[এজরা পাউন্ড (৩০ অক্টোবর ১৮৮৫-১ নভেম্বর ১৯৭২) একজন আমেরিকান কবি। সাহিত্য সমালোচক। তাকে বলা হয় আধুনিক মার্কিন কাব্য আন্দোলনের পুরোধা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করার কারণে তিনি গোটা দুনিয়ার সাহিত্যমোদীদের কাছে সমালোচিত হয়েছিলেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে লন্ডনে তিনি বেশ কিছুদিন মার্কিন সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত থাকার কারণে তিনি টিএসএলিয়ট, রবার্ট ফ্রস্ট, জেমস জয়েস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। এসময় তাদের কাজ নতুন দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেন। ]
ঐতিহাসিক কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এজরা পাউন্ডের সাক্ষাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। প্রথম কারণ হলো সময়। ভাবুন বিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপ যখন শিল্প সাহিত্যের উর্বর ভূমি, তখন সেখানে ভারতের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তেমন কোনো উপস্থিতি ছিল না। অথচ রবীন্দ্রনাথ কবিতায় ও গানে ভারতবর্ষ তো বটেই গোটা পৃথিবীতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কবিগুরু নিজেও শিল্প ও সাহিত্যের বিশ্বায়নে বিশ্বাসী ছিলেন। এজরা পাউন্ডের মধ্যস্থতায় আর পয়েট্রি পত্রিকার কারণে সেই শূন্যস্থানটি পুরণ হতে পেরেছিল। সাহিত্যেরও বিশ্বায়ন ঘটেছিল। দ্বিতীয়ত কারণ হলো মনরো সম্পাদিত ‘পয়েট্রি’ ম্যাগাজিনে রবীন্দ্রনাথের ছয়টি কবিতা ছাপা হওয়া। এরমাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমের এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধনের সুযোগ তৈরি হলো। পূর্ব আর পশ্চিমের এই মেলবন্ধনটি সে সময় খুব জরুইর ছিল। ভুলে গেলে চলবে না, ওই সময় ভারত ছিল বিলেতের ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট একটি দেশ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনায় উচ্চকিত। এই অস্থির সময়ে ‘পয়েট্রি’তে তার নিজের অনূদিত ছয়টি কবিতা স্থান পাওয়া ওই সময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বলা যেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ‘পয়েট্রি’তে রবীন্দ্রনাথের ছয়টি কবিতা ছাপানোর পেছনের যিনি মূল ভূমিকাটি পালন করেন, তিনি কবি এজরা পাউন্ড।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এজরা পাউন্ডের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯১২ সালের ৭ জুলাই লন্ডনের সুপরিচিত মুখ, শিল্পী ও একইসঙ্গে ভারতীয় সংঘের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম রোথেনস্টাইনের বাড়িতে। রোথেনস্টাইন ভারতীয় সংস্কৃতিকে আঁকড়ে পড়ে থাকা লোক। একইসঙ্গে কবির একজন অন্ধ ভক্তও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেতে গেলে তার বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করবেন, এইটাই ছিল স্বাভাবিক চল। সেদিন রোথেনস্টাইনের বাড়িতে বেশ আয়োজন করে এক বৈকালিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ‘টেগর সন্ধ্যা’য় অংশ নেওয়ার জন্য তিনি বিলেতের প্রথম সারির কিছু সাহিত্যিক ও অনেক গণমান্য লোককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই আমন্ত্রিত অতিথিদের মাঝে ছিলেন ইয়েটস ও এজরা পাউন্ড। রথেনস্টাইনের একটি ব্যক্তিগত রোজনামচায় লিখেছেন, ‘‘একজন তরুণ কবি আমাদের ‘টেগর সন্ধ্যায়’ যোগ দেন এবং ঠিক কবিগুরুর পায়ের কাছে তিনি একটি আসন পেতে বসেন। তার নাম এজরা পাউন্ড।’
এজরা পাউন্ডের সঙ্গে কবিগুরুর সেদিনের পারস্পরিক পরিচয় নানারকম গুরুত্ব বহন করে। সেদিনের সেই ‘টেগর সন্ধ্যা’য় কবি ইয়েটস কবিগুরুর নিজের বাংলা থেকে ইংরেজিতে তর্জমা করা অনেক কবিতা উপস্থিত অতিথিদের পাঠ করে শোনান। প্রতিটি কবিতা এজরা পাউন্ড মনযোগ দিয়ে শুনে সঙ্গে সঙ্গে একজন রবীন্দ্রভক্ত হয়ে পড়েন এবং তার এক প্রবন্ধে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাকে গ্রিক পুরান এবং দান্তের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি লেখেন, ‘আমরা গোটা কয়েক সৌভাগ্যবান, যারা মিস্টার টেগরের কাজের সঙ্গে পূর্বপরিচিত ছিলাম। যাঁর কাজ সম্পর্কে আমাদের আগেই একটা ধারণা হয়েছিল।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যে পাউন্ড ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভুক্ত হয়ে পড়েন। তার এই কবিতার রেণু পশ্চিমা বাতাসেও ছড়িয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগে যান। তিনি তৎকালীন আমেরিকার বিখ্যাত লিটলম্যাগ সম্পাদক হেরিয়েট মনরোকে একটি চিঠি লিখবেন বলে ভাবছিলেন। তার আগেই ১৯১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি মিসেস মনরোকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজ নিয়ে বিশদভাবে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে লেখেন, ‘‘আমি ইতোমধ্যেই এই বিষয়টি জানিয়ে ইয়েটসকে লিখেছি। তার কাছ থেকে পত্র মারফত কিছু প্রত্যাশা করা খুব কঠিন একটি কাজ এবং তিনি এই মুহূর্তে (নভেম্বরের আগ পর্যন্ত) লন্ডনে ফিরেও আসবেন না। তথাপি আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু কুলোয় তাই করার চেষ্টা করছি। এটি তার কাছে আমার প্রথম কিছু চাওয়া যা আমি গত তিন বছর ধরে তার কাছে ধরনা দিয়ে চলেছিলাম। আমি তার সঙ্গে ‘কথা বলার পারিবেশ তৈরি করতে চাই। পাশাপাশি আমি চেষ্টা করবো, বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু কবিতা এই শীতের সংখ্যায় ‘পয়েট্রি’তে তুলে ধরতে। ইয়েটস এই বিষয় নিয়ে একটি পরিচিতি লিখছে। কবিতাগুলো লেখক কর্তৃক খুব সুন্দর এবং কাব্যিকভাবে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন কবি স্বয়ং।’’
এর কয়েক সপ্তাহ পর এজরা পাউন্ড আবার মিসেস মনরোকে খুব উত্তেজিত হয়ে একটি চিঠ লিখলেন। এবার তিনি বেশ আনন্দিত এবং তার হাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কয়েকটা কবিতা চলে এসেছে। তিনি সে কবিতাগুলো ‘পয়েট্রি’র পরবর্তী (ডিসেম্বর) সংখ্যায় ছাপাতে আগ্রহী। পাউন্ড বিশ্বাস করতে চাইলেন, ভারতীয় কবির এই কবিতাগুলো সন্দেহাতীতভাবে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় ব্যাপক সাড়া ফেলে দেবে। তিনি চিঠিতে মিসেস মনরোকে লিখলেন, ‘এই তো সুযোগ। আগামী সংখ্যায় টেগরের জন্য একটা পাতা আগেই যেন বরাদ্ধ থাকে। তিনি বাংলায় অসংখ্য গান তৈরি করছেন এবং ইংরেজি তর্জমায় তার কবিতাগুলো অসাধারণ। ইয়েটস মুখবন্ধটি লিখছেন। আমেরিকার কপিরাইট আমাদেরই থাকছে। সাহিত্যের অভ্যন্তরীণ যে শিহরণটি থাকে, যা এখানে ঠিক পাওয়া যায় না, আমি যেন টেগরের কবিতায় তাই ঠিক টের পাচ্ছি। আমরা তার (রবি ঠাকুর) ছয়টি কবিতা পাচ্ছি যা অন্যকেউ কখনো পায়নি।’
বলে রাখা ভালো যে, ১২ ডিসেম্বর সংখ্যায় পাউন্ড খুব কৃতিত্বের সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথে ঠাকুরের ছয়টি কবিতা ‘পয়েট্রি’ পত্রিকায় ছেপেছিলেন। পাশাপাশি তিনি রবি ঠাকুরের ওপর দীর্ঘ একটি প্রবন্ধও জুড়ে দিয়েছিলেন। ছয়টি কবিতাই ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে নেওয়া যা কবি নিজেই বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে ইংরেজিতে প্রকাশিত কবিগুরুর কবিতাগুলো ১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে ‘ইন্ডিয়া সোসাইটি’ প্রকাশ করে এবং স্বত্ব ধরে রাখে।
