বাংলাদেশের ছোটগল্পের একটা রূপ প্রাচীন কাল থেকেই ছিল। এদেশের লোকসাহিত্যে গল্প ছিল। কথা, রূপকথা, উপকথা, অপকথা, কথিকাসহ নানারূপে তা প্রচলিত ছিল। গীতিকার মধ্যে পদ্যাকারেও ছিল। ব্রিটিশ ঔপনেবিশক যুগে রবীন্দ্রনাথের হাতে আধুনিক ছোটগল্পের নতুন ভিত্তি নির্মিত হলে তা পূর্ববঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশে সমাদৃত হয়। বলা ভালো—রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মধ্যে একটি বিরাট অংশই পূর্ববঙ্গে অবস্থানকালে লেখা।
এদেশের ছোটগল্প লেখকদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ, কাজী আবদুল ওদুদ, মাহবুব উল আলম, আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দিন, মবিনউদ্দিন আহমদ, শওকত ওসমান, সোমেন চন্দ, আবু রুশদ, মিরজা আবদুল হাই, কাজী আবুল কাসেম, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সরদার জয়েনউদদীন, আবু ইসহাক, ইব্রাহীম খাঁ, শামসুদদীন আবুল কালাম, আশরাফ সিদ্দিকী, নাজমুল আলম, আহমদ মীর, শহীদ সাবের, আলাউদ্দিন আল আজাদ, জহির রায়হান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শাহেদ আলী, কাজী ফজলুর রহমান, হাসনাত আবদুল হাই, হাসান হাফিজুর রহমান, হুমায়ুন কাদির, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, বশীর আলহেলাল, বুলবুল চৌধুরী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সৈয়দ শামসুল হক, সুচরিত চৌধুরী, আখতারুজ্জমান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ব্রিটিশ আমলে লেখা শুরু করেছেন। আবুল মনসুর আহমদ, মাহবুব উল আলম ও কাজী আবদুল ওদুদ তিরিশের দশকেই গল্পরচনা শুরু করেন। তাঁরা কলকাতাকেন্দ্রিক আধুনিক সাহিত্যের নতুন ধারায় যুক্ত হন। রবীন্দ্রপরবর্তী আধুনিক কথাসাহিত্যের ধারায় এগিয়ে চলেন।
এরপরে চলে আসে চল্লিশের দশকের দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ ইত্যাদি বড় বড় ঘটনা বা অঘটন। এর পরিণতিতে কলকাতা হয়ে পড়ে হিন্দু শিল্পী-সাহিত্যিকদের কেন্দ্র। আর কলকাতা থেকে মুসলমানদের কেন্দ্র সরে আসে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের রাজধানী ঢাকায়। পাকিস্তানি কাল ছিল মাত্র দুই যুগের। তবে এই সময় ছিল ঘটনাবহুল। বাঙালি মুসলমানের আত্মসচেতনতার কালও এটা। এর আগে তারা ব্রিটিশদের শত্রু ভেবেছে হিন্দুদের ভেবেছে বন্ধু। আবার হিন্দুদের ভেবেছে শত্রু পশ্চিম পাঞ্জাব এবং বেলুচিস্তান-সিন্ধুর মুসলমানদের ভেবেছে বন্ধু। পশ্চিম ভারতের মুসলমানদের সাথে যৌথস্বাধীনতাকেই তারা মুক্তির উপায় বলে মেনেছিল। কিন্তু অচিরেই তাদের ভুল ভাঙে। ভাষা, সংস্কৃতি, সংবিধানসহ নানা বিষয়ে তাদের সঙ্গে বনিবনার অভাব দেখা দেয়। পশ্চিমাদের মানসিক সংকীর্ণতা গণতন্ত্রের উপযোগী ছিল না। শাসকশ্রেণীর মধ্যে ছিল বেশিরভাগ পশ্চিমভারতের বিভিন্ন নবাব ও জমিদারদের সন্তানদের ক্ষমতা এবং আভিজাত্যের দাপট। ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্ন সালের নির্বাচন, পঞ্চান্ন সালের প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দুই ইউনিট ঘোষণা এবং পূর্ববঙ্গের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্বপাকিস্তান রাখা, আটান্নতে সামরিক শাসন, বাষট্টিতে শিক্ষা আন্দোলন, পঁয়ষট্টিতে পাক-ভারত যুদ্ধে বাঙালিদের প্রতি অবহেলা, ছেষট্টিতে ছয় দফা আন্দোলন, আটষট্টিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। এত ঘটনার অভিঘাত সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী শাখা ছোটগল্পেও পড়েছে। এখানকার ছোটগল্পকে নতুন ধারায় চালিত করেছে। এবং উপমহাদেশের অন্যান্য জাতির ছোটগল্পের থেকে পৃথক করেছে এবং একটি ভিন্নচরিত্র দান করেছে।
দুই.
