এক.
‘নেই’ শব্দটির সঙ্গে আমি ঘর করছি গত দেড় দশক ধরে। স্বেচ্ছায় অবশ্যই নয়, অনন্যোপায় হয়ে। হাত কিংবা পা হারানো মানুষ যেভাবে, ক্রমে, নিজেকে মানিয়ে নেয় এই অপূরণীয় অথচ অনিবার্য বাস্তবতার সঙ্গে—অনেকটা সেভাবেই। প্রথমাবস্থায় ব্যাপারটি আমার জন্য মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। থাকার কথাও নয়। দুই অক্ষরের এই সামান্য শব্দটি তার বুকে কী বিপুল হাহাকারকে, কী অতল শূন্যতাকে, ধারণ করতে পারে তা প্রথম অনুভব করি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন আমি, এবং আমার মতো আরও অনেকেই, এতটাই আবেগতাড়িত ও শোকাচ্ছন্ন ছিলাম যে, আমাদের চোখ, কান ও চেতন (conscious) মনের কোনো সাক্ষ্যকেই গ্রাহ্য করিনি। আমাদের কালো বস্ত্র আচ্ছাদিত, আকস্মিক ও কল্পনাতীত আঘাতে প্রস্তুরীভূত মগ্নচৈতন্যের চোখ, কান ও অনুভব দিয়ে আমরা সবকিছুকে দেখতে, শুনতে ও অনুভব করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। যে-কারণে চীনা রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসা দম্পত্তির ভরপেট উল্লাস কিংবা আমলাদের যুধিষ্ঠিরীয় কায়দায় দন্ত প্রদর্শন কিংবা পথচারীদের পিঁপড়েসুলভ ত্রস্ততাকেও আমরা শোকজনিত অস্বাভাবিকতার লক্ষণ হিসেবে গণ্য করেছিলাম। সাময়িকভাবে অব্যাহতিপ্রাপ্ত চোখ, কান ও চৈতন্য তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করার আগেই আমি মুখোমুখি হই, হতে থাকি, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও অন্তহীন ‘নেই’-এর। এবং অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করি, সেই ভয়াবহ সত্যকে, যাকে আমরা জোরপর্বক অস্বীকার করতে চেয়েছিলাম, দিতে চেয়েছিলাম চির নির্বাসন। কিন্তু উচ্ছিষ্টের সন্ধানে প্রাত্যহিকতার ডাস্টবিনে নাক পর্যন্ত গুঁজে দেওয়ার আমাদের সম্মিলিত রক্তাক্ত ও করুণ প্রয়াস তাকে আরও উৎকট করে তোলে। সেই থেকে ‘নেই’-এর সঙ্গে আমার একটা আপসরফা হয়ে গেছে। আমরা সজ্ঞানেই সহাবস্থান করে চলেছি।
দুই.
এরমধ্যে পেলাম তোমার সংবাদ। আমার অভ্যস্ত জীবনবৃত্তে এই সর্বশেষ ‘নেই’-এর প্রভাব নিয়ে ভাবতে সাহস হলো না। কারণ সত্যটি আমি জানি এবং সেটি কঠিন। সেই কঠিনেরে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও তার সঙ্গেই আমার সহবাস করতে হয়, তবু আমি ভাবতে চেষ্টা করি তোমার প্রিয় এই নগরীর কথা, তোমার ইয়ারদের কথা, এবং প্রেমিকাদের কথাও (অবশ্য শেষপর্যন্ত তোমার কোনো প্রেমিকা ছিল কি না কিংবা ‘প্রেমিকা’ শব্দটিকে তুমি আদৌ গুরুত্ব দিতে কি না, তা আমার অজ্ঞাত)। শেষবার শ্যামল এক ছিপছিপে রমণীকে (তুমি মেয়েদের ‘রমণী’ বলতেই বেশি ভালোবাসতে) তোমার পাশে দেখেছিলাম। নিকোটিন ওর ঠোঁটকে অদ্ভুত এক ঔজ্জ্বল্য দিয়েছিল। ও ধূমপান করছিল এবং প্রতি দু’টান পরই সিগ্রেটটি সআঙুল তোমার ঠোঁটে লাগিয়ে দিচ্ছিল। দৃশ্যটি আমার বড় ভালো লেগেছিল। আমি মেয়েটিকে তোমার, এবং অবশ্যই সকল কবির, প্রেমিকার দুর্লভ আসনে বসিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন মনে মনে। আচ্ছা, সেই মেয়েটি কি এখন কাঁদছে? ভাবছে তোমাকে? শুধু তোমাকেই? গুনগুন করে গাইছে, ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ?’ নাকি সদ্য কেনা লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট থেকে নিকোটিনের দাগ ঢেকে দেওয়ার প্রাণান্ত প্রয়াস চালাচ্ছে? না এসব আমি ভাবতে চাই না। আমি প্রাণপণে নিজেকে, নিজের অবাধ্য চোখ দু’টিকে, ফিরিয়ে আনি পরিপার্শ্বের দিকে। নিবদ্ধ করি নগরীর চোখে, অবয়বে এবং হৃৎপিণ্ডে।
তিন.
