বাংলাদেশের ছয়ের দশকের দলছুট বিদ্রোহীরা যে দল বেঁধেছিলেন, রফিক আজাদ সেই ‘স্যাড জেনারেশনের’ উজ্জ্বলতম কবি। গত বিশ বছরে তাঁর ভাষায় ‘পদব্রজে’, তিনি দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছেন। শিল্পের জন্য যে-উন্মতাল যাত্রা শুরু হয়েছিল, এখন তা সামাজিক চৈতন্যের একটা স্থির লক্ষ্যের অভিসারী।১ বিশ বছর আগের সমালোচকের এই মন্তব্য রফিক আজাদের কাব্য-উন্মেষ ও পরিণতির যেমন সন্ধান দেয়, তেমনি আভাসিত করে সমসাময়িক রাজনীতিগত পালাবদলের বন্ধ্যা জলবায়ু ও কবির মানস-পরিক্রমা তথা কাব্যযাত্রাও। সমালোচকের এই উক্তিতে কতগুলো বিশেষ শব্দ বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে, যার সঙ্গে জড়িত রফিক আজাদের জীবনবোধ ও বোধির বিশেষ বিশেষ প্রবণতাও। সমালোচকের উক্তির ‘দলছুট বিদ্রোহী’, ‘স্যাড জেনারেশন’, ‘উন্মতাল’, ও ‘সামাজিক চৈতন্য’ ইত্যাকার শব্দবদ্ধগুলো প্রনিধানযোগ্য। প্রথম শব্দবদ্ধ দুটির সঙ্গে জড়িত ছয়ের দশকের কবি-বৈশিষ্ট্যের দলছুট বিদ্রোহ অর্থাৎ চারের ও পাঁচের দশকের কবিকণ্ঠ থেকে স্বতন্ত্রধর্মী এক বাঁধনছেঁড়া বলগাহীন তরুণ তুর্কীদের অভিযাত্রা, যা স্বেচ্ছাচারী এবং স্বৈরাচারীও, এই বিদ্রোহ ভাঙ্গনের, অবক্ষয়ের। এবং ‘স্যাড জেনারেশন” বাক্যাংশটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ছয়ের দশকের কবিদের দুঃখবোধ ও উত্তরাধিকারের সাংস্কৃতিক ফারাকের গন্ধ, যার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা শব্দটিও অনুষঙ্গী হয়ে আছে। এদিকে ‘উন্মতাল’ শব্দটির সঙ্গে উন্মাদনার অতিমাত্রিকতা যেমন আছে, তেমনি আছে ভারসাম্যহীন মানস-পরিক্রমাও। এবং এই মানসতার ছবি যদি হয় সামাজিক বৃক্ষের বীজ, তবে সে সামাজিক কাঠামোও ছিল ক্লেদাক্ত ও কদর্যময়বোধে আকীর্ণ। সে ক্লেদ পচন এবং মাতাল-অনুষঙ্গী যাবতীয় পাপাচার গরলীয় তারল্য তৎকালীন সমাজ ও জীবনায়নেরই ফল। সেই পাপক্ষয়ী মানস-যাত্রা শেষ হয়েছে সামাজিক চৈতন্যের একটি স্থির বিন্দুতে। সামাজিক চৈতন্য বা সেশ্যাল কনসাসনেস’ বলার সঙ্গে সঙ্গে রফিক আজাদের সামাজিকতা, দায়-দায়িত্ব এবং বাস্তবোচিত দর্শন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে-ভারসাম্যহীন মানসযাত্রার সওয়ার হয়ে রফিক আজাদ পদব্রজে বেরিয়েছিলেন শিল্পের সন্ধানে, স্থির বিন্দুর মতো অনঢ় একটি সামাজিক দায়বদ্ধতায় গিয়ে শেষ হয়েছে সেই মনন-পরিক্রমা এবং এর পুরোটাই হয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক পালাবদলের সঙ্গে অনুষঙ্গ বজায় রেখেই। রফিক আজাদের এই দীর্ঘ পদযাত্রার ছাপ ধরা আছে তাঁর সৃজনশীল কাব্যধারায়। এখানে বলা বোধ হয় অন্যায় নয় যে, রফিক আজাদের মানস দ্বিধা বিভক্ত, দীর্ণ। এভাবে তা দেখানো যেতে পারে :
