্তে। কবিতায় তিনি নিজস্ব সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ-রাষ্ট্রের আনন্দ-বেদনার সার্বিক চিত্র অঙ্কন করেছেন। চিত্রকল্প-উপমা সৃষ্টিতেও কবি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। দৃশ্যগ্রাহ্য বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়েছেন ঘ্রাণপ্রাপ্ত ও স্পর্শযোগ্য অভিজ্ঞতার ছাপ। এভাবে কবি স.ম. শামসুল আলম নির্মাণ করেছেন তার নিজস্ব কাব্যভুবন। যা তার উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার সৌন্দর্যে প্রতিভাত।