বাংলাদেশের ক্রমাধুনিক গল্পক্ষেত্রের শীর্ষস্থানীয় ও প্রবাদপ্রতিম সাহিত্য ব্যক্তিত্ব সৈয়দ ওয়ালীউলল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১)। তবে তাঁর সাহিত্যের প্রারম্ভলগ্নের উন্মোচন ঘটে কলকাতায়। বিশ শতকের চারের দশকে সাহিত্যধামে আবির্ভাব হয় এই সাহিত্যিকের। ওয়ালীউল্লাহ্র সূচনাকালের অন্য লেখালেখির সঙ্গে অনেক ছোটোগল্পও প্রকাশের আকাশ দ্যাখে মাসিক সওগাত, বুলবুল, মোহাম্মদী ও পূর্বাশা পত্রিকার মধ্য দিয়ে। তাঁর প্রথম গল্প ‘চিরন্তন পৃথিবী’ সওগাত পত্রিকার ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আশৈশব তিনি সাহিত্যচর্চা ও ছবি আঁকার প্রতি অকৃত্রিম টান অনুভব করেন। যা তাঁর সৃজিত সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে প্রতিভাসিত হয়। তাঁর লেখার অন্যতম দিকচিহ্ন হলো তিনি আধুনিককালে তথাকথিত গতানুগতিক ধারায় লেখার আগ্রহ অনুভব করতেন না একেবারেই। বিষয়, আঙ্গিক ও ভাষাশৈলীতে নবরূপের আবাহন হয় তার হাত ধরে। ফলে তাঁর লেখা ক্রমশ হয়ে ওঠে ক্রমাধুনিক ধারার অনুগামী। সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে তিনি জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাঁর সময়জ্ঞানও ছিল সুতীক্ষ্ম। তাঁর সূচনাপর্বের লেখার মধ্যে অধিকাংশই ছোটোগল্প এবং সেগুলোর সবই চারের দশকে প্রকাশিত। পরবর্তী সময়ে উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার দরুণ খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির নবতর প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে ঢাকা।
সাহিত্যের অন্যতম শাখা ছোটগল্পের রক্ষণশীলতা, গ্রাম্যতা ও প্রথাবদ্ধতার বেড়াজাল ছিন্ন করে আধুনিকতার সংস্পর্শে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র অবদান অনস্বীকার্য :
পঞ্চাশের গল্পকাররাই অনেকাংশে ষাটের দশকজুড়ে বাংলাদেশের গল্পের বীজ বপন করে চলেছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখনীয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। যাঁর গল্পে যুক্ত হয়েছে নতুন দার্শনিক চেতনাদর্শ। জীবনের মর্মমূলকে আধুনিক ফর্মে উন্মুক্ত করেছেন তিনি। গভীর মমতায় মাটিমূল-অনুবর্তী মানুষের অস্তিত্বের সংবাদ পরিবেশন করেছেন। তাঁর গদ্যভঙ্গিতে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক টেকনিক। তবে কোনোকিছুই সর্বস্ব করে তোলেননি, সূক্ষ্ম শিল্পচিন্তায় তা হয়ে উঠেছে জীবনঘনিষ্ঠ। [শহীদ ইকবাল। ২০০৯: ২৬৮]
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথকদিকের সৃজনকর্মে রোমান্টিক ও সমাজ সচেতন মনের বিকাশ দৃষ্ট হলেও ধীরে ধীরে ব্যক্তির সংগুপ্ত মনোলোক উন্মোচনের প্রতি তাঁর ঝোঁক প্রসারিত হয়। তবে এর মানে এই নয় যে, তিনি সমাজের বৃহৎ পরিসর থেকে অন্তর্জগতের ক্ষুদ্র পরিসরে নিজেকে গণ্ডিবদ্ধ করেন, বরং আপাত দৃশ্যনীয় পরিবৃত্তে সমাজকে সীমানা দিয়ে নির্ধারিতে করা গেলেও ব্যক্তির অন্তর্ভুবনের পরিধি অপরিমেয় অসীমে লীন, সীমাহীনতায় অবলুপ্ত। সমাজ উন্নয়নের যেমন কিছু মানদণ্ড আছে, সমস্যা আছে, সমাজে বাসরত মানুষের জীবনমান পরিশীলিত ও উন্নত করার লক্ষ্যমাত্রা আছে, বিবিধ নিয়ম-কানুন-অনুশাসন আছে; তেমনি ব্যক্তির অন্তর্লোকেও যে বহুবিধ সীমাবদ্ধতা, সমস্যা, উত্থানপতন, মোহমায়া, কামনা-বাসনা নিঃসৃত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সংকীর্ণতাজনিত মানসিক দোলাচল প্রতিনিয়ত সক্রিয় থাকে সেই অনুভববেদ্য জগতের রহস্য উদ্ঘাটনের প্রতিই মনোনিবেশ করেন তিনি। আহমদ শরীফের ভাষ্যে :