এজরা পাউন্ড ও মিসেস মনরো দুজনেই আরও বেশি আনন্দি হয়েছিলেন এ কারণেই যে, ‘পয়েট্রি’তে প্রকাশিত এই ছয়টি কবিতাই প্রথম পশ্চিমের কোনো কাগজে ছাপা হওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম কবিতা। এবার ‘পয়েট্রি’ পত্রিকায় প্রকাশিত কবিগুরুর কবিতার পাশাপাশি এজরা পাউন্ড নিজেও তার একটি প্রবন্ধ সে ম্যাগাজিনে জুড়ে দেন। পাউন্ডের প্রবন্ধের দিকে এবার চোখ রাখা যাক। পাউন্ড তার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা যা তিনি বাংলা থেকে ইংরেজিতে তর্জমা করেছেন। আজকের বিশেষ এই ইংরেজি কাব্য এবং গোটা পৃথিবীর কাব্য-ইতিহাসে এটি এক অনন্য ইতিহাস।’ তার রচনার বেশির ভাগ অংশজুড়েই তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন এবং কেন তিনি কবিতাগুলো সে সময়ের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ তারও ব্যাখ্যা দেন। পাউন্ডের ভাষায়, ‘আমার জানামতে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা অসাধারণ একটি কাজ।’ তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার উপমায় শিল্পের উপস্থিতিকে বারবার নিয়ে আসেন। পাউন্ড শুধু কবিতার উপস্থিতি দেখেই খুশি হননি বরং পাশাপাশি তিনি কবির কবিতায় আধ্যাত্মিক যে সুরটি নিরন্তর ঘুরেফিরে আসছে সেটি পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের অন্তরাত্মাতেও যে অসাধরণ সুধা হয়ে ধরা পড়বে সেটিও উল্লেখ করেন। এজরা পাউন্ড টেগরের কবিতার প্রতিটা শব্দে নিখুঁত এক শিল্পকর্মের রেখাচিত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। পাউন্ডের ভাষায়, ‘আপনি যদি ট্রোওবাডোরাস-এর শিল্পকর্মকে নিখুঁতভাবে সামনে নিয়ে আসেন এবং তার সঙ্গে প্লিয়েডাকে মিশ্রণ করেন। সে মিশ্রণে বর্তমান সময়ের আধুনিক শিল্পধারার কবিতা লিব্রেকে যোগ করেন তা হলে সেখানে আপনি বাংলা (রবীন্দ্রনাথকে উল্লেখ করা হয়েছে) কবিতার কিছু স্বাদ পাবেন।’
বিষয়টা এমন নয় যে, এজরা পাউন্ডের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় না ঘটলে তিনি ইউরোপিয়ান সাহিত্যসমাজে পরিচিতি পেতেন না। তবে বিষয়টা হলো, সবসময়ই ‘সময়’-এর নিজস্ব একটি আবেদন থাকে।
পাউন্ড শুধু কবিগুরুর কবিতায় শিল্পকর্মই দেখতে পাননি, পাশাপাশি তিনি সেখানে আত্মার প্রশান্তিতে বিলীন হতে পারে, এমন আধ্যাত্মিক তত্ত্বকথাও খুঁজে পেয়েছিলেন। সে কারণে তিনি ধরে নিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘পয়েট্রি’তে ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমা বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ তার কবিসত্তার পাশাপাশি একজন বড় আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবেও বেশ পরিচিতি লাভ করবেন। সে কারণেই তিনি তার নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘বাঙালি (রবীন্দ্রনাথ) আমাদের পশ্চিমে লোহালক্কর আর মেশিনজীবনের মাঝে যেন একটুকরো শান্তির বারতা নিয়ে হাজির হলেন। এটি যেন মানুষ এবং সৃষ্টিকর্তা একইসঙ্গে মানুষ এবং প্রকৃতির মাঝে এক সরব ঘোষণাপত্র।’
নিবন্ধের শেষ দিকে পাউন্ড তার লেখায় কবিগুরুর কবিতার নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে আলোকপাত করেন। পাউন্ড বিশ্বাস করেন যে, তার কবিতার এ নৈতিক বাণী শুধু পশ্চিম নয়, গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্য এক শুদ্ধ উচ্চারণ। পাউন্ড শুধু কবিগুরুর কবিতার মূল্যবোধ এবং বাণীকেই প্রাধান্য দিলেন না তিনি তার কবিতায় বর্ণনাত্মক ভাষা এবং শব্দের প্রতিও দুর্বল হলেন এবং নিজেও সে ধারায় কিছু কবিতা লেখায় নিমজ্জিত হলেন। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, পাউন্ড কবিগুরুর কবিতার ঈশ্বরবন্দনা এবং তার গুণকীর্তনের মাঝেও সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিলেন। তার ‘গ্রিক ইপিগ্রাম’-এ আমরা সে নান্দনিক তত্ত্বের ছোঁয়া পাই। সেখানে পাউন্ড সৃষ্টিকর্তাকে পৃথিবীর সুন্দরের আধার বলে বর্ণনা করেছেন, যা টেগরের কবিতার মূল বাণীর সঙ্গে মিলে যায়।