তুমি থাকতে পূর্ব রাজাবাজারে। সেখান থেকেই তোমার অনন্ত উড্ডয়ন। আর আমি পশ্চিম রাজাবাজারে, তোমারই এক অগ্রজ প্রতিবেশীর মুখেই প্রথম শুনি তোমার অজ্ঞাতলোক যাত্রার সংবাদ। তখন রাত দশটা। চট্টগ্রামগামী কোনো বাহনের প্রতীক্ষারত এই আমি বিশ্বাসই করিনি যে, কোনো বাহন ছাড়াই তুমি, নিঃশব্দে, যাত্রা করেছ গাঢ় অমানিশায় আবৃত বিপুল সুদূরে। ঢাকা-চট্টগ্রামের সামান্য দূরত্ব অতিক্রমের ভাবনা যেখানে আমাকে একটানা ৩৬ ঘণ্টা ব্যতিব্যস্ত রেখেছে, সেখানে কোনো আড়ম্বর ছাড়াই এত দুঃসাহসিক যাত্রা তুমি কিভাবে শুরু করতে পারো? অবশ্য বরাবরই তুমি একটু অন্যরকম ছিলে। আমাদের ভাবনা-চিন্তার চেয়েও ক্ষিপ্র ছিল তোমার কর্ম, তোমার জীবনাচরণ। কিন্তু এতটা? আমরা, তোমার সমসাময়িকরা, তোমাকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলাম। সবাই চায়। সে লক্ষ্যেই তোমার ইতঃপূর্বেকার অর্জনগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে পরখ করে দেখছিলাম। এবং সেটা তুমি জানতে। আমি ঠিকই জানতাম, এবার তুমি কিছু একটা করবে। এমন কিছু—যা তোমার স্বাতন্ত্র্যকে আরও উজ্জ্বল ও অজেয় করে তুলবে; তোমাকে, তোমার অনন্যতাকে চিহ্নিত করবে সুনির্দিষ্টভাবে। তুমি কী কী করতে পারো, তার একটা সম্ভাব্য ছকও আমার চোখের পর্দায় সংরক্ষিত ছিল। তা অতিক্রমণের যথোপযুক্ত কৌশলও ঠিক করে রেখেছিল কেউ কেউ। কিন্তু তুমি সর্বশেষ যে-কাজটি করে বসলে, তা দুঃসাহসিক সন্দেহ নেই, তবে দুঃসাধ্য যে নয় তা, বোধকরি, তুমি নিজেও জানতে। এও কি জানতে যে, তুমি করে ফেলার পর দ্বিতীয়বার এই কর্ম-সম্পাদনে কেউ কেউ উদ্বুদ্ধ হলেও, এর মধ্যে নতুনত্ব বলে কিছু থাকবে না? এখানেও কি তুমি অনন্য হতে চেয়েছিলে? কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই আবুল হাসানকে বিস্মৃত হওনি। তিনি তো অনেক আগেই, আরও কম বয়সে, এই সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে আছেন। তাকে বাদ দিয়ে তোমাকে শিরোপা দিতে নিশ্চয়ই তোমার ভক্ত-অনুরক্তরাও কুণ্ঠিত হবে। অতি অবশ্যই সিলভিয়া প্লাথ ও সুকান্তসহ আরও অনেকের কথাও তাদের ভাবতে হবে। এই দিকগুলো নিশ্চয়ই তোমার মনোযোগ এড়িয়ে যায়নি। সে ক্ষেত্রে, এই সর্বশেষ কাজটিকে তুমি শিল্পের অভিধা দিতে পারো না। এবং তুমি নিশ্চয় তা চাওনি। তা হলে? তুমি কি তোমার ক্ষমতার ওপর সন্দিহান হয়ে পড়েছিলে? এমনকি কখনো তোমার মনে হয়েছিল যে, তুমি যা লিখেছো, তা-ই যথেষ্ট? কিংবা এর চেয়ে ভালো কিছু লেখা তোমার পক্ষে