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ছোটগল্প কিছু চিরন্তন বা স্থায়ী প্রবণতা ধারণ করে। এর মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, প্রেম, কামনা/ লিবিডোতাড়না, বেকারত্ব, বার্ধক্যজনিত অসহায়ত্ব এবং মৃত্যুচেতনা, শিক্ষা ও চিকিৎসা, মরণব্যাধির আক্রমণ ও জীবনসংকট, প্রতিবন্ধীসমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর রয়েছে বিজ্ঞান কল্পনা। এর বাইরে বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বন্দিদশার মতো নেতিবাচক দিক আছে। আবার আছে তরুণদের বীরত্বের, অসম সাহসিকতার দিক। নারীদের, শিশুদের এমনকি বৃদ্ধের প্রতি পাকিস্তানি সৈন্যদের আচরণ এবং সৈন্যদের প্রতি তাদের বীজয়ের গল্পও বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে। এ ছাড়া এ সময়ের মধ্যে নতুন নতুন সমস্যা লেখকদের কাছে শিল্পসত্য হয়ে দেখা দেয়। কালের স্বাক্ষরসহ এসব প্রবণতা আলোচ্য সময়ের ছোটগল্পে চোখে পড়ার মতো। যেমন,
১. স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাস
২. সমকালীন সামাজিক অবক্ষয়
৩. অর্থনৈতিক সুবিধাবঞ্চনার শিকার
৪. সামরিক শাসকদের অনিয়ম অনিয়ম ও দুর্নীতি
৫. রাজনৈতিক আদর্শের ভাঙন
৬. মিলিটারি ও পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার
৭. রাজনীতিতে ধর্ম, স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থানসহ নয়া উপকরণ
৮. এনজিও তৎপরতা: দাতা/ত্রাতা/ শোষকের ভূমিকা
৯. নতুন নতুন গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট পেশাগত নানা সংকট
১০. নারীমুক্তি
১১. চলচ্চিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপনসহ বিনোদন জগৎ
১২. তৃতীয়লিঙ্গের মানুষদের জীবন
১৩. মৌলবাদের সামাজিক রূপ
১৪. বিশ্বায়নের প্রভাবে পারিবারিক ভাঙন
১৫. প্রযুক্তির অপব্যবহার
১৬. বিশ্বরাজনীতিতে সমাজতন্ত্রের পতন
১৭. শ্রমশক্তি রপ্তানি এবং বিদেশগামিতার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
১৮. টুইন টাওয়ার ধ্বংস পরবর্তী পাশ্চাত্য এবং জঙ্গীবাদের প্রভাব ইত্যাদি।
এর বাইরেও কিছু কিছু বিষয় আঞ্চলিক পর্যায়ে দেখা দিলেও সাহিত্যিকরা তা ধারণ করেন। যেমন,
ক. কৃষিঋণ, সার-বীজ সংকট, সার্টিফিকেট মামলা, পণ্যের বাজারজাতকরণ, শ্রমবঞ্চনা, লোনা পানি সমস্যা, নদীভাঙন, খালবিল নদীভরাট বা ড্রেজারের সমস্যা, পোনা, চারা, জমিসহ কৃষিউপকরণ সমস্যা।
খ. শিল্পায়নের প্রভাব, কৃষিজমিহরণ, দখল, শিল্পস্থাপন, কৃষিভিত্তিক পরিবারের শিল্পশ্রমিকে রূপান্তর, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, শিল্পাঞ্চলের ব্যয়ভার ও নৈতিক অবক্ষয়, নতুন নতুন পেশার উদ্ভব ইত্যাদি।
গ. নতুন নতুন হাটবাজার প্রতিষ্ঠা ও নগরায়ণের প্রভাব। নব্য ব্যবসায়ীশ্রেণীর উত্থান, চাঁদাবাজি, পুরনো হাট-বাজার ও বন্দরের মন্দাভাব, পেশাপরিবর্তন ইত্যাদি।