দেশগত ও কালগত জীবন মানুষের ভাব-চিন্তা কর্মে প্রতিফলিত হয়। সাহিত্য সেই জীবনের প্রতিবিম্বিত রূপ। শিক্ষা ভেদে, মন ভেদে, আর্থিক-সামাজিক অবস্থান ভেদে মানুষের জীবন-চেতনা বিভিন্ন হয়। কাজেই সাহিত্যও হয় বিভিন্ন স্তরের, আদর্শের ও লক্ষ্যের। জ্ঞান-রুচি-আদর্শ ও চিত্তের প্রসারভেদে ভাষা, ভঙ্গি, অলঙ্কার এবং অনুভূতি ও দৃষ্টি হয় বিভিন্ন। [আহমদ শরীফ ২০১১ : ৪৫]
যদিও আকস্মিক প্রয়াণের হেতুবশত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সে পথচলা দীর্ঘ হতে পারেনি, তথাপি তাঁর লেখার প্রাখর্যে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন-পরিক্রমার সামান্য সাহিত্যফসলই তাঁকে বাংলা ছোটগল্প তথা কথাসাহাত্যের আঙিনায় অপরিহার্য কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ প্রথম গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৪৫) প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। নয়নচারা গ্রন্থটিতে বিন্যাস্ত রয়েছে আটটি গল্প। গল্পগুলো যথাক্রমে ‘নয়নচারা’, ‘জাহাজী’, ‘পরাজয়’, ‘মৃত্যুযাত্রা’, ‘খুনী’, ‘রক্ত’, ‘খণ্ড চাঁদের বক্রতায়’ ও ‘সেই পৃথিবী’। গল্পগুলো পাঠের মধ্য দিয়ে অনুধাবন করা যায় যে, ঘটনার ঘনঘটাই শুধু কাহিনি নির্মাণ করে না বরং ঘটনাহীন জীবনেরও যে অন্তলীন কাহিনি থাকতে পারে, সেই কাহিনি নির্মাণের সুদক্ষ স্থপতি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। নিমেষেই তিনি সীমাহীন মানবমনের সংগুপ্ত ভাবনা-চিন্তার জগৎ আলোকিত করে তোলেন স্বতন্ত্র সংবেদী পর্যবেক্ষণশক্তির দার্ঢ্যে। তাই তাঁর এই মনোলোকে আবর্তন কোনো আরোপিত বা নিছক মেকি বিষয়ের ভাগাড়ে পর্যবসিত হয় না, বরং তাঁর এই আরণ্যক অন্তর্ভুবনে যাপনচিত্র হয়ে ওঠে উৎকৃষ্ট শিল্প প্রতিমার প্রমূর্ত রূপ ।
নয়নচারা গ্রন্থটির প্রারম্ভেই রয়েছে নামগল্পটি। গল্পে একটি গ্রামের নাম নয়নচারা। ময়ূরাক্ষী নদীবিধৌত গ্রাম নয়নচারা। দুর্ভিক্ষপীড়িত সেই গ্রাম থেকে হা-ভাতে মানুষের ঢল নামে শহর কলকাতা অভিমুখে। একটা কারণই শহরাভিমুখে এই হুমড়ি খেয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট, তাহলো শহরে ধনীলোক আছে, লঙ্গরখানা আছে, সেখানে গেলে দুমুঠো খেতে পাবে তারা। বাস্তুসহায়হীন এই নিরন্ন মানুষের একজন আমু। মূলত তার একান্ত স্মৃতিরোমন্থন এবং তাদের সকলের এই নির্মম জীবনচর্যার আবর্তন ‘নয়নচারা’র ভিত্তিভূমি। আর দশটি সাধারণ গ্রামের মতো নয়নচারা কেবল একটা গ্রাম থাকে না গল্পে বরং মায়ামমতা-ভালোবাসা, মৎস্য খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ অন্নপূর্ণার প্রতীক হয়ে ওঠে এ গ্রাম। যেহেতু ১৩৫০-এর মন্বন্তরের মর্মান্তিক প্রেক্ষণপটের অবলম্বনে গল্পভূমি নির্মিত, তাই স্বাভবিকভাবেই আজীবন গ্রামে বাসরত আমুর স্মৃতিপটে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে পেছনে ফেলে আসা সুখনিময়ে অতিবাহিত জীবনকল্প। মূলত দুর্ভিক্ষের দুর্বিষহ দুঃখ এবং শহরে নিক্ষিপ্ত উদ্বাস্তু যাপিতজীবনের নির্মম অসহায়ত্বের মধ্যে আমুর মনোজগৎ স্মৃতিচারণ ও কল্পলোকের যৌথযুগপৎ সমন্বয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বারবার সে ফিরে যার শান্তিশোভিত অতীত জীবনের সীমানায়। একজন মূলবিচ্ছিন্ন মানুষের মনোগত উপলব্ধির বয়ান লেখক যথার্থ শৈল্পিক ভাষ্যে তুলে ধরেন গল্পে
১. সন্ধ্যে হয়ে উঠছে। বহু অচেনা পথ ঘুরে-ঘুরে আমু জানলে যে ও-পথগুলো পরের জন্যে, তার জন্যে নয়। রূপকথার দানবের মতো শহরের মানুষরা সায়ন্তন ঘরাভিমুখ চাঞ্চল্যে থরথর করে কাঁপছে। কোন সে গুহায় ফিরে যাবার জন্যে তাদের এ-উদগ্র ব্যস্ততা? সে-গুহা কি ক্ষুধার? এবং সে-গুহায় কী- স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে মাংসের টিলা, ভাতের পাহাড়, মাছের স্তূপ? কত বৃহৎ সে গুহা?
