স্রষ্টার প্রেম ও ধ্যানের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা এক ধরনের অনুভূতিই হচ্ছে সুফিবাদ। ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি উদার ও জীবনের প্রতি কিঞ্চিৎ নিরাসক্তবাদীরা ইসলামে এক নতুন ভাবধারার জন্ম দেয়, যা সুফিবাদ নামে পরিচিতি লাভ করে। পার্থিব ও লৌকিক জীবনকে অসীমলোকে উন্নীত করার সাধনাকে সংক্ষেপে সুফিবাদ বলা যায়। তবে সুফি সাধনা কখনো ইসলামি শরিয়তের বাইরে নয়, কেননা মুসলিম সুফি দর্শনের মূল গ্রন্থ আল কোরআন। আর সুফি সাধনার মূল ভিত্তিও এই কোরআন ও হাদিসের জাহেরি-বাতেনি শিক্ষা। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কিত আয়াতগুলো থেকে সুফিবাদের উদ্ভব ঘটেছে, তাই ইসলামে মরমিবাদকে সুফিবাদ বলা হয়। এ দেশে ইসলাম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই সুফিবাদের আবির্ভাব।
সুফিবাদ হচ্ছে ইসলামের সেই শিক্ষার দিক, যা পরজগৎ, বৈরাগ্যবাদ ও ধার্মিকতার ওপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করে। সুফিবাদ জীবনের পূর্ণাঙ্গ দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও মরমিবাদ জীবনের আংশিক দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ‘‘সুফিতত্ত্বের ইতিহাস বহু প্রাচীন। বাংলায় শ্রী চৈতন্যের (১৪৮৪-১৫৩৩) কাল হচ্ছে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দী। এর বহু আগে একাদশ শতাব্দীতেই বাংলায় সুফি মতবাদ প্রবেশ করে। শাহ সুলতান রুমি (১০৫৩ খ্রি.) নেত্রকোণার মদনপুরে আগমন করেন। ইনি বাংলায় সুফি মতের প্রথম বাণী বাহক। উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে ওই সময়ে এবং একটু পরবর্তীকালে অনেক সুফি সাধক আসেন। এদের প্রভাবে সমগ্র বাংলায় সুফিবাদ প্রসার লাভ করে এবং বাংলার বিপুল সংখ্যক লোক সুফি সাধনায় মগ্ন হয়। বস্তুত চৈতন্য-পূর্ববর্তী বাংলার ধর্ম ও দর্শনে সুফি প্রভাব একটি যুগান্তকারী ঘটনা। প্রত্যেক সুফির খানকায় (আস্তানায়) জিকির (নাম জপ) ও সামা গজল (অধ্যাত্ম সঙ্গীত) অনুষ্ঠিত হতো। কারণ সঙ্গীত সুফি সাধনার অঙ্গ। সুফিগণ সাধনার অঙ্গ হিসেবে সঙ্গীতকে গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে এদেশের দর্শনসম্মত যোগাচার ভিত্তিক দেহতত্ত্ব সাধনাও গ্রহণ করেন।’’১
তবে সুফিতত্ত্ব সম্বন্ধে আমাদের সমাজে নানা ভ্রান্ত ধারণার প্রচলন রয়েছে। ইসলামের আধ্যাত্মিক দিককে জীবনের রূপায়ণের সাধনা থেকেই সুফি তত্ত্বের উৎপত্তি হলেও পরবর্তীকালে আহলে শরিয়তের নিকট তা ছিল ‘বিদআত’। তবে ইমাম আবু আহমদ গাজজালি সুফিতত্ত্ব সম্বন্ধে সে ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন করে তাকে মুসলিম সমাজে শরিয়ত সম্মত মারফতের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। তদবধি সুফিতত্ত্ব মুসলিম জীবনে অতি উচ্চ পর্যায়ের শ্রদ্ধা লাভে সমর্থ হয়েছে এবং আল্লাহর ঐক্য লাভের পদ্ধতি বলে গণ্য হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে সর্বপ্রথম যিনি ‘সুফি’ নামে অভিহিত হন, তিনি সুফি আবুল হাশিম। তিনিই সর্বাগ্রে তাসাউফ বা সুফিবাদের ওপর একখানি পুস্তিকা রচনা করেন। ৫০ হিজরি সালে তার মৃত্যু হয়। সম্ভবত তিনি নিরহঙ্কারজনিত পশমি পোশাক পরিধান করতেন বলেই লোকেরা তাকে ‘সুফি’ নামে অভিহিত করেছিল। ‘সুফি’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যে কয়টি শব্দ থেকে ‘সুফি’ শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে, তন্মধ্যে তিনটি শব্দের দাবি প্রণিধানযোগ্য। যথা-‘সুফিয়া’, ‘সাফা’ ও ‘সাউফ’। ‘সুফিয়া’ অর্থ-জ্ঞান, ‘সাফা’ অর্থ-পবিত্রতা এবং ‘সাউফ’ অর্থ-পশম।
