‘প্রহসনের জ্বলন্ত অঙ্গারে যারা ঘ্রাণ নাওনি/ তারা আমাকে জানো না’ (আলাপ: পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল)। কথা অকপট। স্বতন্ত্র। অন্তর্মুখী। স্থিতধী। সম্ভ্রান্ত মনের একজন মানুষ। বিমূর্তভাবনার স্বচ্ছল গাঁথুনি দিয়ে ‘দূরের কার্নিশ’-এর মাধ্যমে তাঁর আবির্ভাব ও বিকাশ। চোখ মেললে তাঁর আবির্ভাবকালে অনেক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের সন্ধান পাওয়া যাবে, যাঁরা কাব্যস্বাতন্ত্রে বহুল আলোচিত হয়ে আলোকিত করেছেন সময়কে। তাদের মধ্যে অসীম সাহা, আবুল হাসান, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নূরুল হুদা, রফিক আজাদ, সমুদ্র গুপ্ত, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, হেলাল হাফিজ, সিকদার আমিনুল হকসহ অনেকের নাম এসে যায়। ষাটের দশকটি বহুদৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত। কেননা বৈশ্বিক রাজনৈতিক টানাপড়েন, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থানের স্লোগানে তখন ছেয়ে গেছে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মন। সেইসব টানাপড়েনের মধ্যে বেড়ে ওঠা এক সন্ত ‘সিকদার আমিনুল হক’ (১৯৪২-২০০৩), যিনি আপাদমস্তক একজন কবি। অনেকে আছেন যিনি তার ‘নিজের মুদ্রাদোষে’ আলাদা। প্রথম থেকেই স্বতন্ত্র থাকার চেষ্টা করেছেন বলে শেষপর্যন্ত নির্মাণ করতে পেরেছেন নিজস্ব ভাষাশৈলী। তিনি নিজে শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায়, ঠিক মৃত্যুর তিন বছর আগে, অকপটে বলেছেন, ‘আমার কাজ কবিতা লেখা, শুধুই কবিতা লেখা। সৌভাগ্য একটাই, আমার কলম এখনও থামেনি। লেখাকে দৈব ব্যাপার বলেই ছেড়ে দিয়েছি; ভালো লেখার চেষ্টা থাকতে পারে—কিন্তু সফলতা-অসফলতার হাতে কবিকে শেষ পর্যন্ত নিঃশব্দে আত্ম-সমর্পণ করতে হয়।’ কবি আর্থিক অনটনে পড়েছেন তবু কখনো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেরর কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। কারণ যে কবি কাব্যসিংহাসনে বসার সাহস রাখেন, তাঁর শীর চির উন্নত, মননশীল, চির সংবেদনশীল।
দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে সিকদার আমিনুল হক বেছে নিয়েছিলেন কবিতার দুর্গম পথ। চার দশক তিনি অবিচল থেকেছেন কবিতায়, প্রকাশ করেছেন মাত্র ১৬ টি কবিতার বই। ১৯৭৫ সালে ‘দূরের কার্ণিশ’ এর মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে প্রতিনিয়ত সক্রিয় থেকেছেন নিজেকে অতিক্রমের নেশায়। পেশায় তিনি যেমনই থাকুন না কেন কবিতা তাকে পেয়ে বসেছিল, ফলে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে কবিতাই লিখেছেন, প্রলোভোনের দিকে মন বাড়াননি। কবিতার পথে নির্মোহ যাত্রা শুরু করে কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ দিয়ে শক্ত ভীত রচনা