কবিতা ভাষানির্ভর শিল্প। ভাষার সাহায্যে আমরা সবকিছুকেই প্রকাশ করি কিংবা করতে চাই। এই ভাষা নিয়েই তো কবিতার সৃষ্টি। তাই বলে কি সাধারণ ভাষা এবং কবিতার ভাষা এক? নিশ্চয়ই নয়। গদ্যভাষা যে পরিমাণ সৌন্দর্যবোধ প্রকাশ করতে পারে, কবিতা পারে তার চেয়ে অনেক বেশি। কবিতার কাঠামোকে বিশ্লেষণ করলে তার মধ্যে সামগ্রিক ভাবে আমরা ঐক্য, সাম্য, প্রতিসাম্য, ছন্দস্পন্দন ইত্যাদি বহুবিধ সৌন্দর্য সৃষ্টিকারক আলঙ্কারিক উপাদান পাই। ভাষা সরল এবং স্পষ্ট। কবিতা অস্পষ্ট। কথাটা অন্যভাবে বললে বলতে হয় যে, কবিতা আমাদের অস্পষ্টতা এবং কল্পনা প্রতিভাকে অনুভব করিয়ে দিতে সাহায্য করে। কবিতা দ্যোতনামূলক। আবার কবিতা নানা রকম। সারা পৃথিবীব্যাপীই বিভিন্নকাল পর্বে আমরা কবিতার নানান ধারা উপধারার পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখেছি। বাংলা কবিতাও এর বাইরের নয়। নানা বাঁক পরিবর্তন করে সম্প্রতি বাংলা কবিতা যে স্তরে এসে পৌঁছেছে, তার ভেতর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। মাত্র ত্রিশ বছর আগে হাতেগোনা দু’এক জন কবির ভেতর লক্ষ্যযোগ্য ছিল। এই বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পূর্ণ নতুন আবার পুরনোও বটে। মানুষের আচার, ধর্মবোধ, পুরাণ, ঐতিহ্য লোকায়ত বিশ্বাস সবকিছুই আবার নতুন ভঙ্গিতে বিন্যাসে উঠে আসছে কবিতায়। মূল্যবোধ ভাঙছে। আসলে এ এমনই এক সময়-যা কেবলি অস্থিরতার। এখানে নিশ্চিত নিশ্চয়তা বলে কিছু নেই। ফলে কবিতা আবারও মানুষ আর মানবতার আশ্রয়ে নির্ভর হতে চায়। আর মানুষ উঠে আসে তার লোকায়ত বিশ্বাস ধর্ম মূল্যবোধ সহ একুশ শতকের চেতনার আলোকে। যে ক’জন কবিকে এই আলোয় আমরা হাঁটতে দেখি-কবি শাহিদ আনোয়ার তাদের অন্যতম।
শাহিদ আনোয়ার প্রথম গ্রন্থিত হন ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এমন একটি গ্রন্থ নিয়ে তিনি প্রথমে গ্রন্থিত হলেন। যার সঙ্গে এযাবৎ কালের পাঠকের পূর্ব পরিচয় অন্য কোনো কবির ক্ষেত্রে তো নয়ই, এমনকি শাহিদ আনোয়ারের ক্ষেত্রেও লক্ষ্যযোগ্য ছিল না। ইতোপূর্বে এ রকম প্রকরণভঙ্গির কবিতা কোথাও লেখা হয়েছে কি—না আমার জানা নেই। ‘শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে’ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি সম্পর্কে আলোচনায় যাওয়ার আগে পাঠককে জানানো প্রয়োজন যে, কবির দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের প্রায় সব কবিতাই ‘শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে’ কাব্য গ্রন্থের পূর্বে লেখা। অত্যন্ত অন্তর্মুখী, প্রচারবিমুখ ও মিতচারী এই কবি গ্রন্থভুক্তও হয়েছেন বন্ধুদের আগ্রহে। এযাবৎকালে (২০০৫) প্রকাশিত কবির তিনটি কাব্যগ্রন্থ ‘শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে’ (২০০০) কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে (২০০২) এবং ‘দাঁড়াও আমার ক্ষতি’ (২০০৫) নিয়েই আমার এই কাব্যালোচনা।