প্রথম পর্বে : অপচায়িত সময় : আতীব্র যৌনতাস্পৃষ্ট ও বোদলিয়রে বিদ্ধ মনন।
দ্বিতীয় পর্বে : জাগ্রত দেশকালের গভীর সংলগ্নতা
প্রথম পর্বের একমাত্র গ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে।’২ রফিক আজাদ এই পর্বের সামাজিক-বোধিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য যেমন আতীব্র যৌনতাসৃষ্ট ক্লেদ ও পাপাচারে মগ্ন থেকেছেন, তেমনি উজ্জ্বল জীবনবোধে জীবন-উদ্ধারের সন্ধান করেছেন। এই দুই দ্বান্দ্বিকতা কাজ করেছে এই গ্রন্থে। তবে এটা ঠিক ঔজ্জ্বল্যের নিষ্প্রভ আলোয় পচন ও সময়ের অপচয়ই এখানে অন্ধকার ছড়িয়েছে বেশি। প্রথম কাব্য-পরিক্রমায় রফিকের বিষয়-ভাবনা, কাব্যাদর্শ ও দ্বান্দ্বিকসত্তার উন্মোচন দেখানো যাক :
১. বিষয়-ভাবনা : সন্দেহ, অবিশ্বাস, চরম হতাশা, মৃত্যুচিন্তা ও পাপাচার
২. কাব্য-দর্শন : অস্তিত্ববাদ, পরাবাস্তবতা, ফ্রয়েডের অবচেতনা ও প্রতীকধর্মিতা বা সিম্বলিজম্।
৩. দ্বান্দ্বিকতা : অবিশ্বাস > বিশ্বাস; চরম হতাশা > স্নেহ ভালোবাসা বা শ্রেয় কল্যাণবোধ।
যদি অঙ্ক কষে দেখানো যায় : তবে বলা যাবে : মৃত্যু →জীবন : ৪ : ১
জীবনবিরোধী সমকালের মান যদি ৪ হয়, তবে জীবনবোধের সূক্ষ্ম আলোর মান ১ এবং সে ১-এর ওজনও নিষ্প্রভতায় আকীর্ণ। কিংবা
তবে এটা ঠিক যে, প্রথম কাব্যে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার ইঙ্গিত ছিল বলেই দ্বিতীয় কাব্য ‘সীমিত জলে, সীমিত সবুজে’৩ তে তিনি পুনর্জন্ম লাভ করেছেন। একাব্যের :
বিষয়বস্তু : মানবতা, রাজনীতি, দেশপ্রেম, জীবনবাদ
মানসসত্তা : রাজনৈতিক চেতনা, বিদ্রূপাত্মক এষণা, দরদি এবং বিদ্রোহীচেতনা
কাব্য-দর্শন : বাস্তববাদ (Realism)
মানস-পরিক্রমা : যন্ত্রণা→সৃষ্টির মধুর বেদনা জীবনবিরোধী সত্তা→জীবনের ঘনিষ্ঠতাবোধ
রফিক আজাদের তৃতীয় গ্রন্থ ‘নির্বাচিত কবিতা’৪। এই গ্রন্থে ‘অসম্ভবের পায়ে’,‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’ ছাড়াও ‘আমার প্রধান প্রবণতা’ ও ‘অনূদিত জলবায়ু’ আছে। অনুবাদ বাদ দিলে ‘আমার প্রধান প্রবণতা’য় রফিক আজাদের কাব্য-ভুবনের বিষয় ও শব্দরাজির ভালোলাগা-মন্দলাগার ইতিহাস সংলগ্ন হয়ে আছে।৫
তাঁর ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’য়৬ মানবতাবাদ ধ্বনিত, তবে তা বুর্জোয়া মানবতাবাদের সদর্থকতার পরিবাহী।
