রবিউল হুসাইন, কবি, স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ। তবে সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচিতি। পরিশুদ্ধ কবিতা রচনার মাধ্যমে তিনি নিজেকে স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি কবিতাকে কখনোই আত্মমুখী করে তোলার চেষ্টা করেননি। বরং অভিজ্ঞতা ও ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শব্দের পরিচর্যা করেছেন। কবিতাকে তিনি শুধু আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবেই দেখেননি, বরং তার কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি জাতিসত্তার আত্মনুসন্ধানের পথও খুঁজেছেন। যা তার কবিতাকে করে তোলে সামষ্ঠিক চেতনার অংশ।
রবিউল হুসাইনের জন্ম ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ সময়ে। সঙ্গত কারণেই দুই বার মানচিত্র বদলের অভিজ্ঞতায় তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ। নিজের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ অঞ্চলের মানুষের আত্মবিকাশের ধারাটিও প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন। সেইসঙ্গে আধুনিক স্থাপত্য বিদ্যার কুশলী ছাত্র হিসেবেও প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন নগরায়নের অনুষঙ্গগুলো। যা একইসঙ্গে প্রকৃতি, মানুষ ও কৃত্রিমতা বিষয়ে নিবিড় পাঠের অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে তার কবিতায় একইসঙ্গে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে জীবন ও তার বিস্তার। সমাজের বৃহত্তর অংশকে নাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি। তার অভিজ্ঞার ভেতর দিয়ে, নিজের ধারণাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। যেন ব্যক্তির উপলব্ধি স্বাতন্ত্র্য লাভ করে। আর তার চেতনা সম্প্রসারিত হয় অন্যের ভেতরেও।
যে ঘটনাস্রোতের ভেতর দিয়ে তার যাত্রা, সেখানে কেবল প্রতীক আর রূপকের বন্ধনে ভাবনার বিস্তারকে না বেঁধে তিনি যুক্তি ও বোধের জায়গাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।
এই কবি শিল্পের জন্য শিল্পকে ধারণ করেননি। শিল্পের সঙ্গে জীবনকে, অভিজ্ঞতাকে, বাসনাকে মেলাতে চেয়েছেন। তাই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যেমন, তেমনি ব্যক্তির আলোড়নকেও ধারণ করতে চেয়েছেন। আর এক্ষেত্রে শব্দের মালা দিয়েই দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করেছেন। ব্যক্তিগত অনুভূতিকে কখনো যুক্তির বাইরে যেতে দেননি, বরং যুক্তির নাগালের মধ্যে রেখেই ভাঙা-গড়া ও সৃষ্টির আনন্দে মেতেছিলেন।
মানুষেরা নাকি এক সেকেন্ডে চার ফুট হাঁটতে পারে সাধারণত
বারো কোটি মানুষ আমরা
আমরা সবাই একসঙ্গে হাঁটলে মোট আটচল্লিশ কোটি ফুট
অর্থাৎ ষোল কোটি গজ, তার মানে
এক সেকেন্ডে প্রায় নব্বই হাজার নয়শ দশ মাইল
এগিয়ে যেতে পারি
স্বাধীনতা পাওয়ার পর বিশ বছর পার হয়ে গেছে
অথচ আমরা একই জায়গায় একই বিন্দুতে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৌড়িয়ে মরছি সব সময়
এক ইঞ্চিও অগ্রসর হতে পারছি না
…
আসুন স্বাধীনতা যুদ্ধকে বুকের মাঝখানে রেখে তাই একসঙ্গে
আমরা সবাই এক সেকেন্ডে চার ফুট পথ এগিয়ে যাই
বন্ধুগণ এক সেকেন্ডে মাত্র চার ফুট খুব বেশি কিছু নয়।
(এক সেকেন্ডে মাত্র চার ফুট)