‘শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে’ গ্রন্থের কবিতাগুলোর সঙ্গে মধ্যযুগের ফার্সী কবি হাফিজের তত্ত্বগত কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও আঙ্গিক বিচারে কোনো মিল নেই। ‘শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে’-র প্রতিটি কবিতা ৮ লাইনের এবং এদের প্রত্যেকটিরই শুরু প্রথম দুই পঙ্ক্তি—‘ শুড়িখানার নুড়ির মধ্যে/একটি গোলাপ ফোটে’ দিয়ে। এই ভঙ্গিটি হাফিজে নেই। তবে হাফিজের মতো শাহিদও আল্লাহকে ঈশ্বরী বা নারী মনে করেন এবং সেই নারী তার প্রেমিকা। কিন্তু শাহিদ প্রেমিকার রূপোশ্বৈর্যে যেমন উন্মত্ত হয়েছেন তেমনি-নানাভাবে তার নিন্দাও করেছেন। যা হাফিজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। হাফিজ এর রুবাই বা গজলগুলোর গঠনও শাহিদের মতো নয়।
কবি শাহিদ আনোয়ারের আলোচ্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা ৪+৪ পঙ্ক্তিতে দুটি স্তবকে ৮+৬ মাত্রায় লেখা। কবিতাগুলো শিরোনামহীন। কবি তাদের ১, ২, ৩, ৪ করে বেঁধেছেন। যেন এক অদৃশ্য সুতোর মালা। অথবা যেন সব মিলে একটিই কবিতা ওরা। মনে হয় কবির চেতনাগত তত্ত্বটি নানারূপে নানা বিষয়ে প্রকাশ করার পরও শেষ অবধি কবির প্রকাশের তৃপ্তি শেষ হয়ে যায় না। তুমুল সেই আর্তি, সেই প্রেম, গভীর সেই না পাওয়ার বেদনা-যা ব্যাপ্ত এই মর্ত্যভূমি থেকে অন্তরীক্ষ, এই কাল থেকে এক মহাকাল পর্যন্ত। প্রতিটি কবিতা স্বরবৃত্তের চালে এক বিমুগ্ধ আবেশ তৈরি করে পাঠক হৃদয়ে। এ কাব্যে গোলাপ, মদ্য, রেণু, গোলাপ পাঁপড়ি, সুরা বেদানা, আখরোট-এ ধরনের শব্দগুলো প্রেমের আবেশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। নুড়ি-হলো প্রেমের সাধনার বিপরীতে অবস্থানকারী যাবতীয় প্রতিকূলতা।
‘শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে’ গ্রন্থের নামের মধ্যেই কবি দু’টি বৈপরীত্যকে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের প্রথম দু’টি কবিতা ১৯৯০ সালে লেখা। তারপর দীর্ঘ আট বছর কবি আর এ ধারার কোনো কবিতা না লিখলেও চেতনাটি আরও কয়েকটি কবিতাতে ভিন্নভাবে এসেছে। যা তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে (আগে লেখা) পাই। বইটির প্রথম কবিতায়:
শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে
একটি গোলাপ ফোটে
একটি রেণু গর্ভে আমার
একটি রেণু ঠোঁটে।একটি রেণু যাচ্ছে উড়ে
কালের বাড়ি-পার
পান পাত্রে-বাচ্চা বিয়োয়
মাতাল অন্ধকার।
(১নং)
কবিতাটিতে নুড়ি বা পাথরের (প্রতিকূলতা) মধ্যেই গোলাপ বা প্রেমের আবেশ বিকশিত হয়েছে। গোলাপ চূর্ণ অথবা রেণু, প্রেমেরই অংশবিশেষ—যা তিনি ইতোমধ্যেই কিছুটা পান করেছেন, কিছুটা এখনো রেখে দিয়েছেন ঠোঁটের স্বাদে (ঠোঁট-আত্মা)। এর ভেতরই প্রেমের একটি অংশ সময়ের বা কালের বাড়ি পার করে কোনো এক মহাকালে ছুটে চলেছে তার প্রেমিকার সন্ধানে, আর কবির যে পান পাত্র, যা তাকে প্রেম বা সুরা দান করে, সেখানে কেবলি মাতাল অন্ধকার বেড়ে ওঠে, সেটি কোনোভাবেই কবির প্রেমের তৃষ্ণাকে নিবৃত্ত তো করতে পারেই না বরং কবিকে একটি মোহের ঘূর্ণাবর্তে আটকে রাখে।
কবি যে কেবলি প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্যে উন্মাতাল হয়েছেন তাই নয়, কখনো কখনো না পাওয়ার আর্তিতে ক্ষোভে তার প্রতি ঘৃণারও প্রকাশ ঘটাচ্ছেন-
হাজার তারার অন্তরালে
খেলছো তুমি আকাশ ব্যালে
তোমার জন্যে আমার ঘৃণা
গাইছো কি গান ব্যালেরিনা ?