গতিবেগ : মানবতাবাদ →জীবনবাদ →শান্তিকামনা
কাব্য-দর্শন: নষ্টালজিয়া ও প্রতীকবাদ
‘সহস্র সুন্দর’ : সমাজবাদের অনুসারী বিষয়ভাবনা : শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও সমাজবাদ
কাব্য-দর্শন : প্রতীকবাদ
মানসতা : রাজনৈতিক সচেতনতা + দোদুল্যমানতা + ক্রোধ + বিদ্রূপাত্মক চেতনা
ভাষা ও রচনারীতি : কুশলী কবি
. শব্দ ব্যবহারে দক্ষ কারিগরভাষা সংহত
অহমিকার প্রকাশ
নষ্ট শব্দের প্রকাশ, যৌনতাগন্ধী
প্রকাশভঙ্গি উন্নত সমালোচনা সম্পর্কে স্পষ্টকাতর, সৎ ও সৃষ্টিশীল শব্দবাহুল্য, লোকজভাষা, অক্ষরবৃত্ত। কংক্রিট পোয়েট্রির বিভিন্ন ডিজাইনের কবিতা-বিন্যাস। রফিকের কবিতার মূল প্রবণতাগুলো নিম্নরূপ :
১. মন কেমন করা আছে;
২. ব্যর্থতার জ্বালা:
৩. সার্থকতার আকৃতি;
৪. অপরাধবোধ
৫. আদর্শের প্রতি গভীর আনুগত্য;
৬. সর্বোদয়ী ভবিষ্যতের স্বপ্ন;
৭. বর্তমানের প্রতি সুতীব্র বিক্ষোভ;
৮. ভালোবাসার অপরোক্ষ অনুভূতি;
৯. আত্মগ্লানি;
১০. অপরাধবোধ, যৌনতা; এবং
১১. অতীতচারিতা ইত্যাদি।
০২.
এই প্রবন্ধের বিষয় যেহেতু রফিক আজাদের কবিতায় বিক্ষত সময়ের উপাদান সন্ধান, সে কারণে কবির ‘অসম্ভবের পায়ে’, ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজ ‘ এবং ‘আমার প্রধান প্রবণতা’ বা ‘সশস্ত্র সুন্দর’ আলোচনার পরিধি। সময়কাল ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৪ সাল। অর্থাৎ সামরিক শাসক আয়ূব খানের ক্ষমতাদখল থেকে শুরু করে উনিশশো চুয়াত্তরে মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত—এই দীর্ঘ কালবলয় বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি-আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সংকটজনক সময়। কিন্তু মানতেই হবে। যে, বিষয়বস্তু ও চেতনাগত সুরের সম্প্রসারণ-দিগন্ত এই পরিধিকে আরো কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে। ছয়ের দশক বলতে যে ক্লেদ এবং কদর্যতার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, রফিক আজাদ তারই প্রতীক। ১৯৬৭ সাল থেকে অর্থাৎ ষাটের দ্বিতীয়ার্ধে একটি উজ্জ্বল এবং রক্তাক্ত ঝড়ো হাওয়ার মাতন শুরু হলেও তার আগে পর্যন্ত ছয়ের দশক মূলত বন্ধ্যা জলাশয়ের মতন। ঐ সময়ে খুচরো আন্দোলন এবং আপসকামিতা থাকলেও সংস্কৃতি-অঙ্গন মূলত নিয়ন্ত্রিত ছিল সামরিক শাসনের নিষ্ঠুরতায়, ব্যক্তিত্ব হয়েছিল বিনিষ্ট, ভীতি এবং লোভ এসেছিল বরের বেশে। পচন এবং বিকার, রোগ ও