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কবিগুরুর কবিতা ‘পয়েট্রি’তে ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমের সাহিত্যমহলে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া শুরু হতে থাকে। একদল রবীন্দ্রনাথকে ভারতের আধ্যাত্মিক ঋষি বলে সম্বোধন করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে এবং কবি হিসাবে তাকে সরাসারি অস্বীকার করতে থাকে; আরেকটি মহলে তিনি একজন প্রাচ্যের বড় কবি হসাবে স্থান পান। পাউন্ড বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারলেন না। এদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরাসরি ব্রিটিশ রাজের সমালোচনা করায় অনেক বিলাতি কবিও তার সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। রবীন্দ্রনাথের পক্ষ নিয়ে পাউন্ড ‘নিউ ফ্রিওমেন’ পত্রিকায় আবারও কলম ধরলেন। বললেন, ‘কেন এ অঞ্চলের কিছু ভালো মানুষ একজন কবির অসাধারণ শিল্পকর্মকে শ্রদ্ধা জানাতে অপারগ হলো, কেন তারা তার অসাধারণ কবিতাগুলোকে ধারণ করতে তাদের মুখটি ফিরিয়ে নিলো। বিষয়টি আমার জন্যে অদ্ভুত এক রহস্যজনক ঘটনা হয়ে থাকবে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ার কিছুই নাই। তিনি একজন সাধারণ মানুষ, একজন লেখক এবং তিনি একজন কবি।’ পাউন্ড প্রকাশ্যে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে মাঠে নেমে পড়লেন। তার কবিতা এবং শিল্পকর্ম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা এবং লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে তিনি হেরিয়েট মনরোকে টেগরের কবিতার বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে একটি চিঠি লিখলেন। ‘লন্ডনে তার (রবীন্দ্রনাথ) অনুসারীদের জন্যে বিষয়টি খুব কঠিন হয়ে পড়বে, যদি তিনি তার শ্রেষ্ঠ কাজগুলো ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পরতে থাকেন।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক ভাবনা এবং বিলেতের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত মতপার্থক্যের কারণে সেটির ছাপ তার কবিতায় পড়া নিয়ে নিজেও পাউন্ড বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি লিখলেন, ‘একজন ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে তিনি অসাধারণ কিছু নন এবং তার দর্শন তার লেখায় খুব গভীরভাবে প্রোথিত নয় যে, সেখানে মানুষজন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তাকে তার কবিতায় লেগে থাকতে হবে। কবিতার ভাষা দিয়েই তাকে তার বিরুদ্ধপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে। বাংলায় তার অসাধারণ কবিতা রয়েছে এবং কবিতা দিয়ে তিনি সেখানে অনেক বেশি আদৃত হয়ে আছেন। কিন্তু গদ্যে তিনি নিজস্ব বিশ্বাসের বাইরে কিছু নন।’
পাউন্ডের এই চিঠি পড়ে বিস্মিত হতে হয় এ কারণেই যে, তিনি একবছর আগেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তিনি তাকে নিয়ে এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগবেন, তাও কিন্তু মানা যায় না। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি পাউন্ডের মনোভাবের আসল প্রকাশটি আরও বেশি খোলামেলা হয়ে পড়ে। পাউন্ড বিশ্বাস করতে থাকলেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন শুধু তার রাজনৈতিক বিশ্বাস, পুবের সঙ্গে পশ্চিমাদের সখ্য, স্থূল রাজনীতি ইত্যাদি কারণে। বিভিন্ন কারণে রবীন্দ্রনাথের প্রতি পাউন্ডের সেই আগের ভালোবাসা এবং বিশ্বাসে চিড় ধরতে শুরু করে। ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বন্ধু, কবি ইরিস বেরিকে লেখা একটি চিঠিতে সে সুরটি যেন ধরা পড়ে।