(২নং)
অন্যদিকে—
জোছনা জাগায় মদ্য তাজা
নেশার কাব্য ঘোর
রাতের শরীর দাফন করে
আকুল হলো ভোর।
( ৩নং)
‘জোছনা’ এখানে প্রেমের একটা আমেজ তৈরি করে ‘মদ্যরূপী’ প্রেম জাগিয়ে তোলে। তখন কবি প্রেমের আরাধনায় মগ্ন হন। ‘রাতের শরীর’ হলো অন্ধকার জীবন বা সময়। সেটা পার করে কবি সাধনার শীর্ষে তার দ্বিতীয় জীবনের দিকে যেতে আকুল হয়ে ওঠেন। ‘ভোর’ হচ্ছে তার প্রাপ্তি ও মুক্তির পথ। কাব্যগ্রন্থে ‘খোদা’ ‘আল্লাহ’ ‘শিব’ ‘কৃষ্ণ’-এরকম যে শব্দগুলো পাই তা মোটেই ধর্মীয় অনুষঙ্গে ব্যবহৃত হয়নি। বরং অচেনা অদেখা এক মহাশক্তি, যার প্রেমে কবি আকুল সেই প্রেয়সীকেই বোঝানো হয়েছে। কবি সমগ্র সৃষ্টি জগৎব্যাপী এক মহাশক্তির লীলায় মুগ্ধ। তাকে নানাভাবে, নানা নামে ডেকেছেন। কবির চিন্তায় সে এক ‘নির্বিকার ঈশ্বরী’। এটি পৃথিবীর কোনো ধর্মেরই অন্তর্গত নয়। কেননা, আল্লাহ বা ঈশ্বর অথবা ভগবান, কেউই তো নির্বিকার নন। তারা পাপের শাস্তি দেন আর পুণ্যের জন্যে দেন পুরস্কার। অন্যপক্ষে শাহিদ আনোয়ারের কাব্যে আমরা দেখব,তার ‘ঈশ্বরী’ একেবারেই নির্বিকার, অনেকটা স্বার্থপর ও আত্মমগ্ন। এই সৃষ্ট জগতের কোনো কিছুতেই তার কোনো কিছু এসে যায় না। কাজেই আশেক শাহিদ যতই ‘জপের মালা’ পরে, ‘গামছা ফকির’ হয়ে ‘তসবিহ্ হাতে’ নেন না কেন, সেই প্রেমিকা ধরা দেয় না। কবির তখন হতাশ উচ্চারণ—
তুমি আমার স্বর্গ ছিলে
তুমিই আমার নরক
একলা পথিক হাঁটছি; তুমি
অন্তবিহীন সড়ক।
(৫নং)
কূটাভাষ, উপমা, প্রতীক, চিত্রকল্প রূপক ব্যক্তিত্বারোপ ইত্যাদির ব্যবহারে চমৎকারিত্ব এ গ্রন্থের একটি বিশিষ্ট দিক। যেমন-
মদ্য আমার নীল সোহাগী
মদ্য আমার প্রেম
গলনালীতে যাচ্ছে ঢুকে
কাব্য মোলায়েম।
(৬ নং)
অথবা—
বৃক্ষ পাতার মর্মরেতে
তোমার সমান্তরাল
মদের ফোটা যাচ্ছে ঢেলে
আসমানী এক মরাল।
এই কবিতাগুলোর আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—গীতলধর্মিতা, আছে ধ্বনি মাধুর্যের সঙ্গে অর্থগত সাযুজ্য-ব্যঞ্জনা। কোথাও আবার প্রেমিকাকে পাওয়ার নেশা হাহাকারে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি কবিতায়ই রয়েছে এই বেদনা। কোথাও এ থেকে এতটুকু মুক্তি বা স্বস্তির খোঁজ কবি পাননি।
কোথায় তুমি, দাওনা জবাব
আর সহে না সবর
নীল কবিতার অন্ধকারে
তোমার আমার কবর।
প্রেমের বিষ পান করে কবি উপায়হীন দেখতে পান—
অমৃত কই- প্রেমের গরল
পানপাত্র ভরা
রুদ্ধ দুয়ার; অনন্তকাল
নাড়ছো তুমি কড়া।
ঈশ্বরী কেবলি কড়া নেড়ে যায়, ধরা দেয় না, কেবলি পুড়ে পুড়ে খায় কবির প্রাণপাখি। কবি যেনো তার কাছে হয়ে ওঠেন মরচে ধরা এক ‘বিষণ্ন তরবারি’। জীবনের আশ্লেষ উন্মন্থনে কবি তুলে এনেছেন বিনাশি বিষ। আর সেই বিষ সিঞ্জিত তীরে আমূলবিদ্ধ কাপালিক, অসম্পূর্ণ এবং অমানবিক বিকলাঙ্গ ঈশ্বরীর মাতাল হৃদপিণ্ড। গ্রন্থের আরেকটি অনন্য কবিতা আমরা একটু পাঠ করি:
শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে
একটি গোলাপ ফোটে
নিশিন্দা ভোর চক্ষে আমার
মহুয়া রাত ঠোঁটে।হলো ফুটো আয়ুর ঘটি
গড়িয়ে পড়ে দিন
চক্ষে তবু পিদিম জলে
ভাবনাতে রঙিন।
মাতাল রাতের অন্ধকার শেষে তপস্যায় যে ভোর কবির সামনে প্রত্যক্ষ হয়, তাও তার জন্যে খুব বেশি সুখকর হয়ে ওঠে না, কারণ সেখানেও ঘটে না প্রাপ্তি। তাই তা নিশিন্দার মতোই তেতো। এদিকে আয়ুরঘটি থেকে দিন গড়িয়ে পড়ছে, জীবন ক্ষয়মান। তবু দু’চোখে রঙিন স্বপ্ন কবিকে বিভোর করে রাখে। কিন্তু প্রেমিকা ধরা দেয় না।