বৈকল্য ছয়ের দশকের প্রথম বলয়কে নিঃশেষিত করেছিল। সময়ের কালো অবক্ষয় সামাজিক অঙ্গনের ওপর যেভাবে কঠিন ও নিথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল, রফিক আজাদ তারই প্রতিভূ-কবি। এই সময়ের প্রতিকারহীন অধঃপতনের কান্না, আত্মক্লেদের গ্লানিতে কবি আবিল ও অশ্রুময়। এবং পচন থেকে অম্লান উদ্ধারের দিকে তাঁর প্রার্থনা। এই সময়ে রচিত তাঁর (১৯৬০-৭৪) গ্রন্থে কবি রফিক আজাদ সে সময়কার বিক্ষত মুখছবি এঁকেছেন।
রফিক আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’-তে সমকালীন বাংলাদেশের যন্ত্রণাবিদ্ধ সময় বিকৃত। সেখানে ‘স্বাস্থ্যময়তা’ প্রত্যায়িত। স্বপ্ন-আক্রান্ত। এবং স্বপ্নের উজ্জ্বল উদ্ধার শীতের রাত্রির’ কারণে আবহে আটকে থাকে। অন্ধকারের অট্টহাসি অলৌকিক মনে হয়। রক্ত-চক্ষু বাল্ব’ প্রবেশদ্বারের নিষেধাজ্ঞার নোটিশ। এই নিয়তির চিত্র ধরা আছে তাঁর ‘হে দরোজা’ কবিতায়। ‘নগর মাসের আগে’-তে মূলত রফিক আজাদ সামরিক শাসনের পচনশীল সময়কে বিম্বিত করেছেন পরাবাস্তর মাধুর্যে : চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন জলরাশি। / রক্তপূজে মাখামাখি আমাদের লোবাসাবাসি / এখন পাবো না সুস্থতার আকাঙ্ক্ষার খেই। এভাবে ছাড়া অন্ধকারে বেঁধে ফেলা সামরিক নিয়ন্ত্রিত বন্ধ্যা-জীবনকে প্রকাশের অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। সেই সময়ের গ্রহে আনন্দহীনতা, ‘পতিত লাম্পট্যগ্রন্থ’ বিবর্ণ কালস্রোত, ‘ওষ্ঠহীন উদ্ধারহীন আবিলতায়’ হৃদয়, মেধা, অনেক্ষণ, মুক্তি পাপের শিকার হয়েছিল। তাই ক্লিন্ন সময় থেকে মুক্তির কামনা তাঁর কবিতা-পংক্তিতে চরতা পেয়েছিল এভাবে : এ গ্রহের কেউ হায় প্রকৃত আনন্দকে জানলো না/ শুভ্রতা ও মৃত্যুকে জানলো না / বিষাদ ও মৃত্যুকে জানলো না / মুক্তি ও মৃত্যুকে জানলো না | অন্বেষণকে না, হৃদয়কে না, মেধাকে না / ভালোবাসাকে না। / সত্যি কী এক দুঃসহ ক্লাব সময়ের কণ্ঠরোধী বাতাবরণ তৈরি করেছেন কবি।
ষাটের সময় ছিল ক্লেদাক্ত, একথা বলেছি। এবং বলেছি যে, এই সময় এবং কবিতাকে আক্রমণ করেছিল ‘প্রতিশোধপরায়ন ক্লেদ।’ রূপকল্পে তাই ক্লেদাক্ত সময়ের উপ-স্রোতের যৌনতা। ‘কবি’, ‘শরীরী পুতুল, জন্মদিনের জর্নাল’ এবং ‘হে দরোজায় এর দিগন্তবিহারী উপস্থিতি। একথা ঠিক, ঐ-সময়ে এই যৌনতাক্রান্ত বিরংসা ও ক্লেদ কবিতার ফ্রেমে বন্দী হয়েছিল বলে চিৎকার উঠেছিল সমালোচকমহলে; কিন্তু রক্তাক্ত অন্ধকারের ক্লেদময় সময়কে ধরতে গেলে এই গলিত যৌনতার বিষণ্ণ এবং বিবর্ণ মূলছবি আঁকার প্রয়োজন ছিল, কারণ এই ছবি শুধুই সময়ের বিক্ষত দলিল নয়, এর মধ্য দিয়ে একজন অসহায় ‘আলোকপ্রত্যাশী’ কবির মুক্তির হাওয়ার সন্ধানের আর্তচিৎকারও ধ্বনিত হয়েছিল। এবং এই কারণেই কবি তাঁর ঘুমহীন চোখের দুঃচিন্তার দুঃশীল যন্ত্রণার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন ‘হে দরোজা’ কবিতায় শীতের রাতে নিদ্রা ও নিদ্রাহীনতার দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এযেন সময়কে ধারণ করা এবং উপেক্ষা করার দুই বিপরীত বিশ্ব। এই কবিতায় তিনি সামরিক শাসনকে শীতকাল’ ভেবেছেন এবং সেই ‘সময়’ বেদনায় কুঁকড়ে যাচ্ছে,… / ট্রাক চাপা-পড়া কুকুরের মত থেতলে / যাচ্ছে;/ কবি নিজেই যেন সময়ের গরলপিয়াসী নীলকণ্ঠ শায়কের প্রতীক।
ছয়ের দশকে মৃত্যু ও যৌনতা, প্রেম ও মৃত্যু সমার্থক হয়ে উঠেছিল। ভালোবাসা, প্রেম, কামনা গশবদন্ডে নিয়ন্ত্রিত ছিল। প্রতিকারহীন এক সময়কে, নৈরাজ্যে আক্রান্ত এবং মৃতবৎ জীবনকে কবিতায় ধরেছিলেন কবি। ছয়ের দশকের অপচয়িত সামরিক জগদ্দল অন্ধকার সময়ের দ্বৈতসত্তা বিকল্প পন্থায় এর চেয়ে নিপুণভাবে কী পরিস্ফুট করা সম্ভব ছিল?
এই পরিস্থিতি না বুঝলে রফিক আজাদের কবিতার অন্তর্লোক ধরা সম্ভব নয়। তাঁর কবিতায় বিষয়গত অধঃপতন মূলত ক্লেদাক্ত রক্তাক্ত সময়কে ধারণ করেছে; সময়কে মহিমান্বিত, মাধুর্যময় কিংবা শেয়ার করার কোনো কারু বাসনা কবির ছিল না।
রফিক আজাদের কবিতা তৎকালীন সময়কে ধরে ফেলেছিল। ফলে নতুন ঝংকার, অন্যদি জীবনানুভূতি সংরাগ ছড়িয়েছিল মন ও মননে। বোদলেয়ারের কবি-মনন ও দর্শনের সিম্বলিক ও পরাবাস্তবতার মিশ্রণে রফিক আজাদের কবিতা ভিন্নমাত্রা পেয়েছিল। কবির ভাষার ‘রোজা’, ‘মহারাজ’, ‘যাদুকর’, ‘অন্ধকার’, ‘মৃত্যু’, ‘উজ্জ্বল’, ‘অন্তরঙ্গ’, ‘রাত্রি’, ‘নিঃসঙ্গতা’, ‘অলৌকিক’ শব্দরাজি বোদলেয়ারের বিভা ছড়িয়েছিল। ষাটের মার্কিনী বীট কবি ‘হাউলখ্যাত গীষ্মবার্গ-এর ইয়ার্কি কালচার ও ফরাসি জীবনবিরোধী অবক্ষয়, স্যাড জেনারেশনের পচনশীল জীবনবোধ তাঁর এবং সমকালীন অনুসারী কবিদের আষ্টেপৃষ্ঠে আশ্লেষে লেহন করেছিল। আসলে এটা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বন্ধ্যা জলাশয় ও সময়ের অন্ধকারেরই প্রতিচ্ছবি। বলেছি রফিক আজাদের অন্ধকার সময় বিক্ষত হৃদয়ের অন্তরালে, সন্দেহ, হতাশা, অবিশ্বাস, বিষণ্ণতা, রিরংসা, অস্তিত্ববাদ ও পরাবাস্তবতার নিচে মানবিকতা, ভালোবাসা, স্মৃতি, উত্তরাধিকার এবং সাংসারিক বাতাবরণের ছায়াসম্পাত লুকিয়ে ছিল, পরবর্তী