সম্প্রতি যারা বৌদ্ধিক চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আধুনিক কবিতা চর্চায় লিপ্ত রয়েছেন, তাদের মধ্যে শিবলী মোকতাদির অন্যতম। সমসাময়িক কালের এই মূল্যবোধহীন নির্বিকার সময়ে কবিতার কাছে নিজেকে এভাবে সমর্পিত করার এই স্পর্ধা শিবলী যে কিভাবে লালন করেন ভাবলে অবাক লাগে। বর্তমান এ সময়ে জীবিকার্জনের উন্নত বাস্তব সব সোপানগুলো এড়িয়ে কবিতার প্রতি এ ধরনের পিছুটান বজায় রাখা কী করে যে সম্ভব, তা অন্যের কাছে ধারণাতীত।
কবিতার জন্যে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত এই বন্ধুর পথ পরিক্রমায় শশব্যস্ত থাকতে দেখি কবি শিবলী মোকতাদিরকে। যেন কবিতা চর্চা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্র তার এখতিয়ারবহির্ভূত। প্রতিটি ক্ষণজীবনকে নানাভাবে প্রত্যক্ষ করার, ছুঁয়ে দেখার উপলব্ধি নিয়ে নির্মিত থাকে তার কবিতা।
শুধু কি কাব্যরচনা? কাব্যরচনার বাইরে কবিদের নিয়ে আড্ডা, কবি সম্মেলন, এই উপলক্ষে দেশের আনাচে-কানাচে গমন। দেশের ও বাইরের কবিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক রাখা, কোনো পুস্তিকা ছাপা, মুদ্রণ ও পরিকল্পনা সর্বত্র জড়িয়ে থাকে তার নিষ্ঠা ও শ্রম। বলাবাহুল্য বগুড়া শহর বা বগুড়া জেলার সব ধরনের ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য সমাবেশে সংগঠক হিসাবে বা সংগঠকের সহযোগী হিসাবে যে অল্পকজন সাহিত্যসেবী সর্বদা জড়িত থাকেন, শিবলী মোকতাদির তাদের মধ্যে অন্যতম।
এত বেশি আড্ডা, বহির্মুখিতা সর্বত্র থাকার আন্তর স্বভাব শিবলীর সৃজনশীলতাকে কি ব্যাহত করে না? বিঘ্ন ঘটায় না? এসব কথা মনে হয় আমাদের। কবির স্বতঃপ্রণোদিত জবাবকে তখন এভাবে বুঝতে হয় যে প্রতি মুহূর্তে যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে জীবনযাপনের ধরন, সম্পর্কের অবস্থা, তা বুঝতে হলে সমাজের সংস্পর্শে থাকা ছাড়া আর উপায়ই বা কী? এসবের জের ও তো এসে পরে কবিতায়।
শিবলী মোকতাদির কবিতার হাত ধরে নানা ধরনের পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছেন। আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছেন। আবেগে, ক্ষোভে, মমতায় নানা ধরনে সংরাগে নির্মাণ করেছেন তার কবিতার সৌধ। ক্রমে ক্রমে আমরা পেয়ে যাই এক পরিণত কবিকে। এই যাত্রা শুরুর যোগসূত্র ধরেই শিবলী মোকতাদির বিষয়, আঙ্গিক ও ভাষার বদল হয়েছে। লিটলম্যাগ ছাড়া নিজেকে প্রকাশ করেননি। একটা পর্যায়ে নির্বাচিত সাহিত্য সাময়িকী ছাড়া অন্য কোথাও নিজেকে মুদ্রিত হতে দেননি। পরবর্তী সময়ে কিছুটা ঔদার্য তার স্বভাবে বাসা বাঁধে। এরপর থেকে নিজের কবিতা ও গদ্য তিনি প্রকাশ করতে থাকেন দেশ-বিদেশের নামীদামি লিটলম্যাগ ও বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায়। এ নিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে; প্রয়াত কবি ও সম্পাদক ফারুক সিদ্দিকীর অনুরোধে ‘বিপ্রতীক’-এর একটি সংখ্যায় আধুনিক কবিতায় ছন্দবোধ নিয়ে ‘ছন্দের নান্দনিক পাঠ’ নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কবিতার ছন্দ ও সমসাময়িক কালের। অপেক্ষাকৃত নবীন কবিদের কবিতার ছন্দ নির্মাণ ছিল এ প্রবন্ধের বিষয়। ‘বিপ্রতীক’ ওই সংখ্যাটি প্রায় এক মাসের মধ্যে সব বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আরেক সংখ্যায় ওই প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল বলে শুনেছি।
