সংস্কৃতি, চেতনা ও সময়—এই মৌল ত্রয়ীর মাঝে লুকায়িত আছে আমাদের শাশ্বত জীবনচিত্র। এর মাধ্যমেই প্রতিভাত হয়, বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ। যে রূপ বিশ্ববাসীর কাছে রূপে রূপে অপরূপ হয়ে ধরা দিয়েছে। কারণ পৃথিবীর অন্য যেকোনো জাতি অপেক্ষা আমাদের রয়েছে অধিকতর সমৃদ্ধ সংস্কৃতিগত ঐতিহ্য—যে সংস্কৃতি হাজার বছরের লালিত মূল্যবোধকে জাগ্রত করে।
সময়ের হিসাব ধরে রাখার মানসিকতা মানবসভ্যতার উন্মেষকাল থেকেই সঞ্চারিত। তাই সময়ের সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে কোনো এক শুভক্ষণে সূচনা হয় বর্ষ গণনারীতি। বর্তমানে কোনো জাতির সাংস্কৃতিক বৈভবের একটি বিশেষ দিক প্রতিফলিত হয় ওই জাতির নিজস্ব বর্ষ গণনা পদ্ধতির মাধ্যমে।
বাংলা সনের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশে ইসলামি উত্তরাধিকার সঞ্জাত থাকলেও এটি মূলত বাঙালি তথা বাংলাদেশিদের একান্তই নিজস্ব সন। কারণ এর শরীরময় জড়িয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্যগত অনুভব। অবশ্য প্রবর্তনকারীর নাম নিয়ে এখনো পণ্ডিতরা একমত হতে পারেননি। কারও কারও মতে বাংলা সনের প্রচলন করেছেন সম্রাট আকবর। কেউ কেউ আবার রাজা লক্ষণ সেনের নামও উল্লেখ করেন।
ভারত তত্ত্ববিদ আল্-বেরুনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাব-উল হিন্দ’-এ প্রাচীন ভারতবর্ষে প্রচলিত কয়েকটি প্রধান অব্দের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো—শ্রী হর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বলভাব্দ, ও গুপ্তাব্দ। পাল রাজারা সূদীর্ঘ চারশত বছর (৭৫০-১১৫০) গৌড়বঙ্গ তথা বাংলা শাসন করলেও তারা কোনো নতুন অব্দের সৃষ্টি করেননি। তবে রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে লক্ষণাব্দ নামে একটি নতুন অব্দ স্বল্পকাল প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। তবু একথা স্বীকার করতেই হবে যে, সম্রাট আকবরের আগে ভারতবর্ষে সৌরসন প্রচলিত থাকলেও কার্যত সৌর মাসের প্রচলন ছিল না। যার যথার্থ উল্লেখ আছে ‘আকবর নামা’য়-Where as in the Alamance current in India, the years were solar and the month lunar, we oreded that the months of era should be solar.
উড়িষ্যার বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং অক্সফোর্ডের ইতিহাস বিষয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত পণ্ডিত কাশী প্রসাদ জয়সোয়াল তার ইতিহাস গবেষণার আলোকে সর্বপ্রথম বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে জোরালোভাবে সম্রাট আকবরের নাম উল্লেখ করেন। অন্যদিকে বাংলার সুলতানি আমলের প্রামাণ্য ইতিহাসের লেখক সুখময় মুখোপাধ্যায় বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে সম্রাট আকবরকে স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘বঙ্গাব্দের উদ্ভব কিভাবে হয়েছিল, সে প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না’।
অবশ্য সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি মত চালু হয়েছে। সেটি হলো, আগে সবাই দেশে হিজরি সন ব্যবহার করত। হিজরি সনের বছর ছিল চন্দ্র বছর। তা ৩৫৪ দিনে সম্পন্ন হতো। ফলে ফসল কাটায় খুব অসুবিধা হতো। কারণ চাষীরা আগের বছর যে তারিখে ফসল কেটেছে, পরের বছর সে তারিখ ১১ দিন পিছিয়ে গেছে। তাই সম্রাট আকবরের সময় হিজরির যে সন ছিল, সেই সময় থেকে এক সৌরসংবৎ বা ইয়ার প্রবর্তন করেন। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মেষনাদ সাহা এবং নেবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও মনে করেন সম্রাট আকবর’ই বাংলা সনের প্রবর্তক।
সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণ এবং বাংলা সনের জন্মক্ষণ একইসূত্রে গাঁথা। কারণ সিংহাসনে আরোহণের হিজরি সনের সঙ্গে তিনি বাংলা সৌরসন জুড়ে দিয়েছিলেন। ফলে সম্রাট আকবর যত বছর আগে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন তার সঙ্গে সেই সময়ের হিজরি সন যোগ করলেই বাংলা সন পাওয়া যায়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। অর্থাৎ আজ ( ২০১০ ) থেকে ৪৫৪ বছর আগের কথা। তখন হিজরি সন ছিল ৯৬৩। ফলে আজ বাংলা সন দাঁড়ায় ( ৪৫৪+৯৬৩ ) = ১৪১৭।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর ‘নববর্ষের উৎসব ও অনুষ্ঠান’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন, ‘সম্রাট আকবরের নির্দেশে তাঁর বিখ্যাত রাজ-জ্যোতিষী পণ্ডিত ফতে উল্লাহ সিরাজীর গবেষণার ফলে বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছিল’। তিনি আরও লিখেছেন, ‘আরব দেশের নিয়মানুযায়ী বছরের প্রথম মাস মহররমের পয়লা দিন থেকে বছর ধরা হয়েছে। হিজরি সন ছিল চন্দ্র মাস’। মনে রাখতে হবে হিজরি সনেও তারিখের হেরফের হতো। অর্থাৎ সৌর বছরের হিসাবে দিন, তারিখ, মাসের প্রচুর গড়মিল লক্ষণীয়। পণ্ডিত সিরাজী তাই ৯৬৩ হিজরি= ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল, সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণ= পয়লা বৈশাখ ৯৬৩ বাংলা সন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বাদশাহ্ এক শাহী ফরমান জারির মাধ্যমে এটা রাজস্ব সন বা ফসলি সন প্রবর্তনের ঘোষণা দেন। কোথাও-কোথাও এ সন ইলাহি সন নামেও পরিচিত।
বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে গ্রহণ করা হয় শকাব্দের দ্বিতীয় মাস বৈশাখকে। আর শকাব্দের দ্বিতীয় মাস চৈত্র হয়ে যায় নতুন সনের দ্বাদশ মাস। অবশ্য নতুন সনের সাথে শকাব্দের মাসগুলো যুক্ত করা হয়।
অগ্রহায়ণ কোনো নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়
একমাত্র অগ্রহায়ণ মাস ছাড়া অন্য এগারোটি মাস এক একটি নক্ষত্রের নাম ধারণ করে আছে। যেমন, বিশাখা নক্ষত্রের নামে বৈশাখ; জেষ্ঠা নক্ষত্রের নামে জ্যৈষ্ঠ; আষাঢ়া নক্ষত্রের নামে আষাঢ়; শ্রবণ নক্ষত্রের নামে শ্রাবণ; ভাদ্রপদা নক্ষত্রের নামে ভাদ্র; অশ্বিনী নক্ষত্রের নামে আশ্বিন; কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামে কার্তিক; পুষ্যা নক্ষত্রের নামে পৌষ; মঘা নক্ষত্রের নামে মাঘ; ফাল্গুণী নক্ষত্রের নামে ফাল্গুণ; চিত্রা নক্ষত্রের নামে চৈত্র।
বাংলা সনের অষ্টম মাস অগ্রহায়ণ কোনো নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থ অগ্রবর্তী বছর। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে নববর্ষ পালিত হতো হেমন্তকালের এই মাসটির পয়লা তারিখে। নবান্নের আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষ আসত এক বিশেষ আমেজে।
তথাপি নৃ-তাত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাঙালি জাতিসত্তার উদ্ভব হয়েছে প্রায় হাজার বছর আগে। অথচ বাংলা সনের উদ্ভব মাত্র ৪৫৪ বছর আগে। এই প্রলম্বিত সময়ের জন্য বাঙালি মাত্রই আক্ষেপ হওয়া স্বাভাবিক। আর আক্ষেপটুকো আছে বলেই নববর্ষ আমাদের জীবনে নব-প্রাণ সঞ্চার করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, দলমত নির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়াতে পারি। তাই বাঙালির জনজীবনে সংস্কৃতির ঝলমলে মসলিন আবরণ।
বাংলা সনের উদ্ভব নিয়ে যত তর্ক-বিতর্কই থাকুক না কেন, সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের নাড়ির সংযোগ রয়েছে। নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিকাশমান হতে দেখা যায়। বাংলা ক্যালেন্ডার সূর্যোদয়ের প্রথম স্নিগ্ধ আলোয় স্নান করে একটি নতুন দিনের সূচনা করে। শুরু হয় বৈশাখী উৎসব। বর্ষবরণ হর্ষ। আশির দশক থেকে ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট দৃষ্টিনন্দন মঙ্গল শোভযাত্রা বের করে। রং-বেরঙের মুখোশ, প্রাণীর প্রতিকৃতি সংবলিত নজরকাড়া এই শোভযাত্রায় হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। তারা বাদ্য বাজিয়ে ঢাকা শহরের প্রধান-প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এরপর ছায়ানটের গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান জানায় রমনার বটমূলে।
ঢাকায় পয়লা বৈশাখে যে জিনিসটি সবার আগে চোখে পড়ে তা হলো, খুব ভোরে ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবি আর মেয়েরা লালপাড় সাদা শাড়ি পরে রমনার অশ্বত্থ তলে ছুটছে। ছায়ানটের অনুষ্ঠান দেখা, ইলিশ-পান্তা খাওয়া, চারুকলার শোভাযাত্রায় হারিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ, পেশার ঊর্ধ্বে উঠে এদিনে সবাই কেবলই বাঙালি হয়ে ওঠে।