কাব্যে মৃত্যু থেকে যা জীবনের বরাভয় বহন করেছে। রফিক আজাদ এই কাব্যগ্রন্থে অস্তিত্ববাদের নিপুণ কারিগরের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। ফ্রয়েড-এর অবচেতনা’ তাঁর এই কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় অবচেতনভাবে ফ্রেমবন্দী হয়েছে। একথা অস্বীকারের যো নেই যে, রফিক আজাদে অসম্ভবের পায়ে কাব্যগ্রন্থে সমকালের স্যাতস্যাতে পলেস্তরাপরা ভুবনে জীবনের বীজ রোপিত হয়েছিল, পরবর্তীকাব্যে ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’তে সেই বীজ মৃত্যুর চিতাভষ্মে স্কিনিংস পাখি হয়ে জীবনকে, বিদ্রোহকে পুনর্জন্ম দিয়েছিল। এই কাব্যগ্রন্থে তাঁর অতীতচারিতার পাশাপাশি বিদ্রোহাত্মক দেশপ্রেমের নান্দীপাঠ শোনা গেছে। তিনি এই কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় সত্য ও সুন্দরের সহাবস্থান ঘটিয়েছেন। সৌন্দর্যবিজ্ঞানের বাস্তববাদী ইস্তেহারের নির্মাতা রফিক আজাদ বিক্ষত সময়ের দলিল লিপিবদ্ধ করে ‘সশস্ত্র সুন্দর’-এ সাধারণ মানুষের শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থার কথা ব্যক্ত করেছেন। এভাবেই ষাটের প্রথমার্ধের বন্ধ্যা, শ্বাসরুদ্ধ নীলকণ্ঠ বিক্ষত সময়ের প্রতিচ্ছবি অংকন করে, মৃত্যুর সীমান্ত অতিক্রম করে, জীবনানুভূতির বাতাবরণ তৈরি করে কবি মানুষের বিদ্রোহের বর্ণমালায় এসে পৌঁছেছেন। রফিক আজাদ তাঁর ‘চুনিয়া আমার আকের্ডিয়াতেও হতাশার বাণপ্রস্থ ঘটিয়ে মুক্তির কথা বলেছেন। একজন কবির সময়ের অন্ধকার সাগর পেরিয়ে আলোয় প্রত্যাবর্তন নিঃসন্দেহে দায়বদ্ধতার প্রতীক। রফিক আজাদ দ্বান্দ্বিক সত্তায় জীবন, সমাজ ও কবিতার সেই রিফুকর্মটিই অবলীলায় করে এসেছেন একজন মুন্সিয়ানার কারিগর হিসেবে।
পাদটীকা
১. কবি রফিক আজাদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কবি রফিজ আজাদ সংবর্ধনা, কবিতালাপ গোষ্ঠী,
ডিসেম্বর ১৯৮১।
২. অসম্ভবের পায়ে, রফিক আজাদ, খানব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ঢাকা, ১৯৭৩।
৩. সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে, রফিক আজাদ, ঢাকা, ১৯৭৪।
৪. নির্বাচিত কবিতা, রফিক আজাদ, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৭৫।
৫. কণ্ঠস্বর, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, দশম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ঢাকা।
৬. চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া, রফিক আজাদ, ১৯৭৭, ঢাকা।