করে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজেকে। কবিতাই তিনি পছন্দ করতেন, কবিতা নিয়ে কোলাহল নয়। তাই এই কাব্যপরিব্রাজক নিঃসঙ্গ। বিমূর্ত ভাবনা তাকে বহুদূর নিয়ে গেছে, তবে তা বাস্তবতাকে, মূর্ত বিষয় বা বস্তুকে উপেক্ষা করে নয়। কবিতায় যেমন তিনি তুলে এনেছেন নারী, সৌন্দর্য, রোমান্টিকতা, দেশাত্মবোধ, তেমনি তার ধারণ করেছেন গীতিকাব্যিক, আলঙ্কারিক ও কল্পনামুখর ঢঙও। রয়েছে পরাবাস্তব, রূপক, প্রতীকী, শোক কবিতা। এসবে রয়েছে অসাধারণ চিত্রকল্প, রয়েছে ছন্দের নিপুণ প্রয়োগও। বোঝাই যায়, বাংলা কবিতার হাজার বছরের রূপরেখা সম্বন্ধে তার রয়েছে সুস্পষ্ট ধারণা। ফলে মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে একের পর এক ১৬টি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে নিজস্ব পথ তৈরিতে সমর্থ হয়েছেন। কেবল অকালমৃত্যু তার চলার পথে সাময়িক ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। সাময়িক এজন্য যে, তিনি এখনও চলছেন অগণিত পাঠকের পড়ার টেবিলে। যেহেতু নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা কবিকে ঘিরে রাখত, তাই জীবদ্দশায়ও ‘সতত ডানার মানুষ’ নিয়ে তেমন মাতামাতি কেউ করেনি। জীবনানন্দের জীবদ্দশায়ও এমন ঘটেছিল। প্রকৃত কবিদের নিয়তি এমন-ই। তিনি একা থেকেছেন কিন্তু তার একাকীত্বকে খুব একটা আড়ালে রাখেননি, লেখার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছেন এই বলে যে, ‘আমার জীবনের অনেকটাই উপেক্ষার আর অন্ধকারের, সাধে কি আর বইয়ের নাম রেখেছি ‘বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে’ (পূর্ণতা, এপ্রিল-মে ১৯৯৫)। কবি উপলব্ধি করেছিলেন উপেক্ষা হলো কবির জন্যে আশীর্বাদ। কিন্তু তাই বলে তার লেখা সস্তা পথে বাঁক নেয়নি। তার বিশ্বাস ছিল, পরিশ্রমী পাঠকরাই তাকে একদিন আবিষ্কার করবে।
_________________________________________________________________________________________________
তাঁর সময়ে বলা হতো তিনি ফরাসি কবি আঁর্তুর র্যাবো দ্বারা প্রভাবিত। কবিতায় অবশ্য তিনি একাধিকবার র্যাবো-র নামও উল্লেখ করেছেন প্রসঙ্গক্রমে। যাই হোক, একজন কবির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে এটা স্বাভাবিক। কবিরা প্রচণ্ড কল্পনাপ্রবণ, তাই তাকে বাস্তবতাবিবর্জিত মনে হওয়া দোষের নয়। একজন লেখক যদি পাঠক হিসেবে পাশ্চাত্যঘেঁষা হন তবে তো তার লেখার মধ্যে বিদেশি লেখার ছাপ পড়বেই। অবশ্য তিনি অনেক কবিতা ইউরোপীয় কবিতার ঢঙে লিখেছেন এবং প্রচুর বিদেশি আবহ, শব্দ, বর্ণনা, চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন।