ঘ. আদিবাসী, উপজাতি এবং ক্ষুদ্রজাতিসত্তার নানা সংকট।
সব সমস্যা যে লেখকেরা তাদের ছোটগল্পে নিপুণভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন তা নয়। অনেকে বিষয়গুলো আংশিকভাবে বা অন্য সমস্যার সঙ্গে যুক্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আর এসব সমস্যা সত্যি অন্য সমস্যার সঙ্গে যুক্তও থাকে। সতেরো নম্বরে উল্লিখিত বিষয়টি বিশেষভাবে মনে রাখার এ জন্য যে, ধার- দেনা করে বিদেশে যাওয়া, পরিবারের অসহায়ত্ব বা রেমিটেন্সের প্রভাবে পরিবারটির আকস্মিক পরিবর্তন ইত্যাদি স্বাধীনতা-উত্তর ছোটগল্পে উঠে এলেও বিদেশে কর্মে নিযুক্ত শ্রমিকদের সুখ-দুঃখ আনন্দ- বেদনার চিত্র নিয়ে ছোটগল্প রেখা প্রায় হয়ইনি। এর কারণ যে শ্রমিকেরা বিদেশে যায় তাদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত। তাদের মধ্যে সাহিত্যচর্চার হার একেবারেই কম।
তবে সমাজের উঁচুতলার যারা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে স্থায়ীভাবে থাকার মানসিকতায়, সেদেশের মূলস্রোতে মিশে যাওয়ার অভিপ্রায়ে ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে যাচ্ছে তাদের মধ্যে শিক্ষিত এবং সাহিত্যরচনার প্রয়াস চোখে পড়ে।
তিন.
স্বাধীনতার আগে থেকেই যে সব ছোটগল্পকার সচল ছিলেন স্বাধীনতার পরে অনেকেই সে ধারাকে বেগবান করেন। শহীদ সাবের একাত্তরের যুদ্ধের মধ্যেই নিহত হন। জহির রায়হান স্বাধীনতার পরে পরেই নিখোঁজ হন। শক্তিশালী এই দু’জন ছোটগল্পকারকে আমরা হারাই অল্পবয়সে। অনেকে দিক পরিবর্তন করেন। আশিষকুমার লোহ একজন শক্তিশালী ছোটগল্পকার ছিলেন, স্বাধীনতার পরে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের দিকেই প্রবলভাবে ঝোঁকেন। ফতেহ লোহানী এবং ফজলে লোহানীও অভিনয়ের দিকে ঝোঁকেন। ফজলে লোহানী পরে অনুবাদ করেন। সৈয়দ শামসুল হক সচল হন কবিতা এবং উপন্যাসে। পরে তিনি কাব্যনাটকেও মোড় নেন। হাসান হাফিজুর রহমানও কবিতার জগতে প্রবেশ করেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রবন্ধসাহিত্যকেই বেশি আপন করে নেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী সাংবাদিকতায়, আশরাফ সিদ্দিকী লোকসাহিত্য গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। অন্যেরা সচল থাকেন। হাসান আজিজুল হক, রাহাত খান, আবুল খায়ের মোসলেহউদ্দিন, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, রশীদ করীম, সেলিনা হোসেন, হাসনাত আবদুল হাই, শহীদ আখন্দ, রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুন, শওকত আলী, হরিপদ দত্তরা নতুন উদ্যমে লেখালেখিতে সচল হন। এসময় আরো যারা বাংলাদেশের ছোটগল্প সমৃদ্ধ করেন তাঁরা হলেন, লায়লা সামাদ, আল মাহমুদ, আবু বকর সিদ্দিক, আবদুশ শাকুর, বিপ্রদাশ বড়–য়া, আহমদ ছফা আবদুল মান্নান সৈয়দ। আবদুল মান্নান সৈয়দ মূলত তারুণ্যে কবিতা নিয়ে সাহিত্যজগতে এলেও তিনি সব্যসাচীদের অন্যতম। ছোটগল্প, উপন্যাস, কাব্যনাটক ও প্রবন্ধেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সত্যের মতো বদমাশ’ পাকিস্তানি সরকার নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করে। তিনি মনস্তাত্ত্বিক জটিলাকেই গল্পে স্থান দেন।
হাসান আজিজুল হক বরাবরই রাঢ়বঙ্গের গ্রামীণ জীবনের নানা দিক নিয়ে লেখেন। রাহাত খানের ‘দিলুর গল্প’ বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ। এ ছাড়া তাঁর ‘আমাদের বিষবৃক্ষ’ দেশবিভাগ নিয়ে চমৎকার গল্প। আখতারুজ্জমান ইলিয়াসের গল্পে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের নানা ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পুরনো ঢাকার নিম্নবিত্ত এবং উত্তরবঙ্গের যমুনা তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের কথা উঠে আসে বিশেষ ভাষায়। আবুল খায়ের মোসলেহউদ্দিন রোমান্টিক ধারার গল্প লেখেন; তবে পুরনো ঢাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং ইতিহাসাশ্রয়ী গল্পগুলো সুখপাঠ্য। মাহমুদুল হকের ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ গ্রন্থে নিম্নশ্রেণীর মানুষের জীবন ও জীবিকার বিষয় নিয়েই লেখা গল্পগুলো। তাঁর ‘বুড়ো ওবাদের জমাখরচ’ একটি মর্মান্তিক গল্প। এ ছাড়া ‘কালো মাফলার’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি বিশ্বমানের গল্প। সেলিনা হোসেনের গল্প নারীর নানা সংকট এবং রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের নানা বিষয় নিয়ে লিখিত। শওকত আলীর গল্পেও কৃষিভিত্তিক জনজীবন উঠে আসে। শহীদ আখন্দের গল্পে নিম্নমধ্যবিত্ত প্রধানভাবে অঙ্কিত হয়। হরিপদ দত্ত ভাষা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সংকট চিত্ররূপ লাভ করে।
স্বাধীনতা পূর্ব যুগে এক আধটু লিখেছেন অথবা লেখেননি কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রবলভাবে বিকশিত হন অনেক গল্পকার। যেমন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের, ঝর্না রহমান, কায়েস আহমেদ, আতা সরকার, মঞ্জু সরকার প্রমুখ। হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্তের জীবনের সুখ-দুঃখ সহজ ও সরল ভাষায় তুলে ধরেন। তাঁর গল্পে মূলত আচরণবাদী মনস্তত্ত্ব বিশেষ স্থান পায়। কায়েস আহমেদের গল্পে দেশবিভাগ, নিম্নবিত্ত এবং বিত্তহীনদের নিস্করুণভাবে উঠে আসে। ইমদাদুল হক মিলনের গল্পে বিক্রমপুরের কৃষকসমাজ, ঢাকার মধ্যবিত্তের বিষয় স্থান পায়। মঈনুল আহসান সাবের গল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। মধ্যবিত্তের কপটতা, অসারতা এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের আশা-আকাক্সক্ষা স্থান পায়। তাঁর ‘অবসাদ ও আড়মোড়ার গল্প’ ও ‘স্টেশনে শোনা গল্প’ উল্লেখযোগ্য শিল্প। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নাগরিক জীবনের নানা দিক নিয়ে লেখেন। আতা সরকার ইতিহাস এবং ইতিহাসাশ্রয়ী গল্পে কৃষকসমাজ তুলে আনেন। মঞ্জু সরকার রংপুর অঞ্চলের কৃষক, ক্ষুদ্রপেশা ও নিম্নশ্রেণীর মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম বিশেষ যত্নে তুলে ধরেন। প্রথথম গল্পগ্রন্থ ‘অবিনাশী আয়োজনে’ তিনি পাঠক সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তাঁর ‘উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা’ গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলো খুবই উন্নত। এ গ্রন্থের ‘দুশমন’, ‘উপেক্ষিত দুইজন’, ‘উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা’, ‘পুণ্যভূমি’ এবং ‘অন্ধকারে আত্মসমর্পণ’ বার বার পড়ার মতো গল্প।
চার.
শহীদুল জহির যাই রেখেন নিজস্ব ভাষার কারণেই তা বিশেষত্ব লাভ করে। তাঁর গল্পে প্রধানত পুরান ঢাকাই বিশেষ স্থান লাভ করে। আকিমুন রহমান, নাসরীন জাহান মধ্যবিত্তের এবং নিম্নমধ্যবিত্তের নারীর নানা সংকট চিত্ররূপ দেন। মনিরা কায়েস রাজশাহী অঞ্চলের কৃষক এবং নিম্নপেশার মানুষদের নিজস্ব ভাষায় এবং নিজস্ব বয়ানে তুলে ধরেন। তাঁর ‘মাটি পুরাণ পালা’য় নানামুখি সংকট তুলে ধরেছেন। শাহাদুজ্জামান নিরীক্ষাপ্রবণ লেকক। তিনি এনজিও তৎপরতা, গ্রামীণ মানুষের চিকিৎসা সংকট, মধ্যবিত্তের অবক্ষয় তুলে ধরেন। তাঁর ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ গ্রন্থের গল্পগুলোতে সমাজের নানা পেশা ও শ্রেণীর মানুষের নানা কারণে বিহ্বলতা নেমে আসার বিচিত্ররূপ তুলে ধরেছেন। তাঁর ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ’ গল্পগ্রন্থও পাঠকসমাজে সমাদৃত। ইমতিয়ার শামীমও নিরীক্ষাধর্মী লেখক। তাঁর লেখায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের নানা সংকট নিজস্বভাষায় শিল্পরূপ লাভ করে। অদিতি ফাল্গুনী মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যকিত্তের নারীর সংকট নিয়ে লেখেন। তাঁর ছোটগল্পেরও একটি পৃথকভাষারূপ রয়েছে। তিনি বিশ্বরাজনীতির বিষয়টিও তুলে ধরেন। সাদ কামালীর গল্পে মধ্যবিত্তের জীবন, যৌনতা, প্রবাসজীবন ইত্যাদি উঠে আসে। শাহনাজ মুন্নী মধ্যবিত্তের আশাআকাক্সক্ষার কথা সরল বয়ানে তুলে আনেন। জাকির তালুকদার বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূমিপুত্র, সেখানকার কৃষক এবং খেটেখাওয়া মানুষদের কথাই লেখেন। সুশান্ত মজুমদার ও জাফর তালুকদার সরলভাবে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর কথা লেখেন। প্রশান্ত মৃধা দক্ষিণবঙ্গের মানুষের কথা তুলে আনেন উচ্চমানের মানবিক আদর্শের নিক্তিতে। রায়হান রাইনের গল্পে দার্শনিকতা এবং মিথের বিষয়যুক্ত হয় সমকালীন চরিত্রের মধ্যে। শামীম রেজার গল্পে লাতিন আমেরিকার গল্পের মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখা যায়।