এখন পয়লা বৈশাখ শুধু একটি নতুন বছরের শুরু নয়। বরং সর্বজনীন বাঙলি উৎসব, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক।
পাকিস্তান আমল থেকেই বাংলা এবং বাঙালি সংস্কৃতির ওপর বারবার আঘাত এসেছে। বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরেও এ প্রক্রিয়া থেমে নেই। নববর্ষ পালনে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। রটানো হয় কুৎসা। আর ২০০১ সালে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়া হয় অনেকগুলো সতেজ প্রাণ। তারপরেও কি বাঙালির বর্ষবরণ উৎসব থেমে গেছে? না, মোটেও তা সম্ভব হয়নি। বরং বাঙালি আরও সংবদ্ধ হয়েছে। আরও নিবিড়ভাবে আন্দোলিত-আলোড়িত হয়েছে।
পয়লা বৈশাখ সবকালেই বাঙালির উৎসবের দিন ছিল। তবে একসময় পয়লা বৈশাখ এমন সর্বজনীন উৎসব ছিল না। তখন পয়লা বৈশাখের প্রধান কাজ ছিল হালখাতা করা। চৈত্র মাসের শেষ দিনে সারাবছরের হিসাব-নিকাশ, খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। তার পরদিন তৈরি হতো নতুন বছরের নতুন হিসাবের খাতা। তাই পয়লা বৈশাখের দিন ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ন করতেন। এই প্রথাটি এখনো প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে স্বর্ণকারদের দোকানে।
শুভ নববর্ষে ঐতিহ্যগতভাবে বৈশাখী মেলা, খেলাধুলা, গঙ্গাস্নান, পূণ্যাহ, ঘোড়দৌড়, ভূমি কর্ষণ, রকমারি স্বাদু খাবার, নতুন পোশাক পরিচ্ছদ, নৃত্য, যাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে জনাব শামসুজ্জামান খান উল্লেখ করেন, ‘বাংলা সন প্রবর্তিত হওয়ার পর গ্রামীণ বাঙালির উৎসব, অনুষ্ঠান, মেলা, লৌকিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, হালখাতা, পূণ্যাহ প্রভিতি এ সনের সাথে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধার সৃষ্টি হয়নি। অর্থাৎ বাঙালির লোক জীবনের সাংস্কৃতিক ধারাকে বিচ্ছিন্ন না করে বরং জোরদার করেছে’। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মৌল সাংস্কৃতির উপাদানের সঙ্গে বাংলা সন ওতপ্রোতোভাবে মিলে গেছে বলেই এই সন আমাদের বৃহত্তর সামাজিক জীবনে এক নতুন সচলতার সৃষ্টি করেছে।
বঙ্গ সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো উদারতাবাদ। বিশ্বায়নের প্রভাবে যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরলেও বাঙালির জন্য আজও বাঙালি কাঁদে। একের বিপদে অন্যে এগিয়ে আসে। ধর্মে-ধর্মে গড়ে উঠেছে সম্প্রীতির অটুট বন্ধন। আজানের ধ্বনির সঙ্গে ভেসে আসে শাঁখের শব্দ। সীতার কাহিনি শুনে মুসলিম নারী অশ্রুসিক্ত হয়। মানুষে মানুষে রচনা করে ভালবাসার সেতুবন্ধ।
আজকের বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখে খাজনা আদায় করা না হলেও এই দিনটিতে আমরা ধনী-গরিব, ভূমালিক-বর্গচাষি, মালিক- শ্রমিক, মহাজন- ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রভৃতি সর্ম্পকের মধ্যে আত্মীয়তা গড়ে তুলতে পারি। এই দিনটিতে দল, মত নির্বিশেষে কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারি। মূলত শত-শত বছর ধরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা-কর্ণফুলির অববাহিকায় বহমান আমাদের জীবনধারা। আমাদের জীবনধারায় মিশেছে আর্য, অনার্য, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং ইউরোপীয় জীবনধারার নানা স্রোত।
সংস্কৃতি যেন প্রবহমান নদীর মতো। প্রয়োজনে সে যেমন গড়তে পারে, তেমনি ভাঙতেও পারে। বাঙালি সংস্কৃতি ভাঙাগড়ার মাঝেই অর্থাৎ গ্রহণ, বর্জন, মিশ্রণ, নির্মাণের মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। শুধু বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীর যে প্রান্তে বাঙালি ছড়িয়ে আছে, সেখানেই নববর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। তাই একমাত্র পয়লা বৈশাখই পারে বিশ্ববাঙালির মধ্যে বিশ্বভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে। যার ওপর ভিত্তি করে উন্মোচিত হবে সমৃদ্ধির নিত্য নবদিগন্ত।