উল্লেখ্য, সে চিঠির বিষয়বস্তু ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১৩ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। চিঠিতে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরস্কারপ্রাপ্তিকে কটাক্ষ করে ‘সর্বশক্তিমান সাহিত্য’ বলে উল্লেখ করেন। পাউন্ড যে বিষয়টি সবসময় জোর দিয়েছেন, তা হলো রবীন্দ্রনাথ একজন জাত কবি এবং কবিতা দিয়েই তিনি সমাজ বদলাবেন, বক্তৃতা করে বা ব্রিটিশবিরোধী রচনা লিখে নয়। তবে, তিনি ভাবতেন যে, রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি কোনো একটি রাজনৈতিক মহলের চাল ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বিষয়ে বন্ধু মিস বেরিকে লেখা এক চিঠিতে আমরা তারই ঘ্রাণ পাই, ‘তা ছাড়া সুইডিশ একাডেমির পক্ষে সিদ্ধান্তটা নিতে কঠিন হয়নি এ কারণেই যে নোবেল পুরস্কার ইউরোপিয়ান লেখকদের মধ্যে যাওয়া ঝামেলার বিষয় হয়ে যাবে, হার্ডি নাকি হেনরি জেমস? …এবং তারপর সঠিক মানুষের সন্ধানটিই তাদেরকে দেওয়া হলো। এবং সুইডেন হলো সুইডেন।’
রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন পাউন্ড, তা বলা ঠিক হবে না। সে সময়ে তিনি একজন কবির চোখ দিয়ে হয়তো রবীন্দ্রনাথকে যাচাই করতে চেয়েছিলেন। পাউন্ডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গাউডিয়ের ব্রাজেস্কার মৃত্যু পাউন্ডের জীবনে আরেক বিপর্যয় ডেকে আনে। যুদ্ধের ভয়াবহতায় পাউন্ড ১৯১৫ সালে এক নিবন্ধে লিখেন, ‘যদি জার্মানরা গাউডিয়েরকে হত্যা করে কৃতকার্য হয়, তা হলে বুঝতে হবে, তাদের হাত দিয়ে শিল্প আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়বে।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যে এজরা পাউন্ড ফেসিস্ট মুসোলনির গুণকীর্তন করে বেশ কয়েকটি কবিতাও রচনা করেন এবং রাজনৈতিক কারণে তিনি নিজেও তার শিল্পের সঙ্গে আপস করেছিলেন। একপর্যায়ে তিনি বিলাতি সাহিত্যসমাজেও সমালোচিত হতে থাকেন। এজরা পাউন্ডের চরিত্রের এই পরিবর্তন তখন তার বন্ধুসমাজের অনেকেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। পাউন্ডের বন্ধু লেখক ও কবি রিচার্ড এলডিংটন অনেক দিন পর পাউন্ডের সঙ্গে দেখা করলেন। বন্ধু সম্পর্কে লিখলেন, ‘কোনো কারণে এজরা খুব বেশি পরিমাণে ইংল্যান্ডবিদ্বেষী হয়ে গেছে। সম্ভবত কিছু রাতের কুকুর তাকে কামড়ে থাকবে।’
তবে এটা স্পষ্ট যে রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি পাউন্ডের যে ভালোবাসা উপচে পড়েছিল, তার বিশাল পরিবর্তনটা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে রবীন্দ্রনাথ যখন ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন, তখন। যখন একজন প্রাচ্যের কবি পশ্চিমা কবিসমাজে অপরিচিত ছিলেন, তখন পাউন্ড তাকে ‘পয়েট্রি’ পত্রিকার মাধ্যমে ইউরোপিয়ানদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন। যখন বিলেতের কবিসমাজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অবহেলা করা শুরু করলো, তখন পাউন্ড বিলাতি কবি-লেখকদের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। আবার যখন বিলাতিরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন তিনি সেখানে রাজনৈতিক গন্ধ পেলেন এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতা, তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি কটাক্ষ করলেন। তবে ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এজরা পাউন্ডের পরিচয় হওয়ার ঘটনা পুব এবং পশ্চিমের সাহিত্যে এক অনন্য মেলবন্ধন বলে উল্লেখ করা যায়।
এজরা পাউন্ডের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় হওয়াটা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বিষয়টা এমন নয় যে, এজরা পাউন্ডের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় না ঘটলে তিনি ইউরোপিয়ান সাহিত্যসমাজে পরিচিতি পেতেন না। তবে বিষয়টা হলো, সবসময়ই ‘সময়’-এর নিজস্ব একটি আবেদন থাকে। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার ঠিক একবছর আগে পাউন্ডের সঙ্গে তার পরিচয় হওয়া এবং তার ছয়টি কবিতা মনরো সম্পাদিত ‘পয়েট্রি’ ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়াটা ছিল ওই সময়ের এক অনন্য দাবি এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।