এছাড়া সরকার আশরাফ, কাজল শাহনেওয়াজ, সেলিম মোরশেদরা লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে ছোটগল্প চর্চা করেন। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে সরকার আশরাফ সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘নিসর্গ’ গল্পসংখ্যা প্রকাশ করেন। সেখানেও অনেক গল্পকারের সার্থক ছোটগল্প স্থান পায়। যেমন, মামুন হুসাইন, কাজল শাহনেওয়াজ, জাকির তালুকদার, ফারুক ওয়াসিফ, সাদ কামালী, শামীম রেজা, রনজু রাইম, শোয়েব শাহরিয়ার প্রমুখের সার্থক ছোটগল্প স্থান পায়।
এ ছাড়া শিমুল মাহমুদ, নাজিব ওয়াদুদ, হামীম কামরুল হক, মনি হায়দার, জিয়া হাশান, রাশেদ রহমান, মাসুদা ভাট্টি, সমীর আহমেদ, কামরুল আহসান, বদরুন নাহার, রুবাইয়াত আহমেদ, পারভেজ হোসেন, হুমায়ূন মালিক, মহীবুল আজিজ, হরিশংকর জলদাস প্রমুখ গত শতকের শেষের দিকে নতুন নতুন ভাষা ও বয়ানে গল্প রচনা করেন।
নতুন শতকের শুরুর দিকে ২০০২ সালে পাপড়ি রহমান ‘ধূলিচিত্র’ নামে একটি গল্পসংখ্যা প্রকাশ করেন। পাপড়ি রহমান নিজেও গল্পলেখক। তাঁর কাগজে নতুন অনেক লেখকের গল্প স্থান পায়। যেমন, আকমল হোসেন নিপু, আহমাদ মোস্তফা কামাল গল্পের নান্দনিক দিক দিয়ে ঔৎকর্ষে পৌঁছতে সক্ষম হন। চন্দন চৌধুরীর গল্পে থাকে মানবিক আদর্শ এবং দার্শনিক বোধ। কাজী মহম্মদ আশরাফ, মাহমুদ শাওন, ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ প্রমুখ তারাও গল্পরচনায় বিশেষ যতœশীল। এঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে কলম চালনায় সজীব রয়েছেন।
নতুন শতাব্দীতে অনেক গল্পলেখকের আবির্ভাব ঘটে। তাদের মধ্যে পিন্টু রহমান, আনিফ রুবেদ, আশরাফ জুয়েল, বদরুন নাহার, সুমন মজুমদার, সোলায়মান সুমন, মোজাফফর হোসেন প্রমুখ ভালো লিখছেন।
ভাষাগত দিক থেকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ছোটগল্প কয়েকটি ধারায় প্রকাশিত হয়।
ক. রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর-মানিক প্রমুখের ধ্রুপদী সাহিত্যভাষায় লিখিত ছোটগল্প। এ ধারাটি সমকালীন কলকাতার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-সমরেশ মজুমদার-বুদ্ধদেব গুহদের সরল সাহিত্যভাষা দ্বারা প্রভাবিত। এ ধারার তরুণ লেখকদের কাছে ছোটগল্পের ঘটনাটাই মুখ্য।
খ. কমলকুমার মজুমদার-অমিয়ভূষণ মজুমদার-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-হাসান আজিজুল হক এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষা প্রভাবিত ছোটগল্প। এ ধারাটি ছোটগল্পের ভাষায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেন। লেখকদের কাছে পুরনো ভাষা পরিহার করে নতুন ভাষায় গল্প লেখার প্রবণতা একটি বড় দিক। তাঁরা মনে করেন গল্পের মধ্যে শুধু গল্প না, গল্পের ভাষাটাও নতুন।