আর সম্ভব নয়? এসব প্রসঙ্গ নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার বহুবার আলাপ হয়েছে। শেষবার, বোধকরি, মাসদু’য়েক আগে, অসীমদার আড্ডা থেকে ফেরার পথে রিকশায় তুমি তোমার দীর্ঘ অভিমত ব্যক্ত করেছিলে। তুমি বলছিলে আমরা এ যাবৎ যা লিখেছি, তা একটা বিশেষ সময়ের, যা শ্বাসরুদ্ধকর এবং অস্থির, প্রতিচ্ছবি মাত্র। ষাটের এবং সত্তরের সব কবিই কোনো না কোনোভাবে এই সময়কে অবয়ব দানের চেষ্টা করেছে। সব জড়ো করলে হয়তো এর একটা মুল্য দাঁড়ায়, তবে এতে কবিবিশেষের স্বাতন্ত্র্যের অবকাশ খুবই কম। তোমার সঙ্গে একমত হয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, তুমি বলছিলে যে, পূর্বতন সব অবয়বই ভেঙে যাচ্ছে। এটা অবয়বহীনতার কাল। প্রকৃত শিল্প ও শিল্পীর কাজ শুরু করার এটাই প্রকষ্ট সময়। সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তুমি এও বলেছিলে, তুমি খুবই মনোযোগসহকারে ওসব পড়েছো এবং তোমার কাছে তা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু মনে হয়নি। এই দিকটাতে ভালো কিছু করার বিষয়ে তুমি ভাবছিলে। এমনকী নতুন ধরনের উপন্যাসের কথাও—যা, তোমার মতে, কেবল কবিদের পক্ষেই লেখা সম্ভব। তুমি একটি কাব্যনাট্য রচনার কাজ শেষ করেছো বলেও জানিয়েছিলে। সবচে বড় কথা, ভবিষ্যৎ সৃষ্টিশীলতার সম্ভবপরতা সম্পর্কে তুমি খুবই আশাবাদী ছিলে। অতএব, আত্মতৃপ্তি কিংবা অক্ষমতাজনিত যে দ্বিতীয় প্রশ্নটি আমাদের মনে আসে, তাকে আমরা কোনো দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারি না। তবে, তবে কি তোমার কোনো গূঢ় অভিমান ছিল অপ্রাপ্তির? উপেক্ষার? এই প্রশ্নের দুটি দিক আছে। একটি কবি হিসেবে, অন্যটি ব্যক্তি হিসেবে। কবি হিসেবে প্রাপ্তি নিয়ে তোমার কোনো ক্ষোভের কথা অন্তত আমার জ্ঞাত নয়। কারণ সমসাময়িকদের ভেতর তোমার একক প্রাপ্তির তুলনায় অন্য সবার সম্মিলিত প্রাপ্তিও যে অনেক ম্লান সেটাও তোমার অজানা ছিল না। অগ্রজ-অনুজ সবার কাছেই তুমি ঈর্ষণীয় রকমের সমাদৃত ছিলে। কখনো কখনো আমাদের এমনও মনে হয়েছে যে, তোমার সৃষ্টির চেয়ে প্রাপ্তির, অনিবার্যভাবে তোমার নিজত্বের, পাল্লাই অধিক ভারী হয়ে যাচ্ছে। সেটা তোমার শিল্পীসত্তার জন্যে ক্ষতিকর। পাঠকের কাছ থেকেও তুমি আশাতীত পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছো। যেটা, আমাদের এই বিস্মৃতিপ্রবণ দেশে, সমগ্র জীবনপাত করেও অনেকেই পাননি। সেটা তুমি যখন কিছুই লিখছো না কিংবা যা লিখছো, তা যখন তোমার