সুফিমাত্রই গুরুবাদী বা পীর-মুর্শিদনির্ভর। প্রকৃত সুফিরা তাদের দৃঢ় জ্ঞান, আত্মার পবিত্রতা, ভালোবাসা ও সাধনার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার স্বরূপ সন্ধানে ব্যাপৃত হন। কোরআনের বাণী থেকেই সুফিরা খুঁজে পান আল্লাহর ক্ষমাশীলতা, ঔদার্য ও প্রেমময়তা। সুফিদের মূলনীতি হচ্ছে আধ্যাত্মিক সঙ্গীত। সুফিদের উদার মানবতাবাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশ তাদের চিত্ত হরণকারী গানের মর্মবাণীতে বিধৃত হয়েছে। যেমনটি দেখতে পাই সুফি সাধক আরকুম শাহর গানে:
মানুষ নয় রে খেলার পুতুল, মানুষ রূপে আল্লাহ্ রাসুল
জাতি নূরে চমক ধরে, অরূপও তার নমুনা॥
বৈষ্ণব দর্শন, বাউল দর্শন ও সুফিবাদের আকার বা প্রকারগত তেমন কোনো পার্থক্য না থাকায় এই তিনেরই মূল লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। যদিও বাহ্যিক পোশাক পরিধানে বা সাধনার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়, তবে সঙ্গীত-ই তাদের মূল উপজীব্য। সঙ্গীতের মাধ্যমেই তাঁরা স্রষ্টার সন্ধান করেন। তবে সুফিবাদে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তাদের ব্যক্তিগত জীবনযাপন। তাদের কর্ম-ধ্যান-ধারণা-সাধনা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, আচার-আচরণ, চলনে-বলনে সর্বক্ষেত্রে নিরহঙ্কার-নির্লোভ-নির্মোহপরায়ণতা মানুষকে সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেয়। তাদের ধর্মপরায়ণতা, সরলতা, আন্তরিকতা, ঔদার্য, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টা বিরাজে। তাই স্রষ্টার সৃষ্টি সব প্রাণীকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই মহান স্রষ্টাকে ভালোবাসার পথ নির্দেশনা দেন। এখানেও বাউল, বৈষ্ণব ও সুফির মিলন ঘটেছে। তাই সাহিত্য, দর্শন ও ধর্মচিন্তা সর্বত্রই সুফি প্রভাব লক্ষণীয়। সুফি ধর্ম হচ্ছে প্রেমবাদ। মানুষ ও অন্তর্যামীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার সাধনাই সুফি সাধনা। সুফি ধর্মের মহান আদর্শ হলো সব ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং মানুষের দুঃখ দূর করা। কেননা, মানবজাতি হলো আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ও সর্বাপেক্ষা সম্মানিত জীব। আর ইসলাম মানবজাতির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।
যে মানুষে খোদা মিলে, তারে কেন ধরো না মন,
তারে কেন চিনো না
মানুষ মানুষের দায়, কান্দিয়া কেন হয় ফানা॥