২. লাল পেড়ে শাড়ি শাড়ি ঝলকাচ্ছে রক্ত ছুটছে। যেমন করিম মিয়ার মুখ দিয়ে সেদিন ফিনকি দিয়ে ছুটেছিল রক্ত। তবে মেয়েটার গলায় নিচেটা সাদা, এতো সাদা যে মনটা হঠাত মেহের ছায়ায় ছুটে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়বার জন্যে খাঁখাঁ করে ওঠে। মেয়েটি হঠাৎ দুটি পয়সা দিয়ে চলে গেল রক্ত ঝলকিয়ে।
৩. উদরের অসহ্য তাপে জমাট কথাগুলো ধোঁয়া হয়ে বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। আর গলাটা যেন সুড়ঙ্গ, আমু শুনতে পারছে বেশ যে, কেমন একটি অতি ক্ষীণ আওয়াজ সে গভীর ও ফাঁকা সুড়ঙ্গ বেয়ে পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে উঠে আসছে ওপরের পানে এবং অবশেষে বাইরে যখন মুক্তি পেল তখন তার আঘাতে অন্ধকারে ঢেউ জাগল, ঢেউগুলো দু-ধারের খোলা চোখে ঘুমন্ত বাড়িগুলোর গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল তার কানে। মাগো, চাট্টি খেতে দাও-
[সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। ২০১৪ : ৫, ৬, ৪ ]
এভাবেই মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে সংবেদী শব্দের গ্রন্থনে এক অনবদ্য শৈল্পিক চিত্রপট হয়ে ওঠে ‘নয়নচারা’ গল্প।
‘জাহাজী’ শাশ্বতকাল ধরে মানবমনে প্রোথিত থাকা ঈপ্সিত পিতৃহৃদয়ের বার্তাবাহী গল্প। কাহিনিতে দৃষ্টি পরিসীমায় আসে অকৃতদার করীম সারেং। প্রায় সমগ্র একটা জীবন জাহাজে সমুদ্রের অসীমতায় কাটিয়ে সে এখন জীবনসমুদ্রের প্রয়াণপারে এসে পৌঁছেছে। অথচ মনে জেগে আছে অতৃপ্ত জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণাজনিত হাহাকার ও ক্ষোভ :
কিন্তু এ-জীবন ছেড়ে কোথায় যাবে সে? দেশে আপনার বলতে কেউ নেই সেখানে মমতাশূন্য শুষ্কতা। আত্মীয় যারা আছে তারা নামে আত্মীয়, দীর্ঘ বিচ্ছেদের জন্যে তার জীবনের সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ নেই। ছাত্তারের যেমন সবাই আছে, তেমনি তার কেউ-ই নেই। অতএব ছাত্তার যাবে, সে থাকবে। আবার সে জাহাজে চুক্তি নেবে, এবং যদি পারে আমৃত্যু সমূদ্রের বুকেই বাস করবে। [ তদেব: ১৩]
এমনি নির্জীব, প্রাণহীন জীবনে কৈশোর উত্তীর্ণ কচি-কিশলয়ের আভাশোভিত মুখ নিয়ে ছাত্তারের আবির্ভাব যেমন বহুমাত্রিক ক্ষোভ-দুর্দশা-গ্লানি-ক্ষতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় তেমনি কিঞ্চিৎ হলেও তার জীবনে অপাত্মস্নেহের দুয়ার উন্মোচন করে নব প্রাণের সঞ্চারণশীল হাওয়া বইয়ে যায়। ছাত্তারের আবির্ভাব তার হৃতপিতৃত্বের দুয়ারে পুনরায় সজোরে কড়া নাড়ে। তার নিঃসঙ্গতা, একাকীত্বের মর্মছেদী যন্ত্রণা গোঁয়ারী ক্ষিপ্রতায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার অন্তর্ভুবনে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রশ্ন নিবেদন করে, তার মনে হতে থাকে:
দীর্ঘ জীবন- তো অতীক্রান্ত হল প্রায়, কর্মজীবনের অবসান ঘনিয়ে এসেছে, কিন্তু তুমি আমাকে কী দিলে, আর আমি তোমাকে কি দিলাম? সারেং কিছু চঞ্চল হয়ে উঠল : পবিত্র প্রভাত-এ-সময়ে বেদনার মতো অবসাদ ঘনিয়ে উঠছে ক্যানো মনে। সে-অবসন্ন মনের কোণে দুর্বোধ্য প্রায় প্রশ্নটি বারে বারে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল, আর তার প্রতিটি ধ্বনি শূন্য গহ্বরে যেন আওয়াজ করছে-অর্থহীন শূন্যতায় যার কোনো উত্তর মিলছে না। অতিক্রান্ত দীর্ঘ জীবন অদ্ভুতভাবে শূন্য ও ব্যর্থ ঠেকছে কঙ্কালের চোখের মতো। [ তদেব ৯]