রবিউল হুসাইন তার কবিতার প্রতিটি মানুষের জন্য একটি গন্তব্য খুঁজেছেন। অবদমন করে রাখেননি যেমন তার অনুভূতিমালা। তেমিন অসহায়, দিগভ্রান্ত পংক্তিমালারও সমষ্টি নয় তার কবিতা। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তিনি আলোড়িত হয়েছেন, সেই আলোড়নকে তিন প্রতিবাদেও মাধ্যমে প্রবাহিত করে দিতেও শঙ্কা বোধ করেননি। যে ঘটনাস্রোতের ভেতর দিয়ে তার যাত্রা, সেখানে কেবল প্রতীক আর রূপকের বন্ধনে ভাবনার বিস্তারকে না বেঁধে তিনি যুক্তি ও বোধের জায়গাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। যেন পাঠকের ভেতরেও সংক্রমিত হয় কবিচৈতন্য।
ব্যক্তি মনের সঙ্গে শিল্পের যে যন্ত্রণাকতার সহবস্থান প্রতিনিয়ত তার অদম্য স্ফুরণ ঘটানোর অঙ্গীকারের ভেতরেই জাগরূক থাকবেন রবিউল হুসাইন।
শুধু ব্যক্তিক অনুভূতিপুঞ্জকেই ভাষারূপ দেওয়ার চেষ্টা করেননি রবিউল হুসাইন। জনজীবনসংলগ্নতা এবং সমকালীন মানসিকতার নিরুদ্ধ সময়ে বন্দি থেকেও তিনি সমস্ত প্রচলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। সেখানে যুক্তি আছে মুক্তির সপক্ষে। হৃদয়াবেগকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু নির্লিপ্ত হয়ে নয়। ভেতরের অস্থিরতা ও সংঘাতকেও তুলে ধরতে চেয়েছেন প্রতীকী ব্যঞ্জনার ভেতর দিয়ে। যা কবিতাকে করে তুলেছে তাৎপর্যময়। তার অনুভূতিপুঞ্জকে করে তুলেছে চিত্রময়। শিল্পের জন্য শিল্পের প্রচল প্রথায় আবদ্ধ না থাকার কারণেই ভিন্নতর পাঠ হয়ে উঠেছে তার কবিতা, যেখানে তিনি শুধু নির্লিপ্ত দ্রষ্টা নন, বরং এমন এক শিল্পী যিনি একইসঙ্গে সৃষ্টি করেন ও তার সৃষ্টির ভেতর দিয়ে সঞ্চার করেন তীক্ষ্ণ অনুভব। অন্তর্গত টানাপড়েনের চেয়ে সামষ্টিক চেতনার চর্চাইকে তিনি ব্যাপকতা দিয়েছেন কবিতায়।
মানবিক বোধকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াসের ভেতর থেকে রবিউল হুসাইন কবিতাকে শব্দময় করে তুলেছেন। যেখানে তার কবিতা একটি সুস্পষ্ট মীমাংসায় উপনীত হয়। তিনি যখন বলেন,
দেশ ও দশের এখন দেশজ চিকিৎসা প্রয়োজন।
শুকনো মাটির সঙ্গে মানুষের হলুদ পেশাব মিশিয়ে
কাদা কাদা যে মাটির মণ্ড হবে
আদিগন্ত সেই প্রলেপ লাগাতে হবে
তাদের বিস্তীর্ণ কপালে,
দেশ ও দশের যন্ত্রণাকাতর শিরঃপীড়ায়
হবে নিশ্চিত নিরাময়।
….
দুস্থ দেশ আর দুর্বল দশের জন্যে, যতই দিন যায় মনে হয় এখন
বেদে আর বাউলদের সহজিয়া বিন্দু-সাধনা
যৌন যোগ-ব্যায়াম
আর এইসব দেশজ আর ভেষজ ওষুধের
আজ বড্ড প্রয়োজন।
(দেশ ও দশের দেশজ ওষুধ)
সুস্পষ্ট মীমাংসার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় রবিউল হুসাইনের স্বাদেশিকভাবনা। সময়স্রোতকে তিনি ধারণ করেছেন। সম্ভবনার পথ দেখিয়েছেন। তার প্রকাশক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তার অভিরুচি পাঠককে ছুঁয়েছে। বহুপ্রজ ও বহুলপঠিত কবি তকমা না এঁটেও রবিউল হুসাইন ষাটের দশকের কবিতার প্রচল ধারার বিপরীতে স্বাবলম্বী হওয়ার যে পথ নির্মান করতে সক্ষম হয়েছেন এবং অফুরন্ত সম্ভবনার যে পথের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তার ভেতরে খুঁজে পাওয়া যায় ভিন্নতর উপলব্ধি। ব্যক্তি মনের সঙ্গে শিল্পের যে যন্ত্রণাকতার সহবস্থান প্রতিনিয়ত তার অদম্য স্ফুরণ ঘটানোর অঙ্গীকারের ভেতরেই জাগরূক থাকবেন রবিউল হুসাইন।