সেদিন খুব বেশি দূরবর্তী অতীত নয়, যেদিন মানুষ লেখার জন্য ব্যবহার করতো পাথর, তাম্রপাত্র, তালপাতা, কলাপাতা, ভূর্জপত্র, বস্ত্রপত্র, পার্চমেন্ট, পাটের মণ্ডকাগজ—সর্বশেষ পেপিরাস থেকে আজকের কাগজ। এরই বিবর্তন ও ধারাবাহিকতায় এসে আজকে ঠেকেছে কম্পিউটার স্ক্রিনে। এরপর কোথায় যাবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না, হতেও পারে হোলেজেন স্ক্রিন কিংবা ইথারের তরঙ্গবন্দি কোনো স্ক্রিন, বাতাসেই ভেসে বেড়াবে পৃথিবীর সব তথ্য আর মানুষ আজকের কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ডিভাইস ছাড়াও অন্যকোনো মাধ্যম আবিষ্কার করে ফেলবে। অথবা এমনও হতে পারে—মানুষের মস্তিস্কের সঙ্গে কোনো ডিভাইস থাকবে যার মাধ্যমে ইথারের তরঙ্গে ভাসমান যেকোনো তথ্যই জানতে বা সংগ্রহ করতে পারবে। ছুড়ে ফেলে দেবে কম্পিউটার-মোবাইল। অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয় না।
তাম্রপাত্রের লিখনচর্চা পৃথিবীর বয়সের তুলনায় সুদূর অতীত নয়, খ্রিষ্টপূর্ব হয়তো হাজার বছরেরও কম হতে পারে। এরপর তালপাতা, ভূর্জপত্রের লেখার ইতিহাসও খুব বেশি দূরের নয়; পার্চমেন্ট ভেড়া বা ছাগলের চামড়া থেকে তৈরি ভারী কাগজের গল্প তো এই তো সেদিনের কথা—১৮৮৬ সাল থেকে ১৯৩৪ সালেও কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট এবং ভারতীয় ভাইসরয়ের সনদ এই কাগজে লিখিত ও মুদ্রিত হতো। এ সবই পৃথিবীর বয়সের তুলনায় অতি নিকট অতীতের গল্প। এরপর কাগজ, তাও নিকট অতীতে শুরু হয়ে বর্তমানেও চলছে।
আগামী একশ বছর পর কাগজ থাকে কি না, যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক অফিসকে paperless ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘোষণার ঢঙ্কা পৃথিবীব্যাপী কখন বাজবে, তা শোনার জন্য অনেকেই কান পেতে আছে। গত তিন দশকের মধ্যে প্রযুক্তির বিবর্তন ও পরিবর্তনের খেলাটা নিশ্চয়ই দৃশ্যমান। পঞ্চাশ বছর আগেও রেডিও ছিল গণমাধ্যমের একমাত্র আকর্ষণ। তাতে কবি-সাহিত্যিকরা একটি প্রোগ্রাম পেলে নিজেদের ধন্য মনে করতো—এমন নজির পাওয়া যায়। রেডিও এখন জাদুঘরে যাওয়ার পথে, যেমনটি লক্ষণীয় ক্ষুদে বার্তার ঝড়োতাণ্ডবে ডাকবাক্সের হাহাকার। ট্যাপ রেকর্ডার, ভিসিপি, ভিসিআর—এসব মাধ্যমও এখন জাদুঘরের উপাদান।
আশির দশক থেকে টিভি ছিল সব মানুষের একমাত্র শ্রেষ্ঠ বিনোদনের মাধ্যম ও আকর্ষণ। বিটিভির নাটক দেখার জন্য মানুষের আগ্রহের সীমা ছাপিয়ে যেতো। মাত্র তিন দশকের ব্যবধানে টেলিভিশন শুধুই ঘরের শোভার আসবাব, বিনোদনের জন্য ঝুঁকছে ইউটিউব, ইমো, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া ও অ্যাপসে—সিনেমা হলগুলো হয়ে গেছে সুপার মার্কেট। আর খবরের বা অন্যান্য তথ্যের জন্য ইন্টারনেটেই ক্রমে নির্ভরযোগ্য হয়েছে।
যারা সাহিত্যের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছেন, তাদের জন্য ওয়েবম্যাগ জরুরি। ওয়েবম্যাগের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত থাকতেই হবে। হাতে একটি মোবাইলফোন থাকলেই যদি তাবৎ দুনিয়ার সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়, তাহলে কাগুজে বই বহন করার প্রবণতা বাধ্য হয়েই কমে যাবে, বাড়বে ওয়েবম্যাগের ব্যাপ্তি
বিস্ময়কর হলেও সত্য—হাজার হাজার মন সিসার অক্ষর বাক্সসহ লেটারপ্রেস উধাও, হাতের লেখা সাইনবোর্ড, ফেস্টুন নেই হয়ে গেছে। এই খাতের লেখকরা কর্মহীন। এসেছে পিভিসি সিটে লেখা আর মেশিনে এক টিপেই হাজার হাজার কপি বের হচ্ছে। এখন আর প্লেট করারও প্রয়োজন হয় না, সরাসরি কম্পিউটার থেকে প্রেসে মুদ্রণ ও বাঁধাই হয়ে বের হয়ে আসে এক কমান্ডে। এই কর্মযজ্ঞের ধারণা কি দুই দশক আগেও মানুষ করেছিল?