পূর্বতন সৃষ্টির তুলনায় ম্লান, তখনো সমভাবে সক্রিয় ছিল। এই সেদিনও, তোমার দু’বছল আগে প্রকাশিত একটি বইয়ের আলোচনা দেখেছি অনেক ক’টি পত্রিকায়। তা অবশ্যই তোমার সৃষ্টিকর্মের চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তি রুদ্রের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। অবশ্য আমাকে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, তোমার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা সহজেই সবার মনোযোগ কেড়ে নিতো। এমনও দেখা গেছে—তোমার কবিতা পড়েনি, এমন অনেকেও তোমাকে নির্দ্ধিধায় কবি বলে স্বীকার করে নিতো। পত্রপত্রিকা বিশেষ গুরুত্বসহকারে তোমার লেখা প্রকাশ করতো, যা অনেক অগ্রজের ভাগ্যেও কদাচিৎ জুটতো। অতএব, কবি হিসেবে অপ্রাপ্তিজনিত অভিমানকে কোনোভাবেই অভিযুক্ত করা চলে না।
এরপর আসে ব্যক্তি জীবনের প্রসঙ্গ। খুব সঙ্গতকারণেই এ সম্পর্কে বিশদ জানা আমার সাধ্যাতীত ছিল। যে-টুকু জানি, তাতে বলতে পারি, কবিদের মধ্যে তুমি নিঃসন্দেহে ভেনাসের বরপুত্র। তুমি যে-মেয়েটিকে ভালোবাসতে তিনি সুন্দরী ও মেধাবী ছিলেন। এবং সচরাচর যেটা হয় না, মেয়েটি কবিতা ভালোবাসতেন, লিখতেনও। এবং তুমি সেই মেয়েটিকে পেয়েছিলে, যেটা খুব কম কবির ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। এই প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সম্পর্কে একটি নৈর্ব্যক্তিক ও নির্মোহ ধারণায় উপনীত হওয়ার মতো যথেষ্ট সময় তিনি তোমার সঙ্গে ছিলেন। যখন তিনি চলে যান—তাও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে, তখন, সার্ত্রের ভাষায়, তিনি মৃত অর্থাৎ তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে বাঁচছেন এবং তুমিই তার সর্বশেষ জীবিত ভালোবাসা পেয়েছিলে। এবং কবি হিসেবে এর বেশি সম্ভবত তুমি চাইতেও পারো না। এর আগে এবং পরেও অসংখ্য নারীর ভালোবাসা তুমি পেয়েছো। আমি তোমাকে ঈর্ষা করছি না। তবে মেয়েরা তোমাকে যে অতিমাত্রায় পছন্দ করতো এবং তুমি যে কখনোই নারীসঙ্গ বর্জিত ছিলে না, তা আমরা জানতাম। দেখা যাচ্ছে, আবুল হাসানের কিংবা হাসান হাফিজুর রহমানের ক্ষেত্রে যে অভিমানটি খুবই স্বাভাবিক ছিল, তোমার ক্ষেত্রে তা হওয়ার কথা নয়। তাহলে, তোমার সর্বশেষ কাজটিকে আমরা কিভাবে দেখবো? নিশ্চয়ই এর কোনো একটা বাস্তব ভিত্তি আছে। সেটা কী, তা জানাটা তোমার সমসাময়িকদের তো বটেই, এমনকি তোমার অনুজদের জন্য আরও বেশি জরুরি বলে আমার মনে হয়েছে।
পাঁচ.