_________________________________________________________________________________________________
টালমাটাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে কবি বেড়ে উঠেছেন তাই তার মধ্যে দেশাত্মবোধের ছাপ পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সে সময়ে অনেকের রাজনৈতিক কবিতা স্লোগানধর্মী হয়ে উঠেছে কিন্তু তার সচেতন স্বত্ত্বা কবিতাকে স্লোগান হতে দেয়নি। লিখেছেন, ‘অবরুদ্ধ ঢাকা চ’লে গেলো শত্রুসেনা, রাজাকার, আলবরের হাতে।…এবং মধ্যরাত্রি থেকে শুরু আবার আগুন!/ কেরানীর বাড়ি গেলো, মিষ্টিঘর, পরিত্যক্ত বস্তি।/— জিঞ্জিরার পরে নৌকা, ক-একটি পরিবার মিশে চলেছি বিক্রমপুর। জ্যোৎস্নারাত, দেখি একপাশে একটি মেয়ের চোখে ভয় নয়/ অহঙ্কার হাসে।’ (স্মৃতির এ্যালবাম থেকে/ অগ্রন্থিত কবিতা)। স্বাধীনতা যুদ্ধের টালমাটাল সময়ের স্থীরচিত্র কবি তার কবিতার মাধ্যমে আমাদের সামনে এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পর স্বদেশ আমার/ তোমাকে কেমন নতুন নতুন লাগছে। এখন ভাবছি/ আমার বাইফোকাল লেন্স তুলোট কাপড়ে বারবার/ ঘসে নেয়ার দরকার নেই।/ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।’ (নেই নেই নেই/ অগ্রন্থিত কবিতা)। আপাত নীরব কবি এভাবেই তার নিজের ভেতরে পুষে রাখেন প্রচণ্ড কোলাহল।
যেহেতু বিশ্বপর্যটকের মতো কবির মনোজগৎ তাই তিনি কবিতার ভেতরে প্রবেশ করিয়েছেন অসাধারণ চিত্রকল্প। কবিতা যখন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পাঠককে নিয়ে যায় চিত্রাবিষ্ট আবহে তখন চিত্রকল্পের ডানায় ভর করে কবিকে চলতে হয়। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন চিত্রকল্প শুধু ছবি নয় বরং ছবির অন্তর্গত বক্তব্য ও নান্দনিকতার মেলবন্ধন। ‘মেয়েরা যখন তাদের পোশাকগুলি শরীর থেকে একে একে খুলে ফেলে দেয়, হ্যাঁ, তখুনি ভোর।—দিনের, কর্মঠ দিনের পোশাকগুলি সব ধবধবে সাদা/। কিন্তু রাত্রির পোশাকগুলি এমন ছিলো না!/ অভিজ্ঞান আর সহনশীলতার পোশাকগুলি লাল, নীল, হলদে, কমলা, বেগুনি কিংবা জাফরান রঙের।’ (সতত ডানার মানুষ)। তিনি লিখেছেন ‘আমার টেবিল ঠিক আমার মতোই।/ খুব ছোট কিন্তু ক্ষুধা দেখি তার সীমাহীন।/ বই, খাতা-পত্র পত্রিকার টিবি, কাঁচি, পাণ্ডুলিপি, স্কেল, গ্রুপ-ছবি/ সমস্ত একাই রাখে চার বাই ছোট তিন ফুটে।’ (আমার লেখার টেবিলের ইতিহাস/ সুপ্রভাত হে বারান্দা)। আমিনুল হকের চিত্রকল্প তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফসল। পড়তে গেলেই নিজের অজান্তেই কবিতাগুলো ছবি হয়ে ধরা দেয় মনের ক্যানভাসে।
প্রকৃত পাঠক কবিকে আবিস্কার করেছেন ঠিকই কিন্তু খুব ধীর লয়ে। পাঠক যখন কবির নিঃসঙ্গতা আবিষ্কারের জন্য তার কাব্য পড়বে তখন বহু জায়গায় কবিকে একাকি পেয়ে যাবেন। কবিরা মূলত বাস্তবের রৌদ্রতাপে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে কোনো একদিন আউটসাইডার হয়ে যান। তিনি লিখেছেন, ‘একা থাকার স্বভাব নিয়ে আমি জন্মেছি, দলের অনাচার ও কোলাহলে সত্যি বলছি আমি অসুস্থ। দল করলেই নিজের কিছু অন্যায় এবং অন্যের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেই হবে। যা বিশ্বাস করো না তা তোমাকে উচ্চারণ করতে হবে—নিতান্ত অর্বাচীনের ভাঁড়ামি ও চিৎকারে সাড়া দিতেই হবে।’ (পূর্ণতা এপ্রিল-মে ১৯৯৫)। এমন একাকীত্বের সরল ছাপ পড়েছে তার কবিতায়, লিখেছেন, ‘বস্তুত, এখন আমি খুব একা।/ এই একাকীত্ব চট করে পাওয়া নয়;/ বলা হয় ধীমান মস্তিষ্কে করেছি শীতের চাষ।/ বরফের মতো শাদা তুলো ওড়ে আজ চারিদিকে :/ এর নাম অভিজ্ঞতা।’ (স্বাগতম/ সুপ্রভাত হে বারান্দা)। ‘ছবি চুরির গল্প’-তে তিনি বলেছেন, ‘হে জীবন্ত খরগোশ, তুমি আসো কবির টেবিলে।/ কবি তো একাই আছে; চ’লে গ্যাছে সার্কাসের চিতা—/ এসেছিলো গাছ হ’য়ে, প্রেমিকের মতো কত পাতা;/ জামার বোতাম খুলে খেতে দিলো একরাশ ব্লেড্/ খেয়ে খেয়ে ঘেন্না ধরে গেল, শেষে, বললাম, আসি—…। (লোর্কাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেলো)। এমনি করে তিনি তার গোপন একাকীত্ব পুড়িয়ে তা শাব্দিক বিন্যাসে রূপায়িত করেছেন। তার কবিতায় নান্দনিকতার দিকটি যেমন আছে তেমনি তা উল্লম্ফনের কারণে কোনো কোনো পাঠকের কাছে ব্যাঘাত বলে মনে হতে পারে।
২৭শে-মে, ২০০৩ সাল, কবির মৃত্যু পরবর্তী নাগরিক স্মরণসভায় কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছিলেন, ‘সিকদার আমিনুল হক বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ নান্দনিক কবিদের মধ্যে অন্যতম।’ অনেকে আবার বহুবিধ অভিধায় অভিহিত করেছেন। কিন্তু মনে হয় না যে, যারা তার শুধু প্রশংসাই করেছেন তারা সবাই তার কবিতার নিমগ্ন পাঠক। পাঠককে মননশীল হতে হবে, কবিতায় অবগাহন করতে হবে এটাই শেষ কথা, এলেবেলে পাঠক হলে তার কবিতার রস উদ্ধার করা দুষ্কর। কবি বিষ্ণু দে তাঁর ‘ভোরের কার্নিশ’ পড়ে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘কবিতাগুলি পড়েছি। শক্ত। তবে কবির মন সজাগ। অবশ্যই আত্মসচেতনও বটে।’ কেউ বলেছেন তাঁর কবিতায় বিদেশি কবিতার ছায়া দেখতে পাওয়া যায়, কেউ বা বলেছেন তিনি কবিতাকে দুর্বোধ্য করে তুলেছেন। কবি শামসুর রহমান স্বয়ং অভিযোগের সুরে বলেছেন, ‘তিনি ( সিকদার আমিনুল হক) বাইরের জগৎকে নিজের বারান্দা থেকে দেখতে পছন্দ করেন।’ (ভোরের কাগজ, ৩জুন ১৯৯৪)। তাঁর সময়ে বলা হতো তিনি ফরাসি কবি আঁর্তুর র্যাবো দ্বারা প্রভাবিত। কবিতায় অবশ্য তিনি একাধিকবার র্যাবো-র নামও উল্লেখ করেছেন প্রসঙ্গক্রমে। যাই হোক, একজন কবির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে এটা স্বাভাবিক। কবিরা প্রচণ্ড কল্পনাপ্রবণ, তাই তাকে বাস্তবতাবিবর্জিত মনে হওয়া দোষের নয়। একজন লেখক যদি পাঠক হিসেবে পাশ্চাত্যঘেঁষা হন তবে তো তার লেখার মধ্যে বিদেশি লেখার ছাপ পড়বেই। অবশ্য তিনি অনেক কবিতা ইউরোপীয় কবিতার ঢঙে লিখেছেন এবং প্রচুর বিদেশি আবহ, শব্দ, বর্ণনা, চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন। যেমন, একটি জর্জীয় কবিতার বেদনা, একটি ভিনারেল, সাবওয়ের হিস্পানি রুমাল, নিউইয়র্কের রাস্তায়, স্কচ-ভীতি, নিডহাম বোস্টনে, তুষারপাত, পাইন, ওক্, লোরকা, কাফকা ইত্যাদি শব্দ, নাম ব্যবহার করেছেন।