করীম সারেং ছাত্তারের পরিবার সম্পর্কে জানলো এবং এটাও জানলো যে ছাত্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজে এসেছে, আর এটা শোনা মাত্রই ‘হঠাৎ কী হল, সারেং অপ্রত্যাশিতভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল : হয়তো একটা বিকৃত হিংসা ঝলকে উঠেছে মনে।’ (তদেব : ১৩)। পরবর্তীতে যখন জাহাজের চিফ অফিসারের ছাত্তারকে লাথি মারার প্রসঙ্গ করীম জানতে পারে তখন সে পিতৃয়েহে ক্রুদ্ধ হয়ে ওয়ে ওঠে এবং ছাত্তারকে জাহাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। জাহাজের এই নির্মম নিঃসঙ্গ জীবন তার নয়, তাই তাকে প্রিয়জনের সান্নিধ্যলগ্ন বাড়িতে ফিরে যেতে বলে। গল্পের সমাপ্তি ঘটে জাহাজ জেটিতে ভেড়ার পর ছাত্তারের চলে যাওয়ার পথের দিকে করীম সারেং এর উদগ্র জীবনাকাঙ্ক্ষাপূর্ণ জীর্ণ দৃষ্টি প্রক্ষেপের মধ্য দিয়ে কয়েকজন লস্কর নামছে মৃদুগুঞ্জন করে। সে-দলে ছাত্তারও রয়েছে। তার মুখে হয়তো মুক্তির ঔজ্জ্বল্য, তবে সে নত মাথায় নামছে বলে ওপর থেকে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ওপরের পানে মুখ তুলে একবার সে তাকাবে কি? রেলিং ধরে ঝুঁকে করিম সারেং দাঁড়িয়ে রইল প্রেতের মতো আবছা হোয়ে চোখ দুটো তার দীনতায় বীভৎস হয়ে উঠেছে। ও তাকাল না। [তদের ১৪)
২.৩
জীবন ও মৃত্যুর শৈল্পিক রূপায়ণ পরাজয়’ গল্পটি। ওয়ালীউল্লাহ্ এখানে জীবনের কাছে পরাজিত মৃত্যুর কাহিনি বর্ণন করেন। সাপে কাঁটা স্বামীর মৃতদেহ শিয়রে নিয়ে স্ত্রী কুলসুম ও স্বামীর দুই যুবক বন্ধু অর্থাৎ একটি মৃতদেহ ও তাকে ঘিরে তিনজন জীবিত মানুষের মনোজগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে গল্প আবর্তিত হয়। প্রথমে দেখা যায় শোকে মূহ্যমান কুলসুম পার্শ্বস্থিত দুই যুবককে বলে :
-কলা গাছের ভেলা কইরা অরে তোমরা ভাসাইয়া দেও, আর আমি যামু লগে। বেহুলার কাহিনী কুলসুমের মনের প্রান্তে তুলোর মতো, হালকা সাদা মেঘের মতো নিঃশব্দে উদয় হয়েছে। বেহুলার মতো মৃত স্বামীর দেহ নিয়ে ভেলায় ভেসে সেও যাবে, কিন্তু কোথায়? বেহুলা কোন এক অজ্ঞাত স্থানে গিয়েছিল এবং তার মনষ্কামনা সার্থক হয়েছিল এ-কথা সে জানে, কিন্তু তার পথ তো কুলসুমের জানা নেই। তাই মেঘটা যেমনি ভেসে এল, কথার হাওয়ায় তেমনি আবার মিলিয়ে গেল তার মনের আকাশ হতে। শূন্যতা ও স্তব্ধতা আবার ঘন হয়ে উঠল কুলসুমের দেহ চোখে। [তদেব। ১৭ ]
এ থেকে বোঝা যায় যে, কুলসুম বেহুলা-লখিন্দরের মিথ সম্পর্কে অবগত এবং বেহুলার মতো করেই সে মৃত্যুকে পরাজিত করে স্বামীর জীবন পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু সে নিরুদ্দেশ পথ-নির্দেশনা তার জানা নেই। যদিও বেহুলার মতোই সেও মৃত্যুকে পরাস্ত করতে চায়। এভাবেই শবদেহ ঘিরে তিনজনের সময় ও মনের গতি-প্রকৃতি প্রবাহিত হতে থাকে- এরই মাঝে প্রবল প্রলয়ের আঁধার ঘনিয়ে এসে এলোপাতাড়ি তাণ্ডবলীলা চালিয়ে ক্রমশ থিতু হয়, এবং রোদের আলোয় ফের আলো ঝলমলে হয়ে ওঠে প্রকৃতি। তখন মনের গহীনের পরাবাস্তবতার কল্পলোক ছাপিয়ে : ‘কুলসুম হঠাৎ ভয়চকিত কণ্ঠে আচমকা কেঁদে উঠে ঝুঁকে সরে এসে মজনুর পা ছুঁতে লাগল ঘন-ঘন।’ (তদেব : ২০)। এখানে মূলত জীবনের কাছে মৃত্যুর, আশার কাছে হতাশার, বাসনার কাছে নির্জীবতার মোটকথা সুখের কাছে শোকের পরাজয় ঘটে। যদিও জীবন ক্রমশ মৃত্যুপানেই ধাবিত, তথাপি লেখক এখানে জীবনেরই জয়গান করেন। আর এক্ষেত্রে মানবমন- যে দোলাচলময়তা, যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের শাখের করাতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় তার স্বরূপ অতিশয় নান্দনিক মাত্রায় তুলে ধরেন।
২.৪.