এবার আমি যে কথাগুলো বলবো, এবং যে কথাগুলো বলার জন্য ‘পৃথিবীর চেয়ে বড়ো পোড়া এক মরুভূমি’ আমার বুকে চেপে বসে আছে, তা তোমার উপস্থিতিতে বলা আমার পক্ষে যতটা সহজ ও নিরাপদ ছিল, এখন ঠিক ততটাই দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ। আমি জানি, এই প্রতারক সমাজ ও মুখোশাবৃত সামাজিকতার প্রতি তোমার প্রচণ্ড ক্রোধ ছিল। এই ক্রোধই স্বাপ্নিক ও শ্যামল তরুণ মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে ‘রুদ্র’রূপ দিয়েছিল। এবং বাংলাদেশে না হয়ে ল্যাটিন আমেরিকায় জন্ম হলে তুমি হয়তো চে গুয়েবারার সুযোগ্য কমরেড হতে। মসি নয় অসিই হতো তোমার দ্রোহের আয়ুধ। কিন্তু এমন একটি দেশে তোমার জন্ম হয়েছে, যেখানে ‘বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে’, কিন্তু রাজনীতিক বুদ্ধিজীবীদের নয়; যেখানে, ‘হাজার মুজিব মরে/হাজার সিরাজ মরে/বেঁচে থাকে চাটুকার পা-চাটা কুকুর’; যেখানে মুহূর্তে বদলে যায় ‘রূপশালী ধান নদীটির তীর, সরল চক্ষু’ এবং প্রিয়তমা ‘স্বাতীর পৃথিবী’; যেখানে নিয়ত ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ এবং ‘ধর্ষিতার করুণ চিৎকার’। আর তাই তোমাকে হাতে তুলে নিতে হয় ‘গ্লাসে উপচানো মদ’। কিন্তু ‘এইটুকু মদ গরল পানীয় পারে না ভেজাতে ‘পৃথিবীর চেয়ে বড়ো পোড়া এক মরুভূমি’। সেই মরুভূমি যে তোমার অতিশয় কোমল বুক, তা তো আমরা জানি। আমরা এও জানি যে, তুমি ‘উপদ্রুত উপকূল’-এর বাসিন্দা; কিন্তু তোমার স্বপ্ন ‘স্বর্ণগ্রাম’-এর। তাই তুমি একের পর এক এঁকে চলো ‘মানুষের মানচিত্র’; তাই তোমার প্রিয় শিল্পী সুলতান। তাই তোমার মানুষেরা পেশীবহুল এবং আদিম ও সরল। এবং অপরাজেয়। কিন্তু তমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারো না। কেননা তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, সেটা ‘উপদ্রুত উপকূল’। এর মাটি বড় নড়বড়ে, বড়ই নাজুক। তাই তোমার প্রবল দ্রোহ ও অটল বিশ্বাসও একসময় ‘গল্প’-এর বিষয়বস্তু হয়ে যায়; একদাপ্রাপ্ত ভালোবাসার ‘সকল আকাশ’ও হয়ে যায় কালের কুয়াশায় অপস্রিয়মাণ কোনো স্মৃতি। যে-সমাজকে তুমি ভাঙতে চাও, অগ্রাহ্য করো, অস্বীকার করো—দেখা যায়, সেই সমাজ ক্রমে তোমাকে, তোমার ক্ষুরধার চৈতন্যকে, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে তার আসুরিক অক্টোপাস