আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা সম্মেলন— সাহিত্য বিষয়ক সেমিনার।
প্রধান আলোচক শহীদ কাদরী ও সৈয়দ শামসুল হক। মঞ্চে বসবেন অতিথিরা। শহীদ কাদরী হুইল চেয়ারে বসেন। তাঁকে মঞ্চে নিতে হবে। আমাকে বললেন, আমি কিভাবে যাব সেখানে, ইলিয়াস! নিচেই বসি। আমি চমকে উঠলাম। বলেন কী শহীদ ভাই! হুইল চেয়ার সহ-ই আপনাকে সেখানে নেব।
আমি এগিয়ে গেলাম। সঙ্গে-সঙ্গেই আমার বন্ধুরা বাহু বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। মিথুন আহমেদ, শাহেদ চৌধুরী, এজাজ আলমসহ কয়েকজন। একমিনিটেই তাঁকে আমরা নিয়ে গেলাম মধ্যমঞ্চে।
এখানের সাহিত্যকর্মীরা তাঁর পা ছোঁওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকতেন। কী চাই শহীদ ভাই! পারসন্স বুলোবার্ডের যে অ্যাপার্টম্যান্টে তিনি থাকতেন, সেই বাগড়র দরজা ২০ ঘণ্টাই খোলা থাকতো। আড্ডা চলছেই। তা থেমে গেছে ২৮ আগস্ট ২০১৬। কবি নেই। কবি বাংলাদেশে চলে গেছেন। চলে গেছেন, আমাদের সবাইকে ছেড়ে।
হ্যাঁ। একটা অভিমান নিয়ে ১৯৭৮ সালে তিনি দেশত্যাগ করেছিলেন। কী ছিল সেই অভিমান? তা নিয়ে অনেক কথাই তিনি বলেছিলেন আমাকে। বলেছিলেন, ‘চোখের সামনেই দেখলাম অনেক কিছু দখল হয়ে গেল। অযোগ্যরা ছড়ি ঘোরাতে শুরু করলো। মেধার মূল্যায়ন কেউ করছে না। কী হবে সেই দেশ দিয়ে, যে দেশে একটি মোটা কাপড়ের শাড়ির জন্য নারীর সম্ভ্রম বিক্রি করতে হয়? যে দেশে একটি শিশু একবেলা পেট ভরে খেতে পারে না। আমি অন্যায়, অসত্য, দখলবাজি, সামরিক বুট মেনে নেইনি। নিতে পারি না। তাই দেশ ছেড়ে চলে এসেছি। কই কেউ তো জানতেও চায়নি আমি কোথায় আছি, কেমন আছি!’ তাঁর কথার কোনো জবাব দিতে পারিনি সেদিন। তা ৯০ দশকের কথা। তখন তিনি ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। অসুখ তখন তাঁর শরীরে দানা বাঁধেনি। শহীদ কাদরী তাঁর কবিতায় কী বলেছেন, তা কি আমরা আবারও পড়ব না?
বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়,
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোনো উপমায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সাথে তাদের কথাও হয়েছিল,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলা মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।
(হন্তারকদের প্রতি: শহীদ কাদরী)
এমন কিছু শোক জমা ছিল তাঁর হৃদয়ের শোকেসে। কথা উঠলেই সেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেন। তিনি চাইতেন এই প্রজন্ম ঘুরে দাঁড়াক। আমি দেখেছি, শহীদ কাদরী বলেছেন, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ-তরুণীরা আমাকে চমকে দিয়েছে। যেমনটি আমি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির মাঝে দেখেছিলাম।
যেদিন নিউইয়র্কে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মহাসমাবেশের আয়োজন চলাকালে তিনি ফোনালাপে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ভেবেই পাই না একাত্তর পরবর্তী সময়েই কেন এসব ঘাতক-দালালের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়নি।’ কবি বলেছিলেন, ‘আমরা জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল হয়। সেখানে নাৎসিদের কিভাবে বিচার করা হয়, সেটাও আমরা জানি। সেই সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিল যেসব গণিকা, তাদেরও হত্যা করা হয়। এটাই ইতিহাস। বাঙালিরা একাত্তরের ধর্ষকদের সেই শাস্তি দিতে পারেনি বলেই- আজ আমাদের এ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’