উল্লেখ্য, তাঁর বিদেশযাত্রা খুব বেশি ছিল না। ফলে তাঁকে অনেকসময় প্রবল স্বপ্নাবিষ্ট বলে মনে হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত স্বপ্নময়তার ফলে তার কবিতার মধ্যে পজেটিভ ইমেজ সৃষ্টি হয়েছে। লিখেছেন, ‘তোমরা দেখবে শুধু এই ঘর, আর পারসিক গালিচার কারুকাজ, আসবাব, বার্ণিশের ঠাণ্ড…মার্বেল পাথরে তৈরি উঁচু থাম্, বেলজিয়াম-গ্লাস; ঝাড়বাতি, মিসরীয় ধাতু দ্রব্য, বাঁকুড়ার ঘোড়া!…।’ (অবেলার কান্ত গান/ সুপ্রভাত হে বারান্দা)। এমনি করে অসংখ্য কবিতায় অবলিলায় তিনি বিদেশি শব্দ-আবহ তৈরি করেছেন। যেগুলো শেষমেষ নতুন মাত্রা পেয়েছে। তার কবিতা যতই দুর্বোধ্য বলা হোক না কেন, তা শেষ পর্যন্ত পাঠক মহলে অবোধ্য থাকেনি।
বিংশ শতাব্দীর অভিনব সাহিত্য উপাদান সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদী চিন্তাধারার তিনি সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। মানুষের মনের চেতন ও অচেতন অবস্থার ঊর্ধ্বে যে একটি অবচেতন সত্তা বিরাজ করে, সে অবচেতনের গহিন থেকে উঠে আসা বাস্তবের অধিক বাস্তব আপাত অবাস্তবই পরাবাস্তবতা। বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার ছাপ তিনি এমনভাবে স্পষ্ট করে তুলেছিলেন, যা কবিতাকে এবং সংবেদনশীল পাঠককে অনেক দূর নিয়ে গেছে। ‘ভোর থেকে আমার প্রিয় লাল জামার ওপরে টিপটিপ ক’রে পড়ছে কালো বৃষ্টির ফোঁটা/ তুমি তুলে রাখো খাবার টেবিলের ওপরে-যে ভাবে রাখো কমলালেবু/ অথবা কয়েকটি রক্তাভ আপেল…/ যদিও সেই প্লেটেই আছে একটি কর্তিত আঙুল/ যে আঙুল একজন কবির:/ যাঁর কবিতা ছিলো প্রধানত কাম, সমুদ্র ও মানুষের কঙ্কাল সম্পর্কিত।’ (আমার প্রিয় লাল জামা, সুপ্রভাত হে বারান্দা)। অন্য একটি উদাহরণ দেওয়ার লোভও সামলানো দায়। তিনি লিখেছেন, ‘জাহাজডুবির পরেই দেখি সমুদ্র ভাগ হ’য়ে গেছে চারখণ্ডে।/ একখণ্ডে রয়েছে আমাদের প্রিয় হাড়-গোড় সমেত রক্ত।/ দ্বিতীয় খণ্ডে রাজত্ব করছে শুধু তিমিরা;/ তৃতীয় খণ্ড হাঙর আর তলোয়ার-মাছের;/ এবং চতুর্থ খণ্ডে আসে রাত্রি, তার জামা ফক্ফকে জ্যোৎস্নার মতো শাদা।/ যেমন শাদা বরফ ও কাফনের কাপড়ে মিলে মিশে থাকে। (জাহাজ ডুবি/ অগ্রন্থিত)। এমনই অনেক উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন, যে কবিতাগুলো পড়লে আগামী প্রজন্মের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। সমকালে কতজন পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে তা তো হাতে গুনে বলে দেয়া যায়!