বাহুতে; একটু একটু করে সরিয়ে দেয় তোমার পায়ের তলার মাটি; নিংড়ে নেয় জীবনের সব নির্যাস। তুমি কি ব্যাপারটা একেবারেই আঁচ করতে পারোনি? আমার তো মনে হয়, পেরেছিলে। আমরা শুনেছি তোমার কণ্ঠে সেই আত্মসতর্কবাণী: ‘ভাঙবো বলে থমকে এখন দাঁড়িয়ে আছি রুক্ষ পথে/ভাঙবো বলে ভাঙছি এখন নিজের সীমাগণ্ডি’। তোমার এই দাঁড়িয়ে থাকাটা ওদের জন্যে বাস্তবিকই বিপজ্জনক ছিল। তাই ওরা তোমার আত্মজয়ের তপস্যাকে নস্যাৎ করার জন্য তোমার দিকে বাড়িয়ে দেয় আত্মহননের হলাহল। অবশ্যই মেনকা-ঊর্বশী ও নন্দীভৃঙ্গির সহায়তা ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। এবং ওরা যে এ-ধরনের ষড়যন্ত্র করবে সেটা তো তুমি জানতে। নয়তো তুমি ‘রুদ্র’ কেন? ওরা তোমার দুর্বলতার ফাঁকফোকর খুঁজবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কারণ সত্যিকারের দ্রোহকে লৌকিক কিংবা অলৌকিক কোনো দেবতাই কোনোকালে পছন্দ করেনি। সে জন্যই লখিন্দরের লৌহবাসরে বারবার কালনাগ প্রেরিত হবে, চাঁদ সওদাগরের ডিঙি নিমজ্জিত হবে, আর প্রমিথিউসের যকৃত জেউসের ঈগলেরা ঠুকরে খাবে—এটাই তো প্রত্যাশিত। কিন্তু আমাদের সান্ত্বনাবর্জিত যে-কষ্ট, প্রতিকারহীন যে-হাহাকার, তা হচ্ছে, তুমি এতো অল্পেই পরাস্ত হলে কেন? তোমার কাছে আমরা ‘রুদ্র’ত্বই আশা করেছিলাম এবং সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? তিলোত্তমারা তোমার চতুষ্পার্শ্বে নিতম্বে ঢেউ তুলবে; কিন্তু তোমার চোখের পলকটুকুও পড়বে না। তুমি ‘স্থাণু’ নামে নিন্দিত অথবা নন্দিত হবে। তাতে তোমার কিছু আসে যাবে না। কারণ নিন্দা বা প্রশংসা তোমার লক্ষ্য নয়, তোমার লক্ষ্য তো এই সমাজ এবং তার মোড়লদের সব ষড়যন্ত্র পরাস্ত করা। পৃথিবী-মন্থনজাত সকল পাপ ও গরল পান করে তুমি নীলকণ্ঠ হবে, বিরল সিদ্ধি খেয়ে তুমি বুঁদ হয়ে থাকবে; কিন্তু সিদ্ধি তোমাকে খাবে না। তোমার তৃতীয় নেত্রের চকিত উন্মোচনে মদন ভস্ম হবে। কাম-ক্রোধ-আসঙ্গ-নন্দীভৃঙ্গি সবাই সানন্দে তোমার শিষ্যত্ব বরণ করে নেবে। আর তুমি তুরীয়ানন্দে নটরাজ হয়ে নাচবে। তোমার নৃত্য মূঢ়তার শিলাখণ্ডকেও জাগিয়ে তুলবে। তুমি গাইবে, তোমার গানে বাধার বিন্ধ্যাচল বিগলিত হবে। এই, এই সবই তো প্রত্যাশিত ছিল তোমার কাছে। কিন্তু তুমি এ কী করলে? ‘রুদ্র’ পরাজিত হলে, কূলে একা পড়ে থাকা ছাড়া, আমাদের জন্য কোথায় ভরসা?
ছয়.