‘মৃত্যুযাত্রা’ গল্পের কাহিনিও নির্মিত হয়েছে ‘নয়নচারা” গল্পের মতোই দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে। মন্বন্তরের নৃশংস হাহাকারকে সঙ্গে নিয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া মানুষের মিছিলের চিত্র গল্পকার প্রস্ফুটিত করে তোলেন এখানে। গল্পের এন্টাগনিস্ট তথা খলনায়ক মন্বন্তর হলেও কোনো নির্দিষ্ট প্রোটাগনিস্ট বা মূলচরিত্র নেই। আপামর নিরন্ন, ক্ষুৎপিপাসার্ত মানুষের ক্রমশ নিরুপায় মৃত্যুর দিকে পতিত হওয়ার গল্প এটা। এরমধ্যেই যাত্রাপথে অনাহারে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। আর এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিরন্ন, বুভুক্ষু মানুষের দল যে সকল সমস্যার মাঝে পতিত হয় ও মৃতদেহর শেষকৃত্য সম্পাদন নিয়ে যে অনিশ্চিত বেদনাঘন আবহের সৃষ্টি হয়, তাকে উপজীব্য করেই গল্পের বুনট পরিপূর্ণতা লাভ করে। গোঁজামিল দেওয়ার মতো কোনোরকমে কোদাল, খন্তার ব্যবস্থা করে বৃদ্ধার কবর খোঁড়ার মুহূর্তে তাদের মনোজগতের চিত্র এভাবে প্রস্ফুটিত করে তোলেন গল্পকার :
১. লকলকে সাঁকো বেয়ে কে একটি মেয়ে এদিকে পানে আসছে সারা পিঠময় তার, ছড়ানো ভেজা চুল চিকমিক করছে প্রখর সূর্যালোকে। এবং পেট ভরে প্রচুর প্রচুর খেয়ে এসেছে কিনা, তাই ঝলমল করছে তার সারা দেহ… |
২. বহুদূরে একটা ঘূর্ণি উঠেছে দীর্ঘ হয়ে। হাওয়া যেন ধরণীর বুকে কী খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ হয়ে হঠাৎ উর্ধ্ব উঠে উন্মত্ত হয়ে বলছে: নেই নেই কিছু নেই গো কোথাও। [তদের ২৪, ২৫ |
এখানে অনাহারক্লিষ্টতার অবসাদ, সহযাত্রী পথিকের হঠাৎ মৃত্যুর অসংলগ্ন অথচ মর্মভেদী যন্ত্রণার দহন এবং একিসাথে দুর্যোগ আক্রান্ত পারিপার্শ্বিকের কৃষ্ণ গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে বুভুক্ষু মানুষের পীড়িত মনস্তত্ত্বের চেতনা-প্রবাহরীতি কীভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাদের মনোজাগতিক চিন্তন-প্রক্রিয়ায় কী কী বিষয়-আশয় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তার ভাষ্যরূপ প্রতিফলিত হয়ে ওঠে। তাদের মৃত্যুযাত্রা পথের সূচনা তারা করে অথচ এর পরিসমাপ্তি তাদের অজানা। বৃদ্ধাকে সমাহিত করার পর সাহায্যকারী দলের মানুষেরা ফিরে এসে দুর্ভিক্ষ পীড়িত দলের বাকি সবাইকে জানায় যে, ঐ গ্রামে চৌধুরী সাহেব নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি আছে যার পায়ে ধরি পড়লি পরে দুটি খাতি দেবেন’ (তদেব : ২৭)। এই কথা শোনামাত্র হাভাতে মানুষের এই দলগত অনিশ্চিত অভিযাত্রায় নতুন করে বাঁচার আশা সঞ্চারিত হয়। কিন্তু পরক্ষণেই নিরাশায় পর্যবসিত হয় তাদের কল্পলোকে ভেবে নেওয়া মনোভাবের। আর এই বিপত্তির উদ্ভব ঘটে হাজুর বাপ তথা সদ্য বিপত্নীক হওয়া বৃদ্ধার স্বামীর কারণে। গাছের তলায় বসে থাকা অবস্থাতেই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। একটি মৃত্যুর ধকল সামলে না উঠতেই আরেকটি মৃত্যুর আছড়ে পড়ার ভয়াবহতায় এবার তারা নিস্তব্ধ হয়ে যায়, মুষড়ে পড়ে চরম অবসাদে। মূলত দীর্ঘসময় অনাহারে থাকার পর যখন পরম কাঙ্ক্ষিত খাবারের সন্ধান মিলতে পারে, এমন দুর্লভ আশার উন্মেষ ঘটে তখন হঠাৎ আরেকটি মৃত্যু তাদের শঙ্কাগ্রস্ত করে তোলে, কিন্তু অনাহারক্লিষ্ট মানুষের এই অসাড়তা কিছুক্ষণের মধ্যেই সরব হয়ে ওঠে। এবং দলেরই তোতা নাম্নী একজন বলে ওঠে ‘থাক পড়ি বুড়ার লাশ।’ (তদেব : ২৮)। কিন্তু আরেক বৃদ্ধা হালুর মা প্রস্তাব করে- যেহেতু তারা ঐ গ্রামের দিকেই যাচ্ছে যেখানে খাবারের আশা আছে; তাহলে যাওয়ার পথে এর আগেরবার বৃদ্ধার শেষকার্য সম্পাদন করতে যারা সাহায্য করেছিলো তাদের নাহয় একবার খবর দিয়ে যাবে। এই কথায় সকলেই সম্মতি প্রদান করে এবং বৃদ্ধের লাশ কে নিঃসঙ্গ ফেলে রেখেই তারা সম্মুখে যাত্রা করে,