পায়ে ঠেলে ঠেলে সেসব লেটারপ্রেস এখন জাদুঘরের ফসিল। আঁকিয়েদের অনেকেই এখন রঙতুলির ব্যবহার ভুলে গেছেন, তারা ওয়াকম দিয়েই রঙের খেলা খেলছেন কম্পিউটারে আর সেগুলোই চমৎকার মুদ্রণে আমাদের তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। প্রযুক্তির বিবর্তন ও বিকাশ হচ্ছে অতি দ্রুত। ভবিষ্যতে মানুষের চিন্তাই সরাসরি ইথারতরঙ্গে মুদ্রণের নানার রকম ফন্দি করছেন বিজ্ঞানীরা। ধারণা করা কি খুব হতাশাজনক বলে প্রতীয়মান হয়? মোটেও না।
এমনভাবে যদি প্রযুক্তি এগিয়ে যেতে থাকে, তাহলে সাহিত্যের ওয়েবম্যাগই আগামী কয়েক দশকের মধ্যে আমাদের মনে হয় সাহিত্যের মুখ্য মাধ্যম হবে। ক্রমে হারিয়ে যেতে পারে কাগজের ব্যয়বহুল মুদ্রণ। বর্তমানে ওয়েবম্যাগের পাশপাশাপাশি ই-লাইব্রেরিও বড় জায়গা দখল করে আছে। অনেক সাহিত্যানুরাগীরা ই-লাইব্রেরি ব্যবহার করার আগ্রহী। উন্নত বিশ্বে এখন ইবুক যথেষ্ট সমাদৃত ও জনপ্রিয়।
ওয়েবম্যাগ কেন সম্ভাবনাময়?
যাদের কারিগরি জ্ঞান রয়েছে, তারা ডোমেইন কিনে দুয়েকজন মিলে একটি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ পরিচালনা করতে পারেন। কাগজের মুদ্রণের জন্য যে শ্রম, মেধা ও অর্থ খরচ করতে হয়, তার চেয়ে অনেক কম ব্যয়ে ওয়েবম্যাগের নির্বাহ সম্ভব। শুধু প্রয়োজন কারিগরি জ্ঞান, দক্ষতা ও রুচিশীল বিন্যাসের। এক্ষেত্রে কারিগরি জ্ঞানের লোকেরও অভাব নেই। বাংলাদেশে আশির ওপরে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটিতেই কম্পিউটার সায়েন্সসহ ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিক্স আর্টসহ মুদ্রণশিল্প সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে। তারাও স্বল্পব্যয়ে এসব কাজ করেন বলে সাশ্রয়ী মূল্যে ওয়েবম্যাগ চালু করা সম্ভব।
কোনো সাহিত্যানুরাগীর হাতে মোবাইল সেট ও ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নন এমন কাউকে যদি পাওয়া যায়, তবে ধরে নিতে হবে তিনি অনেক পেছনে পড়ে গেছেন, সাহিত্যের দৌড়েও তিনি হেরে যাওয়ার পথে। আর যারা ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নেটিজেন, তারা কোনো না কোনোভাবে ওয়েবম্যাগ দেখেন, পড়েন কয়েকটি কারণে।
অস্বীকার করার উপায় নেই—বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক আবিষ্কার হলো গুগল ও ইউটিউব। কোনো তথ্যটি এই মাধ্যমে নেই? তাই যারা সাহিত্যের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছেন, তাদের জন্য ওয়েবম্যাগ জরুরি। ওয়েবম্যাগের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত থাকতেই হবে। হাতে একটি মোবাইলফোন থাকলেই যদি তাবৎ দুনিয়ার সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়, তাহলে কাগুজে বই বহন করার প্রবণতা বাধ্য হয়েই কমে যাবে, বাড়বে ওয়েবম্যাগের ব্যাপ্তি।