খোদাভীতি, খোদাপ্রীতি, আত্মোৎসর্গ ও আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন জ্ঞান পিপাসু এই সাধক। মনের সব অভিব্যক্তির প্রকাশ, বিচিত্র ভাব, বিচিত্র চিন্তার প্রসার ঘটিয়েছেন গানে। আধ্যাত্মিকতার ভাব রসে সিক্ত আরকুম শাহর এসব মরমি সঙ্গীত। প্রেমের গানগুলো রোম্যান্টিক-চেতনায়-কল্পনায় ভাস্বর, বাস্তবে ও জাগতিক কামনা-বাসনাতে গানগুলো উদ্দীপ্ত হয়েছে অবলীলায়। সমাজের বাস্তব দিকগুলো গানে তুলে ধরে যেন এক অসাধারণ চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। আরও রয়েছে মানুষে মানুষে পারস্পরিক প্রেমবোধ, রয়েছে ধর্মের পারস্পরিক সহমর্মী কথা। এককথায় বলা যায় যে, তার প্রেমিক-প্রেমিকার জীবন রস সমৃদ্ধ গানগুলো যেমন তত্ত্ব কথায় আবর্তিত, তেমনি সাহিত্যরসমণ্ডিত।
সঙ্গীতের জন্ম কখন বা জয়যাত্রা কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নির্ণয় করা সম্ভব না হলেও ধারণা করা যায় যে, সৃষ্টি লগ্ন থেকেই সঙ্গীত মানব-জীবনের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। কেননা মানব সৃষ্টির পর থেকেই বাণীর সঙ্গে মানুষের ভাবের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কথার বাইরেও আবেগ, অভিমান, না পাওয়া, বিচ্ছেদ, কষ্ট, কিছু কান্না বা সুখের অব্যক্ত কথা মানুষের অন্তরে সর্বদা ঘুরপাক খেতে থাকে। আর তখনই মানুষ ভাবনার রাজ্যে প্রবেশ করে। সেই ভাবনার ফলস্বরূপ মানুষ তার অন্তরের অব্যক্ত অর্থ ও ভাবপূর্ণ কথাগুলো প্রকাশ করে কবিতায়, ছন্দে, গানের বাণীতে, যা ব্যক্তি নিজে প্রকাশ করা ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারে না। যুগে যুগে মানুষের অন্তর নিঙ্ড়ানো বাণীতে রয়েছে কল্যাণের বার্তা, প্রেমের কথা, স্রষ্টা-সৃষ্টি, জন্ম-মৃত্যু ও বেদনার কথা। কাব্যগুণ সমৃদ্ধ এসব বাণীর সঙ্গে সুর যুক্ত হয়ে প্রকাশ ঘটে সঙ্গীতের। তাই বলা হয়, বাণীর সাথে ভাবের ও সুরের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কোমল ও সূক্ষ্ম অনুভূতিজাত সঙ্গীতের বাণী, আবেগ, সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের বার্তা উপলব্ধিতে মানুষ আপ্লুত হয়, আনন্দে উদ্ভাসিত করে মানুষের হৃৎকমল। এটাই সঙ্গীতের ধর্ম। কালের বিবর্তনের সাথে সাথে সঙ্গীতের রচনা, ঢং, আঙ্গিক এবং পরিবেশনায় নতুন নতুন স্বাদ সংযোজিত হয়। প্রকারভেদে সঙ্গীত সবাই ভালোবাসে। কিন্তু সুর নিজের অজান্তেই ব্যথিতের চোখে অশ্রু হয়ে ঝরে; শক্তিধর এই সুর আবার কখনো কখনো মানুষের হৃদয়ে আনন্দের ঝংকারও তোলে।
পীর-ফকির-দরবেশ-সাধু-সন্ত-সুফি ও মরমি সাধকের মতে জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মারই অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদের বিশ্বাস অন্তরের ধন অন্তরেই বিরাজ করে। তাঁদের দর্শনে জাত-পাতের বিভেদ নয়; রয়েছে মানবধর্মের প্রতি, আল্লাহর সব সৃষ্টির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। তারা কখনো কখনো সৃষ্টিকর্তার প্রেমে মত্ত হয়ে জাগতিক কার্যাবলি থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে নিজেকে দগ্ধ করেন। যে আগুনের আলোকচ্ছটা নেই, অথচ দহন করে অঙ্গার করে দেয় সাধকের দেহ ও মন। আর এই পোড়া মনের সব অভিব্যক্তি ও মনের মানুষের সন্ধানে শাশ্বত প্রেমের প্রকাশ পায় বাউল, বৈষ্ণব, মরমি ও সুফি সাধকদের চিন্তা-চেতনার সমন্বয়ে রচিত আকুল করা গানে। তাদের বাণী, মর্মস্পর্শী আকুলতা, অন্তরের আবেদন, আহ্বান, হৃদয়স্পর্শী আবেগে, রূপে-রসে-মাধুর্যে ও হৃদয়ের আকুলতা মিশ্রিত গানগুলো যখন