_________________________________________________________________________________________________
সংবেদনশীল মানুষেরা বোধ হয় অভিমান করলে গ্রহ বদলানোর সিদ্ধান্ত নেন! হতে পারে। তিনি গেছেন ২০০৩ সালে। সংবেদনশীল শব্দ ও বাক্যবাণে তিনি জাত পাঠকের মেধায় জায়গা করে নিয়েছেন। কাব্যে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করার পর তিনি আরও বেপরোয়া হয়েছেন, অসাধারণ শব্দসমুদ্রে ডুবেছেন ও ডুবিয়েছেন। তার একনিষ্ঠতার কারণে তিনি কাব্যে স্থায়িত্ব পেয়েছেন।
_________________________________________________________________________________________________
মৃত্যু মানুষকে আমৃত্যু তাড়া করে ফেরে। শিকদার আমিনুল হক যে তার উর্ধ্বে থাকেন এমনটি নয়। তাকেও মৃত্যু তার হিমশীতল বাহু উঁচু করে ডেকেছে। তিনি প্রথম থেকেই মৃত্যু নিয়ে খেলেছেন এবং লিখেছেন। বলেছেন, ‘কে না মৃত্যুর পায়ের শব্দ পায়।’ মৃত্যু যেন করতলের মার্বেল, ইচ্ছে হলো আর ছুঁড়ে দিলাম উঁচুতে, ইচ্ছে হয় ধরলাম না হয় ছেড়ে দিলাম। মৃত্যু তার কাছে একটি প্রশ্ন হয়ে প্রাথমিক দিকেই দেখা দিয়েছিলো, ‘আজ সারারাত জানি বৃষ্টি হবে, আর তুমি পিতা থাকবে অযত্ন ভুলে ঠাণ্ডা ঘুমে।/ এতই নিঃসঙ্গ মৃত্যুগন্ধময় গোরস্থান— কিন্তু তোমার বিশ্রাম বিব্রত অস্তিত্ব শেষে এই শান্তি তবে ভালোবাসে।’ (এই মৃত্যু এই স্বাধীনতা/ পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা)। মৃত্যুকে তিনি প্রশ্ন করেছেন, কৌতুক করেছেন, তবে বয়স পঞ্চাশ পেরোনোর পর নির্ভয়ও থাকতে পারেননি। বলেছেন, ‘বয়স অল্পই ভালো।/ মৃত্যু তা হলে দূরে থাকে।’ (উত্তাপ শেষ শীতে/ কাফকার জামা)। কবিতার প্রাথমিক ইতিহাস থেকে আজ পর্যন্ত যে মানুষটি কবিতার পথে পা বাড়িয়েছে তাকেই মৃত্যু নামক অনাবিষ্কৃত গ্রহ জয় করার জন্য তুমুল আগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেছে। কেউ কেউ আবিষ্কার করেছেন কেউ বা পারেননি। তবে যারা পেরেছেন তাদের আবিষ্কার কতটুকু সম্পূর্ণ সে প্রশ্ন এখনও মানুষের মনে রয়ে গেছে।
শুধু কি মৃত্যুতেই জীবনের শেষ? না। তিনি তা কখনো ভাবেননি। তার কবিতার বিশেষ অংশ জুড়ে আছে প্রেম। সিকদার আমিনুল হক-এর প্রেমের কবিতা সম্পর্কে তাঁর খুব কাছের বন্ধু ফারুক মাহমুদ মন্তব্য করেছেন, ‘প্রেমের কবিতা লেখার দিকে তার একটা বিশেষ মনোযোগ ছিল। এই বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলতেন, নারীর রহস্যের জানালা খুলেই আমি ঈশ্বরের মুখ দেখতে পাই কখনও কখনও। দুঃখ আর আনন্দকে এত পাশাপাশি উজ্জীবিত রাখতে প্রকৃতিতে আর কেউ পারেনা বলে নারীই বোধ হয় ঈশ্বরের কাছাকাছি।’ প্রকৃত প্রেমিকা বোধ হয় ঈশ্বরের খুব কাছাকাছি থাকেন। শিকদার লিখেছেন, ‘নিঃশব্দ বারান্দা থেকে তুমি কি দেখতে চাও জানি;/ আমাদের খঞ্জ গলি মেঘভর্তী নর্তকী আকাশ,/ যেন বালা সরস্বতী জীবনের আহত ঝিলিক দিয়ে যায় সুন্দরের হাতে হাতে।/ যাকেই দেখ না তুমি আমি কিন্তু তোমাকেই দেখি, তোমাকে ছাড়া তো কিছুই দেখি না।/ সারাক্ষণ তোমার বারান্দা আর যখন থাক না নিজে, ফ্যাট বাড়িটার প্রৌঢ় ছায়া গিলে খায় চোখ দিয়ে;/ আর তুমি আসছো না যেন কত যুগ থেকে।’ (তোমার বারান্দা/ পারাবাত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা)। নাগরিক জীবনের বেড়াজালে বেড়ে উঠেছেন ঠিকই কিন্তু কখনই সিকদারের প্রেম আর দশটি সাধারণ প্রেমের কবিতার মতো সরল পথে হেঁটে যায়নি। বরং সহজভাবে তাঁর প্রেম চলে গেছে নৈসর্গিক, ঐশ্বরিক আবহে—‘পাখির চেয়ে পাখির পালকের প্রসাধন আজকাল বেশি টানে।/ তোমার টিপের নীল, খয়েরীর হতভম্ব নীরবতা মুখস্থ করেছি—!/ লাল ভালো নয়, বন্ধুদের কবিতার মতো উগ্র। যেদিন পরেছো ওই ছাই-রঙা; মৃত্যু এসেছিলো।/ তুমি ভেবেছিলে এতো হিম, না কি এর ধারণাই পবিত্র।/ ( সুলতাকে নিয়ে/ তিন পাপড়ির ফুল)। শিকদার আমিনুল হকের কবিতার মধ্যে বিশেষ একটি দিক সহজেই নির্ণয় করা যায়, তা হলো, তিনি একটি বিষয়ে একাধিক কবিতা লিখেছেন কিন্তু বিষয় এক হলেও প্রতিটি লেখার উপস্থাপনা ভিন্ন হওয়ায় তা পাঠককে প্রয়োজনের দিকে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে তার একটি বিশেষ শক্তি রয়েছে। নারী, ঈশ্বর, প্রকৃতিকে তিনি প্রেমের অনুষঙ্গ করেই ক্ষান্ত হননি লিখেছেন দক্ষ ছান্দসিক এর মতো, ‘সুলতা তুমি জলের মতো একা/ এখানে নদী মেঘের মতো কাঁপে/ অলস চোখ জলের মতো নীল/ তুমি কি আছো আগের সেই খাপে?’ (সুলতা জানে/ তিন পাপড়ির ফুল)। এমনিভাবে ছন্দের ভাণ্ডারও তিনি স্পর্শ করেছেন যাদুর কলম দিয়ে।
কলমটি অসময়ে থেমে গেছে। সংবেদনশীল মানুষেরা বোধ হয় অভিমান করলে গ্রহ বদলানোর সিদ্ধান্ত নেন! হতে পারে। তিনি গেছেন ২০০৩ সালে। সংবেদনশীল শব্দ ও বাক্যবাণে তিনি জাত পাঠকের মেধায় জায়গা করে নিয়েছেন। কাব্যে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করার পর তিনি আরও বেপরোয়া হয়েছেন, অসাধারণ শব্দসমুদ্রে ডুবেছেন ও ডুবিয়েছেন। তার একনিষ্ঠতার কারণে তিনি কাব্যে স্থায়িত্ব পেয়েছেন। সস্তা হাততালির আশায় একদিনের জন্যও কাউন সাজেননি। শিকদারের হাতে যে শক্তি ছিল, তাতে তিনি স্বকালে অনেক জনপ্রিয়তা পেতে পারতেন। কিন্তু না। একজন স্বভাবকবির দ্বারা তা কখনো সম্ভব নয়। যার কারণে মহাকাল তার কাব্যপ্রতিভাকে পরমযতেœ আগলে রাখবে।