এ সময়ের ছোটগল্পের প্রকরণগত পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। এসময় প্রধান দুটি ধারা উল্লেখ করার মতো। আসলে এই ধারাগুলো সারাবিশ্বেই চর্চা হয়ে আসছে।
ক. ধ্রুপদী সাহিত্যের বাস্তববাদী ধারা। এ ধারায় উনিশ শতকের ইংরেজি, রুশ, ফরাসি, জার্মানসহ ইউরোপের অন্যসব ভাষার সরল ও বাস্তববাদী এবং বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সমকালীন পশ্চিম বাংলার সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ-বুদ্ধদেব-সুকুমারী হয়ে এদেশের স্বাধীনতাপূর্ব এবং সাতচল্লিশের আগে থেকে চলে আসা সরল ও বাস্তববাদী ধারাটাই অনুসরণ করা হয়।
খ. পশ্চিমের নতুন সাহিত্যধারা। এটি নানা নামে পরিচিত। উত্তর ঔপনিবেশিক, উত্তর আধুনিক, উত্তর কাঠামোবাদী, জাদুবাস্তব, পরাবাস্তব, মায়াবাস্তব ইত্যাদি। এ ধারাটি লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং স্পেন ও পর্তুগালের নতুন কথাসাহিত্যের ধারা অনুসরণ করে। সারাবিশ্বেই এ ধারাটি জনপ্রিয়। স্পেনিশ ও পর্তুগিজ ভাষায় লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাহিত্য পাশ্চাত্য মাধ্যমে সারাবিশ্বে জনপ্রিয় হয়েছে। অনেক সাহিত্যিক এই নতুন ধারায় সাহিত্য রচনা করে নোবেল পুরস্কার লাভ করে ধারাটিকে আরো জনপ্রিয় করেছেন। ইংরেজি-ফরাসি-জার্মান প্রভৃতি ভাষায় আফ্রিকার বিভিন্ন জাতির এবং উপজাতির সাহিত্য লিখিত এবং অনুলিখিত হয়ে সারাবিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশের তরুণরা সে পথও অনুসরণ করেছেন কেউ কেউ।
এসব ধারা অনুসরণের মধ্যে নানা উপধারা এবং ভাগ-বিভাগের জটিলতা থাকা সত্ত্বেও সরলবিভাগে এখানে দেখানো হল। অনেকে যেমন সরাসরি পাশ্চাত্যের খ. ধারার সাহিত্যপথ অনুসরণ করেছেন। তেমনি আবার অনেকে নিজ দেশের লোকজীবন এবং লোকসাহিত্যের নানা উপকরণ দিয়ে নিজের মতো করে নতুন ধারাও সৃষ্টি করে নিয়েছেন।
অনুসরণ এবং অনুকরণ সবকালেই ছিল এবং আছে। আমাদের ছোটগল্পের মূল ধারাটাই ছিল ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর সাহিত্যরীতির অনুসারী। তখন ঔপনিবেশিক প্রভাব ছিল। এখন প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে নানা রীতি গ্রহণ এবং অনুসরণ চলছে। এর মধ্যেই চলবে ভাঙাগড়ার ইতিহাসসৃষ্টির কাজ। সবার সাহিত্যকর্ম কালজয়ী হবে না। কিন্তু কারটা হবে আর কারটা হবে না, তাতো কেউ জানে না। কাজেই অনুশীলন চলতেই থাকবে। সমকালীন গল্পকারদের মধ্যে যারা লিখে চলেছেন অনেকের গল্প পড়েই মনে আশাবাদ জেগে ওঠে। এঁদের মধ্যে থেকেই একদিন কালজয়ী মহীরূহ—বনস্পতি হয়ে টিকে থাকবেন কেউ কেউ।