ভরসার খড়কুটোর সন্ধানে আমি আবার ফিরে আসি তোমার প্রিয় ও পরিত্যক্ত এই নগরে। এই ‘উপদ্রুত উপকূলে’। মধ্যরাতে নগরীর গরল আকণ্ঠ পান করে তুমি যে-পথ দিয়ে ফিরতে সিংহাসনচ্যুত সম্রাটের মতো, আমি সেই পথ ধরে হাঁটতে থাকি উৎসের দিকে। ‘গোল্ডেন ড্রাগন’-এর সামনে গাড়িদের ভিড় লেগেছিল। রূপসী রমণীরা বিত্তজয়ী পুরুষদের বগলে নাক গুঁজে সহাস্যে নেমে আসছিল পরিতৃপ্তির শিখর বেয়ে। কলাবাগান থেকে গাউসিয়া পর্যন্ত সবক’টি মার্কেট গমগম করছিল। নিতম্বদোলানো নারীদের পেছনে তাদের ভূরিগর্বী পুরুষেরা হাঁস-ফাঁস করে ছুটছিল। সড়কের দুরারোগ্য ক্ষতে জমে থাকা রক্ত-পুঁজ ছিটাতে ছিটাতে উড়ছিল মন্ত্রিদের গাড়ি। রিকশাচালক শিস ছুঁড়ে দিচ্ছিল গার্মেন্টস্-ফেরৎ শীর্ণকায়, করুণ মেয়েদের উদ্দেশে। শাহবাগের আড্ডাগুলোতে তখনো ভিড় ছিল। আমি ছুটে গিয়েছিলাম ‘সাকুরা’র দিকে। (একমাত্র বুঝি সেই ই তোমাকে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল, আহা, ঢাকার বনলতা সেন!) কেবল ওটাই নিস্তব্ধ ছিল। তবে তোমার জন্য নয়, শুক্রবার বলেই, এবং অতি অবশ্যই আলখেল্লাধারী খাসোগীদের সন্তুষ্টির জন্যই। এটাই আসল। আমি সাহস পাই নি ‘ইত্যাদি’র দিকে যাওয়ার। এলিফ্যান্ট রোড তখনো ঝলমল করছিল। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, ‘হে নির্বিকার শহর, হে পরিতৃপ্ত রমণীরা-পুরুষেরা, তোমরা কী জানো না রুদ্র নেই? হ্যাঁ রুদ্র, যে তোমাদের জন্য গান গেয়ে বেড়াতো; যে তোমাদের মেদমাংসের অন্ধকার থেকে এই নগরকে, এই জনপদকে, বাঁচানোর জন্য নিজের প্রতিবিন্দু রক্তে আগুন ধরিয়ে দিতো।’ আমি বলতে চেয়েছিলাম, ‘রুদ্র নেই, সব বন্ধ করে দাও। সব। আজ কোনো বাতি জ্বলবে না; কোনো গাড়ি চলবে না। আজ শুধু পানশালাগুলো খোলা থাকবে। আজ শুধু পবিত্র গণিকারা জেগে থাকবে।’ কিন্তু কিছুই বলতে পারি নি। কিছুই না। শুধু নতমুখে ফিরে গিয়েছিলাম, রাজাবাজার-সংসদ ভবন পার হয়ে, অভ্যস্ত জীবনের খোয়াড়ে। তবু, তুমি বেঁচে গেছো। তোমাকে আর কোনো রাজা, আর কোনো সংসদ পার হতে হবে না। বলতে হবে না, ‘ও মন, আমি আর পারি না’।
সাত.
রুদ্র, তুমি কি তোমার আত্মাহুতি দিয়ে থমকে দিতে চেয়েছিলে ওদের? আকর্ষণ করতে চেয়েছিলে স্বর্ণশিকারীদের মনোযোগ? দু’দণ্ড ওদেরকে দাঁড় করাতে চেয়েছিলে নিজেদের মুখোমুখি? সব বৃথা, রুদ্র, সবই বৃথা। অসংখ্য মৃত্যু দিয়েই যে এই নগরের, এই স্বর্ণশিকারীদের, দেহমন পুষ্ট হয় এই সত্য তো তোমার অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। ওদের পরিতৃপ্ত জীবনের নির্বোধ প্রাচীরে সামান্য কম্পনও তুমি জাগাতে পারোনি। ২৯ এপ্রিলের (১৯৯১) মহাদুর্যোগে লক্ষ লক্ষ নির্দোষ প্রাণের আত্মাহুতি যেখানে কিছুই করতে পারেনি, সেখানে তুমি একা পারবে কেন? বরং তোমার মৃত্যু ওদেরকে আরও প্রগাঢ় তৃপ্তির দিকে নিয়ে যাবে। কারণ ওরা সবসময় এমনটিই আশা করে। ওরা তৃপ্ত। ওরা এখন তোমার জন্য বাণী দেবে। তোমার স্তূতি গাইবে। তুমি যা নও, তা-ই তোমাকে বানাতে চাইবে। কিন্তু এতে তোমার উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। মনে রাখবে, ওদের আতিশয্যের মাত্রা যত প্রবল হবে, বিস্মৃতিও তত ত্বরান্বিত হবে। এটা তোমার জন্য নয়, ওদের স্বাস্থ্যের জন্যই অত্যাবশ্যক। ওরা বৈচিত্র্য খোঁজে, কখনো উদরপূর্তিতে, কখনো সঙ্গমে, এবং প্রায়শ তোমার মতো দ্রোহের অকাল নির্বাপণে। এইভাবে ওরা ওদের চারপাশের নির্বোধের প্রাচীরটাকে সব আঘাত ও আঘাতের আশঙ্কা থেকে মুক্ত রাখে। তুমি হেরে গেছ, রুদ্র, বড় বেশি হেরে গেছ। হারিয়ে দিয়েছ আমাদেরও।
আট.