তারপর সন্ধ্যা হলো, হাওয়া থামলো, ক্রমে ক্রমে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠলো। এবং প্রান্তরের ধারে বৃহৎ বৃক্ষের তলে তার শুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বুড়োর মৃতদেহ বসে রইলো অনন্ত তমিস্রার দার্শনিকের মতো।
[তদেব: ২৭]
এমন সীমাহীনতা মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটে মৃত্যুযাত্রা’ গল্পের।
২.৫
মানব-মানবীর আরণ্যক অন্তর্জগতের সচিত্র বয়ান ‘খুনী’ গল্পটি। লেখকের প্রাতিস্বিক সৃজনশৈলী ও ভাষিক মন্ত্রমুগ্ধতার মায়া-অনুবর্তী হয়ে এই গল্প নিছক অপরাধ কাহিনিতে পর্যবসিত না হয়ে বরং একটি শিল্পসফল মনোভূমিতে পরিণত হয়। আর গল্পের শুরু থেকেই এই মনোলোকের মায়ার খেলা ভূমি ছাপিয়ে সুদূরপ্রসারী দিগ-দিগন্তের দিকে ছুটে চলে। এখানে নিমেষ উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে রাজ্জাক তাদের গ্রামেরই ফইন্যাকে খুন করে পলাতক হয় এবং আশ্রয় নেয় ভিন্ন গ্রামের দর্জি আবেদ আলীর বাড়িতে- তারই এক যুগ আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলে মোমেনের স্থানাভিষক্ত রূপে :
আবেদ দর্জির বাড়িতে রাজ্জাক আশ্রয় পেল। তবে রাজ্জাক নামে নয়, মোমেন। নামে বাড়ির লোক ছাড়া সবাই প্রথমে জানলে যে এক যুগ আগে পালিয়ে যাওয়া দর্জির ছেলেটি আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু সত্যটা সূর্যালোকের মতো স্বচ্ছ বলে তা মিথ্যা কথায় ঢাকা গেল না, একে-একে সবাই জেনে ফেললে ছড়ানো কথা সত্য নয়, এ- ছেলে আসলে মোমেন নয়; তবে পরকে ঘরে ডেকে আপন ছেলে বলে প্রচার করায় মিথ্যায় লোকে অন্যায় কিছু দেখলে না, বরঞ্চ দর্জির প্রতি শ্রদ্ধায় তাদের অন্তর ভরে গেল। [তদের। ৩০)
আর এখান থেকেই ঘটনা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করে রূপ নেয় মহীরুহের। সামাজিক কারণে যথোপযুক্ত দূরত্বে অবস্থান করলেও দর্জির বড়ো ছেলের বিধবা স্ত্রী জরিনা এবং রাজ্জাক একে-অপরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে :
চৈত্র শেষ হয়ে গেল, বৈশাখ এল, কালবোশেখি ঝড় শুরু হল। এবং রাজ্জাকের মনে যে ঝড় শুরু হল, সে ঝড়ের উদ্দামতা কালবোশেখির চেয়ে কম নয়। কখনো সে তাকিয়ে দেখে, তীব্র হাওয়ায় গাছের পাতা ছিন্ন হয়ে উড়ে গেল, মিলিয়ে গেল কোথায়, দেখে তারও মনে প্রবল বাসনা জাগে-কাকে ঠিক এমনিভাবে ছিন্ন করে নিয়ে আসে। নিজের কাছে, তারপর ভেসে পড়ে দু-জনে। চৈত্র মাসে একদিন নদীর ওপারে বালুর চরে ধুলো উড়তে দেখে হঠাৎ তার মনে পড়েছিল চর আলেকজান্দ্রার কথা, এবং তার মন নিষ্করুণ শুদ্ধতার মধ্যে জেগে উঠে দিশাহারা হয়ে ছুটতে ছুটতে বালির বাঁধে আছড়ে পড়েছিল, আর আকুল হয়ে উঠেছিল গভীর নীল পানির তৃষ্ণায়। কিন্তু বালির বাঁধ যেন ভেঙে গেছে সে-নীল পানিরই বন্যায়। সে-নীল পানি বয়ে যাচ্ছে তার অন্তরের ওপর দিয়ে, অথচ এখনো তৃষ্ণা মেটে নি । সে-তৃষ্ণা মেটাতে হবে। [তদের। ৩২]
এক সময় রাজ্জাক ঠিক করে যে সে গ্রামের অন্য কাউকে দিয়ে দর্জির স্ত্রীর কাছে এই প্রস্তাব পেশ করবে যে সে জরিনাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটনা আরো জটিল ও বহুভঙ্গিম রূপ লাভ করে। দর্জির যুগপূর্বে নিখোঁজ হওয়া ছেলে মোমেন ফিরে এলে। উদ্ধৃত প্রকৃতির মোমেন ফিরে এসেই রাজ্জাকের প্রতি ক্রূরদৃষ্টি হেনে জিজ্ঞেস করে : তুমি বুঝি মোমেন সেজেছো?’ তখন এই নির্মম প্রশ্নের বক্ষভেদী তীক্ষ্ণ সোজা উত্তর দেয় সে, ‘আমার নাম আবদুর রাজ্জাক। আলেকজান্ডার চরের সোনাভাঙা গেরামের ফজুমিগ্রাদের বাড়ির ফইন্যারে আমি খুন করছি-গত চৈত মাসে।’ (তদেব: ৩৪)। এই কথা শোনামাত্র মোমেন প্রথমে থমকে যায় এবং পরবর্তীতে বাড়ির ভিতরে গিয়ে এই বিষয় নিয়ে সবার সঙ্গে হৈ চৈ শুরু করে। এমতাবস্থায় মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে: ‘রাজ্জাক বাইরে চলে এল এবং এল চিরদিনের জন্যে।’ (তদেব : ৩৪)। এভাবেই অসমাপ্ত সমাপ্তি ঘটে গল্পের।