একতারা-দোতারা-বেহালার সুরে বেজে ওঠে তখন মানুষের প্রাণে নিরন্তর অনুরণন তোলে, যা সব জাতির মর্ম মূলে সাড়া জাগিয়ে সর্ব যুগের মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করে অনায়াসে। নিঃসন্দেহে এসব গান শাশ্বত-চিরন্তন। আঁধার রাতে চাঁদ যেমন আলো ছড়ায়, তেমনি সাধকদের কঠোর সাধনায়-সারাবিশ্বের শান্তি কামনায়-ভালোবাসায়-ত্যাগে-সৃষ্টিতে-চিন্তায় আমাদেরকে সঠিক, সহজ, আলো, মুক্তি ও প্রেমের পথ দেখায়।
প্রেম-ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আল্লাহ মানব সৃষ্টিকালেই তাতে প্রেম-প্রকৃতি দান করেছেন। অন্য কোনও প্রাণীর মধ্যে প্রেম-অনুরক্তির প্রকৃতি তেমন নেই। প্রেমে প্রকারভেদ থাকলেও আল্লাহ্কে ভালোবাসাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেম। এই প্রেমের মাধ্যমে আল্লাহ্পাক ও রাসুল (সা.) নির্দেশিত পথে অটল-অবিচল থাকা যায়; আত্মাও বিশুদ্ধ হয়। যারা আল্লাহ প্রেমে দেওয়ানা হন; জাগতিক সব ভালোবাসা থেকে নিজেকে দূরে রাখেন; তারাই হচ্ছেন ওলি আল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধু। আল্লাহর এশকে বা মহব্বতে যারা বিভোর থাকেন, তাদের ‘সুফি’ বলা হয়। বাংলায় তাদের বলা হয় আধ্যাত্মিক সাধক বা মরমি সাধক। আল্লাহ প্রেমে যারা আত্মহারা হন, তারা গানের মাধ্যমে নিজের ভালোবাসা ও প্রেমাস্পদের প্রশংসা করেন। সাধকদের রচিত ভক্তিমূলক বা আধ্যাত্মিক গান মানুষের প্রাণে ভাবের উদ্রেক সৃষ্টি করে। সাধক মনের ভাব প্রকাশ করেন সঙ্গীত রচনার মাধ্যমে, আর সঙ্গীতের প্রকাশ ঘটে সুরের সাহায্যে।
সুফিরা ধর্ম-কর্ম পালনে মনোনিবেশ করেন কঠোরভাবে। নিয়মিত নামাজ আদায়, পরিশুদ্ধতা, জিকির বা স্মরণ, নির্ঘুম দিবা-রাত্রি যাপন করেন। তারা দুনিয়ার সব মোহ পরিত্যাগ করে সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তারা কঠিন সাধনা ও প্রেমের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে ঐশী জ্ঞান লাভ করে পরম সত্তা ও জীবাত্মার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করেন। সুফিরা ‘তাসাওফ’ সাধনায় নিয়োজিত, তাদের কাছে আল্লাহ প্রেমাস্পদ। জীবাত্মার মাঝেই পরমাত্মার স্থিতি; তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি সাধনাই সুফিদের ব্রত। জীবাত্মা-পরমাত্মা সুফিতত্ত্বে আশেক-মাশুকরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। সুফিদের কাছে প্রেমই বড়, প্রেমের দ্বারাই তারা (অতীন্দ্রিয়) ঈশ্বরের মধ্যে ও মানুষের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন অর্থাৎ ঐশ্বরিক ঐক্য লাভ করার প্রয়াস করেন। তাই সুফিরা প্রেম ও অবলীলামুক্ত অন্তরে প্রাপ্ত ঐশ্বরিক প্রেরণার সত্যস্বরূপ স্রষ্টার সঙ্গে মিলনের পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে তারা কখনো বিবাদ-হানাহানি করেননি বরং তর্কের মধ্য দিয়ে পথ ভোলা মানুষের ভ্রান্তি নিরসনের প্রয়াস করেছেন। স্রষ্টা লাভের একমাত্র উপায় আপন আত্মার পরিশুদ্ধি। মানুষ যখন সঠিক সাধনার দ্বারা নিজেকে চিনবে, জানবে তখন-ই প্রকৃত আত্মার সন্ধান পাবে। সুফিরা সৎ কর্ম ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সত্যের পরিচয় লাভ করে থাকেন, তাই তারা