এবার আসা যাক ওয়েবম্যাগের সংকট প্রসঙ্গে।
উদারহণটা যদি টিভি চ্যানেলগুলো থেকে নেওয়া হয়, তাহলে লাগসই হয়। আজকাল মানুষ টিভির নাটক দেখার আগ্রহ কেন হারিয়ে ফেলছে? কারণ, অধিক চ্যানেল হওয়ায় মানসম্মত নাটক হচ্ছে না, কোন চ্যানেলে কী নাটক হয়, তার খোঁজ না থাকার কারণে দর্শক কমে গেছে নাটকীয়ভাবে। অতিরিক্ত হলে দক্ষ ও প্রাজ্ঞ মানুষ কোথায় পাবেন?
এই সংকট কাটানোর জন্য ভালো সম্পাদক, দায়িত্বশীল ও সাহিত্যমনীষাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যখন ওয়েবম্যাগের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, তখন অনেক ভালো লেখকও ওয়েবম্যাগের ওপর নির্ভরশীল হবেন
প্রযুক্তি যে গতিতে দৌড়াচ্ছে, মানুষের মেধা তো আর সেই গতিতে দৌড়াতে পারছে না। তাই ওয়েবম্যাগের সম্পাদক হওয়া সহজ কিন্তু সম্পাদনার কাজ অনেক কঠিন। অনেককেই বলতে শোনা যায়, ওয়েবম্যাগের সম্পাদকরা সম্পাদনা করেন না, তারা কেবল সংকলন করেন; তারা সংগ্রাহক। কথাটি মিথ্যে নয়। বাংলা ভাষার নানারূপ রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা বানান ও বাক্যগঠনে। ওয়েবম্যাগ সহজে মুদ্রণের সুযোগ থাকায় লেখা সংগ্রহ করে মুদ্রণ করার প্রবণতা যদি থাকে, তাহলে মানসম্মত লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছাবে না। এটি একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মনে হয়।
অনেক লেখক এখনো ওয়েবম্যাগে লেখা দিতে দ্বিধা-ধন্দ্বে ভোগেন—সনাতনী মনোভাবের কারণে। এছাড়া একটি কাগজে ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেলে অধিক মানুষের চোখে পড়ে এমন ধারণাও অনেক লেখক মনে পোষণ করেন। যারা লেখক তারাও জানেন, কোন ওয়েবম্যাগের সঙ্গে কোন সম্পাদক যুক্ত। তাই ভালো লেখকরা সম্পাদকের ওজন বুঝে, ব্যাপ্তি পরিমাপ করে লেখা দিয়ে থাকেন। এই সংকট কাটানোর জন্য ভালো সম্পাদক, দায়িত্বশীল ও সাহিত্যমনীষাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যখন ওয়েবম্যাগের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, তখন অনেক ভালো লেখকও ওয়েবম্যাগের ওপর নির্ভরশীল হবেন।
সর্বোপরি সাহিত্য ওয়েবম্যাগগুলো এখনো বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে পারে না। তাই নিজের খেয়ে বনের মোষ কত দিন তাড়ানো যাবে? এছাড়া, সম্মানী না দিলে ভালো লেখকরাও হয়তো এখানে ভিড়বেন না। ফলে এই উদ্যোগ মাঠে মারাও যেতে পারে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা থাকা দরকার। অন্যথায় প্রযুক্তির দৌড়ের সঙ্গে দৌড়াতে গিয়ে এই উদ্যোগটি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।