২.৬
‘রক্ত’ জাহাজের খালাসির চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া যক্ষা রোগাক্রান্ত আবদুলের জীবনের সংগুপ্ত অন্তর্ভুবনের বিপর্যস্ত রূপকল্প। মূলত এই ব্যধির কারণেই তাকে দীর্ঘ সাত বছরের চাকরি ক্ষেত্র থেকে একপ্রকার বিতাড়িত করা হয়। এহেন অবস্থায় রাস্তার পাশে অবস্থিত পানের দোকানের টুলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকার সময় তার সাক্ষাৎ হয় আরেক সহায়-সম্বলহীন আক্কাসের সাথে। এই দুজনের একসাথে কিছু সময় যাপনের সূত্রধরে এদের জীবনের বহিলোক-অন্তর্লোকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব মিশ্রিত বিবিধ ভাবনা-চিন্তার মধ্য দিয়ে গল্প এগিয়ে যায় পরিণতির দিকে। যেখানে নিঃসঙ্গতা, যৌনচেতনা, স্বাভাবিক গৃহী জীবন ধারণের আকাঙ্ক্ষা পত্র-পল্লবিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সব চিন্তাধারাই নিপতিত হয়। সমাধানহীন দুর্বোধ্য, দুর্ভেদ্য ঝাপসা দুরাশায়,
আবদুল চোখ বুজলে। কিন্তু কোথায় স্নেহের উৎস? শ্রান্তপায়ে মস্তিষ্কের অলিগলিতে মন ইটিছে খুঁজতে খুঁজতে, কোথাও দেখলে, নদী রয়েছে বটে তবে নিষ্করুণ শুদ্ধতায় ধু-ধু করছে দিগন্তব্যাপী, কোথাও-বা অনাত্মীয় নিঃসঙ্গতা তীররেখাশূন্য নীল সাগরের মতো বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। আবার কেউ কোথাও মাকে ডাকলে, কিন্তু তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, ওপারে ঘন অন্ধকার নেবেছে, আর এধারে খেয়াঘাটে লোকও নেই নৌকাও নেই। ওধারে একদল লোক ঝুড়ি-ঝুড়ি অর্থ নিয়ে গেল-তাই দিয়ে নাকি তারা সাতমহলা বাড়ি তুলবে। শেষে এক জায়গায় দেখলে একটি মিছরের (মিশরের মেয়ে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে চোখ বুজে হাসছে, অথচ একটা ক্ষ্যাপা কুকুর মানুষের মত ছুটে আসছে তাকে কামড়ানোর জন্যে, এবং দেহের কোন অংশে কামড়ায় সে তা দেখবার জন্যে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে একদল খালাসি ঝুঁকে তাকিয়ে রয়েছে ফেনায়িত ঢেউয়ের পানে। কিন্তু কোথাও বিবিকে দেখতে পেলে না সে। [তদের ৩৯]
এই অপ্রাপ্তির রুদ্ধশ্বাসের মধ্য দিয়েই যবনিকা ঘটে ব্যধিগ্রস্ত নিঃসঙ্গ খালাসি জীবনের ও গল্পের।
নয়নচারা গ্রন্থের ‘খণ্ড চাঁদের বক্রতায়’ ও ‘সেই পৃথিবী” গল্পদ্বয়েও একেবারে নিম্নশ্রেণির তথা মানবিকতার দিক থেকেও নিম্নস্তরের মানুষের জীবনের ভেতর-বাহিরের চালচিত্র তুলে ধরেন। খণ্ড চাঁদের বক্রতায় দুটো ঘোড়ার গাড়ির মহাজন শেখ জব্বার তার বিকৃত জীবনযাপনের ধারার একটি দিক হিসেবে চারটি বিয়ে করেন। আর এই চতুর্থ বিয়েকে কেন্দ্র করে আয়োজিত উৎসবে যে নিম্নস্তরের রুচি, অসংলগ্ন ও অসংযত মানসিক অধপতনচিত্র এবং বিকৃত জীবনচর্যার প্রতিবেশ সংঘটিত হয়- গল্পে তার স্বরূপ উন্মোচন করা হয়। সমান্তরালভাবে চতুর্থ স্ত্রীকে কেন্দ্র করে অন্যান্য তিন স্ত্রীর যে হিংসা উত্থিত হিংস্র মনোভাব ও ঈর্ষাকাতর হীন মনোবৃত্তি তাড়িত কৃত জঘন্য ও অমানবিক আচরণ নবধুর সাথে তারা করে- তাও প্রস্ফুটিত করে তুলে ধরেন
বাইরে আনন্দের আগুন জ্বলছে, এখানে জ্বলছে হিংসার আগুন। হিংসা বিদ্বেষ এদের ধর্ম, এবং এরই উত্তাপে তারা বেঁচে থাকে : তাদের দেহে-তো সূর্যের আলো পৌঁছয় না। প্রত্যেকের ঠোঁটে কুটিল হাসি, সে হাসির তলে জ্বালা, এবং এ জ্বালা সঞ্জীবনী। [তদেব: ৪২]