শহীদ কাদরী বলেছিলেন, ‘আমি এ প্রজন্মের কাছে ঋণ স্বীকার করে বলতে চাই, আমি খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে, বাঙালি কি আর ঘুরে দাঁড়াবে না! আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকার মানুষ এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি খুবই আশান্বিত।’ তিনি বলেছিলেন, ”সরকারের উচিত দ্রুত এ গণদাবি মেনে নিয়ে বিচারের রায় ত্বরান্বিত করা। কারণ ‘রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ’ প্রজন্মের প্রাণের দাবি।”
দৃঢ়তার সঙ্গে কবি বলেছিলেন, ‘আমি সমাবেশে যেতে পারব না ঠিকই, কিন্তু আমার আত্মিক সমর্থন থাকছে। গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি। জানি, বাঙালির জয় সুনিশ্চিত।’ কেন তিনি পরবাসী হয়েছিলেন? এর জবাবও দিয়েছেন কবিতায়। লিখেছেন:
দু’ টুকরো রুটি কিংবা লাল শানকি ভরা
এবং নক্ষত্রকুচির মতন কিছু লবণের কণা
দিগন্তের শান্ত দাওয়ায় আমাকে চাও নি তুমি দিতে-
তাই এই দীর্ঘ পরবাস।জীবনকে শ্বাপদসংকুল করে তুলেছো
এবং আমার প্রতিটি পদক্ষেপের উপর
তোমাদের তাক-করা বন্দুকের নল।
ঝোপে ঝাড়ে সরীসৃপের মতন বুকে
নিরাপদ নিভৃত কুটির খুঁজতে হয়েছে আমাকে-
তাই এই দীর্ঘ পরবাস।যা কিছু বলার ছিল দেশের-দশের কাছে
বলতে পারি নি আমি-
তাই এই পরবাস।সূর্যে-সুর্যে গাঁথা লাল মোরগের চোখের মতন
হিরন্ময় ভোরবেলাকার শুচিশুভ্রতায়
আমার বিবৃত গানগুলো
কোনো সুষমা পায় নি খুঁজে আলো-
তাই এই পরবাসযারা ধরে আছে ধর্মের ধ্বজা
তাদের শিকারি কুকুরগুলোর মুখে
ভোরের নদীর মতো সাদা আমাদের প্রিয় খরগোশগুলো
আহত-নিহত আজ এবং তারাই
প্রতিশ্রুত আজ বগ্লাহীন বাণিজ্যে
তাই বিক্রি হয়ে গেছে আমাদের সমূহ সম্ভ্রম, স্বাধীনতা, নিজস্ব আকাশ-
তাই এই দীর্ঘ পরবাস।একরোখা এক জন্মান্ধ প্রতিক্রিয়া আজ
সওয়ার হয়ে প্রগতির পিঠের ওপর
দারুণ মসৃণভাবে এগিয়ে চলেছে-
আর্তনাদ আর রক্তপাতে- ভরা অন্ধকার-প্রিয়
মধ্যযুগের দিকে তাই এই পরবাস।স্বীকার করছি আমি বৈশাখের রঙ্গালয়ে
কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে দেখেছি নৃত্যপর হলুদ-শালিক
বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গমালা থেকে
দেখেছি হিরণপয়েন্টে দশ হাজার হরিণের জ্যোৎস্না জ্বলা চোখ
দেখেছি সৈকতলগ্ন সমুদ্রর জলে ভেসে তাকা তারা মাছের স্পন্দন
নবদম্পতির চুম্বনের মতো শুনেছি বৃষ্টির ধ্বনি
বাংলা খরায়।সেই এক সময় ছিল
বাংলার পথে পথে রৌদ্রজলে সাঁঝে উষায়
অবিশ্বাস্য মৈত্রী আর ভ্রাতৃত্বের
অপার তৃপ্তি ছিল হৃদয়ে আমার
আর ছিল অপুরন্ত মিষ্টান্ন ভাণ্ডার আমাদের জীবনেক ঘিরে।
তবুর দেখেছি আমি অকাল জরায় নুয়ে পড়া
সন্ত্রাস্ত কৃষকের হাত
প্রসারিত সভ্যতার শূন্যতার দিকে।
বাংলার বিষণ্ন মানচিত্র
দেখেছি বন্ধুর মুখে,
স্বাধীনতার সৈনিক ছিল যারা
আমি দেখেছি তাদের নিঃশব্দে নিহত হতে
তাই এই দীর্ঘ পরবাস;
চিরকাল পরবাসী আমি স্বদেশে-বিদেশে।
(তাই এই দীর্ঘ পরবাস: শহীদ কাদরী)
তিনি ছিলেন কবিতার বরপুত্র। বেশি লেখার দরকার পড়েনি তাঁর। আমাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শামসুর রাহমানের উচিত ছিল এক সময় আর কবিতা না লেখা। কারণ তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করে ফেলেছিলেন অনেক আগেই। মাত্র চারটি কবিতার জনক শহীদ কাদরীর কোনো আক্ষেপ ছিল না নিজের কবিতা নিয়ে। তিনি তুষ্ট ছিলেন। একজন কবির এই আত্মবিশ্বাস না থাকলে তার লেখাই উচিত নয়- বলতেন তিনি।