‘শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে’ মূলত একটি বিরহের কাব্য। কবি তার প্রেমিকার খণ্ডাংশ, খণ্ড সৌন্দর্য দেখতে পান কিন্তু সে অধরাই থেকে যায়। জোছনার ভেতর, ঢেউয়ের শীর্ষে, ফেনার মধ্যে, বিনিদ্র তানপুরায়, লালচে কাঁচের ফুলে, খোঁপার গন্ধে সর্বত্র ঈশ্বরী প্রেমিকার রং-রূপ তিনি দেখতে পান। গ্রন্থের শেষ কবিতার প্রথমাংশ—
শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে
একটি গোলাপ ফোটে
প্রেমের বুকে ধাতব পেরেক
জেসাস হয়ে ওঠে।
এভাবে ঈশ্বরীকে পাওয়ার নানা কৌশল,স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় সাজানো চুয়াল্লিশটি কবিতা মূলত একটি সম্প্রসারিত ড্রামাটিক মনোলোগ।
তার কবিতা সম্পর্কে কবি অরুণ দাশগুপ্ত বলেন—‘কবি শাহিদ আনোয়ার মগ্নচৈতন্যের রূপকার। ক্ষণিক জীবনের মধ্যে আনন্দ আস্বাদের আকাঙ্ক্ষায় তিনি গড়ে তোলেন এক মনো পৃথিবী। আর, আকণ্ঠ জীবন পিপাসায় সেখান থেকে তুলে আনেন কখনো মাতাল অন্ধকার, কখনো আসমানি মরাল, কখনো বা নীল কবিতার সুগন্ধী কস্তুরী। তার কবিতার মনোবীজ প্রেম। মনোরাজ্যের প্রেমানুভূতিকে বিচিত্র অনুষঙ্গে তিনি ব্যক্ত করেন রহস্যময়তায়, সাংকেতিকতায়। অঘোরপন্থী প্রেমিকের মতো প্রেমের বিরাটত্বকে এক চুমুকে পান করে তিনি হন বীরাচারী প্রেমতান্ত্রিক। তার গন্তব্য হয় আসক্তি থেকে পরমানন্দে। বাংলাদেশের কবিকূল যখন একত্বের অধীন সত্তাকে অতিক্রমে প্রয়াসী তখনো কবি শাহিদ আনোয়ার একান্ত অন্তর্মুখী বিভূতিতে জীবনমদিরা পান করে জীবনরসিক হয়ে ওঠেন। আর তখন পাঠক মন পরম প্রাপ্তিতে ভরে ওঠে।’
‘কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে’ গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘ধাত্রী’। কবিতাটিতে আমাদের জাতীয় জীবনের অন্ধকার, জাতি হিসেবে বিকশিত হবার স্বপ্ন বাসনা প্রকাশিত হয়েছে। ধাত্রী যেমন একটি শিশুকে মাতৃজঠর থেকে বের করে আনে, শিশুর বন্ধ চোখের রন্ধ্রে যেমন তখন আলোকচ্ছটা ঝরে পড়ে,তেমনি জাতির ক্রান্তিলগ্নে কবি কোনো এক ধাত্রীকে আহ্বান জানাচ্ছেন, তিনি যেন এই মনোটোনাস গর্ভ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসেন। পুরো কবিতাটি অত্যন্ত আটোসাঁটো স্বরবৃত্তে লেখা—
কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে
ধাত্রী আমায় মুক্ত কখন করবে
…
উৎস থেকে আমায় ফেলো খুলে
মিথ্যা থেকে আমায় লহো তুলে
স্বপ্ন ছিঁড়ে দোলনা কাছে আনো
ধাত্রী আমায় দু’হাত ধরে টানো।
(১৯৮০)
এখানে ‘স্বপ্ন’-এর বিপরীতে ‘বাস্তবতা’ বোঝাতে ‘দোলনা’ শব্দটির প্রয়োগ অসাধারণ।
কবির জন্ম, বেড়ে ওঠা থেকে যৌবনের একটি বড় অংশ দখল করে আছে চাটগাঁর ঐতিহ্যবাহী ‘শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন।’ অসংখ্য গলি, সিঁড়ি কোঠা, টেরাকোটা কারুকাজে ভগ্নপ্রায় বাড়িটি, তার চারপাশের পরিবেশ সহ চমৎকার চিত্রকল্পে ধরা পড়েছে কবির ‘শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন’ নামে ১৯৮০ সালে লেখা দু’টি কবিতায়।
বুকের পিঁজরাসহ কেঁপে ওঠে আমাদের পুরোনো ভবন
কখনও স্বপ্নে দেখি, এ ভবন ধ্বসে পড়ে ভেঙে চুরমার
কেউ বেঁচে নেই, শুধু আমি একা
দু’হাতে সরিয়ে ধস পানকৌড়ির মতো ঘাড় তুলে চাইছি বেরুতে
…
এ ভবনে কোন মেয়ে কখনোই ছাদে যায় নাকো পাছে,
পাথরের অসভ্য গোঙানি জেগে ওঠে তেতালায়, অন্যকোন খানে
(১নং)
অথবা
চাঁদ বড় মুক্ত হস্ত, তাই
এ ভবনে প্রত্যেকে একফালি জোছনা পেতে পারে
(২নং)
দু’টো কবিতায় উঠে এসেছে ফিরিঙ্গি বাজারের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের নানা চিত্র, মদের দোকানি, রাস্তার মেয়ে, মাতাল এমনকি ‘শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবনের জীর্ণদশা, ছাদের ঘৃতকাঞ্চন পর্যন্ত।