‘ধানের রচনা দিলে পত্রে’ শিবলী’র প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। এর পরম্পরায় আজ অবধি তার আরও ১০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘ছন্দের নান্দনিক পাঠ’ (প্রবন্ধগ্রন্থ), নিষিদ্ধ পুষ্টির কোলাহল (কাব্যগ্রন্থ), ‘সোনার কার্তুজ’ (কাব্যগ্রন্থ), ‘রৌদ্রবঞ্চিত লোক’ (মুক্তগদ্য), ‘ব্যবহারিক বিস্ময়’ (কাব্যগ্রন্থ) ‘দুর্ভিক্ষের রাতে’ (কাব্যগ্রন্থ) কায়া ও কৌতুকী (কাব্যগ্রন্থ), ছন্দকথা (প্রবন্ধগ্রন্থ), লুপ্ত সভ্যতার দিকে (কাব্যগ্রন্থ), অন্ধের ওস্তাদি (কাব্যগ্রন্থ)। তার কবিতার প্রধান বিষয় মানুষের যাপিত জীবন ও প্রকৃতি। প্রচলিত রীতিতে কবিতা লিখতে চাননি বলেই তার কবিতার উপলব্ধিতে অভিনিবেশ ও মগ্নতার প্রয়োজন পরে। কখনো ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ ও শ্লেষের প্রতিতুলনা তিনি তার কবিতায় আভাসিত করেন। যেমন তিনি বলছেন, ‘খতিয়ানখণ্ড বগলে চেপে চলেছ কোথায়; হে বিদ্রূপ,/ হে অন্ধকুমার; তৎপর এখনই/ আমি তো জানি, যত হস্তের প্রসারিত অভিমান/ কী করে যুক্ত করেছ সেথা; ফন্দি ও ফাত্নার রসায়নে।’
এই মানচিত্রে তার এই অনিশ্চিত অভিযান এখন অবধি জায়মান রয়েছে। একজন প্রকৃত কবি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই অভিযাত্রা যতটা রোমাঞ্চকর, সাফল্য লাভ ততটাই দুরূহ। তবে সৃজনশীল প্রতিটি মানুষই উত্তীর্ণ হতে পারে তার স্বাতন্ত্র্যে, যে স্বাতন্ত্র্য অর্জন চাট্টিখানি কথা নয়, শিবলী মোকতাদিরের কবিতায় তার কিছুটা হলেও ঘ্রাণ, আভা আমি দেখতে পাই। একজন মহত কবির এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
গদ্যরীতির কাব্যবন্ধে বা মহাপয়ারের বৃত্তে শিবলী কবিতা রচনা করতে পছন্দ করেন। এসব কবিতায় কবির নিজস্ব স্মৃতির বয়ান থাকে। কখনো কখনো এতে ফ্যান্টাসি লক্ষ করা যায়। মনে হয় এভাবে কবি তার বিশ্লেষণের ব্যালান্স তৈরি করেন। বা এটা হতে পারে তার ডিফেন্স-এর শৈলী। তিনি বলছেন, ‘অথচ প্রচুর খনি ও খননের কারিগরিক রেখায় ডুবে থাকা এইসব পাপীয়-অঞ্চলে/ তুমি খুব সামান্য এক জল ও জালের মধ্যে গেঁথে রাখা বউ/ ক্রোশ আর ক্লান্তির উপযোগে ছুটে যাও চন্দ্রাহত বিস্তৃত মাঠের অন্ধকারে;/ জেগে থাকা ঠুনকো-ঠমকীত ত্রিভুজ-পল্লীর আশেপাশে।’
পরাবাস্তবতার এক ধরনের আস্তরণে ঢেকে যায় এই বর্ণনা। এ ধরনের দীর্ঘ কবিতায় সর্বোচ্চ ৮৭টি লাইনও ব্যবহৃত হতে দেখেছি আমি। যে কবিতাটি তিনি অসামান্য এক প্রতিভাবান কবি শামীম কবীরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। কিংবদন্তি বা প্রবাদের বিষয় নিয়ে কবির স্যাটায়ার যেন বিপরীতার্থক কোনো কোনো দৃশ্যের অবতারণা লক্ষ করা যায়। উদ্ভট রস উঠে আসে। যেমন, ‘ঈশান কোণে তখন জাগে ঝড়ের পরে ঝড়/ প্রবাদ-প্রথা বেষ্টিত সব আমরা পরস্পর/ জামের ডালে আম দেখেছি, কদম গাছে কেয়া/ নদীর জলে উট যদি হয় মরুতে পাই খেয়া।’