অন্যদিকে আজীবন জনজীবনের জন্য হানিকর, জনমনে ত্রাস সঞ্চারী হীন কর্মকাণ্ডে সংলিপ্ত থাকা সাদেক হঠাৎ করেই জনকল্যাণে নিযুক্ত- এমন একটি চাকরি পাওয়ার পর তার মনোবৃত্তির আভ্যন্তরীণ যে দোলাচলময়তা, তার অসাধারণ শৈল্পিক ও সংবেদী প্রমূর্তায়ণ ‘সেই পৃথিবী’ গল্প :
কিন্তু বহুকাল পৃথিবীর ভাঙা বাংলা ঘাটে নোংরা জল খেয়ে খেয়ে ইদানীং আশ্চর্যভাবে নতুন ভোল এসেছে তার জীবনে। বর্তমানে জনকল্যাণের জন্যে যে-সব চাকরি পথে-ঘাটে লুটোচ্ছে, তারই একটা কী করে তার কপালে এসে লেগেছে। সে থাকি-প্যান্ট-শার্ট, মোজা-জুতো পরতে শুরু করেছে। একটা চাকরি : মাসে-মাসে মাইনে আসবে হাতে, এর অনুভূতি ওর পক্ষে অনাস্বাদিত, তাই বিচিত্র। [তদেব : ৪৪-৪৫]
সেই বিচিত্র অনুভবের অর্থাৎ চাকরি পাওয়ার আগের জীবনের এবং পরের জীবনের মধ্যকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব চেতনা-প্রবাহরীতির টানাপড়েন গল্পে প্রতিফলিত হয়। চাকরি পাওয়ার পূর্বের জীবনে একবার সে বাংলো ধাঁচের একটা বাড়িতে চুরি করতে যায়। আর পরবর্তীতে তার সমগ্র চৈতন্য জুড়ে এই চুরির ঘটনা, সেই রাত প্রতিবেশ বারবার ঘুরেফিরে আসে বহুবিধ চিত্র-বিচিত্র রূপে। এবং সেই ঘটনাজনিত গ্লানি, অপরাধবোধ দ্বারা সে প্রতিনিয়ত জর্জরিত হয় মর্মে মস্তিষ্কে :
হ্যাঁ, তার অন্তর আছে বৈকি। অন্যান্য মানুষের যদি অন্তর থাকে তবে তার লোমশকালো দেহেরও অন্তরালে অন্তর আছে বৈকি। এবং সে অন্তর এখন কতদিন আগেকার একটা অপরাধের অনুতাপে নীল নীল হয়ে উঠেছে। সে- রাত কি কোনোদিন আসবে না, কোনোদিন দেখা পাবে না সে মেয়ের? যদি দেখা পেত সে-মেয়ের, তবে তার পায়ে মাথা গুঁজে কাঁপতে পারত, অন্তরের যত অপরাধ যত গ্লানি যত বেদনা-সব ঢেলে কাঁদতে পারত প্রবল প্রচুর, এমন-কি বুক চিরে রক্ত বের করে ঢেলে দিতে পারত তার শুভ্র-কোমল পা-দুটিতে। ওর মন হঠাৎ ডাকল আস্তে মাগো। তারপর আকুল হয়ে ডাকল মাগো, ওমা মাগো, ওমা… [তদের ৪৬]
মূলত একই ব্যক্তির মধ্যে ইতি-নেতির যে দ্বৈরথ সত্তার যোঝাবুঝি নিয়ত সক্রিয় থাকে এবং এই দুয়ের মাঝে যে সাংঘর্ষিক সম্বন্ধ বিরাজমান সেই বিপর্যন্ত অন্তর্লোকের উপরই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এখানে আলোকপাত করেন।
০৩.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ নয়নচারাতেই তাঁর সর্বজ্ঞ মনন ও পরিণত শিল্পীসত্তার সাক্ষর রাখতে সমর্থ হন। নয়নচারার প্রতিটি গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি মূলত মানব অন্তর্লোকের অজ্ঞেয় ও দুর্ভেদ্য রহস্য উন্মোচনে প্রয়াসী হন। গল্পগ্রন্থের আটটি গল্পের মধ্যে দু-একটি বাদে অধিকাংশ সব গল্পতেই প্রণয়াকাঙ্ক্ষী ও আশ্রয় প্রত্যাশী মানব-মনের বহুভঙ্গিম দীনতা-হীনতা আবার একইসাথে উচ্চাভিলাষী ভোগ-বাসনার শিল্পশৈলী সমৃদ্ধ বুনন পরিদৃষ্ট হয়। বাংলা ভাষার প্রথাসিদ্ধ রীতিতে নির্মিত হওয়া কোনো গল্পগ্রন্থ এটা নয়, বরং লেখকের নিবিড়-নিগূঢ় অন্তদৃষ্টি ও সূক্ষ্ম অনুভববেদ্য অভিজ্ঞানের সুষম সংলিপ্ততায় গ্রন্থটি হয়ে ওঠে বাংলা ভাষায় একেবারেই অভিনব সৃজনের শৈল্পিক প্রতিমা। কথাসাহিত্যে আধুনিক সৃজন-মননের অধিকারী যে কজন কথাসাহিত্যিক প্রণিধানযোগ্য তাঁদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ অবিসংবাদিতভাবে অগ্রস্মরণীয় হিসেবে প্রণম্য।
গ্রন্থপঞ্জি
১। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। গল্পসমগ্র। ঢাকা প্রতীক, ২০১৪
২। শহীদ ইকবাল। বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস। ঢাকা আলেয়া বুক ডিপো, ২০০৯
৩। সৈয়দ আবুল মকসুদ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য। ঢাকা: তাম্রলিপি, ২০০৭
৪। আহমদ শরীফ। নির্বাচিত প্রবন্ধ। ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১১