রুদ্র, তুমি নেই, আমি আছি। কিন্তু তোমার না-থাকা আর আমার থাকার মধ্যে কোনটি ভালো, তা নিশ্চিত করে বলার মতো দৃঢ়তা আমার নেই। সক্রেটিসের ঈশ্বর ছিল, তাই পরম বিশ্বাসে এই দু’য়ের মধ্যে ভালোমন্দ নির্ধারণের ভার তিনি ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দিয়ে মুক্ত হতে পেরেছিলেন। কিন্তু সক্রেটিসের মতো বিশ্বাসের অখণ্ডতা আমার কোথায়? আমি কি ঈশ্বর সম্বন্ধে অতটা নিঃসন্ধিগ্ধ? কিংবা ঈশ্বর কি আমার ওপর অতটা আস্থাশীল যে, আমি চাপিয়ে দিলেই তিনি সে দায়িত্ব মাথা পেতে নেবেন! আমি কি উল্লসিত হবো তোমার আসনটি শূন্য হয়েছে বলে? নাকি শোকার্ত হবো তোমার পরিণতির অনিবার্যতা ভেবে? না, আমিও আর পারি না। আমি শুধু এইটুকু জানি, আমি-তুমি-আমরা, ভারতির ব্যর্থ প্রেমিকরা, একা। বড় একা। জীবন-মৃত্যু কেউ আমাদের প্রেমিকা নয়। আমাদের কোনো ত্রাণকর্তা বা কর্ত্রী নেই। আমরা মানুষের জন্য আলোক ছিনিয়ে আনি, কিন্তু আমরা আলোকপ্রাপ্তদের কেউ নই। তবু আমাদের বেঁচে থাকতে হবে—কারণ মৃত্যুর প্রতি আমাদের কোনো আসক্তি নেই কিংবা জীবনও যে আঁকড়ে ধরার মতো কিছু নয় তাও আমরা জেনে গেছি। আমাদের বেঁচে থাকতে হবে—কারণ জীবন ও মৃত্যু উভয়ের প্রতি সমান নিরাসক্তি একমাত্র আমরাই প্রদর্শন করতে পারি। আমাদের বেঁচে থাকতে হবে—কারণ একমাত্র আমরাই স্বর্ণশিকারীদের, এবং তাদের রক্ষিতা এই সমাজের, আত্মতৃপ্তির নির্বোধ প্রাচীরকে হাস্যকরভাবে অর্থহীন করে তুলতে পারি আমাদের উপেক্ষা দিয়ে। আমাদের বেঁচে থাকতে হবে—এই ফাঁপা মানুষ ও অধিকতর ফাঁপা পৃথিবীর প্রতি আরো বড়ো ও তাৎপর্যময় বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শনের জন্য। রুদ্র, তোমার অনন্য ও দ্রোহী বৃদ্ধাঙ্গুলির শূন্যতা বহুদিন অপূর্ণই থাকবে; অন্তত আমাদের কাছে।