স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যকে বরণ করে নেন। যাবতীয় আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে সংযম-সাধনার মধ্যে দিয়ে স্রষ্টায় লীন হয়ে যাওয়া, মানবসেবা, জাতি-ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করে নির্লোভ, নিরহঙ্কার জীবন যাপন করাই সুফি ধর্মের আদর্শ। আর তাই প্রকৃত সুফির কাছে হিন্দু, মুসলমান, পার্সি, খ্রিস্টান, উঁচু, নিচু—সব শ্রেণির মানুষই সমান। জাতি-ধর্ম-বর্ণ বৈষম্যের দেয়াল ভেঙে সুফিরা তৈরি করেছেন এক উদার মানবতাবাদের দর্শন। তাই আমার দৃষ্টিতে সুফিরা কেবল প্রেমের কারিগর নয়, তারা সাম্যের সমাজ নির্মাতা। তাইতো অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সুফি সাধকগণ গেয়ে ওঠেন:
পাগল আরকুম শাহর-ই গান, শোনো ভক্ত আশিকান
হিন্দু মুসলিম যতই দেখো, মরলে পরে এক সমান॥
সুফিদের বিশ্বাস, আল্লাহকে পেতে হলে প্রকৃত প্রেমিক হতে হবে, আর মহান আল্লাহর নৈকট্য বা সান্নিধ্য লাভ করতে তাদের ইসলামি শাস্ত্রমতে সাধন পথের চারটি স্তর অতিক্রম করতে হবে। যেমন: ১. শরিয়ত, ২. তরিকত, ৩. মারেফাত, ৪. হকিকত। এই প্রত্যেকটি স্তর অন্যটির পরিপূরক। প্রকৃত সাধনার দ্বারা এই স্তরগুলো সফলভাবে পার হতে পারলেই সুফিরা বিশেষ অবস্থায় পৌঁছাতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে আরকুম শাহ বলেন:
শরিয়ত মারিফত আর, তরিকত হকিকত।
যে চিজেতে মাশুক মিলে, আমার মকছদ॥
‘পীর’ হচ্ছেন সুফিদের আধ্যাত্মিক গুরু। ‘গুরু’ অর্থ আলোর রোশনাই, ধর্মোপদেষ্টা; দীক্ষাদাতা, মন্ত্রদাতা; ২ আচার্য, উপদেশক, শিক্ষক। ‘পীর’ শব্দটি ফারসি, এর আভিধানিক অর্থ—মুসলমান সাধু, মহাপুরুষ, বৃদ্ধ, বয়স্ক, প্রবীণ, পরিপক্ক, অভিজ্ঞ। তাসাওফ বা তরিকতের বিদ্যায় যিনি পরিপক্ব, পরিপূর্ণ, অভিজ্ঞ, পারদর্শী তিনিই ‘পিরে কামেল’ নামে পরিচিত। ‘পিরে কামেল’-এর প্রতিশব্দ ‘মুর্শিদে কামেল’। ‘মুর্শিদ’ আরবি শব্দ, এর আভিধানিক অর্থ-দিশারি। ‘মুরিদ’ শব্দটি ও আরবি, এর আভিধানিক অর্থ-ইচ্ছুক। আল্লাহ্ ও তার রাসুলের নৈকট্য লাভে যিনি ইচ্ছুক তাসাওফ শাস্ত্রে বা তরিকতের ভাষায় তাকেই ‘মুরিদ’ নামে অভিহিত করা হয়। একজন মুরিদের পক্ষে কামেল পীরের সাহায্য ছাড়া একাকী আত্মজগতের অনুসন্ধান বা অন্বেষণ করার মতো দুর্গম পথ অতিক্রম করা খুবই কঠিন। এজন্যই সিদ্ধ পুরুষের দীক্ষা লাভ অপরিহার্য। মুরিদ তার পীর বা মুর্শিদের অনুকরণ ও অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে তার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য উপলব্ধির মাধ্যমে ভালোবাসা অর্জন করে নেয়। মুরিদ প্রথমে তার পীরকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে রাসুলকে ভালোবাসার পথ সুগম করে নেন; অতপর রাসুলের ভালোবাসা থেকেই মহান আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে। মুর্শিদ প্রসঙ্গে আরকুম শাহ বলেন:
মুর্শিদ ভজিয়াছে যারা, খোদাকে পাইছে তারা
মানুষ ও জানিয়া কইল বিনাশ সংসার॥
পাগল আরকুমে বলে বারে বার, মানবলীলা সারাসার
ভক্তি করো মুর্শিদ পদে শোভা নাই আর॥