মুক্তগদ্যের ঢঙে রচনা করেছেন বেশ কিছু রচনা। রচনার কতকতা বাস্তব, অতিবাস্তব ও পরাবাস্তবধর্মী। গদ্যগুলো বহমান জীবন সম্পর্কিত হলেও অতিমাত্রায় ফ্যান্টাসিগ্রস্ত। কোনোটির কাহিনি রূপকথার আদলে নির্মিত।
শিবলী মোকতাদির এর ছোট ছোট কবিতাগুলোই সবচেয়ে রম্য ও সহজপাঠ্য। অক্ষর, শব্দ ও বাক্যের মধ্যে পরিমিতিবোধসহ এক প্রতিকী, স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তাৎপর্য, অন্তর্গত ভাবের দ্বন্দ্ব, ধাঁধা, লোকগাথা ও মিথ ইত্যাদির ব্যঞ্জনায় ভিন্ন এক অনুভূতির সৃষ্টি করে। কল্পনা ও বাস্তবতার মিশ্র প্রভাব কবিতাগুলোতে মহিমা ছড়ায়।
টানা গদ্যগুলোতে বাক্য উপস্থাপনার চাতুর্য, উপমা ও উপমানের রিভার্স উপস্থাপনা বা প্রতিতুলনা যা পাঠকের উপলব্ধির জন্য অনেক সময় সহজতর হয় না। তখন মনে হয় এ ধরনের অর্থালঙ্কার দ্বারা তিনি বিষয়ের রহস্যকে ঘনীভূত করে তোলার ক্ষেত্রে ক্যথারসিস হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বরং ছোট কবিতাগুলো বাস্তব জীবনের নানা অভিজ্ঞতার পিকারেক্স তৈরি করেছেন। কোন কোনটি ধাঁধার মতো লাগলেও রস গ্রহণে কাঁটার মতো বিঘ্ন সৃষ্টি করে না। ফ্যান্টাসির ঘোরে বিষয়কে অবলীলায় চালিয়ে দেওয়ার এই উদ্ভট টেকনিক মুক্তগদ্যগুলোকে মরুভূমির মতো উষরতা দ্বারা আবিষ্ট করেছে। ‘ব্যবহারিক বিস্ময়’ কাব্যগ্রন্থটিতে আছে একশটি ত্রিপদী। যেমন : ‘বাজারে যায় মানুষ/ ফাঁকা এবং ঝুলন্ত ব্যাগ হাতে/ পরাপাঠ্যে এদের বলে মাত্রাবৃত্তে ফানুস!’ বা ‘তালাশ করো, তালাশ করো/ চোরকে বেঁধে চৌর্য শব্দে এসে/ তৎসমভাব মর্মে রেখে তদ্ভবে ভাব গড়ো!’ এ ধরনের ত্রিপদী পয়ারের বেশ কিছু সংখ্যক ছোট কবিতা লিখেছেন কবি। নানা ধরনের ভাবনাকে একটি সংহত কাঠামোতে রজ্জুবদ্ধ করেছেন। চাবি শব্দের সম্মোহন সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি পৌঁছে যান তার কাম্য সিদ্ধান্তের অন্তর্লোকে। এ কবিতাগুলোর ভাষা, ভঙ্গি, বিন্যাস, বর্ণনা, উপমা বিভাবিত সারৎসার খুলে দেয় উপলব্ধির এক নতুন ক্ষেত্র। শিবলীর এই ছোট কবিতাগুলো নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। কবিতাগুলোতে ঠিকরে পড়েছে তার নতুন প্রত্যবেক্ষণের রীতি। কিছুটা প্রবচনধর্মীও বটে।
শিবলী মোকতাদির এভাবেই ভাব ও বিভাব ছড়িয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে স্বকীয়তার ছাপ ও ছায়া মেলে ধরার চরিত্র নিয়ে সৃষ্টিশীল রয়েছেন। শব্দ ও বাক্যের রেখায় জরিপ করে চলেছেন সমসাময়ীক কালের বৈশিষ্ট্য। কাব্য চর্চাই তার আরাধ্য জগত। এই মানচিত্রে তার এই অনিশ্চিত অভিযান এখন অবধি জায়মান রয়েছে। একজন প্রকৃত কবি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই অভিযাত্রা যতটা রোমাঞ্চকর, সাফল্য লাভ ততটাই দুরূহ। তবে সৃজনশীল প্রতিটি মানুষই উত্তীর্ণ হতে পারে তার স্বাতন্ত্র্যে, যে স্বাতন্ত্র্য অর্জন চাট্টিখানি কথা নয়, শিবলী মোকতাদিরের কবিতায় তার কিছুটা হলেও ঘ্রাণ, আভা আমি দেখতে পাই। একজন মহত কবির এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।