‘কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে’র রাজনৈতিক কবিতাগুলোতে সেই সময়কার রাজনৈতিক এবং সামাজিক চিত্র পাই আমরা। ১৯৮০ সালে খুলনা জেলে নিমর্মভাবে ৩০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। কবিতাটিতে তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকারের অমানবিকতার প্রতি ঘৃণা এবং নিহতের প্রতি কবির অপরিসীম ভালোবাসার ছবি পাই আমরা:
শান্ত দু’চোখ আমার বাপের
শিকার হলো কোন সে পাপের
বুকের ওপর রক্তচাপের
চিহ্ন পড়ে আছে।
…
চোখের জলে স্নান করাবো
আঁজলা ভরে ঘাস সরাবো
কাফন দেবো, খুশবু দেবো
দে ফিরিয়ে লাশ।
কবিতাটি স্বরবৃত্তে লেখা বলে বক্তব্য জোরালো হয়ে উঠেছে।
এরশাদীয় সামরিক দুঃশাসন নিয়ে লেখা কবিতা ‘আটচল্লিশ ঘণ্টা একটানা হরতালের পর ফিরে পাওয়া স্বাভাবিক জীবন’—একটি দীর্ঘ গদ্য কবিতা:
আই হেইট,
এই রক্ত পুঁজময়, কালো, ফোস্কাবৃত
ব্যথায় কঁকিয়ে কাতর এই স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।
…
এই বাতিল জীবন
আমরা চাইনি ফেরত পেতে
…
ওরা বারবার বস্তাবন্দি এই বাতিল জীবন ফেরত পাঠাবে।
তেমনি ‘আকাশের দিকে ওড়ে লাল মাফলার’ কবিতায় রাজনৈতিক সচেতনতা আরও প্রকট। আবার কোনো কোনো প্রেমের কবিতাও হয়ে উঠেছে এই রকম সচেতনতা-নির্ভর।
তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে
শৃঙ্খল ছাড়া শোষিতের হারানোর মতো কিছু নেই
জয় করার জন্য রয়েছে সমস্ত পৃথিবী।
তুমি নিশ্চয়ই অস্বীকার করবে না
ভুলে যাওয়ার জন্যে রয়েছে আমাদের সমস্ত জীবন
আর মনে রাখবার জন্যে
মাত্র কয়েকটি চন্দ্রভূক মুহূর্ত।
(তুমি নিশ্চয়ই ’৮৫)
‘কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে’র কবিতাগুলোয় (যার বেশিরভাগই প্রথম গ্রন্থের পূর্ববর্তী রচনা) গল্প আছে, আছে উপমার মাধুর্য বিন্যাস এবং অসাধারণ শব্দ চয়ন ও সৃষ্টির নান্দনিকতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শার্টল ট্রেনে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কত চেনা-অচেনা তরুণ তরুণী মুখোমুখি বসে আসা যাওয়া করে। সেই চিত্রকল্প কবিার ভাষায়—
আমার সমুখে এক রূপবতী তরুণীর মুখ
রেলওয়ের কল্যাণে হয়ে আছি অদ্ভুত সমুখ।
…
চাইনি বেহায়া হয়ে, একবারো চোখাচোখি নয়
প্রেম নয়, কিছু নয় তবু কেন নীলাভ প্রণয়
আকাশের প্রকৃতির দু’চোখে মেঘ জমে আসে
তরুণীর চুল ওড়ে জানালায় দারুণ বাতাসে।
(১৯৮২)
ধর্মানুষঙ্গ বিভিন্নভাবে এই গ্রন্থের কবিতাগুলোতেও আমরা পাই। কোথাও সেটি তত্ত্বানুভূতি জাগায়, কোথাও বা বিষয় হিসেবে এসেছে। এক্ষেত্রে মুসলিম হিন্দু খ্রিস্টান,বৌদ্ধ—এই চারটি ধর্মের নানা দিক তার কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে। গ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা ৮০-এর দশকে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ‘ধাত্রী’ কবিতার মতো আরেকটি কবিতা ‘তপস্যা’।
হঠাৎ হাওয়ায় ফিস্ফিসানি, তন্তুছেঁড়ার শব্দ পাই
হাওয়ায় এমন সুর মেশালো দূর থেকে কে তানপুরার
…
উজল নূরের হাত দু’খানি, পদ্মিনী ঠোঁট সুন্দরীর
চোখের আলোর দীপজ্বালিয়ে বললো, কবি-বন্ধনে
জিব্রাইলের কন্যা আমি নম্রবাহুলগ্ন হও
দার্শনিকের মান ভাঙাবো একটি মহান চুম্বনে।
(১৯৮৫)
এই কবিতার নায়িকা অলৌকিকতার সীমা ছাড়িয়ে লৌকিক হয়ে পড়েছে। ধর্মানুষঙ্গ কবি যেভাবে ব্যবহার করেছেন তা ইতোপূর্বে পাঠক কোনো কবিতে তেমন বেশি লক্ষ করেননি। প্রথম গ্রন্থের মতো দ্বিতীয় গ্রন্থেও কবি গতানুগতিকতা ভেঙে নতুন একটি চিন্তায় নিজেকে স্থাপন করেছেন, যেখানে মিথের ব্যবহার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে উঠেছে এবং প্রখর কল্পনাশক্তিতে নতুন জীবনচেতনার দুয়ার খুলে গেছে। কবি সৃষ্ট জগতের,এই লোকায়ত জীবনধারার সবটুকু বোঝার চেষ্টা করার পরও ‘ঈশ্বরী এক অধরা’ থেকে যায়। তাই তিনি ক্ষুব্ধচিত্তে ‘স্বর্গকে কাঠের খড়ম’ বানাতে চান, ‘আর হাওয়াকে করেছি আমার অতৃপ্ত জায়নামাজ’ বলেন। কেননা:
তোমার স্তনাভা আগর সুষমা ভরা
মসজিদের বর্তুল গম্বুজ
অনন্তকাল আমি নক্ষত্রময় জলে অযু করতে
থাকবো প্রিয়তমা
ওই মসজিদে একদিন নামাজ পড়বো বলে।
(কবিতাকণা ১৯৯০)
‘নমরুদ’ কবিতায় ইসলামি মিথের ব্যবহার রয়েছে। তবে কবির সময়জ্ঞান এখানে সঠিকভাবে আসেনি। কেননা ‘নমরুদ’ (ফেরাউন)-এর সময় যিশু বা গৌতমবুদ্ধের আরও পূর্ববতী। কাজেই প্রেমিকা আল্লাহর আত্মাকে যিশুর ‘শেষ তবারক’ বলা অথবা আল্লাহর ‘চোখের মণিতে পোড়ে গৌতম বুদ্ধের বিষণ্ন পাঁচটি আঙুল’—এ রকম বক্তব্য সময়জ্ঞানহীন। ‘রুবাইয়াৎ (৯২) নামে তিনটি কবিতাও সুফিতত্ত্বের ভিন্নধর্মী প্রকাশ। কবির কাব্যে উঠে আসে একমহাসময়ের পরিব্যাপ্ত অস্তিত্বের উন্মোচন। একটি সমগ্রবাদী অণ্বেষণ। কোন কিছুই শেষ পর্যন্ত শেষ হয়না-শুরু হয় আবারও গোড়া থেকেই। ‘বেদনার মায়াবী ওষ্ঠে’ কবিতায় কবির এই বেদনার স্বরূপ:
তুমি নও, তোমার শরীরাংশ নয়, প্রেম নয়, হায়
চুম্বনে শুধু পাই গাঢ় বেদনাকে।’ (২০০১)
তেমনি ‘করাতে’ কবিতায়:
বিকীর্ণ বেদনা ঝরে নক্ষত্র হতে
চলো চুম্বন দিই বেদনা করাতে। (২০০১)
মিথ বাঙালির লৌকিক জীবনেরই অনুষঙ্গ। সামাজিকভাবেও এর ভূমিকা অশেষ। মানুষের আচরণ চেতনার স্তর বিকাশ মিথকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। অবচেতনার একটি স্তরে এই মিথের মটিফ তৈরি হয়েছে, যা আজও বংশ পরম্পরায় মানুষ বিশ্বাস করে। কাজেই বাঙালির এই বিশ্বাসের স্রোতকে আমরা অস্বীকার করি কী করে?
যখনই আমার পাশে আসো
আমার জমজ চোখ বুঁজে আসে মহাপ্রভু বুদ্ধের ভঙ্গিতে
ক্যাফের চেয়ারজুড়ে পদ্মাসনে বসি,
জ্বরা মৃত্যু ও ব্যধি, পুনর্জন্ম একে একে মনে পড়ে যায়
অষ্টমার্গ খেলে লুকোচুরি খেলা
মেধা ও মননে।
…
এ কেমন ব্যর্থতা, কথা বলি প্রাকৃত পালিতে।
(তুমি যখনি আমার পাশে থাকো, ১৯৮৩)
মানুষ পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। এভাবেই কবি আমাদের ঐতিহ্য, লোকায়ত ধর্মবোধ সামাজিক পুরানকথা নতুনভাবে ভাবেন এবং প্রকাশ করেন। এই পুনর্জন্মের আর্কিটাইপে কবি ফিরে তাকান বুদ্ধের নির্বাণ তত্ত্বে।
শাহিদ আনোয়ারের এই গ্রন্থের কবিতাগুলোকে কাব্য ঐতিহ্যের সঙ্গে, সমাজ ও প্রতিবেশের সঙ্গে, বিজ্ঞান, দর্শন, পুরাণের সঙ্গে ও অন্যান্য অনুষঙ্গে শ্লিষ্ট করে বিশ্লেষণ করলে তার আরও নানাবিধ মাত্রা প্রতিভাত হবে।
কবির ইসলামি ভাবানুষঙ্গের কবিতার বহিরাবরণের ভেতর থেকেই বেরিয়ে এসেছে যৌন উপলব্ধি—যা কবি আল মাহমুদ ছাড়া অন্য কোথাও খুব বেশি দৃষ্টি গোচর হয়নি। যেমন:
পরকাল ম্লান হেসে স্তনবৃন্ত থেকে ঢেলে দেয়
বাইকাল ছন্দের ম্রিয়মান গোলাবি আদর।
স্বতঃস্ফূর্ততার অনিরুদ্ধ তাগিদে বহু নতুন শব্দ, ব্যঞ্জনাময় শব্দাংশ নির্মাণ করেছেন কবি। টিএস এলিয়ট নবায়নের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে যে সুচিন্তিত মন্তব্য করেন—শাহিদের কবিতা পাঠে তা মনে পড়ে যায়। শাহিদের দ্বিতীয় গ্রন্থের নারীরা প্রথম গ্রন্থের মতো নয়। তারা প্রেমিকা, ঈশ্বরী, অলৌকিক হলেও কখনো কখনো রক্ত মাংসের গন্ধমাখা। কুটাভাস (যাকে ক্লিন্থ ব্রুক্স বলেন কবিতার অনিবার্য উপাদান) এখানেই যে, শাহিদের নায়িকা এক ভিন্ন অর্থে আদর্শায়িতা। এই আদর্শ বোদলেয়ার এর ‘কালো ভিনাস’ বা শেক্সপিয়রের ‘কৃষ্ণকেশী রমণী’র মতো নয়, মধ্যযুগের সুফি সহজিয়া সাধক কবিদের নায়িকার মতো। জীবাত্মা-পরমাত্মার এক নবতর চেতনা খেলা করে কবির ‘শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে’র সব এবং ‘কুঁকড়ে আছি মনোটোনোস গর্ভে’র কিছু কবিতার ভেতর। প্রথম গ্রন্থে কবি কেবলি নায়িকার বিভা রূপ, মাধুর্য দেখেন এবং আশেক হয়ে ওঠেন, কিন্তু দ্বিতীয় গ্রন্থের কোথাও কোথাও কবিতা অলৌকিকতার সীমা ছাড়িয়ে যেতে যেতে লৌকিক হয়ে ওঠে, দেখি নায়িকার মিনতি ঝরে পড়ে কবির কাছে।
কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দাঁড়াও আমার ক্ষতি’। ২০০১ সালে লিখিত কবিতায়ও এই নারীরূপী ঈশ্বরী প্রেমিকার উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। কবি তার প্রেমে মশগুল হন অন্তরীক্ষে এবং মর্ত্যলোকে। তার ঐশ্বর্য দেখেন, মুগ্ধ হন, কিন্তু তাকে তিনি পান না কোনোদিনই:
আরো একটি প্রেম করেছি
অন্তরীক্ষে থাকেন
লায়লা তিনি মর্ত্যালোকে
লুকিয়ে ছবি আঁকেন।
দুইটি প্রেমেই ব্যর্থতা খুব
চোখের সামনে নেই
তবুও তাদের বাসছি ভালো
আমার অজান্তেই।
(আরো একটি প্রেম করেছি ২০০১)
‘লায়লা’ শব্দটি আমরা সুফি সাহিত্যে পাই। লায়লা শব্দের অর্থ ‘কালো’। কালো বা রাত অস্পষ্ট, অধরা।
আবার ‘এক ঐশী’ কবিতার ঈশ্বর একেবারেই নশ্বর যে কিনা পঙ্গু, নুলো, নশ্বর হাতের মতো। কবির কাছে সে কখনো-কখনো হয়ে ওঠে ক্লান্তিকর। সেই নারীশ্বরের জন্যই কবি আবার আকুল—‘এক লহমায় গড়তে পারি মনোবৃন্দাবন।’ কবির ধর্মতত্ত্ব যে একান্তভাবেই তার নিজস্ব, বিশেষ কোনো ধর্মের ইঙ্গিত বাহী নয়, তা পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। কবির যেটি প্রবল প্রবণতা, ক্ষমতা তা হচ্ছে বৈপরিত্ম্যের সমন্বয়। খুব সহজেই তিনি সারল্যের সঙ্গে জটিলতার, ধর্মের সঙ্গে যৌনতার, বিপ্লবের সঙ্গে প্রেমের সমন্বয় করে ফেলতে পারেন। ‘স্বর্গকাতর নই আমি’ (২০০১) কবিতাটি একেবারেই বাস্তববাদী। কবি তথাকথিত স্বর্গে যেতে রাজি নন। কেননা স্বর্গে কোনো বৈচিত্র্য নেই, সন্তানের জন্মদান, দুঃখ-মৃত্যু ইত্যাদি নেই। সেজন্য তিনি বড় বেশি পৃথিবীকাতর। কারণ:
পৃথিবী নামের নীল গ্রহটায় স্বর্গের চেয়ে
কয়েকটি স্বাদ বেশী
শাহিদ কখনো কখনো তার ঈশ্বরীকে ‘নষ্ট মেয়ে’ হিসেবে চিহ্নিত করতেও দ্বিধা করেননি,যে কিনা কবির জীবনে ‘নীল তারকা’ হিসেবে দেখা দেয়। কবি তবু নতুনভাবে বেঁচে উঠতে চান সবুজ পরীকে নিয়ে, কারণ তার ভাগ্য বিপদ সংকুল:
রহম করো সবুজ পরী, ভালবাসার বর্ষায়
মিথ্যুক এই বছরগুলো ডুবন্ত সব নৌকো
মিথ্যা কথার নীল বেসাতি যাচ্ছে করে তারকা
ভালবাসার পিঁড়ি -পাতো-কাঁঠাল কাঠের চৌকো।
(গভীর আলোর কাটাকুটি, ২০০১)
গ্রন্থের নামাঙ্কিত কবিতাটি একটি প্রেমের কবিতা। এখানে কবি তার প্রেমিকাকে ‘ক্ষতি’ নামে ডেকেছেন।
যাচ্ছো কোথায়, দাঁড়াও আমার ক্ষতি
…
দাঁড়াও কাছে দু’খান কথা কই
জানে না যা সবার সেরা বই
যেসব কথা চূড়ান্ত লাগ সই
তেমন কথা বলতে হবে আজ।
(১৯৮৫, দাঁড়াও আমার ক্ষতি)
‘লালমরিচের ঠোঁটে’ (১৯৮৬) কবিতাটিও একটি প্রেমের কবিতা-যার নায়িকা একেবারেই রক্তমাংসে গড়া।
তরুণী তোমার দুঃখ আমাকে দাও
জ্বলজ্বলে এক আংটির মতো পরি।
এই গ্রন্থের সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক কবিতাগুলোও অনবদ্য। ‘একজন দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী’ (১৯৮৬) কবিতাটিতে কবি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিভাজিত করেছেন-রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও প্রেমের দিক থেকে। যেমন :
একজন দক্ষিণপন্থী ‘মৌলবাদী’
আমাকে বললো
আপনি একজন পাড় কমিউনিস্ট
অতএব আপনি ধর্মচ্যূত।
ওই মেয়েটির বাবা
আমাকে একজন মুসলিম ‘সন্তান’ ছাড়া
আর কিছুই ভাবে না
অতএব আমি মুসলিম ছাড়া আর কি ?