সুফিবাদের অন্যতম একটি অংশ ‘মারেফাত’। ‘মারেফাত’ শব্দটি ‘উরফুন’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘উরফুন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ চেনা-জানা, কোনো বিষয় সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হওয়া, কোনো বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা। ‘মারেফাত’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ-জানা-শোনাও নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা যে বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ হয় তাকেই মারেফাত বলা হয়। নিজ ও নিরঞ্জনকে জানার নামই মারেফাত। আরকুম বলেন:
যেখানে মারফত আগে, হইয়াছে সৃজন,
না চিনিলে না পাইবায়, প্রাণনাথের দরশন।
যে কালে ধরিবায় গিয়া, মুর্শিদের দামন,
দরখাস্ত করিয়া কও তালিব নন্দন॥
সুফি সাধনার লক্ষ হলো ‘আল্লাহ্’ জ্ঞান বা ‘ঈশ্বরজ্ঞান’। আল্লাহ্তায়ালার প্রেমময় জ্ঞানকেই সুফি সাধনায় মারেফাত বলা হয়। অর্থাৎ জ্ঞানের স্তর বলতেই বোঝায় মারেফাত। সুফিদের পথ চলায় এটি তৃতীয় স্তর। এই স্তরে আধ্যাত্মিক আলোয় আলোকিত হয় সুফিদের হৃদয় এবং জীবন রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। ফলে মহান আল্লাহর মহিমা ছাড়া আর কিছু অনুভব করতে পারেন না। আল্লাহর সু-বিশাল সৃষ্টি ও আপন সত্তাকে চেনা বা জানার মাধ্যমে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করার এই সাধনাই হলো মারফতি সাধনা। মারেফাতের নিগূঢ়তত্ত্ব আরও স্পষ্ট করার জন্যে আরকুম শাহ নিজেকে এবং স্রষ্টাকে চেনার-জানার পথের সন্ধানে নেমেছেন এভাবে:
আপনাকে না চিনিলে, না পাইবায় নিরঞ্জন
মারফতের বন্দেগি সব, যাবে অকারণ॥
আল্লাহ্ কে বা, রসুল কে বা, আদম কোন জন
হাওয়াকে কইলায় পয়দা, কিসের কারণ॥
কী রূপে আসিলু ভবে, কে মোরে কইলো সৃজন
বল মোরে চিনি তারে, কিরূপ গঠন॥
আশেক আর মাশুকের মিলন কামনাই সুফিবাদের মর্মকথা আর এই মর্মকথাই হলো মরমিবাদ। জীবন, স্রষ্টা ও সৃষ্টি জগতের অনন্ত জিজ্ঞাসা ও ভাবনা থেকে মরমিবাদের উদ্ভব। মরমিবাদী সাধকরা আল্লাহর ধ্যান ও চিন্তায় সর্বক্ষণ মশগুল থাকেন। কখনো কখনো জাগতিক কার্যাবলি হতে বিচ্ছিন্ন থেকে নীরবে, নিভৃতে আল্লাহর কাছে সুরের মাধ্যমে ইবাদতস্বরূপ যে আধ্যাত্মিক বাণী প্রকাশ করেন তা-ই মরমি গান। তাদের অন্তরের বিরহের ক্রন্দন প্রকাশ পায় সুরের সাহায্যে। তারা স্রষ্টা প্রেম, আধ্যাত্মিক সঙ্গীত আর দেহ সাধনার মাঝে সহজ পথের সন্ধান করেন, এই পাওয়া-ই পরম পাওয়া। তাদের চাই অনন্ত প্রেম, যে চাওয়ার কোনো অন্ত নেই। কখনো কখনো দেখা যায় সংসারী হয়েও তারা সন্ন্যাস জীবনযাপন করেন। প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় সাধক অন্তরজ্বালায় দগ্ধ হয়ে ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে কঠোর সাধনায় মগ্ন হন। মরমি সাধকেরা অন্তর্জ্ঞানে জিকির ও সাধনার মাধ্যমে জীবনকে নিরোগ ও সুখময় রূপে ভোগ করার মাঝেই মানব জীবনের প্রধান সার্থকতা খুঁজেছেন। খোদা-প্রেমিক সুফিদের জীবন ধারণের অন্তরালে রয়েছে কেবল প্রেমাস্পদের প্রেম লাভ এবং তার সন্দর্শন লাভের আকাঙ্ক্ষা, এই প্রেম ঐশী প্রেম। মরমি সাধকেরা স্রষ্টার প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্বন্ধ স্থাপন করেন। স্রষ্টা, সৃষ্টি, ইহকাল-পরকাল, সমাজ-সংসার, জীবন-মরণ, হতাশা-নৈরাশা, বিচ্ছেদ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া, আচার-আচরণ, শাস্ত্রনীতি, প্রভৃতি বিষয় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেই সাধকেরা মরমি গান রচনা করেন। প্রেমিক হলেই আল্লাহকে পাওয়া যায়, আর ভাবুক হয়ে আপন সত্তাকে চিনলেই আল্লাহকে চেনা যায়। স্রষ্টার আসন মানবের হৃৎকমলে, তাইতো সুফি কবি আরকুম শাহ গেয়ে ওঠেন:
যদি আমায় চিনতে চাও, জীবন থাকতে মরিয়া যাও
প্রেম সূত বান্ধিয়া গলে, নাম ফুলের মধু খাও॥
সুফিবাদে যে আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের কথা বলা হয়, তা মানুষের দৈহিক অনুভূতির সঙ্গে জড়িত বলেই সুফিরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় হিসেবে সঙ্গীতকে সমর্থন করেন। তাদের বিশ্বাস, সঙ্গীতের মূর্ছনা অন্তরে আধ্যাত্মিক অনুভূতি জাগ্রত করে, যার মাধ্যমে আল্লাহর ধ্যানে তন্ময় থাকা যায়। তাই তারা গানের সুরের মাধ্যমে প্রেম, বিচ্ছেদ কিংবা চাওয়া-পাওয়ার আর্তি ব্যক্ত করেন প্রেমময়ের নিকট। সঙ্গীতের ধর্ম মানুষের হৃদয়ে রসসঞ্চার করা, তাই সঙ্গীতের কোনো জাত নেই। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব, ছোট-বড় সর্বপ্রকার মানুষের মনকে জাগ্রত করে বলেই সঙ্গীত মানুষের মনের খোরাক। মানুষের সুখ-দুঃখ, মনের সব চাওয়া-পাওয়া, হারানোর বেদনা, না পাওয়ার আর্তনাদ উপমা, রূপক ও তত্ত্ব কথার আশ্রয়ে যেন সুরের বিনুনিতে গেঁথে রাখেন রচয়িতা। গানের গভীরে প্রবেশ করতে উচ্চশিক্ষিত আর জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন রয়েছে ভাবুকের।
সঙ্গীতের জন্ম কখন বা জয়যাত্রা কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নির্ণয় করা সম্ভব না হলেও ধারণা করা যায় যে, সৃষ্টি লগ্ন থেকেই সঙ্গীত মানব-জীবনের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। কেননা মানব সৃষ্টির পর থেকেই বাণীর সঙ্গে মানুষের ভাবের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কথার বাইরেও আবেগ, অভিমান, না পাওয়া, বিচ্ছেদ, কষ্ট, কিছু কান্না বা সুখের অব্যক্ত কথা মানুষের অন্তরে সর্বদা ঘুরপাক খেতে থাকে। আর তখনই মানুষ ভাবনার রাজ্যে প্রবেশ করে। সেই ভাবনার ফলস্বরূপ মানুষ তার অন্তরের অব্যক্ত অর্থ ও ভাবপূর্ণ কথাগুলো প্রকাশ করে কবিতায়, ছন্দে, গানের বাণীতে, যা ব্যক্তি নিজে প্রকাশ করা ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারে না।
মানবসৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে হতাশা-দুঃখ-বেদনা-মৃত্যু-হাসি-কান্না ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ সুখে হাসে, দুঃখে কাঁদে, এই দুঃখের কান্নার একটা সুর প্রতিটি মানুষের অন্তরে বেজে ওঠে নিভৃতে। সেই কান্না যখন অন্তর জর্জরিত করে তোলে তখন বিরহের আর্তিগুলো ক্রন্দনধ্বনি হয়ে শব্দের মাধ্যমে মানুষের কণ্ঠে প্রকাশ পায়। সুরে প্রকাশিত এই কথাগুলোকেই আমরা গান বা সঙ্গীত বলি। বাঁশিতে ফুঁ না দিলে যেমন বাঁশি বাজে না; তেমনি কোনো কিছুতে আঘাত ছাড়া শব্দের সৃষ্টি হয় না। যেমন অন্তরে আঘাত ছাড়া কবিত্ব শক্তির প্রকাশ পায় না; তেমনি দুঃখ ছাড়াও সুরের সৃষ্টি হয় না। কেননা মানুষ দেহে আঘাত পেলে উহ্ শব্দ করে, আর অন্তরে আঘাত পেলে নীরবে কাঁদে। ব্যথিতের এই নীরব কান্না যখন শব্দে প্রকাশ পায় তখন এক ধরনের সুরের সৃষ্টি হয়। তাই ধারণা করা হয় যে, মানুষের ক্রন্দন থেকেই সুরের সৃষ্টি; আর দুঃখ থেকেই গানের জন্ম। তবে সুখের প্রকাশও মানুষ করে সঙ্গীতের মাধ্যমে। বাতাসের শনশন শব্দ, পাখির ডাক, প্রকৃতি থেকে পাওয়া শব্দ থেকেই মানুষ সুর খুঁজে পেয়েছিল এ কথাও সত্য।