বর্ণশ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার একজন শ্বেতাঙ্গলোক
আমাকে কৃষ্ণাঙ্গ ছাড়া কিছুই ভাবে না
অতএব আমি একজন ঘৃণিত মানুষ।
আমাদের অনুভূতিকে নাড়িয়ে দেয় কবির আরেকটি কবিতা:
দাঁড়িয়ে রয়েছো তুমি বর্ষাময়তায়
মেঘের ঐশ্বর্যে বোনা গাঢ় বরষায়
তোমার গন্ধ খুঁজি বৃষ্টির জলে
জলপতনের স্বরে আচ্ছন্নতায়।
(ক্যাকটাস ২০০৪)
‘ঘণ্টাবাজে’ কবিতাটি কবি ত্রিদিব দস্তিদার এর মৃত্যুর পর পর লেখা। এর প্রথম পঙ্ক্তিটি ত্রিদিবের একটি বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে শুরু। কবিতাটিতে ত্রিদিবের প্রতি কবির ভালবাসা এবং ত্রিদিবের ব্যক্তিজীবনে প্রেমহীন কষ্টের কথা বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
কানাকড়ি দাম পেলোনা মনোবৃন্দাবন
রাধাবিহীন কৈবল্যধাম কৃষ্ণ শবাসন।
(২০০৪)
আর সকল কবির মতো শাহিদ আনোয়ারের কবিতাও কোনো সুনিয়ন্ত্রিত, শৃংখলিত নিয়মের কাছে দায়বদ্ধ নয়। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বিভেদের স্কেরোমিটারে কবিতা পরিমিত হয় না, কবিতাকে শেষ পর্যন্ত কবিতাই হয়ে উঠতে হয়। আর এজন্যেই কবিতার রয়েছে অগাধ স্বাধীনতা।
কবির স্বরবৃত্তের কবিতাগুলোয় তিনি এক গভীর সাঙ্গীতিক আবেশের নিরীক্ষা চালিয়েছেন। কবির প্রেমের সর্বত্রই ব্যর্থতাবোধ-মানবীয় কি ঈশ্বরীর প্রেম সর্বত্র ছড়ানো এই বেদনা। অস্থিরতা, মহাকালিক পরিভ্রমণ, পুনর্জন্ম, মৃত্যুচিন্তা-সত্য চিন্তার মিথোলোজিক্যাল ব্যবহারে কবি হয়ে উঠেছেন-উত্তর উপনিবেশিক ধারার এক উজ্জ্বল কবি। তাঁর কবিতার শিল্পরূপ, বাকপ্রতিমা, উপমা, উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার কবিতার শরীর ও মানসে পূর্বসুরীর প্রভাব প্রতিভাস সুদূর কিন্তু লক্ষ্যযোগ্য। অভিজ্ঞতাকে যেমন শিল্পের জারকরসে জারিত করতে হয় তেমনি শিল্পকেও অভিজ্ঞতার দ্বারা সমর্থিত হতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন জীবনের উত্তাপ ও শৈত্যকে যুগোপৎ বুকে ধারণ করা। বিচিত্র সুখ দুঃখভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া। কবি শাহিদ আনোয়ারের কবিতাগুলো সেই অভিজ্ঞতারই প্রকাশ। বিশ্বাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, পুরাণকে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় কবিতায় উপস্থাপন করা একটি কঠিন কাজ। সে কাজটি খুব সহজেই করেছেন কবি শাহিদ আনোয়ার।
জীবনের ধর্ম-প্রকাশ আর মৃত্যুর ধর্ম রহস্যাবৃত অপ্রকাশের মধ্যে। জীবনের অন্বেষায় মানুষ যে কীর্তির কোলাজ প্রতিষ্ঠিত করে, সেখানেই তার অমরতার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত। তাই জীবনের ধারা কতো যে বড়-তা কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে-তার কোনো সুরাহা নেই। এই গভীর তত্ত্বটি শাহিদের কবিতা থেকে অনুভূত হয়।
কবিতালোচনার ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যক্তিরই সীমাবদ্ধতা স্বীকার্য, এ সীমাবদ্ধতা কখনো কেবলি সময়ের কারণে, কখনো তার পাঠ, মেধা বা বিশ্লেষণ শক্তির অপ্রতুলতায়। সেক্ষেত্রে আমি খুব তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে যত্নবান হলেও এবং দৃষ্টিকে অনেকদূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত করলেও তা যে তলশায়ী হয়নি নির্দ্বিধায় সেটি স্বীকার করেও বলি—নতুন বাংলা কবিতার ধারায় কবি শাহিদ আনোয়ারের নাম অক্ষয় হয়েই থাকবে।