যুগ-যুগ ধরে মানুষের অন্তর নিঙ্ড়ানো বাণীতে রয়েছে কল্যাণের বার্তা, প্রেমের কথা, স্রষ্টা-সৃষ্টি, জন্ম-মৃত্যু ও বেদনার কথা। কাব্যগুণ সমৃদ্ধ এসব বাণীর সঙ্গে সুর যুক্ত হয়ে প্রকাশ ঘটে সঙ্গীতের। তাই বলা হয়, বাণীর সঙ্গে ভাবের ও সুরের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কোমল ও সূক্ষ্ম অনুভূতিজাত সঙ্গীতের বাণী, আবেগ, সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের বার্তা উপলব্ধিতে মানুষ আপ্লুত হয়, আনন্দে উদ্ভাসিত করে মানুষের হৃৎকমল। এটাই সঙ্গীতের ধর্ম। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতের রচনা, ঢং, আঙ্গিক ও পরিবেশনায় নতুন নতুন স্বাদ সংযোজিত হয়। প্রকারভেদে সঙ্গীত সবাই ভালোবাসে। এমন একজন খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যে জীবনে মনের আনন্দে কিংবা দুঃখে গুনগুন করে মনের ভাব প্রকাশ করেননি। সে-টা হোক যে কোনও প্রকারের সঙ্গীত। মানুষের মনের ভাবকে সুর ও বাণীর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করাই সঙ্গীতের ধর্ম। জীবনের সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতনের মর্মবাণী মিশ্রিত কথাগুলো মানুষের সুমিষ্ট কণ্ঠে সুরের সাহায্যে বেরিয়ে আসে। দেখা যায় সেই সুর নিজের অজান্তেই ব্যথিতের চোখে অশ্রু হয়ে ঝরে; শক্তিধর এই সুর আবার কখনো কখনো মানুষের হৃদয়ে আনন্দের ঝঙ্কারও তোলে।
পীর-ফকির-দরবেশ-সাধু-সন্ত-সুফি ও মরমি সাধকের মতে জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মারই অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদের বিশ্বাস অন্তরের ধন অন্তরেই বিরাজ করে। তাদের দর্শনে জাত-পাতের বিভেদ নয়; রয়েছে মানবধর্মের প্রতি, আল্লাহর সব সৃষ্টির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। তারা কখনো কখনো সৃষ্টিকর্তার প্রেমে মত্ত হয়ে জাগতিক কার্যাবলি থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে নিজেকে দগ্ধ করেন। যে আগুনের আলোকচ্ছটা নেই, অথচ দহন করে অঙ্গার করে দেয় সাধকের দেহ ও মন। আর এই পোড়া মনের সব অভিব্যক্তি ও মনের মানুষের সন্ধানে শাশ্বত প্রেমের প্রকাশ পায় বাউল, বৈষ্ণব, মরমি ও সুফি সাধকদের চিন্তা-চেতনার সমন্বয়ে রচিত আকুল করা গানে। তাদের বাণী, মর্মস্পর্শী আকুলতা, অন্তরের আবেদন, আহ্বান, হৃদয়স্পর্শী আবেগে, রূপে-রসে-মাধুর্যে ও হৃদয়ের আকুলতা মিশ্রিত গানগুলো যখন একতারা-দোতারা-বেহালার সুরে বেজে ওঠে তখন মানুষের প্রাণে নিরন্তর অনুরণন তোলে, যা সব জাতির মর্ম মূলে সাড়া জাগিয়ে সর্ব যুগের মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করে অনায়াসে। নিঃসন্দেহে এসব গান শাশ্বত-চিরন্তন।
তথ্যসূত্র
১। খন্দকার রিয়াজুল হক ও আবদুর রাহীম হাযারী: সুফি তত্ত্বের আত্মকথা, চতুর্থ প্রকাশ, ২০০৮; পৃ. ১৮-১৯